এস এম মোজাম্মেল হক
উত্তর আমেরিকা মহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে নিউইয়র্ক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শহর, যার সরকারি নাম সিটি অব নিউইয়র্ক (City of New York) এবং প্রচলিত কথ্য নাম নিউইয়র্ক সিটি (New York City)। এর আয়তন ৩০২.৬০ বর্গমাইল বা ৭৮৪ বর্গকিলোমিটার। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নিউইয়র্ক শহরের জনসংখ্যা ৮.৩৪৩ মিলিয়ন। শহরটি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হাডসন নদী ও ইস্ট নদীর মোহনায় অবস্থিত। এটি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে উত্তর-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বন্দর শহর। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের মূল ভূখণ্ডের এক সামান্য অংশের ওপর শহরটি দাঁড়িয়ে আছে।
নিউইয়র্ক শহর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ও সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী মহানগরী, যেটি পৃথিবীর রাজধানী হিসেবে খ্যাত। জাতিসংঘ সদর দপ্তর ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্বকারী দেশসমূহের কূটনৈতিক মিশন এই শহরে অবস্থানের কারণে শহরটির গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। নিউইয়র্ক শহরটিতে বহুসংখ্যক আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকা রয়েছে এবং এগুলোকে প্রশাসনিকভাবে পাঁচটি প্রশাসনিক অঞ্চল বা বরোতে (Borough) বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো ম্যানহাটন, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস, কুইন্স ও স্টাটেন আইল্যান্ড, যাদের প্রতিটিরই নিজস্ব জীবনধারা রয়েছে।
নিউইয়র্কের জলবায়ু আর্দ্র উপক্রান্তীয় ধরনের। গড় তাপমাত্রা জানুয়ারি মাসে সর্বনিম্ন শূন্যের নিচে ৩-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং জুলাই-আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। এখানে মূলত গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতÑএই তিন ঋতু পরিলক্ষিত হয়, তবে শীতের সময়টিই লম্বা এবং গ্রীষ্মের সময় তুলনামূলক কম আর বর্ষার জন্য আলাদা কোনো ঋতু (সময়) নেই বললেই চলে। কারণ বর্ষা হলো খেয়ালি মানুষের মতো, যখন যা খুশি করে বসে। সেরূপ গ্রীষ্ম, শীত উভয় ঋতুতেই বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ বর্ষার আগমন ঘটে। দিনের ২৪ ঘণ্টায় কখন কেমন আবহাওয়া বিরাজ করবে, তা ভাবনারও অতীত। ফলে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আবহাওয়া রিপোর্ট দেখে প্রস্তুতি নিয়ে বের হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ভুলবশত কেউ আবহাওয়ার রিপোর্ট না দেখে প্রস্তুতিবিহীন বাসা থেকে বের হলে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। ফলে ঠান্ডা ও বৃষ্টিতে ভেজার কারণে হঠাৎ রোগব্যাধিতে ভুগতে হতে পারে। এ শহরটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত ও বহুজাতিক শহর। নিউইয়র্ক শহরে পৃথিবীর প্রায় সব কটি দেশের ও সব ভাষাভাষী লোকজনের বসবাস।
নিউইয়র্ক শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ থেকে ৬০০ টন এবং বছরে ৩.২০ মিলিয়ন টন বর্জ্য তৈরি হয়, যা পরিবহনের জন্য প্রতিদিন ২০০০ ট্রাক ব্যবহৃত হয়। বর্জ্যরে অংশবিশেষ স্টাটেন আইল্যান্ডের কোভেন্টার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে ৯৭ ফুট গভীর এবং ২৭০ ফুট লম্বা বিশাল সংরক্ষণাগারে রাখা হয়। এরপর তা চুল্লিতে ফেলে সেখানে ২০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় বর্জ্যগুলো পোড়ানো হয়। চুল্লির সব বর্জ্য পোড়াতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। পোড়ানোর সময় তেজস্ক্রিয় বাষ্পে টারবাইনে ঘূর্ণনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত বিদ্যুৎ দ্বারা ৪৬ হাজার বাড়িতে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হয় এবং পোড়ানো ছাই থেকে চুম্বকের সাহায্যে আহরিত লোহা দ্বারা ২১ হাজার গাড়ি তৈরি সম্ভব।
