Thikana News
০৪ ডিসেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

কৈশোরের ভালোলাগা ভালোবাসা

কৈশোরের ভালোলাগা ভালোবাসা
ড. এবিএম এনায়েত হোসেন

কলেজ ছুটিতে ‘ছবি ভাই’ বাড়িতে এসেছেন ক’দিন বেড়াতে। ভালোমন্দ নানা পদের রান্না তো আছেই, এর উপর রাতের বেলায় চিতই পিঠা, ধুপি পিঠা, পুলি পিঠা, হাতে কাটা সেমাই রান্না ও পাটি সাপটা বানানোর ধূম। ছবি ভাই রান্নাঘরের মধ্যেই পিড়ি পেতে বসে গরম গরম পিঠা খাচ্ছেন আর মা ও ভাবির সাথে হাসি ঠাট্টায় মগ্ন। গৈ-গেরামের অন্যান্য গেরস্থালীতে হ্যারিকেন কিংবা কুপির বাতি রাত আটটা হলেই সাধারণত নিভে যায়। আমার রোজকার পড়া এবং স্কুলের দেয়া বাড়ির কাজ তখন শেষ। রাতের খাওয়াটা সেরে আমার তখন বিছানায় শুতে যাবার কথা। দু’একবার রান্না ঘরে গিয়ে মাকে তাগিদ দিয়েও এসেছি। কিন্তু মা একই সুরে বারবার বলছেন

-আর একটু সবুর কর রে বাবা! এই তো পিঠা বানানো শেষ হলেই তোকে ভাত খেতে দিচ্ছি।
শুক্লপক্ষের চরম পরিণতি হবে হয়তো সেদিন। কারণ, আকাশে জ্বল-জ্বলে পূর্ণ চাঁদের আলো। আমি সময় কাটানোর জন্য আমাদের বাড়ির ভিতরকার উঠানে পায়চারি করছিলাম আর একটার পর একটা আধুনিক গান গাইছিলাম। কিছুটা উচ্চস্বরেই। মাঝে-মধ্যে আমাদের বড় টালিঘরের পিছন দিককার পায়ে চলা পথেও গান গাইতে গাইতে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। বিষয়টি ছবি ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। তিনি আমাকে ডেকে মা ও সেজ ভাবির সামনেই কিছুটা রাগ ও তিরস্কারের সুরে বললেন
-ছোটকা! তোর কোন লেখাপড়া নেই না কি? লেখাপড়া ছেড়ে এত রাতে গান গাওয়া হচ্ছে, না?
- জি দাদা! আমি তো আমার স্কুলের সব কাজ ও পড়া শেষ করে ফেলেছি। মা রাতের ভাত দিতে দেরি করছেন বলেই একটু গান গেয়ে সময় কাটাচ্ছি!
মা আমার পক্ষে রায় দিয়ে বললেন
-ও তো রাত ৮-৯টার মধ্যেই ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে। পড়ার কথা ছোটকাকে কোনদিন বলতে হয় না।
ছবি ভাই মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন
-সবই বুঝলাম মা! কিন্ত ওর লক্ষণটা তো আমি ভালো দেখছি না। রাতের বেলায় উচ্চস্বরে ও যেসব গান গাইছে, তাতে মনে হয় ওর মনে কোনো রঙ ধরেছে। 
এ কথা শুনে আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। 
মা আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, আর ছবি ভাইকে আশ্বস্ত করে বললেন
-ছোটকা ওরকম ছেলেই নয়!
তবে রিনির প্রতি এক রকম আকর্ষণ প্রতিনিয়তই বেড়ে চললো। কিছুটা অলক্ষ্যে, কিন্তু রিনির পরিবার-পরিজনদের পরোক্ষ সমর্থনেই। তাছাড়া স্কুলের একজন ভালো ছাত্র হবার সুবাদেও আমার পক্ষে গ্রামের কোনো বাড়িতে যাতায়াত করাতে কেউই কোনোরূপ বিরূপ মন্তব্য করতো না!
