মুহম্মদ শামসুল হক
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদপুষ্ট একুশ শতকের পরম মাহেন্দ্রক্ষণেও সারা বিশ্বে নাস্তিক বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকারকারীর তুলনায় আস্তিক বা ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। আর প্রত্যেক আস্তিক এবং ধর্মাবলম্বীর নিকটই নিজস্ব ধর্মীয় গুরু-অবতার-পুরোহিত-পাদরি-যাজক-ইমাম প্রমুখ অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্মীয় গুরু-পুরোহিত-যাজক-ইমাম-পাদরিদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাঁদের আদেশ-নিষেধ-হিতোপদেশ ও মুখনিঃসৃত বাণী আন্তরিকভাবে পালনে যথাসাধ্য তৎপর থাকেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক পাদরি বা ক্লার্জিমেনকে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা ভক্তি-শ্রদ্ধার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করে থাকেন এবং তাদের আদেশ-নিষেধ আক্ষরিকভাবে পালনে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। এমনতর বাস্তবতায় বিশপ বা ধর্মাবতারের লেবাসধারী কতিপয় নষ্টচরিত-নরপশুর অ্যাবিউজ বা অপব্যবহার বা বিশ্বাসভঙ্গ-জাতীয় ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড রাষ্ট্র হয়ে পড়লে সাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাসে বড় ধরনের চিড় ধরে। অনবদ্য কারণে ক্যাথলিক ক্লার্জিমেন পদবিধারী কিছুসংখ্যক কুলাঙ্গারের শিশু-কিশোর অ্যাবিউজ বা উত্ত্যক্তকরণের ঘটনাবলিকে ঘোমটার ভেতর খেমটার নাচ হিসেবে অভিহিত করাকে আদৌ অতিশয়োক্তি বলা চলে না।
সম্প্রতি সিএনএন পরিবেশিত এক সংবাদে ইলিনয়ে ৪৫১ জন প্রাপ্তবয়স্ক ক্যাথলিক পাদরির ১ হাজার ৯৯৭টি নিষ্পাপ শিশু-কিশোরকে অ্যাবিউজ বা উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা সমগ্র আমেরিকায় বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইলিনয় অ্যাটর্নি জেনারেল কওয়ামে রাউলের বরাত দিয়ে পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়, ইলিনয় স্টেটে বিভিন্ন বিশপের এলাকায় বিগত প্রায় ৯০ বছর ধরে ৪৫১ জন ক্যাথলিক ক্লারিক ও রিলিজিয়াস ব্রাদার্স (পাদরি ও ধর্মীয় পুরোহিত) কমপক্ষে ১ হাজার ৯৯৭ জন নিষ্পাপ শিশু-কিশোরকে যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের বিশ্বাসভঙ্গ-জাতীয় কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছে। অ্যাটর্নি রাউল জানান, ব্যাপক তদন্তে শিকাগোর দ্য আর্কডাইঅ্যাসিসে ২৭৫ জন, বেলেভিলে ডাইঅ্যাসিসে ৪৩ জন, জলিটে ৬৯, পেয়োরিয়ায় ৫১, রকফোর্ডে ২৪ এবং স্প্রিংফিল্ডে ৩২ জন ক্লারিক ও রিলিজিয়াস ব্রাদার্সের অ্যাবিউজের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে অভিযুক্ত ৪৫১ জন ক্লারিক ও রিলিজিয়াস ব্রাদার্স একাধিক ডাইঅ্যাসিসেও দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপসংহারে ইলিনয় চার্চের ধর্ষক পাদরি এবং শিশু-কিশোরদের নির্যাতনের ধরন ও প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপ উদঘাটনের নিমিত্তে আরও আনুষ্ঠানিক এবং সমন্বিত তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে। অধিকন্তু নির্যাতনের জীবিত শিকারদের পরিষেবার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া এবং ডাইঅ্যাসিসের অভিযুক্ত ধর্ষক পাদরিদের হালনাগাদ খতিয়ান প্রকাশেরও জোর সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এদিকে শিকাগোর কার্ডিনাল ব্লেস জে কুপিচ, আর্কবিশপের এক বক্তব্যে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনে প্রকাশিত অভিযুক্তদের নামধাম-সংবলিত বিশদ বিবরণ গির্জা এবং সর্বসাধারণকে যথারীতি অবহিত করা হয়েছে।
আর শৈশবে অমানবিক অ্যাবিউজ ও উত্ত্যক্তের জীবিত শিকারদের নিকট প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে দ্য ডাইঅ্যাসিস অব রকফোর্ড। ডাইঅ্যাসিসের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, রকফোর্ডই একমাত্র ডাইঅ্যাসিস, যেখানে প্রকাশযোগ্য অপর কোনো পাদরির নামধাম বা সন্ধান মেলেনি। আবার স্প্রিংফিল্ড ডাইঅ্যাসিসের পক্ষ থেকে এক বক্তব্যে বলা হয়েছে, চার্চের কিছুসংখ্যক পাদরি নিষ্পাপ শিশুদের অ্যাবিউজের মাধ্যমে যে লজ্জা ও কলঙ্কজনক পাপ করেছে, তা এক কথায় অমার্জনীয় এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
বেলেভিলের বিশপ মাইকেল ম্যাকগভারন এক বক্তব্যে শিশু-কিশোর অ্যাবিউজ প্রতিরোধের নিমিত্তে ডাইঅ্যাসিস কর্মকাণ্ডের বিশদ ফিরিস্তি দিয়েছেন। তিনি সপ্রত্যয়ে ঘোষণা করেন, কর্তৃপক্ষের জানামতো বর্তমানে কোনো অভিযুক্ত পাদরি ডাইঅ্যাসিসে কর্মরত নেই। আবার পিয়রিয়ার ডাইঅ্যাসিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কমিউনিটি ডাইঅ্যাসিসে তাৎপর্যমণ্ডিত পরিবর্তন আনয়ন করেছে এবং বর্তমানে চার্চটি নিষ্পাপ শিশু-কিশোরদের সহজাত প্রতিভার উন্মেষ সাধনের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাথলিক চার্চে মলেস্টারিং (উত্ত্যক্তকরণ) এবং অ্যাবিউজের বহু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বারবার প্রচার মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছে। দ্য জন জের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৫০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন গির্জা ও উপাসনালয়ের ১১ সহস্রাধিক যাজক-পাদরির বিরুদ্ধে নানা ধরনের অ্যাবিউজের অভিযোগ উঠেছে। সুষ্ঠু তদন্তে মোট অভিযুক্তের ৪ শতাংশ বা প্রায় ৪ হাজার ৩৯২ জন যাজকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অ্যাবিউজের নির্ভরযোগ্য প্রমাণও পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের বিরুদ্ধে আনীত সেক্স অ্যাবিউজ বা যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ৫৫.৭ শতাংশ যাজক বা বিশপের বিরুদ্ধে অ্যাবিজের একটিমাত্র আনুষ্ঠানিক অভিযোগ; ২৬.৪ শতাংশ যাজক বা বিশপের বিরুদ্ধে অ্যাবিউজের দুই বা তিনটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ; ১৭.৮ শতাংশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অ্যাবিউজের চার থেকে নয়টি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এবং ৩.৫ শতাংশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অ্যাবিউজের ১০ বা ততোধিক আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনয়ন করা হয়েছিল। আর ক্যাথলিক চার্চের সিংহভাগ অভিযোগের আপসরফা হিসেবে প্রতিটি অভিযোগের বিপরীতে নির্যাতিত বা জীবিত অভিযুক্তকে তিন লাখ থেকে চার লাখ ডলার নগদে প্রদান করা হয়েছে। আর হালনাগাদ বিভিন্ন অভিযোগের ক্ষতিপূরণ বাবদ যৌন হয়রানির অদ্যাবধি জীবিত শিকারদের যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথলিক ডাইঅ্যাসিস তিন বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, যুুক্তরাষ্ট্রে অ্যাবিউজের দায়ে অভিযুক্ত ৪ হাজার ৩৯২ জন ক্লার্জি সদস্যের মধ্যে ১ হাজার ২১ জনের বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে মোট অভিযুক্তের প্রায় ২৫ শতাংশ বা ২৫২ জন ক্লার্জি সদস্যকে ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত করা হয়েছে। অবশ্য দণ্ডিত অভিযুক্তের সংখ্যা কম হলেও বহু ভিকটিম আপসরফা এবং সিভিল ল শ্যুটের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছেন বলেও বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। অপর এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত ৮০ বছরে স্টেটের তদন্তকারীরা ছয় শতাধিক ভিকটিমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫৮ জন ক্যাথলিক প্রিস্ট বা যাজককে অভিযুক্ত করেছেন।
যাহোক, রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের সুযোগ্য পুত্র বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার বলেছিলেন, টু মাই ফাদার আই ঔ মাই লাইফ, টু অ্যারিস্টটল দ্য নলেজ হাউ টু লিভ ওয়ার্দিলি (জন্ম দেওয়ার জন্য আমি বাবার নিকট আর অর্থবহ জীবনযাপন পদ্ধতি শেখানোর জন্য অ্যারিস্টটলের নিকট ঋণী)। পুঁথিসাহিত্য যুগের প্রথিতযশা কবি শাহ মুহম্মদ সগীর ওস্তাদকে দ্বিতীয় পিতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। স্বহস্তে ওস্তাদের পদযুগল পরিচ্ছন্ন না করে শুধু পানি ঢেলে পরিচ্ছন্ন করার অবহেলায় বাদশাহ আলমগীর নিজ পুত্র এবং ওস্তাদ উভয়কে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন। এসব প্রবাদপ্রতিম ঘটনা নিছক ভাববিলাস কিংবা হেয়ালিপূর্ণ কাহিনি নয়। যাহোক, আমাদের ধারণা, সারা বিশ্বে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসীর সংখ্যা শত কোটিরও বেশি। আর পাদরি ও ধর্মীয় পুরোহিতদের প্রতি নিজ ধর্মাবলম্বীদের ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসার ইয়ত্তা নেই।
খ্রিষ্টান শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা, মনুষ্যত্ববোধের উন্মেষ, শিশুসত্তার সহজাত সুকুমারবৃত্তির সুষম ও সমন্বিত বিকাশ এবং প্রাত্যহিক জীবনাচরণের অপরিহার্য ধ্যান-জ্ঞান ও সমাজবদ্ধ জীবন নির্বাহের আদর্শাবলি শিক্ষাদানের গুরুদায়িত্ব প্রধানত ক্লারিক ও রিলিজিয়াস ব্রাদার্সের ওপরই ন্যস্ত থাকে। সে ক্ষেত্রে বেড়ায় খেত খেলে অঙ্কুরিত বীজ ও চারাগাছ কীভাবে রক্ষা পাবে। আর স্বল্পসংখ্যক নষ্টচরিত এবং সত্যভ্রষ্ট ক্লারিক ও রিলিজিয়াস ব্রাদার্সের ঘৃণ্য আচরণে শিশু-কিশোররা উপাসনালয়-ধর্মাবতার সর্বোপরি ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ কিংবা ধর্মবিমুখ হয়ে পড়লে দেশ ও জাতির ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। কারণ বিশ্বপ্রতিপালক প্রদত্ত মানবশিশুর জন্মলগ্নের সহজাত সুকুমারবৃত্তির সুষম ও সমন্বিত বিকাশ বাধাগ্রস্ত এবং সঠিক উন্মেষ সাধিত না হলে সহজাত পাশবিক প্রবৃত্তির সমূল উৎপাটন হবে না। ফলে অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মনুষ্যত্ববোধ নির্বাসনে যাবে এবং পাশবিক প্রবৃত্তি দিনে দিনে সিন্দাবাদের একচোখা দৈত্যের আকার ধারণ করবে। তেমন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে দস্যু-দানব এবং মানুষের অবয়বধারী সাক্ষাৎ শয়তানরাই সমাজ-দেশ-উপাসনালয় তথা গোটা বিশ্ব গ্রাস করবে। সম্ভবত তেমন ভয়াবহ পরিস্থিতি ও নৈরাজ্য বিশ্বসভ্যতার কাম্য হতে পারে না। লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ২৮ মে ২০২৩