বছরে এক মিলিয়ন টন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়। বাকি বর্জ্য ট্রেন ও কনটেইনারবাহী ফেরির মাধ্যমে সাউথ ক্যারোলাইনা ও ওহাইওর ভাগাড়ে ফেলা হয়, যার ব্যবস্থাপনায় স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের বছরে ৪.২৯ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ২০৩০ সাল নাগাদ নিউইয়র্ক শহর বর্জ্যমুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে।
আমেরিকায় ৫০টি অঙ্গরাজ্যের প্রতিটির জীবনধারা, আবহাওয়া, যাতায়াতব্যবস্থা এবং ফেডারেল আইনের বাইরে অঙ্গরাজ্যসমূহের নিজস্ব আইনকানুন রয়েছে। এ দেশের সবচেয়ে সৌন্দর্যের দিক হলো বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, নিরাপত্তা এবং নাগরিকদের সমমর্যাদা ভোগের অধিকার। আমেরিকার অন্যান্য অঙ্গরাজ্য ও শহর এলাকা থেকে নিউইয়র্ক শহরের যাতায়াতব্যবস্থার ভিন্নতা রয়েছে। এখানে ব্যক্তিগত পরিবহনের বাইরে পাবলিক পরিবহন হিসেবে রয়েছে বাস, ট্রেন যথাক্রমে সাবওয়ে ও মাটির ওপরে।
এর আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো একই টিকিটে বাস ও ট্রেন উভয় পরিবহনে যাতায়াতের সুবিধা। টিকিটেরও আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো ট্রিপ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য টিকিট এবং সাপ্তাহিক ও মাসিক আনলিমিটেট টিকিট, যা দৈনিক একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে প্রাইভেট ব্যবহারের জন্য উবার ও লিফট, যা অনলাইনে দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া পরিশোধের মাধ্যমে খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ডেকে ব্যবহারের সুযোগ। তবে বেশির ভাগ মানুষই তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে অভ্যস্ত। এতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা সময়ের অপচয় রোধ, সঙ্গে আর্থিক শাস্ত্রীয় বিষয়ও জড়িত।
সবচেয়ে বড় কথা দেওয়া-নেওয়ার যে বিষয়টি প্রথম পর্বে উল্লেখ করা হয়েছিল, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর বহু দেশে ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করেও যেমন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়, তেমনি সেবা দিয়েও তার ন্যায্য পাওনা পেতে দুর্ভোগের শিকার হতে হয় কিন্তু এখানে আইনের যথাযথ প্রয়োগের ফলে কোনো পক্ষকেই তেমন ভোগান্তির শিকার হতে হয় না। তাই সেবাদাতার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ন্যায্য মজুরি এবং সেবাগ্রহীতার ক্ষেত্রে পরিশোধিত অর্থের যথোপযুক্ত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিতের ব্যাপারে কোনো পক্ষই ব্যতিক্রম ঘটায় না, যা শিরোনামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পক্ষের দ্বারা বেআইনি কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগহেতু সবাই সচেতন এবং কোনোভাবেই বেআইনি কার্যকলাপে জড়ানোর সাহস করে না। নিউইয়র্ক শহর কখনো ঘুমায় না-এই বাস্তবতায় দিনরাত ২৪ ঘণ্টা নিউইয়র্ক শহর ও শহরের মানুষের কর্মব্যস্ত থাকা এবং যেকোনো সময় বাস-ট্রেন ব্যবহার করে যাতায়াত করলেও এখানে নিরাপত্তাজনিত কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ফলে এখানকার জীবনযাত্রা অত্যন্ত সহজ, সুন্দর ও সাবলীল।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।