এস এম মোজাম্মেল হক :
সাধের সংসারের প্রতি মমতা বাড়তে বাড়তে একসময় উভয়ে উভয়ের প্রতি আকর্ষণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বৃক্ষের ন্যায় শিকড় এত গভীরে পৌঁছে যায়, মনে হয় এ থেকে আর তার প্রস্থানের কোনো সম্ভাবনাই নেই। অথচ প্রকৃতির এমনই এক অলঙ্ঘনীয় রীতি, শিকড় যতই গভীরে পৌঁছাক, মমতা যতই নিবিড় হোক, সে বন্ধন ছিন্ন করে একসময় উভয়ে উভয়কে ছেড়ে যেতেই হয়। যদিও মোহগ্রস্ত এবং প্রকৃতির নিয়মের ওপর আস্থাহীন অনেকে এমন ভাবেন যে এই মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে এমন সাধ্য কারও নেই। এমন ভাবনা থেকেই মানুষ ন্যায়-অন্যায়বোধ বিস্মৃত হয়ে পরম আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে এবং সংসার ও নিকটজনের প্রতিই তার সমস্ত স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। ফলে স্বার্থপরতার এমন এক বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ হয়, সেখান থেকে পরমেশ্বরের কঠোর সিদ্ধান্ত ব্যতীত বন্ধনমুক্ত হওয়ার উপায় থাকে না। আর এমন কঠিন বাস্তবতায় পৃথিবীতে আগমনের যে বহুমাত্রিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অবকাশ ছিল এবং জন্মের চেয়েও প্রস্থান অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ হতে পারত, তা অর্জনের আর সময় হাতে থাকে না। ফলে মর্যাদাপূর্ণ জীবন লাভ করলেও ধিক্কৃত প্রস্থানই হয় অনিবার্য।
পৃথিবীর সবকিছুই চাহিদা ও জোগানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। স্নেহ-মায়া-মমতা, ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-ভক্তি-এসবও এর বাইরে নয়।
বিদ্যাবুদ্ধিতে মানুষ যত দক্ষতা অর্জন করে, পারস্পরিক সম্পর্ক তত জটিল হয়Ñহোক তা নিকটজন বা ভিন্ন কেউ। সংসার এমন এক বাস্তবতা, যা সরল অঙ্কের মতো নির্ভুলভাবে পরিচালনা করতে পারলে ফলাফল অতি চমৎকার কিন্তু সামান্য ভুলের কারণেও সরল অঙ্কের মতো ফল মেলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে। সংসার মূলত অতি নিকটজনের সমন্বয়ে অতি ক্ষুদ্র সমাজের প্রাথমিক ইউনিট, যেখানে পিতামাতা, ভাইবোন সকলেই একে অপরের অতি আপন, তবে সে আপন সম্পর্কের পরস্পর বন্ধন সময় ও শিক্ষাদীক্ষার উন্নতির ফলে ক্রমান্বয়ে অপেক্ষাকৃত সরল অবস্থা থেকে জটিলতায় রূপ লাভ করে।
পিতামাতার সংসারে ভাইবোনেরা ছোট থাকা অবস্থায় খাওয়া-পরার চাহিদা পিতামাতার দায়িত্বে থাকলেও বড় হয়ে শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে কর্মসংস্থান পর্যায়ে উন্নীত হলে বাস্তবতার কারণেই ভাইবোনদের আর ছোট বয়সের মতো বন্ধন দৃঢ় থাকে না অর্থাৎ একত্রে এক ঘরে থাকা সম্ভব হয় না। ভাইবোনদের যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থানের ভিন্নতার কারণে এবং কর্মক্ষেত্র ভিন্ন হওয়ায় সকলের আয়-রোজগার এবং জীবনযাত্রার মানও একরকম থাকে না এবং কর্মের সুবাদে হয়তো ভিন্ন অবস্থান ও দূরত্বে বসবাস করতে হয়। ভাইবোনদের এমন বয়সে মা-বাবা পৌঁছে যান বার্ধক্যে। ফলে এ বয়সে তাদের মূল চাহিদা হয়ে দাঁড়ায় সেবা-শুশ্রুষা ও নিকটজনদের সান্নিধ্য কিন্তু শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন পরিবারের সকল সন্তানেরাই এত ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটান যে বৃদ্ধ পিতামাতার সেবা-শুশ্রুষা করার মতো সময়-সুযোগ করতে পারে না।
ফলে বৃদ্ধ পিতামাতা তাদের নিকট হয়ে পড়েন বোঝাস্বরূপ। মানবিক কারণে তাদেরকে সঙ্গে রাখাও সম্ভব হয় না আবার ফেলে দেওয়ারও সুযোগ থাকে না। তখন বৃদ্ধ পিতামাতার অবস্থা হয় না ঘরকা না ঘাটকা। ফলে অতি যত্নে মানুষ করা সন্তানদের নিকট থেকে সেবা-শুশ্রুষা থেকে বঞ্চিত পিতামাতার নিজেদেরকে পরগাছাতুল্য ভাবতে একটুও কুণ্ঠাবোধ হয় না, যদিও এ অভিব্যক্তি প্রকাশের তেমন সুযোগ থাকে না। তাই সব দিক বিবেচনায় উভয় পক্ষের সম্মান রক্ষার্থে তাদের আশ্রয়স্থল হয় সিনিয়র সেন্টার বা বৃদ্ধাশ্রমে। তবে এ ব্যবস্থা কেবল শিক্ষিত ও ধনবানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, পক্ষান্তরে দরিদ্রদের পক্ষে আর্থিক সংগতি না থাকায় কষ্টক্লেশে হলেও তারা একত্রে থাকতে বাধ্য হয়। এতে শারীরিক কিছু কষ্ট হলেও উভয় পক্ষ মানসিকভাবে খুবই তৃপ্তি অনুভব করে।
স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সম্মান-শ্রদ্ধা কেবল রক্তের সম্পর্ক বা নিকটজনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং এটি একটি অতি মানবীয় গুণ। এই মানবীয় গুণ অর্জনের জন্য শিক্ষা অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হলেও সাধারণ শিক্ষার চেয়ে ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধের ধারণ ও লালন অতি বেশি কার্যকর। এর অন্যতম কারণ এ বোধের সঙ্গে ইহকাল ও পরকালীন ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, শাস্তি-পুরস্কার ইত্যাদি বিশ্বাস জড়িত এবং একান্ত নাস্তিক ব্যতীত প্রায় সব ধর্মের এই মর্মবাণী ধর্মাশ্রিত সকলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং তদনুযায়ী পালনের চেষ্টা করে। যার বাস্তব প্রমাণ চোখকান খোলা রাখলেই যে কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব। যাদের মধ্যে এ গুণ বিদ্যমান, আত্মীয়-অনাত্মীয় সবার ক্ষেত্রেই তারা তা পালনের চেষ্টা করেন। তবে বর্তমান সমাজব্যবস্থার কারণে ক্রমান্বয়ে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে মানবিক গুণের যতটা উন্নতি সম্ভব, তার চেয়ে সামাজিক পরিমণ্ডলে এর চর্চার মাধ্যমে অধিকতর সুফল পাওয়া সম্ভব। আর এ কারণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য ও ত্বরান্বিত হবে। অতীব দুঃখের বিষয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি ধর্মের অনুশাসনেরও ব্যবহার ও ব্যাখ্যা নিজ নিজ সুবিধামতো গ্রহণ-বর্জন করে থাকে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক শাসনের প্রাক্কালে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। সামাজিক অবক্ষয় সমাজে একবার প্রতিষ্ঠিত হলে পরবর্তী পর্যায়ে তা থেকে পরিত্রাণ লাভ খুবই দুরূহ। তাই সামাজিক অবক্ষয় থেকে সমাজকে রক্ষার জন্য সকল পক্ষের সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।