বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তীব্র আকারই রয়ে গেছে। এ সংকট কমে আসবে বলেই সংশ্লিষ্টরা আশা করছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় এলসি খোলা ব্যাহত, এলসি নিষ্পত্তিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এতে অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব, বিশেষ করে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আদায়ও উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে। এলসি খুলতে না পারায় অভ্যন্তরীণভাবে পণ্যের সংকট ও দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়েছে। মানুষের দুর্ভোগও বেড়েই চলেছে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত এলসি খোলা কমেছে ৩৪ শতাংশ। এই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমে হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। গত অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৫৭ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছর ১১ মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি বছরের একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি হয় ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ফলেই অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি ও দেশের মানুষ। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে। ২০ মে পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। অপ্রয়োজনীয় এবং জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিধিনিষেধে উদ্যোক্তারা এলসি খুলতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ডলারের সংকটে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না। ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে দেশে ডলার সংকট থেকেই যাচ্ছে। বড় অঙ্কের এলসি খোলা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা আটকে দেয়। ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যমানের ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ডলার স্বল্পতার জন্য অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা বন্ধ করে দিয়েছে বা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছে। এতে করে কাঁচামাল আমদানি, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যাটেরিয়াল আমদানিও কমে গেছে। জুলাই-মে সময়ে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ডলার সংকটে প্রয়োজনীয় এলসি খোলা সম্ভব না হওয়ায় স্থানীয় অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বৈধপথে আসা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে না, বরং কমে গেছে। এ অবস্থাটা সরকারের রাজস্ব আয় কমার অন্যতম কারণ। ইমপোর্ট ডিউটি, ট্যাক্স, ভ্যাট বাবদ সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা কমে যাওয়ায় পণ্য আমদানি কমেছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে দামও বেড়েছ। কম্পিউটার, মোটরসাইকেল আমদানির জন্য এলসি খোলা প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। টেক্সটাইল ফেব্রিকস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যাটেরিয়ালের এলসি কমেছে ৩৫ শতাংশ হারে। সিমেন্টের ৩২ শতাংশ, লেদার ও টেক্সটাইল মেশিনারিজ, বিভিন্ন ক্যাপিটাল মেশিনারিজের এলসি খোলা ৫৭-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এতে স্থানীয় শিল্প-কারখানাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন কমেছে, বেড়েছে বেকারত্ব।