আব্দুল কাইউম আনোয়ার
ঐতিহাসিক সূত্রমতে, আমাদের এই গ্রহে মানবের উৎপত্তি ও বসতি শুরু হয়েছে মধ্য এশিয়ায় অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে। বৈজ্ঞানিক কিংবা ধর্মীয় তথ্য অনুসারে বাইবেলে (Biblical Facts) প্রথম মানব আদম (আ.) ও তাঁর সঙ্গী হাওয়ার (আ.) পৃথিবীতে আবির্ভাব হয়েছিল আনুমানিক ৯ হাজার ৭০০ বছর আগে, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ছয় হাজার বছর আগে। সেই আদম-হাওয়ার যৌন মিলনের প্রতিভূস্বরূপ আমাদের এই মানবকুল।
মনে প্রশ্ন জাগে, স্রষ্টা কেন মানবের উৎপত্তিস্থল হিসেবে মধ্য এশিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন? কারণ নিশ্চয় আছে, তা শুধু স্রষ্টাই জানেন। গার্ডেন অব ইডেন থেকে বহিষ্কারের পর স্রষ্টা কি আদম-হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের অভিশপ্ত জীবনে আরও শাস্তিভোগের লক্ষ্যে, নাকি পরোক্ষে ভালোবেসে? সে যা-ই হোক, আমরা সেই আদি পিতামাতার উত্তরসূরি। কালের বিবর্তনে আমরা কেউ হয়েছি ইহুদি, কেউ খ্রিষ্টান, কেউ মুসলমান ইত্যাদি।
বিগত চৌদ্দ শত বছর ধরে মুসলমানদের নবী ও রাসুল মোহাম্মদ (সা.) এর অনুসারীরা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ব বহাল রেখে আসছে। সেই সময় মুসলমানরা কেবল যে আরব্য উপত্যকায় (বর্তমান সৌদি আরব ও তার পার্শ্ববর্তী সাতটি রাষ্ট্র) তাদের কর্তৃত্ব বিস্তার করেছিল তা নয়; পারস্য, মেসোপটেমিয়া, এমনকি আনাতোলিয়া পর্যন্ত মুসলিম সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে সেই পুরো অঞ্চলকে আরব বিশ্ব হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে সবাই।
বিশ শতকে দুটি বিশ্বযুদ্ধ (প্রথমটি ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল, দ্বিতীয়টি ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল) সংঘটিত হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণাম পৃথিবীতে অভাবনীয় পরিবর্তন নিয়ে আসে। ইতিহাসে সেই ঘটনা একটি মাইলফলক। যুদ্ধে যেসব দেশ লাভবান হয়, তাদের বেশির ভাগই পশ্চিমা দেশ। বস্তুত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশ যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নেয় নিজেদের মধ্যে বিজিত সম্পদ ভাগাভাগি করে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া তেমন পড়েনি, তাই তারা পশ্চিমাদের ভাগাভাগিতে শরিক হতে পারেনি। বাকি যে দুই মহাদেশ আফ্রিকা ও এশিয়া, তাদের ভাগ্যে লাভের বদলে ক্ষতির পাল্লাই ভারী করেছিল।
যাক, আমার এই আলোচনা যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে, সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের ভৌগোলিক গুরুত্বের প্রসঙ্গ এসে যায়। এর আয়তন ২৭ লাখ ৮২ হাজার ৮৬০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ৩৭১ মিলিয়ন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় যৎসামান্য বলতে গেলে। কিন্তু বহুদিক বিবেচনায় এই এলাকার গুরুত্ব অনেক বেশি। সারা বিশ্বের মুসলমানদের সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান মক্কা-মদিনার কারণেই কেবল নয়, বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের (Per Capita Income) কারণেও বটে। তেলের আয় থেকে সঞ্চিত সম্পদ ব্যয় করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে দৃষ্টিনন্দন বহু স্থাপনা গড়ে তুলেছে। এককালীন অনগ্রসর মধ্যপ্রাচ্য এখন সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে বহির্বিশ্বের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে উদ্যোগী হয়েছে। এই জাতীয় উদ্যোগ প্রশংসনীয় বৈকি।
এই তো সেদিন কাতারে হয়ে গেল ফিফা ফুটবলের মহা আয়োজন। সেই আসরের প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে সৌদি টিম হারিয়ে দিল একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন দল আর্জেন্টিনাকে। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল সেই উন্নতি। এই কিছুকাল আগেও যে সৌদি আরবে পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, এখন সেখানে নারীরা গাড়ি চালাতে পাড়ে, দোকানে সেলসের কাজ করতে পারে। তা ছাড়া ফুটবল খেলা দেখতে মাঠে যেতে পারে। এসব সামাজিক বিবর্তন অবশ্য আরবের অন্যান্য দেশে বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে।
আরবের দেশ কুয়েত সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার উল্লেখ করি। যেহেতু আমি আমার জীবনের পুরো আটটি বছর (১৯৭৯ থেকে ১৯৮৭ সাল) চাকরিসূত্রে কাটিয়েছি সেখানে, সেই সুবাদে সেখানকার জাতিতত্ত্ব (Anthropology) জানার আগ্রহে কিছু সুশিক্ষিত ব্যক্তির সাহচর্য পেয়েছিলাম। সেই স্মরণীয় ব্যক্তিদের একজন আবু আয়াদ, যিনি ছিলেন কুয়েত জাতীয় ব্যাংকের ট্রেজারার। তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস বলতে গিয়ে বিশ্ব মানচিত্র আমার সামনে রেখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন তারা বারবার সন্ত্রাসী পাঠিয়ে সৌদি সরকারকে অপদস্থ করছেন? তিনি বলেছিলেন, ইরানিরা খুব দুর্ধর্ষ ও একগুঁয়ে জাতি। সাম্রাজ্য হারিয়েছে বটে, তবে হেরে যাওয়ার গ্লানি তারা ভুলতে পারেনি। তাদের আকাক্সক্ষা আবার তারা পুনরুদ্ধার করবে তাদের সাম্রাজ্য। সৌদি আরবের কর্তৃত্বকে তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। তাই তো বিগত শতকে একাধিকবার তারা সন্ত্রাসী পাঠিয়ে সৌদি আরবের প্রাণ মক্কায় অবস্থিত কাবা শরিফকে দখল করতে চেয়েছিল। এত সব কর্মকাণ্ড স্পষ্টত প্রমাণ করে যে আরবের মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিভেদ সর্বদা লেগেই ছিল। যদি তা-ই না হতো, তবে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া আরব-ইসরাইল সংঘাতের কেন সমাপ্তি হচ্ছে না। ১৯৬৭ সালে পাঁচ আরব দেশ একত্রে ইসরাইলে সামরিক অভিযান চালিয়ে কেন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল? সেসবের পেছনে কারণ মূলত একই-ঐক্যের অভাব।
ইসরাইলের জবরদখল করা ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমি দখলের প্রতিবাদে সৌদি আরব কখনো সক্রিয়ভাবে যোগ দেয়নি। তারা বরং ফিলিস্তিনিদের সেই সব সংগ্রামকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে আসছে। সৌদির এ ধরনের আচরণ পরোক্ষে ইসরাইলকে অধিকতর কঠোর হতে কঠোরতর হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। সৌদির এই আচরণের পেছনে কারণ অবশ্যই আছে। আরবের সন্ত্রাসীরা রাজতন্ত্রকে আদৌ পছন্দ করে না বলেই রাজতন্ত্রীরা সর্বদা ভয়ে থাকে। শুধু সৌদি আরবই নয়, এমনকি জর্ডানের বাদশাও উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেননি তার দেশে। একমাত্র দেশ যারা একসময় এই উপত্যকার অধিপতি ছিল, সেই পারস্য মানে ইরানের শাসকেরা ফিলিস্তিনের জন্মগত আবাসভূমি রক্ষায় ইসরাইলের আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। আর সে কারণেই ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক সাপে-নেউলে।
পারস্যের সর্বশেষ বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভিকে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে সিংহাসনচ্যুত করে তখন ইরানের নির্বাসিত ইসলামিক নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সেই সময়ে ইরান-ইসরাইল সম্পর্ক অধিক ঘোলাটে হয়ে ওঠে। প্রায়শই খোমেনি সরকার ইসরাইলকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিল। ভেতরে ভেতরে ইরান পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতেরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর ভীষণ খেপে যায়। একের পর এক স্যাংশন জারি করতে থাকে, যাতে ইরান কোনোভাবেই আণবিক বোমা তৈরি করতে না পারে।
জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইরান সেই প্রকল্পকে সাময়িক স্থগিত করে নেয়। এদিকে লোক দেখানোর অভিনয় শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে শান্তিচুক্তিতে বসে একাধিকবার। কিন্তু প্রতিবারই যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের মৌলিক দাবিকে অগ্রাহ্য করে ইসরাইলের পক্ষ সমর্থন করে। এতে ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের ক্ষোভকে আরও চাঙা করে দেয়, ফিলিস্তানিরা বাঁশের লাঠি হাতে ইসরাইলি রকেট আর বোমার মোকাবিলা করতে থাকে।
অতি সম্প্রতি বিশ্ব সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দুই বৃহৎ বৈরী দেশ ইরান ও সৌদি আরব (আয়তন ও সক্ষমতায় অন্য আরব দেশসমূহের তুলনায় প্রণিধানযোগ্য) বিগত সত্তর দশক ধরে যেখানে শত্রুসম আচরণ করে আসছে, তারা আচমকা আকাশে বিদ্যুতের মতো ঝলকানি দিয়ে উঠেছে। কূটনৈতিকভাবে তারা একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এর মানে, তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে আর কোনো ক্ষতিকর কার্যকলাপে লিপ্ত হবে না। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, বিগত দশকে এই ইরানি সন্ত্রাসীরা একাধিকবার সৌদি আরবে অবস্থিত বিশ্ব মুসলমানের প্রাণের টুকরো মক্কার হেরেম শরিফ দখলের চেষ্টায় আক্রমণ চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। বর্তমানের এই উদ্যোগ বিস্ময়ের হলেও প্রশংসনীয় বৈকি। প্রশংসনীয় ও আশাব্যঞ্জক এ জন্য যে যুগ যুগ ধরে আরব বিশ্বের অভ্যন্তরীণ যে বিভেদ বিরাজমান ছিল, সাম্প্রতিক উদ্যোগটি তার অবসান ঘটাবে এবং কোমরের জোর অনেক গুণ বর্ধিত করবে।
আমার উচ্চাকাক্সক্ষা, এখন যদি ইরান ও আরব লিগের অন্যান্য দেশ একত্রিত হয়ে একটি জোট গঠন করে, যেমন বিশ্বে আরও জোট NATO, EU, APAC, SARC, G-7, G-20 ইত্যাদি বহাল আছে, তেমনি যদি MATO (মুসলিম অ্যালায়েন্স ট্রিটি অর্গানাইজেশন) নামে নতুন জোটের আবির্ভাব ঘটে, তবে বহু শতাব্দী ধরে আরব জাতির অভ্যন্তরীণ বিভেদের উচ্ছেদ হবে এবং মুসলমানদের শৌর্যবীর্য পুনরুদ্ধার হয়ে বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে বৈকি।