রিনির প্রথম চিরকূট পত্র ও সেলাই করা ছোট রুমালখানা পাবার পর থেকেই মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো- কিভাবে তার সেলাই দক্ষতা আরো ভালো হতে পারে। তাছাড়া ওর চিঠিতে লেখা প্রতিশ্রুতি মোতাবেক একটি মনের মত রুমাল পাবার আশায় আমি এমব্রয়ডারি করার জন্য ভালো ভালো ডিজাইন বা নকশা খুঁজতে লাগলাম। ভাগ্যক্রমে বড়ঘরে রাখা একটা পুরনো বাক্সের মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই বেশ কতগুলো সেলাইয়ের নকশার কাগজ পেয়ে গেলাম। 
মা বললেনÑ ওগুলো তোর লিলি বু, অর্থাৎ ছোট আপার জিনিস। তুই এসব দিয়ে কী করবি?
উত্তরে আমি বললামÑ আমি নিচ্ছি না, মা। এমনি দেখছি আর কি!
মা আর বেশি কথা বাড়ালেন না।
কিন্তু মায়ের অজান্তেই আমি ওগুলো বাক্স থেকে সরিয়ে ফেললাম। রিনিকে আমাদের পুকুরঘাটে বাসনপত্র ধোয়ার সময় দেখতে পেয়ে ওকে উচ্ছাসের সাথে জানালাম
- রিনি! তোমার জন্য কিছু সেলাইয়ের ডিজাইন জোগাড় করেছি। তুমি আজ সন্ধ্যার পরপরই আমাদের কাছারি ঘরের পূর্ব দিকে এসে দরজায় টোকা দেবে। আমি তখন ওগুলো তোমাকে দিয়ে দেবো।
অধীর অপেক্ষায় সেদিনটা কাটালাম। সন্ধ্যার পরেই যথারীতি আমি কাছারি ঘরে গিয়ে চুপিসারে রিনির অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু রিনি সেদিন এলো না। অগত্যা আমি নকশাগুলোর শিট কাগজগুলোকে কাছারি ঘরের বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখে বড়ঘরের পূর্ব দিকে অবস্থিত আমার পড়ার ঘরে ফিরে এলাম। ভাবলাম, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো অসুবিধা হয়েছে রিনির! নইলে আমার ডাকে সে সাড়া না দিয়েই পারে না!
পরদিন ভোরে উঠে কাছারি ঘরে গিয়ে নকশাগুলো ঠিকমত আছে কিনা, দেখতে গিয়েই দেখি সেগুলো গায়ের! অবশ্য কে এগুলো নিতে পারে, সে ব্যাপারে আমার আন্দাজ ছিল অব্যর্থ। এ কাজ আমারই সেজ ভাইয়ের বড় ছেলে মুরাদ (সরদার মিজানুর রহমান) ছাড়া বাড়িতে আর দ্বিতীয় কোন ব্যক্তিই নেই! কারণ, মুরাদ তখন ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। এবং তখনই সে পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানী করতে শুরু করেছে। তাছাড়া ঐ সময়েই পশ্চিম পাড়ার মতু শেখের ভাতিজি ‘সাহারা’র পেছনে তার ঘোরাফেরার বিষয়টা নিয়ে অনেকেই নানারকম কথাবার্তায় মশগুল। আমি মনে মনে নিশ্চিতভাবে ধরে নিলাম যে, মুরাদই আমার লুকিয়ে রাখা নকশাগুলো সরিয়ে ফেলেছে।
বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সকাল বেলা আমাদের ভিতরবাড়ির উঠানে মুরাদের মায়ের সামনে ওকে জিজ্ঞেস করলাম
-আমার নকশাগুলো ফেরৎ দিয়ে দে। নইলে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না, বলে দিচ্ছি।
-আমি কোনো নকশা নেই নাই। মুরাদের স্পষ্ট উত্তর।
-কিন্তু আমি তোকে কাছারি ঘর থেকে সকালেই বের হয়ে যেতে দেখেছি!
