নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিএনপির দ্বিমুখী নীতি দলটির কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত, হতাশ করেছে। মার্কিন ভিসা নীতি ও তার পরিপ্রেক্ষিতে দলের শীর্ষস্থানীয়দের বক্তব্যে তাদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে ও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। এতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে তৃণমূলে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা করছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে জাতীয়, স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। স্থানীয় সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন সিটি করপোরেশনে বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নিলেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে নির্বাচন হচ্ছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে অংশগ্রহণকারী ২৯ জনকে বিএনপি দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। তাদের প্রত্যেকেই বিএনপির ওয়ার্ড ও থানার শীর্ষস্থানীয় নেতা। অপর চার সিটি করপোরেশনে বিএনপির শতাধিক স্থানীয় বিশিষ্ট নেতা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা মেয়র ও কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নির্বাচন থেকে তাদের সরিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্র থেকে জোর চেষ্টাও চলছে। সাবেক এমপি ও জনপ্রিয় সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীদের এ ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালাতে বলা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে তারা চেষ্টাও করছেন। কিন্তু গাজীপুরে দলীয় প্রার্থীরা এবং অন্যান্য সিটি করপোরেশনে বিএনপির স্থানীয় নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। গাজীপুরে দলীয়দের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারেনি বিএনপি। মহানগরের কর্মীদের পাশাপাশি জেলা, উপজেলার অনেক নেতাকর্মীও নির্বাচনী মাঠে ভূমিকা রেখেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় দলের কোনো পর্যায়ের পদাধিকারী, সদস্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হলে তাকে স্থায়ীভাবে দল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে এই নির্দেশ এসেছে বলে জানানো হয়। সাংগঠনিক চরম এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও দলের সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে দৃশ্যমান নয়, যা শীর্ষ নেতৃত্বে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
বিএনপি হাইকমান্ডের উল্লিখিত সিদ্ধান্তের ফলে মহানগরগুলোতে দলটি তীব্র নেতৃত্ব সংকটে পড়বে। বেশ কয়েকজন যোগ্য ও জনপ্রিয় মেয়র প্রার্থী থাকলেও হাইকমান্ডের নির্দেশ তারা মান্য করে প্রার্থী হননি। তবে নিজেদের একান্ত পারিবারিক সদস্যকে প্রার্থী করার ঘটনা রয়েছে। কোনো কোনো প্রভাবশালী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। সিলেটে বিএনপি প্রায় নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় পড়ার আশঙ্কায় অত্যন্ত জনপ্রিয় আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বরিশাল, খুলনায়ও দলটি সংকটে পড়েছে। মেয়র পদে আরিফুল হক চৌধুরীর আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। কেন্দ্র থেকে তাকে জোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে কাউন্সিলরদের অধিকাংশ এবারও প্রার্থী হচ্ছেন। নিজেদের রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানতে আগ্রহী নন বলেই তারা দলের সিদ্ধান্ত মান্য করতে পারছেন না বলেই জানা যায়। বিএনপির কাউন্সিলরদের অনেকেই স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় এবং নির্বাচনেও তারা বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে গভীরভাবে আশাবাদী। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আরিফুল হককে নিশ্চিতভাবেই প্রার্থী করার কথা বলা হয়েছে। বৃহত্তর সিলেটে ও জাতীয়ভাবে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সিটি নির্বাচনে অংশ নিলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই বোঝানো হয়। গাজীপুরে মেয়র প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি নেতা হাসান সরকারের ভাইপো শাহীনুর সরকার রনি। তিনি অবশ্য বিএনপির কোনো পদাধিকারী নন। জেলা যুবদল সভাপতি নুরুল ইসলাম সরকারের পুত্র রনি। প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার আসামি হিসেবে দণ্ডিত হয়ে নুরুল ইসলাম দীর্ঘদিন যাবৎ কারাগারে রয়েছেন। তার মুক্তির ব্যাপারে বিএনপির কাছ থেকে প্রার্থিত সহযোগিতা না পাওয়ায় টঙ্গীর সরকার পরিবার দারুণভাবে অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ। হাসান সরকার ভাতিজার পক্ষে প্রকাশ্যে জোরালো ভূমিকা না নিলেও নেপথ্যে থেকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। টঙ্গী, গাজীপুরে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী রনির পক্ষে নানা কৌশলে কাজ করেন। অনেকে প্রকাশ্যেও ভূমিকা রাখেন। তিনি পরাজিত হওয়ার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের পক্ষে কাজ করেন।
এদিকে গত মাসেই বিএনপি হাইকমান্ড স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কৃতদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেয়। সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী দলীয়দের সংখ্যা সাত শয়ের মতো। দলীয় নির্দেশ উপেক্ষা করে তারা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে জয়ী হন। নির্দেশ প্রতিপালন না করায় তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয় এবং তাদেরকে দলীয় কার্যক্রমে জোরালোভাবে অংশ নিতে বলা হয়। সরকারবিরোধী বেং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ত করাই এর উদ্দেশ্য। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয় এবং তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী-সমর্থক রয়েছে। এদের নিষ্ক্রিয় রেখে আন্দোলন যেমনি সফল করা সহজ হবে না, আবার বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে এদের সক্রিয় ভূমিকাও জরুরি। এই দুই দিক বিবেচনায়ই নমনীয়তার নীতি নেওয়া হয়।
বিএনপির এই পরস্পরবিরোধী নীতি শীর্ষস্থানীয়দের আশাহত করেছে। স্থায়ী কমিটির কোনো সদস্যই এতে সন্তুষ্ট নন। তবে তারা প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। জেলা, উপজেলা, তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দলের হাইকমান্ডের দ্বিমুখী নীতি সানন্দে গ্রহণ করতে পারেননি। তারাও অসহায় বোধ করছেন। এমনই অবস্থায় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে মাঠের নেতাকর্মীরা সর্বাত্মক ভূমিকা নেন কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের সংশয় রয়েছে। সর্বশেষ মার্কিন ভিসা নীতি ও হাইকমান্ডের অবস্থান মাঠের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত না করে হতাশাই বাড়াচ্ছে।