
কবর-সব মানুষেরই এই পৃথিবীতে শেষ ও স্থায়ী ঠিকানা। এটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য-এ নিয়েই আমার ব্যক্তিগত কিছু অনুধ্যান। বিগত ছয় মাসে বহুজনকে কবর দিলাম, এমনকি নিজের বাবাকেও জুনের ৩ তারিখে। তাই মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে থাকে প্রায়ই। প্রতিদিনকার নিয়মিত দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ব্যস্ত রাখি নিজেকে সেই বিষণ্নতা থেকে দূরে থাকার জন্য। প্রিয়জন, কাছের মানুষ ও পরিচিতদের কবরে শুইয়ে রেখে এসে এ রকম মনের অবস্থা হয়তো সবারই হয়-কেউ প্রকাশ করে, কেউ করে না, আবার কেউ কেউ চাপা স্বভাবের বলে নীরবে কষ্ট করে যায় সবার অগোচরে। ভুক্তভোগী, অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ হলো মনের এই অবস্থা কোনো পরিচিত ও আস্থাবান কাছের মানুষের সঙ্গে সহভাগিতা করা, যাতে মনটা কিছুটা হালকা হয় এবং কিছু কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত রাখা, যেমন শারীরিক ও মানসিক ব্যায়াম করা, চিত্তবিনোদনে কিছু সময় কাটানো, আধ্যাত্মিক অনুশীলনে প্রতিদিন কিছু সময় রাখা নামাজ, রোজা, পূজা, আরাধনা, ধ্যান, প্রার্থনা, খ্রিষ্টযাগের জন্য।
অন্যান্য দৈনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের কিছুটা সময় আমি কাটাই একজন নাটকপ্রেমী মানুষ হিসেবে বাংলা নাটক দেখে, ঢাকা ও কলকাতা দুই জায়গারই। মনের গভীরে থাকা বিষণ্নতার কারণেই হয়তো-বা সে রকম বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা নাটকগুলোই ইদানীং চোখে পড়ে বেশি, দেখার জন্যও মন টানে, ইচ্ছাও যেন কেমন তীব্র হয়। এ রকমই একটা নাটক আমার মনে যেমন সাড়া জাগিয়েছে, জীবনভিত্তিক গল্প ও অভিনয়ের উচ্চমানে মুগ্ধ হয়েছি, তেমনি আবার মনে সান্ত্বনাও জাগিয়েছে প্রচুর। নাটকটা হলো ‘কবর’।
কবর নাটকটা একটা সত্য কাহিনির ওপর আশ্রয় করে কাল্পনিক পটভূমিতে রচনা করেছেন যোবায়েদ আহসান, তাকে সহযোগিতা করেছেন আলি সিদ্দিক অভি, পরিচালনা করেছেন রাফাত মজুমদার রিংকু। অভিনয় করেছেন ফারহান আহমেদ জোভান, দ্বৈত চরিত্রে তাসনিয়া ফারিন, সমাপ্তি মাসুক, এক মায়ের চরিত্রে আমার প্রিয় অভিনেত্রী মিলি বাসার ও অন্য মায়ের চরিত্রে টুনটুনি সোবাহান, হিমি হাফিজ, হারুণ রসিদ বান্টি, আনোয়ার শাহী, শাফিজ মামুন, মার্জিয়া আক্তার এবং মিতু। গল্পটা সাজানো হয়েছে দুই সামাজিক প্রান্তের দুটি অনাগত শিশুর আত্মীয়দের ঘিরে। দুজন স্বামী ব্যক্তিগতভাবে তাদের স্ত্রীদের খুবই ভালোবাসে। প্রথমবার বাবা হওয়ার প্রতীক্ষায় নানাভাবে উদ্বিগ্ন, তেমনি আবার আনন্দেও আত্মহারা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে। তবে কর্মক্ষেত্রে দুজনই কিছুটা অসৎ পথের পথিক, যা তারা অন্যদের কাছ থেকে গোপন রাখে। সন্তানসম্ভবা দুই স্ত্রী তাদের পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে দিন অতিবাহিত করে তাদের স্বামীদের ও শাশুড়িদের প্রতি লক্ষ রেখে এবং নিজেদের যথাসাধ্য শারীরিক যত্ন নিয়ে। এই দ্বৈত চরিত্রে তাসনিয়া ফারিন চমৎকার অভিনয় করেছেন, বিশেষ করে দরিদ্র স্ত্রীর চরিত্রে।
