ক্যানসার— যাকে বলা হয় নীরব মরণব্যাধি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধারণ করে মারাত্মক আকার। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিতে পারলে ঘটে বিপদ। বর্তমানে ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার পেছনে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কিছু কিছু অভ্যাস দায়ী। এজন্য ক্যানসারকে ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’ও বলা হচ্ছে। অর্থাৎ জীবনযাপনের থেকেই নাকি এই রোগকে ডেকে আনা হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে তা ঘটছে? এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলেন ভারতের ফর্টিস হাসপাতালের কনসালট্যান্ট অঙ্কোলজিস্ট চিকিৎসক দেবপ্রিয় মন্ডল।
ক্যানসারকে কেন লাইফস্টাইল ডিজিজ বলা হচ্ছে?
চিকিৎসক দেবপ্রিয়র মতে, ক্যানসার নানা কারণে হয়। ১০ থেকে ২০ শতাংশ ক্যানসার জিনগত কারণে হয়। এর মধ্যে কিছু বংশগত জিনের কারণে হয়। আবার কিছু জিনের অন্যান্য কারণেও হতে পারে। আরও ২০ শতাংশ ক্যানসার রয়েছে যার কারণ এখনও বিজ্ঞান পুরোপুরি জানে না। এগুলো বাদে আরো ৫০ শতাংশ ক্যানসার রয়েছে যেগুলো আমাদের প্রতিদিনকার চলাফেরার বেশ কিছু অভ্যাসের জন্য হয়ে থাকে। এই অভ্যাসগুলো আমরা চাইলেই পাল্টে ফেলতে পারি। অর্থাৎ ওই ৫০ শতাংশ ক্যানসার হওয়া না হওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের হাতেই থাকে।
লাইফের কোন কোন ‘স্টাইল’ ক্যানসার ডেকে আনে ?
খাওয়া-দাওয়া : লাইফস্টাইলের একটা বড় অঙ্গ হলো খাওয়া-দাওয়া। যার মধ্যে নানা গেরো থেকে যায়। কিছু নির্দিষ্ট খাবার ক্যানসারের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। এই তালিকায় রয়েছে...
ধূমপান ও তামাকের নেশা
চিকিৎসকের কথায়, এই তালিকায় প্রথমেই থাকবে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের নেশা। ধূমপান ছাড়াও অনেকে তামাকজাত দ্রব্যের নেশা করেন। কেউ কেউ আবার জর্দা, পানমশলা, সুপারি খেতেও পছন্দ করেন। কিন্তু এগুলো থেকেও ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এই অভ্যাসের কারণে ফুসফুস, মুখ ও গলার ক্যানসারের বাড়বাড়ন্ত আমাদের দেশে। এমনকি রক্তের ক্যানসারও হতে পারে।
মদ্যপান
এখন ‘সোশ্যাল ড্রিঙ্কিং’ ব্যাপারটাও খুব ‘ইন’ হয়ে গেছে। তাদের অনেকেই বলেন, তারা লিমিটেড ড্রিঙ্কিং করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণা বলছে মদের কোনো ঝুঁকিহীন পরিমাপ হয় না। অর্থাৎ ‘এইটুকু মদ খেলে শরীর খারাপ হয় না’ বলে এমন কিছু মাপ হয় না। মদের যেকোনো পরিমাপই শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই এই ব্যাপারে সময় থাকতেই সতর্ক হতে হবে। অনেকের তো মদ্যপানের নেশা রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মদ লিভার, কোলন, খাদ্যনালি, পাকস্থলি ক্যানসারসহ আরও বেশ কিছু ক্যানসারের জন্য দায়ী। মহিলাদের স্তন ক্যানসারের জন্যও মদ্যপান দায়ী থাকতে পারে।
ধূম ও মদ্যপান অনেকেই একসঙ্গে করতে পছন্দ করেন। সেটা আরও ভয়ানক।
ব্যায়াম না করা
ব্যায়াম না করাও অনেকের লাইফস্টাইল চয়েস! অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ একাধিক শীর্ষ স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো ব্যায়ামকে প্রাধান্য দিচ্ছে। যেকোনো ধরনের ব্যায়ামই একাধিক ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। এর জন্য কেউ জিমে যেতে পারেন। নাও যেতে পারেন। স্পোর্টস জয়েন করতে পারেন। নাও করতে পারেন। সাঁতার কাটতে পারেন, দৌড়াতে পারেন, জগিং করতে পারেন বা সাধারণ ঘরোয়া ব্যায়ামও করতে পারেন। অর্থাৎ যেকোনো ধরনের ব্যায়ামই করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের ব্যস্ত লাইফস্টাইলে ব্যায়াম সময় পায় না। যা ক্যানসারের বিপদ বাড়িয়ে দেয়। মূলত অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্যই ব্যায়াম করতে হবে। কারণ ওবেসিটি থেকে বেশ কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
স্ট্রেস ও রাত জেগে থাকা
