রেভারেন্ড ফাদার স্ট্যানলী গমেজ
রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কোন সাধু ব্যক্তিকে তারা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর হবে পর্তুগালের লিসবনে জন্মগ্রহণকারী ও ইতালির পাদুয়ায় সমাধিস্থ সাধু আন্তনি। বাংলাদেশি ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের কাছেও আন্তনি তেমনভাবেই সমাদৃত। তাই জুন মাস এলেই বাংলাদেশি খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, কানেকটিকাট ও মেরিল্যান্ডে সাড়া পড়ে যায় জুন মাসের ১৩ তারিখের কাছাকাছি শনি কিংবা রোববারে এই মহান ও জনপ্রিয় সাধুর পর্ব (Feast Day) পালন করতে। এই বিশেষ দিনের প্রস্তুতির পূর্বে নয় দিন ধরে বিশেষ প্রার্থনা বা নভেনা হয় বাড়িতে বাড়িতে কিংবা গির্জায়। নিউইয়র্ক এলাকার কুইন্স ভিলেজের শ্রদ্ধেয় অ্যালেন ও ক্যাথেরিন গোনসাভেজের বাড়িতে প্রায় ২৫ বছর আগে কয়েকটি পরিবার নিয়ে বাংলা ভাষায় সাধু আন্তনির পর্ব পালন শুরু হয়। তাদের ও বৃহত্তর পরিবারের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকবে সব সময়। বছর বছর অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাই এখন স্থান সংকুলান না হওয়ায় এই পর্ব গির্জায় হয়।
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এই সাধু আন্তনি?
আন্তনির জন্ম পর্তুগালের বর্তমান রাজধানী লিসবনে ১১৯৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাপ্তিষ্ম বা দীক্ষাস্নানের সময় তাঁর নাম দেওয়া হয় ফেরনান্দো মার্টিনস ডে বুলওয়েস। তাঁদের পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী এবং তাঁর পিতামাতা ভিসেন্তে মার্টিনস ওতেরেসা টাভেইরা ছিলেন খুবই ধর্মভীরু এক দম্পতি। ছোটবেলাতেই তাঁর বুদ্ধিদীপ্ততার জন্য তাঁকে ক্যাথিড্রাল স্কুলে পাঠানো হয় পড়াশোনার জন্য। তাঁর যখন মাত্র ১৫ বছর বয়স, তখন তিনি যাজক হওয়ার বাসনায় সাধু আগস্টিনের সন্ন্যাস সম্প্রদায়ে যোগদান করেন। তাঁদের মঠের নাম ছিল সাধু ভিনসেন্ট অ্যাবি এবং তা লিসবন শহরের একটু বাইরে অবস্থিত ছিল। কয়েক বছর পরে তিনি ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ব (Theology) ও ল্যাটিন ভাষার ওপর উচ্চশিক্ষার জন্য তদানীন্তন রাজধানী কোইম্ব্রাতে অবস্থিত কোইম্ব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইউরোপ মহাদেশের প্রাচীন বিদ্যাপীঠের একটি। অল্প বয়সেই তাঁর তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার জন্য তিনি অনেক প্রশংসা অর্জন করেন।
উচ্চশিক্ষা শেষে ফেরনান্দো (পরবর্তী সময়ে আন্তনি নামে পরিচিত) মাত্র ১৯ বছর বয়সে যাজক পদে অভিষিক্ত হন এবং তাঁদের মঠের অতিথিদের তদারকির দায়িত্বে নিযুক্ত হন। সে সময় ইতালির আসিসি শহরে ১১ বছর আগে ফ্রান্সিস (St. Francis of Assisi) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ের কয়েকজন সন্ন্যাসী কোইম্ব্রাতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁদের অতি সাধারণ জীবনযাপন, ধর্মভীরুতা, ঈশ্বরে দৃঢ়বিশ্বাস, সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক, দরিদ্রদের প্রতি উদারতা ইত্যাদি গুণাবলি তাঁকে আকৃষ্ট করে।
তিনিও তাঁদের একজন হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। ঠিক এই সময়েই পাঁচজন ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসী মরক্কোতে গিয়ে ধর্মশহীদ হন। তাঁদের মৃতদেহ পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় আলফন্সোর নির্দেশ অনুযায়ী পবিত্র ক্রুশ মঠে সমাহিত করা হয়। এই ধর্মশহীদদের সাহসী উদাহরণে আকৃষ্ট হয়ে এবং তাঁদের শূন্যস্থান পূরণের প্রত্যাশায় আগস্টিনিয়ান ধর্মসংঘ থেকে বিদায় নিয়ে ফ্রান্সিসকান ধর্মসংঘের একজন সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। তাঁর আবেদন গৃহীত হয় এবং তিনি ফ্রান্সিসকান ধর্ম সংঘের প্রথা অনুযায়ী নতুন নাম আন্তনি গ্রহণ করেন।
ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ আন্তনিকে মিশনারি হিসেবে মরক্কোতে প্রেরণ করে। কিন্তু সেখানে তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি হতে থাকলে তাঁকে পর্তুগালে ফেরত পাঠানো হয়। ফেরতযাত্রায় সমুদ্রের ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জাহাজ সিসিলি দ্বীপে এসে নোঙর ফেলে। সেখান থেকে আন্তনি উত্তর ইতালির টাসকানি প্রদেশে এক মঠে নতুন কাজের দায়িত্ব পান। সেখানেও তাঁর স্বাস্থ্যগত অবনতি হতে থাকলে রোমানিয়া প্রদেশের ফর্লি নগরের নিকটবর্তী সান পাওলো অঞ্চলে এক আশ্রমে তাঁকে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি প্রার্থনা, ধ্যান, বিবিধ পাণ্ডুলিপি পড়ে জ্ঞানার্জন এবং গরিব ও স্থানীয় জনগণের সেবায় সময় কাটান আর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এই সময় পর্যন্ত আন্তনির তেমন পরিচিতি হয়নি, একজন সাধারণ সন্ন্যাসী হিসেবেই আশপাশের লোকেরা তাঁকে জানত। কিন্তু একটা ঘটনা তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। ১২২২ সালের গ্রীষ্মকালে ফর্লি নগরে যাজকীয় অভিষেক উপলক্ষে বহু যাজক ও সন্ন্যাসীর আগমন ঘটে। ডমিনিকান পুরোহিতরা সুবক্তা ও প্রচারক হিসেবে সব সময়ই পরিচিত ছিলেন, এখনো তাঁদের সেই সুখ্যাতি বজায় আছে। কিন্তু সেই যাজকীয় অভিষেক উপাসনায় কে বক্তব্য রাখবেন, তা নিয়ে দ্বিধা সৃষ্টি হয় এবং ডমিনিকান পুরোহিতদের মধ্যে কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। ফান্সিসকানদের মঠের অধ্যক্ষ আন্তনিকে বক্তব্য রাখতে বললেন। আন্তনির পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলেও বাধ্যতা ব্রতের জন্য তিনি রাজি হন ও অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সকলের বোধগম্য চমৎকার এক ধর্মীয় বক্তব্য (Sermon) রাখেন এবং উপস্থিত সবাই তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান অধ্যক্ষ আসিসির ফ্রান্সিস আন্তনিকে তাদের নতুন সভ্যদের ধর্মতত্ত্বের (Theology) প্রভাষক নিযুক্ত করেন।
এরপর মুখে মুখে তাঁর গুণাগুণের কথা, বাইবেল ও ধর্মীয় বিষয়ে তাঁর জ্ঞান, পরামর্শদানের ক্ষমতা, যুবকদের অসৎ পথ থেকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক, পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা, হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া, এমনকি অলৌকিক কাজের ক্ষমতার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একবার এক শিশু নদীর ধারে খেলতে গিয়ে পানিতে পড়ে ডুবে যায়। গ্রামের জেলেরা শিশুটির দেহ নদী থেকে জাল দিয়ে তুলে আনে কিন্তু ততক্ষণে শিশুটির প্রাণ আর নেই। বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে তার মায়ের হৃদয়বিদারক আর্তনাদে সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তাদের কান্না শুনে আন্তনি তা সহ্য করতে না পেরে প্রার্থনায় মগ্ন হন। তারপর সেই মৃত শিশুটির গায়ে হাত রেখে আশীর্বাদ করলে শিশুটি জীবন ফিরে পেয়ে কান্না শুরু করে এবং সেই কান্না শুনে তার মা ও উপস্থিত সবার কান্না থেমে গিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসিতে ভরে ওঠে। আরেকবার এক নবজাত শিশুর পিতা তার স্ত্রীকে পরকীয়ার অভিযোগ এনে বিবাহবিচ্ছেদ করতে উদ্যত হলে সেই নতুন মা তাদের পুরোহিত আন্তনিকে সাহায্য করতে বলেন। আন্তনি তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেন যে সেই নতুন মায়ের স্বামীই শিশুর পিতা। এতে পরিবারে আবার শান্তি নেমে আসে। এখনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা কিছু হারিয়ে গেলে তা ফিরে পাওয়ার জন্য সাধু আন্তনির মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করেন; স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কলহ হলে অনেক দম্পতি সাধু আন্তনির সাহায্য যাচনা করেন। বর্তমানকালে গাড়ি চালাতে গিয়ে যদি পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়া না যায়, তখন গাড়ির চালকেরা সাধু আন্তনির কাছে অনুরোধ করে পার্কিং স্থান পাইয়ে দেওয়ার জন্য।
পর্তুগাল, মরক্কো, ইতালি ও ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় আন্তনি শিক্ষাদান করেন, ধর্ম প্রচার করেন, দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-ধনী সকলকেই তিনি পালকীয় সেবা দান করেন বিভিন্নভাবে। কর্মবহুল কিন্তু সংক্ষিপ্ত জীবন শেষে ১২৩১ সালের ১৩ জুন পাদুয়া নগরের একটু বাইরে আছেল্লা গ্রামে সাধ্বী ক্ল্যায়ের মঠে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন। জীবনের অনেকগুলো বছর যেহেতু তিনি পাদুয়া নগরে কাটিয়েছেন, তাই তাঁকে পাদুয়াতেই সমাহিত করা হয়। এ জন্যই তাঁকে বলা হয় পাদুয়ার সাধু আন্তনি (St. Anthony of Padua)। তবে পর্তুগালের লিসবনে তাঁর জন্ম হওয়ায় তাঁকে ডাকা হয় পাদুয়া ও লিসবনের সাধু আন্তনি (St. Anthony of Padua & Lisbon)। তাঁর অসাধারণ ধার্মিকতা, ঈশ্বরে গভীর বিশ্বাস, অলৌকিক কাজ, বহুভিদ মানবীয় গুণাবলি, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে মিলন-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ইত্যাদি কারণে পোপ নবম গ্রেগরি ১২৩২ সালের ৩০ মে ইতালির স্পোলেটো শহরে তাঁর পিতা-মাতার উপস্থিতিতে আন্তনিকে সাধু হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ক্যাথলিকদের কাছে সাধু আন্তনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাদের বাড়িতে এই সাধুর ছবি কিংবা মূর্তি দেখা যাবেই। এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে এই মহান ও সবচেয়ে জনপ্রিয় সাধুর গুণকীর্তন করবেই। আমাদের মনোবাসনা এই, আমরা যেন তাঁর বহু গুণাবলির কিছুটা হলেও আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি এবং মানুষের মাঝে যেন দেয়াল নয় বরং সেতু গঠন করতে পারি।
সাধু আন্তনি-আমাদের মঙ্গল প্রার্থনা করো।
তথ্যসূত্র : ক্যাথলিক পরিবারে প্রচলিত সাধু আন্তনির গল্প; সাধু আন্তনির পার্বণে শোনা তাঁর
জীবনী ও ধর্মীয় বক্তৃতামালা; বই ও ডিজিটাল আকারে সাধু আন্তনির বহু জীবনকাহিনি থেকে অংশবিশেষ।
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।