নবজাত শিশুদের মৃত্যুতে নতুন দুই মায়ের বিলাপ দেখে সব দর্শকের চোখই অশ্রুসজল হবে। দুই মা/শাশুড়ি তাদের পোয়াতি ছেলেবউদের দেখাশোনা করেন তাদের নিজস্ব সামাজিক শ্রেণিভেদে একজন আধুনিকা ও অন্যজন কুসংস্কারপূর্ণা হিসেবে। সমাপ্তি মাসুক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কারখানার স্বত্বাধিকার হিসেবে কর্মচারীদের প্রতি মালিকসুলভ ব্যবহার, স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ, প্রথমবার বাবা হওয়ার উচ্ছ্বাস এবং খুবই চাওয়ার নবজাত রাজকন্যা মেয়েবাবুকে হারিয়ে শোকার্ত পিতার কান্না ও গাম্ভীর্য। ফারহান আহমেদ জোভান অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মিশে গেছেন তার চরিত্র ড্রাইভার ও দুই নম্বরি কাজে, আবার স্ত্রীর প্রতি মমতা দেখাতে মিষ্টি ও বিরিয়ানি চুরি করাতে এবং ক্ল্যাসিক বা স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার সন্তান হারানোর আর্তনাদ। মৃত শিশুর জন্য কবর কিনতে গিয়ে হারাম টাকা ব্যয় না করার সংলাপ, অনেক চাওয়ার ও গরিবের স্বপ্নের ধন তার ছেলেবাবুকে কবরে শোয়ানোর সময় হৃদয়বিদারক কান্না এবং কবর দেওয়ার সময় সেই শিশুর জ্ঞান ফিরে আসায় তার কান্না শুনে নিজের কান্নাজড়িত কণ্ঠে পরম করুণাময় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো ও সেই জীবিত শিশু হুমায়ুনকে ‘আব্বা’ বলে ডেকে বুকের সঙ্গে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখার দৃশ্যটি প্রতিটি বাবা/মায়ের ও অন্যান্য দর্শকের হৃদয়ের অনেক গভীরে গিয়ে পৌঁছাবে।
তারপর সেই শূন্য কবরে কারখানা মালিকের মেয়েকে দাফন করার সময় মনে জাগে এই চিরন্তন সত্য : ‘দয়াময় স্রষ্টার লীলা বোঝা বড় দায়, কার কবরে কে শোয়।’ একই সময়ে দরিদ্র বাবা শিশুকে তুলে দেয় তার মায়ের কোলে। আমার জানা নেই, পরিচালক রাফাত মজুমদার রিংকু শেষ দৃশ্যের কী রকম নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং এর মহড়া কতবার হয়েছিল, কিন্তু নবজাত শিশু, যে মৃত শিশু (still born) হিসেবে জন্মেছিল, তাকে কোলে নিয়ে জোভান ও তাসনিয়ার মুখের, চোখের ও শারীরিক অভিব্যক্তি, ওদের দুজনের অভিনয়শৈলী যে কত গভীর, তা প্রমাণ করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আপেল মাহমুদ এমিলের সংগীত পরিচালনায়, তারিক তুহিনের কথা ও সুরে এবং শিল্পী পিন্টু ঘোষের কণ্ঠে ‘মুর্দা বাঁচে, জিন্দায় মরে তোমার ইশারায়’ গানটা হৃদয়ে এনে দেবে অনেক প্রশান্তি ও সান্ত্বনা। স্মরণে আসবে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের সেই মহান উক্তি, ‘হে মানব, তুমি ধূলি মাত্র আবার ধূলিতেই মিশে যাবে কিন্তু অন্তিমকালে প্রভু তোমাকে আবার পুনর্জীবিত করবেন।’ অথবা ‘যে আমাতে বিশ্বাস করবে, সে মরলেও জীবিত হয়ে উঠবে।’
এখানে উল্লেখ্য, শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষাসৈনিকদের পাকিস্তান সরকার গোপনে কবর দিতে চেয়েছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই প্রতিবাদী নাটকের কাহিনি। আরণ্যক নাট্যদল তাদের যাত্রা শুরু করেছিল ‘কবর’ নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে। তবে এই নাটক লেখা ও কারাগারের ভেতরে ও বাইরে এর মঞ্চায়ন সবই ঐতিহাসিক ঘটনা এবং সেটা ইতিহাসে বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই আমাদের এর তাৎপর্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বর্ণনা করতে পারবেন।
কবর আমাদের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। আমরা সবাই বাবা বা মা, অথবা অন্য কোনো আত্মীয় পরিজন, কাউকে না কাউকে মৃত্যুর কাছে হারিয়েছি এবং তাদের মরদেহকে কবরে শুইয়ে রেখে এসেছি। তাদের আর না দেখতে পাওয়া, না ফেরার দেশে চলে যাওয়া এখনো আমাদের পীড়া দেয়, হৃদয় ভারাক্রান্ত করে। মৃত্যুদিবসে কিংবা অন্য কোনো দিনে তাদের কবরে যাই, প্রার্থনা, মোনাজাত করি, ফুল রেখে আসি। কারণ তাদের এখনো ভালবাসি। বাঙালির গর্ব, সর্বজনশ্রদ্ধেয় পল্লিকবি জসীমউদ্্দীন তাঁর ‘কবর’ কবিতার মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন সম্পর্কের গুরুত্ব, ভালোবাসার মাহাত্ম্য এবং কবরের মর্যাদা।
কবর কোনো ভয়ের জায়গা নয়, বরং শান্তির জায়গা, দুঃখ পাওয়ার স্থান বটে, তবে সবারই অন্তিম গন্তব্যস্থান। সন্ধ্যা কিংবা অমাবশ্যার রাতে কবরস্থানকে ভয় লাগতে পারে, তবে সে ভয় আসে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কিছু ভূত-পেতনির গল্প ছোটবেলায় পড়া থেকে। অনেকে শেষ গন্তব্যের স্থান আগেই নির্ধারণ করে রাখেন, এমনকি খরচপাতিও পরিশোধ করে রাখেন, যাতে পরিবারে সিদ্ধান্ত নিতে কোনো রকম উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা না হয়। তবে এটা ঠিক, কার কখন, কোথায় মৃত্যু হবে ও কোথায় কবর বা দাফন হবে, কেউই জানে না। এমনকি কীভাবে যে কবরের ব্যবস্থা হবে, কার জন্য প্রস্তুত করে রাখা কবরে কে শায়িত হবে, সবই পরম দয়াময় স্রষ্টার ওপরই নির্ভর করে।
কবর আমাদের নিজেকে চিনতে শেখায়, জীবনের আসল সত্যগুলো শেখায়। কবরে কিছুই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় নাÑবাড়ি, গাড়ি, সম্পদ কিছুই না। শুধু মাটির দেহটি, আর কিছু না। বহু বছর আগে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় হলিক্রস বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে হলি রোজারি গির্জায় ও মাদার তেরেসার নির্মল হৃদয় আশ্রমে স্বেচ্ছাসেবী ছিলাম। তখনকার পালক পুরোহিত ফাদার পিটার বি. রোজারিও একদিন বললেন, একটা শিশু মারা গেছে এবং তার বাবা-মা খুবই গরিব, তাই অন্য কোনো কবরস্থানে কবর কেনা তাদের সামর্থ্যরে বাইরে, এ জন্য আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদেরই বিনা পয়সায় কবরের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমরা দুজন স্বেচ্ছাসেবী কবর খোঁড়ায় লেগে গেলাম। ভরদুপুরে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে তা আবার কবরের পাশেই স্তূপ করতে লাগলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, গরমে শরীর ঘামছিল বটে, কিন্তু ক্লান্তি লাগছিল না। বেশ কিছু খোঁড়া হয়ে গেলে, কবরে নেমে মাটি কেটে ঝুড়িতে ভরে তা উঁচু করে আমার বন্ধুর হাতে দিলে, ও সেটা মাটির স্তূপে রেখে খালি ঝুড়ি আবার আমার কাছে দিত। এর মাঝে কবরে একটু বসে ঝুড়ির অপেক্ষা করতে গিয়ে একটু আশপাশে চোখ বোলালামÑআমার ডানে, বামে, সামনে, পেছনে ও নিচে খয়েরি-লালচে রঙের মাটির দেয়াল, আমাদের দুজনের দ্বারা সদ্য কাটা। কোনো আড়ম্বর নেই, কোনো রকম সাজসজ্জা নেই, দেয়ালে প্রিয়জনের বা অন্য কোনো ছবি নেই, শুধু এখানে-সেখানে কোনো গাছের শিকড়-বাকড় কিছু বেরিয়ে আছে। এটাই তাহলে আমাদের শেষ ঘর!! যেভাবে আমরা পৃথিবীতে এসেছিলাম শূন্য হস্তে, সেভাবেই আবার ফিরে যাব খালি হাতে। জন্মের সময় আমরা কাঁদি, অন্যরা স্বস্তিতে ও আনন্দে হাসে, এমনকি মাও তার প্রসববেদনা ভুলে গিয়ে হাসে। মৃত্যুর পরে কবরে নামালে আমরা হাসব আর ওরা কি কাঁদবে? উপরে তাকালাম, শুধু একচিলতে আকাশ দেখা যায়, দু’পাশের মাটির দেয়াল ছাড়িয়ে অনেক উপরে। কী সুন্দর নীল আকাশ! দু-একটা সাদা রঙের মেঘ ভেসে যাচ্ছে, যেন মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো তাড়া নেই, সময়ের কোনো পরিমাপ নেই। মাটি, মেঘ আর আকাশÑএদের রঙের মাঝে আমার কাছে আকাশের রংকেই সুন্দর লাগছে, প্রিয় মনে হচ্ছে। নীল রঙের আরও কত কিছু যে আমার প্রিয়, তা মনে পড়ছেÑনীল পেনসিল, যা দিয়ে ছবি আঁকি; ফাউন্টেন পেনের নীল কালি, যা দিয়ে সবকিছুই লিখি কলেজের পরীক্ষা থেকে শুরু করে পত্রিকায় ছাপানোর অযোগ্য কবিতা পর্যন্ত। সমুদ্রের নীল জল দেখার ভীষণ ইচ্ছা। আরও একটা পছন্দ আছে, সেটা হলো নীল শাড়ি। প্রিয় কাউকে নীল শাড়িতে দেখলে মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যায়। কবর আমাদের কত কিছু শেখায়, এমনকি প্রিয় রং পর্যন্ত। তবে যখন আমাকে কবরে নামানো হবে, তখন তো আমার চোখ কিছু দেখবে না। সেই দিন আসার আগ পর্যন্ত নীল আকাশকে ভালোবাসব।
‘কবর’ নাটকটির শেষ অংশটা দেখতে দেখতে যার জন্য কবর খুঁড়েছিলাম, সেই শিশুটির কথা মনে হচ্ছিল বারবার। দাফনের সাদা কাপড়ে জড়ানো ছিল ছোট্ট শরীরটা, মুখটাও দেখতে পাইনি, ছেলেবাবু না মেয়েবাবু তাও জানা হয়নি। ওর বাপ-মায়ের মতো আমিও যেন স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কখনো কখনো কবর আমাদের মূক করে রাখে, নীরবতায় বিদায় জানাতে। ছোট্টমণি তুমি শান্তিতে ঘুমাও, তোমার জন্য দোয়া/প্রার্থনা করি। আমার বাবা-মাও মূক ছিলেন আমার নয় মাসের ভাই কলিন্সকে কবরে রেখে এসে, সেটাও সেই একই কবরস্থানে। শিশুসন্তানকে হারানোর বেদনা তাঁরা নীরবে বয়ে গেছেন সারাটা জীবন, কিন্তু সেই বেদনাকে আমাদের স্পর্শ করতে দেননি কখনো। কবর একটা গ্রন্থাগারের মতোই নীরবে জ্ঞানদান করে যায়। আমাদের উচিত চুপ থেকে, নীরবতা পালন করে সে জ্ঞানকে মাথা পেতে বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করা।
কবর সবার ভাগ্যে জোটে না। যুদ্ধ, মহামারি, বোমা বিস্ফোরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদিতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়ে গণকবরে সমাহিত হন কিংবা তাদের মৃতদেহের কোনো কিছুই অবশিষ্ট পাওয়া যায় না কবর দেওয়ার মতো। সাইক্লোন, টাইফুনে বহু মানুষ ভেসে যায় সাগরে। অনেক মরদেহ আর পাওয়া যায় না, সামুদ্রিক প্রাণীর খাদ্য হয়ে কিংবা জলেই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের স্তূপ থেকে অনেককেই উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। প্রতিদিনই অনেক শিশু মায়ের গর্ভ থেকেই চিরবিদায় নেয়, Miscarriage-এ কত শিশু দিনের আলো দেখতে পায় না, মায়ের কোনো স্বাস্থ্যগত কারণে কিংবা অপ্রত্যাশিত কোনো পরিস্থিতির জন্য তারা মাতৃগর্ভে পূর্ণভাবে গঠিত হওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেয়। বেশ কিছু প্রিয়জনের এ রকম দুঃখের সময়ে তাদের সঙ্গে সহভাগী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। মা তো অবশ্যই, বাবাও অনাগত সন্তানকে হারিয়ে বিষাদ ও হতাশার অন্ধকারে পড়ে যায়। অনেক পরিবারে শাশুড়ি কিংবা অন্যরা শিশুহীনা মাকে অনেক দোষারোপ করে, হেয়প্রতিপন্ন করে, খোঁটা দিয়ে বলে সন্তানসম্ভবা অবস্থায় সে সাবধানে থাকেনি, নিজের যত্ন নেয়নি।
এটা করা একেবারেই অনুচিত ও অনৈতিক। এই সময় দরকার মা, বাবা এমনকি পুরো পরিবারের জন্যই ভালোবাসাপূর্ণ ব্যবহার, ইতিবাচক কথাবার্তা, শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা ও সহায়তা। অভিজ্ঞ মা ও বাবাদের উচিত তাঁদের miscarriage-এর মাধ্যমে সন্তান হারানোর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ও এর মধ্য থেকে আরোগ্য হওয়ার পথ ও পন্থা সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সহভাগিতা করে তাদের সাহায্য করা। এটা অনেক বড় একটা আত্মিক দয়ার কাজ। আবার অন্যদিকে প্রতিদিন অনেক শিশু ভ্রুন অবস্থাতেই তাদের মা-বাবার জীবনের জটিল কোনো পরিস্থিতিতে মা কিংবা মা-বাবার অথবা পারিবারিক সিদ্ধান্তে গর্ভপাতের মতো মহাপাপের মাধ্যমে জন্ম নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আইনগতভাবে স্বীকৃত হলেও নৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে গর্ভপাত অনুচিত। তাই জটিল অবস্থায় নিমজ্জিত ভাবী মাকে ও বাবাকে গর্ভপাতের আগেই বয়োজ্যেষ্ঠদের সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া গুরুদায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতেও কোনো দোষারোপের মধ্যে না গিয়ে তাদের কাছে আরোগ্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সবার। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে এই শিশুরা জন্মাতে যেমন পারে না, আবার এরা কবরও পায় না, তাদের মা-বাবা, প্রিয়জনেরা বিদায়ও জানাতে পারে না।
কবর যেমন শোক দেয়, কবরে শায়িত প্রিয়জনের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলার সুযোগ দেয়, তেমনি আবার পরিদর্শনকারীকেও যেন অনেক কিছু বলে। বিজ্ঞ ব্যক্তির মতোই বলে নিজের যত্ন নিতে, কারণ শোক, বিষাদ মানুষকে ভীষণ ক্লান্ত করে তোলে। শোক যেন শরীরে একটা খোলা ক্ষত, একে পরিষ্কার রাখতে হয়, প্রতিদিন ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করতে হয়, তবেই না তা শুকিয়ে আরোগ্যের দিকে যাবে। এ সময়ে কয়েকটি করণীয় বিষয় হলো :
অশ্রুÑপ্রিয়জনকে হারিয়ে যে অশ্রুপাত হয়, তা পবিত্র। কারণ তা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সেটা দুর্বলতার প্রকাশ নয় বরং ভালোবাসার শক্তির প্রকাশ। হাজারো শব্দের চাইতে এক ফোঁটা অশ্রু সবকিছু বলে দেয়। তাই কান্নায়, অশ্রু বর্ষণে বাধা নেই, লজ্জা নেই, গোপনীয়তা নেই।
বিশ্রামