রোমিনা লোদী (জয়িতা) :
বিষয়টা প্রথম সাড়া জাগিয়েছিল গত বছরে অর্থাৎ ২০২২ এর নভেম্বর মাসে। হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিতে তো বটেই, এমনকি ননটেক মানুষদের মাঝেও দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং টুল, যার ভাষার দক্ষতা অসীম। সে এমনভাবে লেখালেখি করতে পারে, কারও বোঝার সাধ্য নেই কে লিখেছে, একজন মানুষ নাকি কোনো চ্যাটবট, যা কিনা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তিবিজ্ঞানের এক অনবদ্য সৃষ্টি। বর্তমান যুগে এআই দিন দিন আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই এআই গ্রাহকের নির্দেশমতে, তার চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা করে থাকে। তবে এটি মানব মস্তিষ্কের মতো কোনো নিউরন দ্বারা গঠিত নয়। বরং এটি তৈরি হয়েছে ন্যানো টেকনোলজির মাইক্রোচিপ দ্বারা। কম্পিউটার সিস্টেমকে কোডিং করে তার মধ্যে বিভিন্ন নির্দেশ প্রদান করে সেটি দিয়ে কৃত্রিম কার্যক্ষমতা তৈরিকেই আমরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলতে পারি।
এই এআই এর একটি চাঞ্চল্যকর নমুনা হলো চ্যাটজিপিটি। এটি প্রথম তৈরি করে ওপেন এআই কোম্পানি এবং সবার নজরে আনে ৩০ নভেম্বর ২০২২। চ্যাটজিপিটি চালুর প্রথম পাঁচ দিনে এক মিলিয়ন গ্রাহক বা ইউজার পেতে সক্ষম হয়। আর প্রথম দুই মাসে এর সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০ মিলিয়নেরও অধিক, টিকটকের তুলনায় যা অনেক বেশি। টিকটকের ক্ষেত্রে ১০০ মিলিয়ন ইউজার পেতে সময় লেগেছিল নয় মাস।
নভেম্বরের পরে চ্যাটজিপিটি আবার আমার নজরে আসে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আমি ঢাকায় ছিলাম। ঢাকার একটা স্থানীয় খবরের কাগজে দেখলাম বড় একটা আর্টিকেল ছেপেছে যে ভ্যালেন্টাইনস ডেতে এখন আর প্রেমিক-প্রেমিকার একে অপরকে প্রেমপত্র বা ভ্যালেন্টাইনস চিঠি লিখতে হবে না। ওদের হয়ে চ্যাটজিপিটি লিখে দেবে। লেখাগুলো যদিও হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা রচিত বা সম্পাদিত, কিন্তু ওগুলো হবে অনেক আবেগসম্পন্ন, একদম আসল মানুষের হৃদয় নিংড়ানো। খবরটা পড়ে আমি খুবই অবাক হলাম। প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের ভালোবাসা নিখাদ হলেও তার মনের কথাগুলো বলে দেবে সে নিজে নয়, অন্য আরেকজন, যে কিনা মানুষ নয়, একটি কৃত্রিম যন্ত্র। দুনিয়াটা অনেক বদলে যাচ্ছে!
চ্যাটজিপিটি হলো একটি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং মডেল, যা কিনা মানুষের জিজ্ঞেস করা যেকোনো প্রশ্নের ভিত্তিতে একটি উচ্চমানের উত্তর দিতে সক্ষম। মানবসমাজে যোগাযোগের পন্থা হিসেবে যা কিছু ব্যবহার করা হয়, সেগুলো তৈরি করতেও সে সক্ষম। যেমন ইমেইল, ব্লগ, চিঠি, প্রবন্ধ, রচনা, ছোটগল্প, গান, কবিতা, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার মতো কমেন্টস।
চ্যাটজিপিটি প্রোগ্রামারদের কোড লিখতেও পটু। যেই প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ‘পাইথন’ দিয়ে তাকে তৈরি করা হয়েছে, সেই পাইথন ভাষায়ও সে কোড লিখতে পারে। সে আরও জানে সি/সি++, জাভা, জাভা স্ক্রিপ্ট, এসকিউএল, শেল ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রোগ্রামারদের জন্য বাগ ফিক্সিং ও ডকুমেন্টেশন করতে সক্ষম। ইলান মাস্কের মতে, চ্যাটজিপিটি হলো খুব শক্তিশালী একটি এআই, যা দিনে দিনে আরও শক্তিশালী হচ্ছে। কারণ তাকে প্রতিনিয়ত অনেক, অনেক করে তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। ধারণকৃত তথ্যের ভিত্তিতে সে মানুষের জিজ্ঞেস করা চমৎকার একটি প্রশ্নের চমৎকার একটি উত্তর সাজানোর চেষ্টা করে থাকে।
চ্যাটজিপিটি একটি গবেষণামূলক পর্যায়ে বিদ্যমান থাকায় এটা প্রথম গ্রাহকদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি করা হয়। তবে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এটির আরও একটি ভার্সন বেরিয়েছে, যার নাম চ্যাটজিপিটি প্লাস, যা কিনা টাকা দিয়ে সাবস্ক্রিপশন করতে হবে। সম্প্রতি মাইক্রোসফট এবং গুগল তাদের নিজস্ব স্টাইলের এআই-ভিত্তিক চ্যাটজিপিটি বের করেছে। তবে ওগুলো তেমনভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে চাইলে এটির টেক্সট ফিল্ডে আপনার প্রশ্নটা বা কমান্ড টাইপ করতে হবে। তারপর সাবমিট বাটনে চাপ দিলে সে প্রশ্নের উত্তর জেনেরেট করবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে উত্তরটা বাস্তবসম্মত বা গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। তাই গবেষকদের মতে, আপনি যদি প্রফেশনাল কপিরাইটিং, অনলাইন মার্কেটিং বা ব্লগিংয়ের জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনি চ্যাটজিপিটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা বা যৌক্তিকতা যাচাই করে নিন।
চ্যাটজিপিটি বিশ্বের ৯৫টি ভাষায় কথা বলতে পারে। এর মধ্যে বাংলাও একটি। এবার আসি আমাদের বন্ধু আলাপচারীর প্রসঙ্গে। কে এই ‘আলাপচারী’? আলাপচারী আমাদের বাংলা ভাষার চ্যাটবট, যে কিনা এআই-ভিত্তিক যান্ত্রিক ইঞ্জিন ‘চাত্রিক’ দ্বারা পরিচালিত। তাকে বাংলায় প্রশ্ন করলে সে বাংলায় উত্তর দেয়। তবে প্রশ্নটি লিখতে হবে বাংলা ইউনিকোডে। আলাপচারী কতটা আলাপী আমি তার একটি পরীক্ষা নিয়েছি। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আমি তাকে প্রশ্ন করেছি এবং সে উত্তর দিয়েছে। তার কিছু নমুনা দিলাম।
আমার প্রশ্ন : আলাপচারী, তুমি কী এবং কে তোমাকে তৈরি করেছে?
আলাপচারীর উত্তর : হ্যাঁ, আমি একটি এআই সহযোগী বট। আমাকে তৈরি করেছেন ফাহমিদুল হাসান, যিনি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থী।
প্রশ্ন : মাতৃভাষা দিবস কবে?
উত্তর : মাতৃভাষা দিবস হলো ২১ ফেব্রুয়ারি। এটি একটি জাতীয় উদযাপন, যা বাংলাদেশ ও ভারতে পালিত হয়। এই দিনটিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মূল্যায়ন করা হয়।
প্রশ্ন : পৃথিবী কেন সূর্যের চারদিকে ঘোরে?
উত্তর : পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, কারণ সূর্যের গ্রহণ করা শক্তি একদম সমান নয় এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে থাকলে সমস্ত পৃথিবীবাসীর জীবন সমর্থ হয়। এ ছাড়া পৃথিবীর ঘূর্ণন সূর্যের গ্রহণ করা শক্তির পরিমাণ নিয়ামক হয় এবং এটি পৃথিবীর জীবনসম্পন্নতা ও পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : তোমার প্রিয় রং কী?
উত্তর : আমার কোনো প্রিয় রং নেই, কারণ আমি একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
প্রশ্ন : প্রেম নিয়ে একটি কবিতা লিখো।
উত্তর : প্রেম এক রঙের ফুল, যা ফুটে উঠে নতুন আশা দেবে। প্রেম এক সুরের গান, যা শুনে হৃদয় ভরে যাবে সদা। প্রেম এক আবেগের স্পর্শ, যা সব সময় থাকবে তোমার পাশে। প্রেম এক দুঃখ এবং সুখের মিশ্রণ, যা তোমাকে সম্পূর্ণ করে দেবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে। প্রেম এক আলোর ঝলক, যা তোমার জীবন আন্দোলিত করে দেবে সব সময়। প্রেম এক অদ্ভুত সন্ধান, যা তোমাকে নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেবে। প্রেম এক স্বপ্নের মতো, যা সম্পূর্ণ করে দেবে তোমার জীবনের সকল ইচ্ছা। প্রেম এক নির্বাণ স্বর, যা সম্পূর্ণ করে দেবে তোমার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন।
প্রশ্ন : আমার মাকে একটা চিঠি লিখো। চিঠির বিষয়-আমি তাকে কতটা মিস করি।
উত্তর : প্রিয় মা, আমি আপনাকে কতটা মিস করি, তা কথায় বলতে পারছি না। আপনি আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ
অংশ এবং আমার জীবনে আপনার উপস্থিতি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আপনি আমার জন্য সর্বদা একটি সুরক্ষিত স্থান হিসেবে থাকেন এবং আমার সমস্ত সমস্যা ও দুঃখের সঙ্গে সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য আপনি সর্বদা আমার পাশে থাকেন। আশা করি আপনি সুস্থ ও সুখী থাকবেন। আপনার সন্তান [আপনার নাম]।
আলাপচারীকে প্রশ্ন করার যে কমান্ড বক্সটি আছে, ঠিক তার নিচেই পরিষ্কার বাংলায় লেখা আছে, ‘আলাপচারী প্রায়ই অবাস্তব তথ্যমূলক রেসপন্স দেয়। এটি কেবল গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।’ আলাপচারীকে পেতে হলে এই ওয়েবসাইটটিতে যেতে হবে : http://chatrik.org/alapchari
এই গবেষণা চলতে চলতে হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই চ্যাটজিপিটি প্রযুক্তি জগতে পাকাপোক্ত অবস্থান করে নেবে। আমাদের মতো লেখক, সাহিত্যিক, কবি, ব্লগার, সম্পাদক-সবাই চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে লেখালেখি করবে, সম্পাদনা করবে, বই ছাপাবে। ভাবতেই কেমন লাগছে। লেখক সমাজ কী ভাবছে জানি না, তবে আমি মনে মনে কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আসল আর মেকির মধ্যে ভেদাভেদ দিনকে দিন ক্ষীণতর হয়ে আসছে।
শব্দ দিয়ে, কথা দিয়ে সাজানো আমার নিজস্ব অনুভূতিগুলো কেন একটি কম্পিউটার বলে দেবে?
লেখক : ব্লগার ও কলামিস্ট, টেক্সাস