আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘরে-বাইরে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দলটির তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানো বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন মোকাবিলা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ক্ষুব্ধ নাগরিকদের সন্তুষ্ট রাখতে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা, ক্ষমতার মেয়াদের শেষ সময়ে এসে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ধরে রাখা ক্ষমতাসীনদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি ঘোষিত মার্কিন ভিসা নীতি। এই ভিসা নীতিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ খুব একটা আমলে না নিলেও এর নেতিবাচক দিক পর্যবেক্ষণ করছে দলটি, থাকছে সতর্কও। সামগ্রিকভাবে এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় দলটি নিজেদের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সামর্থ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ততই বাড়ছে। দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ছাড়াও প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম ও হত্যা, গুলি করে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটছে অহরহ। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলেরই অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ। নির্বাচনে প্রতিপক্ষ, স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব বলয় তৈরিসহ নানা কারণে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন নেতারা। দলের অব্যাহত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীনরা। ভোটের আগে তৃণমূলের এসব বিরোধ মেটানো বড় চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের।
গাজীপুর সিটি নির্বাচন তৃণমূলে অনৈক্যের বড় সতর্কবার্তা দিয়েছে আওয়ামী লীগকে। আজমত উল্লার হারের পেছনে অভ্যন্তরীণ বিভেদকেই প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। সামনে আরও চারটি সিটি নির্বাচন। এসব নির্বাচন ঘিরেও কোন্দল স্পষ্ট হয়েছে। বরিশাল ও রাজশাহীতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকট। প্রকাশ্যেই অনেকে নৌকার বিরোধিতা করছেন। ভোটের খুব বেশি সময় বাকি না থাকলেও নৌকার পক্ষে এখনো সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামানো সম্ভব হয়নি।
সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা আরেক চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে। এবার নির্বাচন অতীতের চেয়ে কঠিন হবে। ফলে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়ে আসতে পারেন এমন প্রার্থীদেরই বেছে নিতে হবে দলটিকে। বর্তমানে দেশে বেড়েছে লোডশেডিং। তীব্র গরমে অস্থির জনজীবন। এতে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছে আওয়ামী লীগ। লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দলটির বিদ্যুৎ খাতে অতীতের সকল অর্জন ম্লান হওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্ষমতাসীন দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার রোধ।
নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পরে গঠিত সরকারে শরিক দলের একাধিক নেতা মন্ত্রী হয়েছেন। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পরে শরিকবিহীন সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এর পর থেকেই তাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দলীয় জোটকে আবারও চাঙা করার চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের সামনে। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে বিএনপিসহ বিরোধী পক্ষ আন্দোলনে ততই গতি বাড়াচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল হিসেবে এখানে আওয়ামী লীগের দুটি মূল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে রাজপথে থেকেই আন্দোলন মোকাবিলা করতে হবে, আবার আন্দোলনের নামে বা আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হলেও দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, তা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনের আগে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ৫ জুন সোমবার গণভবনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে আগামী নির্বাচনটা চ্যালেঞ্জের হবে বলে জানান দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, নির্বাচনটা একটা চ্যালেঞ্জ, কারণ নানা ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়ে দলটির প্রধান বলেন, আমাদের সংগঠন যথেষ্ট শক্তিশালী। সংগঠনটা যেন আরও মজবুত থাকে, সেদিকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আওয়ামী লীগ মনে করছে, সংগঠন শক্তিশালী থাকলে পরিস্থিতি মোকাবিলা সহজ। জাতীয় নির্বাচনের দিকে সময় যত অগ্রসর হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গন ততটাই উত্তপ্ত হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা, আর সরকারি দল তা মোকাবিলা করতে গেলে দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকছে না। কর্মসূচি-পাল্টা কর্মসূচি চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি শঙ্কা কাজ করে। ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার এক দফা আন্দোলনের হুঁশিয়ারি’ জানানো হয়েছে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে প্রস্তুত রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। জাতীয় নির্বাচনের আগে শুধু বিরোধী দলকে মোকাবিলাই নয়, দলটির সামনে থাকা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া দলের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে সক্রিয় রয়েছে শীর্ষ নেতৃত্ব। দলকে শক্তিশালী করতে ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে একাধিকবার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। চলছে দফায় দফায় বৈঠকও।
এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে আমরা শিক্ষা হিসেবে নিতে চাই। সামনের সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য নির্বাচনে আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে, কোনো দুর্বলতা থাকলে সেগুলো দূর করতে চাই।