এ কথা শুনে মুরাদ কিছুটা আমতা আমতা করলো বটে, তথাপি সে বারবার অস্বীকার করে যেতে লাগলো। এক পর্যায়ে আমি সাহারার কথা উল্লেখ করার মুরাদ রেগে গিয়ে আমাকে ‘হারামজাদা’ বলে গালাগাল দিয়ে বসলো! এতে আমারও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো। এগিয়ে গিয়ে ওকে চড়-ঘুষি মেরে বেশ উত্তম-মধ্যম দিলাম। সেজ ভাবি (মুরাদের মা) তার ঘরের দাওয়ায় বসে কিছুটা বিচলিত চিত্তে ছেলের মার খাওয়া দেখলেন। মুরাদ কেঁদে-কেটে গিয়ে বাবার কাছে এর বিচার চাইলো। কিন্তু যেহেতু সে-ই প্রথমে আমাকে গালি দিয়েছে এবং এর চাক্ষুস স্বাক্ষী মা ও সেজ ভাবি, তাই বাবা আর এ নিয়ে কোনোরূপ কথা বাড়ালেন না। সবকিছু বিস্তারিত শুনে মন্তব্য করলেন
-উভয়েই কমবেশি দোষী! অতএব, এ নিয়ে যেনো আর কোনরূপ বাড়াবাড়ি না হয়, তা খেয়াল রেখে কুদুর মা।
সাল-তারিখটা সঠিক মনে নেই। তবে এ সময়েই ‘তছলু’র একমাত্র বোন ‘চিনি’, অর্থাৎ, আমাদের চিনি খালার বিয়ে ঠিক হয়। হলুদের দিন সাধারণত রঙ খেলা হয়ে থাকে। মনে আছে, সেদিন আমি একটা বালতিতে ইটের গুড়া, খয়ের ও কাঁচা হলুদ বাটা মিশিয়ে রঙ বানিয়েছিলাম। তল্লা বাঁশের তৈরি একটা পিচকিরি দিয়ে ঐ রঙ ছিটাচ্ছিলাম আগত পাড়া-পড়শিদেরকে। স্থানটি ছিল তছলুদের দালানের পশ্চিম পাশের গলিপথ। রঙ খেলার মজা দেখতে ছোট-বড়দের একটা ভীড় জমে ওঠে দুপুরের পর থেকেই। বর্ষীয়সী অনেক মহিলাই সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মাফ চাইছিলেন। অনেকে রঙ মেখে হাসছিলেন, আবার কেউ কেউ কিছুটা রাগান্বিত হয়েই বিয়ে বাড়িয়ে ঢুকে পড়ছিলেন। সঙ্গে আসা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের শখের জামা নষ্ট হওয়ায় কাঁদা-কাটি করছিল।
হঠাৎ এ সময়ে এখানে আসে ‘বদির মোল্লা’, সম্পর্কে আমার বেয়াই। গায়ে-গতরে বেশ তাগড়া ছেলে। সবে ধানের নৌকা থেকে গ্রামে ফিরেছে। ওকে রঙ দিতে এগুতেই বদির চট করে এসে আমাকে দু’হাতে জাপটে ধরে ফেললো। আশ-পাশের সবাই তখন রঙ খেলার চেয়ে আমাদের দু’জনের মল্লযুদ্ধ দেখার জন্যই উৎসুক হয়ে উঠেছে। ততোক্ষণে নানাজনে দু-একটা টিকা-টিপ্পনীও কাটতে শুরু করেছে। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! হাতের পিচকিরি রক্ষা করবো, না বদিরকে শক্তিতে কাবু করবো, তা ভাবতে না ভাবতেই ও আমাকে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দিলো চিৎ করে। আমি বলতে থাকলাম
-এটা কিন্তু ঠিক করলে না বেয়াই! আমার পিচকিরিটা ছেড়ে দাও।
যা হোক, এ সময় চারপাশের জনতাও একই সুরে বলতে থাকলো
-ছেড়ে দে রে, বরিদ ছেড়ে দে।
বদির মোল্লা আমাকে ছেড়ে দিতেই জনতার ভিড় থেকে এগিয়ে এলো আমার মাছমারার সঙ্গী ‘চুনচালে’। সে হাসতে হাসতে বললো
-কী নানা? তুমি ইডা (এটা) কি করলে, বদির মোল্লার মতন ফুলো (মোটা) শরীলের ছাওয়ালরে কাৎ করতি পারলে না?
উত্তরে আমি বললাম
-আরে কী যে বলো না, নানা! আমি কী ওর সাথে কুস্তি লড়তে গেছি না কি! আমি তো আমার পিচকিরিটা ঠেকাতেই ব্যস্ত ছিলাম। ও শালা আমাকে হঠাৎ এমনভাবে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে, তা ভাবিনি!
পরদিন রিনির সাথে দেখা হতেই সে বদির মোল্লার সাথে হাতাহাতির পরিণামের কথা উঠলো।
আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম বটে, তবে উত্তরে তাকে বুঝালাম যে, এটি কোনরূপ শক্তি পরীক্ষার মোকাবেলা ছিল না।
বুঝতে পারলাম যে, বিষয়টি চুনচালে নানাই রিনিকে বলেছে! নিজকে কিছুটা হলেও দুর্বল ও পরাজিত নায়ক বলে মনে হলো। তাই রিনি ও তার পরিবার-পরিজনের কাছে আমার শক্তিমত্তার উপযুক্ত প্রমাণ কীভাবে দেয়া যায়, তার উপায় খুঁজতে লাগলাম। আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে সুযোগও এসে গেল আমার হাতের মুঠোয়!
তখন আমার হ্যাংলা রোগা-পাতলা শরীরে বেশ কিছুটা মাংসের সংযোগ ঘটেছে। হুইল বড়শি দিয়ে মাছ ধরার মধ্য দিয়ে ‘আবু সরদার’, অর্থাৎ আবু ভাইয়ের সাথে এ সময় আমার বেশ নৈকট্য হয়ে ওঠে। গাঁয়ের সবাই জানে যে, আবু সরদার কালীর সাধনা করে। তুক-তাক, তাবিজ-কবজও দেয়। দৈত্যের মতই অনেকটা দেখতে তার দৈহিক অবয়ব। গায়ের রং আবলুস কাঠের মতোই মিশমিশে কালো। প্রতি মাসের অমাবস্যা রাতে প্রায়ই আবু ভাই কোথায় যেনো গায়েব হয়ে যেতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো
-বুঝিস না? কালীর সাধনা বড়ই কঠিন। মন্তর পাঠে একবার ভুল হলি আর রক্ষি নাই! অমনি আমার ঘাড়ডা মটকায়ে খাবি!
ভয়ে আমি আর কথা বাড়াতাম না। এই আবু ভাইয়ের বদৌলতেই আমি রিনির মেজ ভাইকে বুঝাতে সক্ষম হলাম যে, মন্ত্রপাঠ করে কিছু সময়ের জন্য আমিও মহাশক্তিধর হতে পারি! এ সময় আমাকে একটা শক্ত দড়ি দিয়ে কোমরে বেঁধে রাখতে হবে, আর একটা মুরগির রক্ত খেতে দিতে হবে!
এ কথা শুনে রিনির মা, বড় ভাবি ও রিনির ছোট ছোট ভাই-বোনরা বিশেষভাবে কৌতূহলী হয়ে উঠলো আমার এই অতিন্দ্রীয় শক্তির পরাকাষ্ঠা একবারটি চাক্ষুস দেখার জন্য। রিনির মেজ ভাই ব্যাপারটা চুনচালেকেও জানালো। সেও এ বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখালো। কারণ, রিনির সামনে আমার বীরত্বের এরূপ অকাট্য প্রমাণে সেও কম সন্তুষ্ট হবে না!
অতএব, যথারীতি একদিন সকাল দশ-এগারোটার দিকে যখন রিনির বাবা বাজারে গিয়েছেন, তখন রিনির মেজ ভাই ও চুনচালে একটা শক্ত দড়ি দিয়ে আমার কোমর বাঁধলো। আমি একটা কাঁসার বাটিতে সামান্য পানি আনতে বললাম। বিড় বিড় করে আবু ভাইয়ের শেখানো কিছু মন্ত্র পাঠ করে পানিতে ফুঁ দিলাম এবং বললাম
-সাবধান! মুরগির রক্ত পান করার সাথে সাথেই যেনো এই পড়া পানি আমার উপর ছিটিয়ে দেয়া হয়। দেরি হলে আমি কিন্তু বেহুস হয়ে পড়ে যেতে পারি। এতে সবারই বিপদ হবে!
কোমরে দড়ি বাঁধার পর চোখ দুটো বড় বড় করে প্রথমে আস্তে আস্তে এবং ক্রমশ বিকৃত স্বরে আবোল-তাবোল সব মন্ত্র শব্দ ও কিছু আরবি শব্দ আউড়ে উপস্থিত সবাইকে বেশ চমকে দিলাম। অতঃপর হুংকার দিয়ে উঠলাম
-দে, দে, আমায় রক্ত পান করতে দে!
তৎক্ষণাৎ রিনির বড় ভাবি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা ৩-৪ মাসের ছোট্ট পোষা মুরগি। আমি দেরি না করে এক হাতে মুরগিটির কল্লা ছিঁড়ে অন্য হাতে মুরগিটি ধরে চুকচুক করে গরম রক্ত চুষে খেতে লাগলাম! এ সময় পাশ থেকে কে যেনো আমার গায়ে পড়া পানি ছিটিয়ে দিলো। আর সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার ছানাবড়া চোখ দুটিকে স্বাভাবিক করলাম। মুরগিটাকে ফেলে দিলাম এবং এক গ্লাস পানি চাইলাম। পানি দিয়ে চোখ-মুখ ভালো করে ধুয়ে বাড়িতে চলে এলাম।
রিনি ও তার পরিবার-পরিজনের কাছে আমার অতিন্দ্রীয় শক্তিমত্তার পরীক্ষায় আমি ঠিকই উত্তীর্ণ হলাম। কিন্তু, ঐদিন দুপুরেই আমার গা কেঁপে এলো জ্বর। মা জিজ্ঞেস করলেন
-ছোটকা! শুনলাম রিনিদের বাড়িতে তুই কী খেলা দেখিয়েছিস? সত্যি করে বলতো বাবা, আসলে ব্যাপারটা কী? লোকজনতো নানারকম কথা বলছে!
উত্তরে আমি মাকে উল্টো প্রশ্ন করলাম
-মা! তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?
-হ্যাঁ, করি।
মায়ের কণ্ঠে গভীর স্নেহমাখা বিশ্বাসের প্রত্যয় শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম।
-তা হলে মানুষের কান কথায় গুরুত্ব দিও না। তোমার ও বাবার সম্মানের হানী হয়, এমন কোন কাজ তোমার এ ছোট ছেলে কোনদিন করবে নাÑ এটা ভালো করে জেনে রেখো।
আমার কথা শুনে মা এ বিষয়ে আর কোন উচ্চবাচ্চ করলেন না। সময় বয়ে চললো তার আপন গতিতে। আমারও লেখাপড়ার চাপ বাড়তে থাকলো। দেখতে দেখতে ম্যাট্রিক পরীক্ষাও দিয়ে ফেললাম। তখন ১৯৬০ সাল। ফল বের হতে বেশ ক’মাস লেগে যায়। কারণ, সারাদেশে একটিই মাত্র বোর্ড- পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা। হাতে অখণ্ড অবসর। মাছ ধরা, গল্প-উপন্যাস পড়া আর কখনওবা কবিতা লিখে সময় কাটে। তখন রিনির বাবা আমাকে অনুরোধ করলেন

-বাবা ছোটকা! তোমার তো এখন স্কুল-কলেজ নাই। তুমি একটু সময় করে রিনি আর তুষারকে (সঠিক নামটি উল্লেখ করা হলো না) পড়াও না? ওরা দু’জনেই অঙ্ক এবং ইংরেজিতে বেশ কাঁচা।
আমি বেশ আগ্রহের সাথেই মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলাম। বললাম
-ঠিক আছে, খালুজান। আপনি কোন চিন্তা করবেন না! আমার তো এখন ছুটি। আমি রোজ সকাল ও সন্ধ্যায় ওদের দু’জনকে পড়া দেখিয়ে দেবো।
-বেঁচে থাকো বাবা! জীবনে অনেক বড় হও, এই দোয়াই করি।
খালুজানের কণ্ঠে আবেগ ও তৃপ্তির সুর শুনতে পেলাম। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা খালুজানও যেন একটা তৃপ্তির হাসি হাসলেন।
রিনিদের বাড়িতে আমার যাতায়াত আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু রিনি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে, তখন থেকেই তার আব্বা-আম্মা দু’জনেই অস্থির হয়ে উঠলেন মেয়ের বিয়ে দিতে। ইতোমধ্যে একদিন রিনির মা এসে মায়ের কাছে রিনির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন। মা বললেন
-এসব বিষয়ে কুদুর বাবার মতামতই শেষ কথা। আপনি রিনির আব্বাকে দিয়ে উনার কাছে প্রস্তাবটা পেশ করেন।
মায়ের পরামর্শ মোতাবেক অতঃপর একদিন সকালবেলা রিনির আব্বা এলেন আমাদের বাড়িতে। বাবা শুয়ে ছিলেন খাটে। মা দাঁড়িয়ে আছেন বাবার মাথায় দিকে। খালুজান যথারীতি এসে বাবার পায়ের দিকে দক্ষিণের দরজা বরাবর বসলেন। মা পান-সুপারির পানদানটা এগিয়ে দিলেন রিনির আব্বার দিকে। আমি চুপিসারে বেকি বেড়াটার পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন শুনতে অধীর আগ্রহে প্রহর গুণছি।
যথারীতি ভালোমন্দ কুশল বিনিময়ের পর রিনির আব্বা বাবাকে সম্বোধন করে বললেন
-বু জানের কাছে রিনির মা একটা আবদার করে গেছে। এ ব্যাপারে ভাইসাব আপনার মতামত জানতে এসেছি। আপনি কী বলেন?
-দেখো ভাই, শাদি-বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছা না হলে কিছুই হয় না। আমাদের এখন দু’টি ছেলের সংসার বসানোর বাকি। এর মধ্যে ছোটকাতো সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলো মাত্র। ওর লেখাপড়া শেষ করতে তো অনেক বাকি। আর ‘নল্টু’ (জাহিদ ভাই) এখন খুলনায় চাকরি করছে। সম্পর্ক করতে চাইলে নন্টুর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা যায়।
-পছন্দের কথা যদি বলেন ভাইসাব, তাহলে আমাদের দু’জনেরই ছোটকাকেই বেশি পছন্দ হয়। কিন্তু ওর যেহেতু পড়ালেখা এখনও শেষ হয়নি, তাই রিনির সাথে নন্টু মিঞার বিয়ে হলেও আমরা খুশি হবো।
-ঠিক আছে ভাই! খুলনায় ছালামই ওর গার্জিয়ান। ছালামের মতামতটাও জানা দরকার। তাছাড়া নন্টুকে চিঠি লিখে বাড়িতে আসতে বলতে হবে। ওরও পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার রয়েছে।
-সে তো অবশ্যই! আপনি নন্টুকে চিঠি দেন। ও যেন সামনের ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসে। সে আসলেই রিনিকে দেখিয়ে ওর মতামতটা জেনে নেয়া যাবে।
রিনির আব্বা এ কথাগুলো বলে বাবা ও মাকে আশ্বস্ত করলেন এবং হাসিমুখে বিদায় নিলেন।
রিনির আব্বা এবং আমার মা-বাবার কথোপকথন শুনে আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। সত্যি সত্যিই যদি নন্টু ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। সে আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে এলে সম্পর্কে সে হবে আমার ভাবি! ব্যাপারটা তাহলে কেমন দাঁড়াবে? মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকলাম। এমনটি যেনো না হয়! অন্যথা হলে হয়ত সারাজীবন ধরে রিনি ও আমি একে অপরের কাছে সহজ হতে পারবো কি?
দেখতে দেখতে ঈদের ছুটি ঘনিয়ে এলো। নন্টু ভাই বাড়িতে এলেন ঠিকই। সবকিছু বিস্তারিত জেনে রিনিদের বাড়িতে গেলো ওকে দেখতে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে বিয়ের ব্যাপারে তেমন কোন তোড়জোড় হতে দেখলাম না। বিষয়টা একটু খোলাসা করে জানার জন্য মাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম

-মা! নন্টু ভাইয়ের বিয়ের কী হলো? রিনিকে নন্টু ভাইয়ের পছন্দ হয়নি?
-নারে বাবা! পছন্দ ঠিকই হয়েছে, কিন্তু বাঁধ সেজেছে তোর মেজ ভাই। চিঠিতে তোর বাবাকে সে লিখে জানিয়েছে যে নন্টুর এখন বিয়ে করা ঠিক হবে না! ওকে শিপইয়ার্ডের টালিক্লার্কের চাকরিতে ইস্তাফা দিয়ে অচিরেই ওকে তোর মেজ ভাইয়ের কাঠের করাতকল দেখাশুনা করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে!

খবরটা শুনে আমি যেনো অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু রিনির আব্বা ও আম্মা আমাদের পরিবারের উপর ভীষণভাবে মনোক্ষুণ্ন হলেন।

সময়ের স্রোতে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বেরোল। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬০ সালের শীতেই আমি চলে গেলাম চট্টগ্রাম শহরে, মেজবুর বাসায় থেকে কলেজে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে। আর রিনি সে বছর পঞ্চম শ্রেণির চৌকাঠ পার হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রাখলো। আমাদেও কৈশোর জীবনের ভালোলাগার সম্পর্কটা আর বেশি দূর এগুতে পারলো না। কারণ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আমি উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থাতেই পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৬১ সালে রিনির বিয়ে হয়ে গেলো তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এক অফিসারের সাথে।

কমেন্ট বক্স