অতিরিক্ত স্ট্রেস ক্যানসারের অন্যতম কারণ। অনেকেই মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। ওয়েব সিরিজ, ওটিটির যুগে এই প্রবণতা আরও বাড়ছে। স্লিপ সাইকেল ডিসঅর্ডার ক্যানসারের বিপদ বাড়িয়ে দেয়। চিকিৎসকের কথায়, রাতে কম ঘুমোনার প্রবণতা ছাড়াও অনেকে রাতের শিফটে কাজ করেন। তাদেরও একই ঝুঁকি রয়েছে।
সূর্যের রোদ এড়িয়ে না চলা
সূর্যের রোদের থেকে যে বিকিরণ বা রেডিয়েশন হয়, তাও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ত্বকের বেশ কিছু ক্যানসার যেমন মেলানোমা, বেসাল সেল, স্কোয়ামাশ ক্যানসারের জন্য সূর্যের রোদ দায়ী। ভারতের বাইরে বেশ কিছু দেশে এই নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। কারণ সেই সব দেশে সূর্যের কারণে ক্যানসারের হার বেশি।
যেমন ধরা যাক, অস্ট্রেলিয়া। সেখানে এই নিয়ে কড়া নিয়ম রয়েছে। বাইরে বেরোলে ঢাকা জামাকাপড় পরে বেরোতে হবে। চোখে সানগ্লাস, মাথায় হ্যাট পরা জরুরি। এছাড়া ভালো মানের সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে হলিডেতে কোথাও ঘুরতে গেলে ‘সানবাথিং’-এর প্রবণতা বাড়ছে, যা বিপদের কারণ হতে পারে।
সংক্রমণ ও টিকা না নেওয়ার মানসিকতা
অনেকেই আজকাল টিকার বিরোধিতা করেন। ‘অ্যান্টিভ্যাক্সার’ ট্রেন্ড তৈরি হচ্ছে এখন। অর্থাৎ টিকা খারাপ জিনিস। কিন্তু বিজ্ঞান উল্টোটাই বলছে। টিকা নেওয়া থাকলে অনেক রকম সংক্রমণকে প্রতিহত করা যায়। আর বেশ কিছু সংক্রমণ থেকে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
যেমন হেপাটাইটিস থেকে লিভার ক্যানসার হতে পারে। হেপাটাইটিস আদতে একটি ভাইরাস সংক্রমণ। ঠিক সময়ে এই সংক্রমণের টিকা নিলে হেপাটাইটিস ঠেকানো যায়। পাশাপাশি ক্যানসারের আশঙ্কাও রোধ করা যায়। আবার হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের থেকে সার্ভিক্যাল ক্যানসার হতে পারে। এটিও একরকমের সংক্রমণ। টিকা নিলে এইচপিভি ইনফেকশন ৯০ শতাংশ ঠেকানো যেতে পারে! তাই টিকা না নেওয়ার ‘স্টাইল’ মোটেই ভালো নয়।
ঝুঁকিপূর্ণ যৌনতা
এছাড়া আরেকটি দিক গত কিছু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো ঝুঁকিপূর্ণ যৌনতার প্রবণতা। আগে এটি কম থাকলেও বর্তমানে বাড়ছে। এই নিয়ে এইমাসেও গবেষণা হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শতাংশের নিরিখে এই ধরনের যৌনতা বেড়েছে। যার ফলে ক্যানসারও বেড়েছে।
যেমন, ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ২৫ শতাংশের মুখ ও গলার ক্যানসার হয় ভারতে। তাদের শরীর থেকে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস পাওয়া গেছে। এই বিশেষ ভাইরাস কিন্তু যৌন মেলামেশার মাধ্যমেই ছড়ায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মুখ ও গলার ক্যানসারের বড় কারণগুলোর তালিকায় সিগারেটের পরেই রয়েছে মুখমেহন (ওরাল সেক্স)!
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগে এই কারণে মুখ ও গলার ক্যানসারের হার পাঁচ শতাংশেরও কম ছিল। কিন্তু বর্তমান তথ্য তার সঙ্গে মেলে না। কারণ চারজনের মধ্যে একজনের (অর্থাৎ ২৫ শতাংশের) মুখ ও গলার ক্যানসার হয়। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই রোগীরা এইপিভি পজিটিভ হয়েছেন। অর্থাৎ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণ দেহে উপস্থিত! আবার অন্যদিকে হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস অর্থাৎ এইচআইভি-ও একইভাবে ক্ষতিকর। কারণ এর থেকে বেশ কিছু ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
বেলাগাম দূষণ নিয়ে সচেতন না হওয়া
এখন দূষণ আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গছে। এটিও কিছু ক্যানসারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বর্তমান সময়ে। যারা ৩০০ একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স)-এর বেশি এলাকায় থাকেন, তাদের বিপদ বেশি। বরং পাহাড়ে ৪০-৬০ একিউআই এলাকার বাসিন্দাদের ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কম। তবে এটি একজনের লাইফস্টাইল হিসেবে ধরা যায় না। কিন্তু একজন একজন করে সবার সদিচ্ছে তৈরি হলে এই লাইফস্টাইল বদলে ফেলা যায়। সূত্র : এবিপি আনন্দ
ঠিকানা/এসআর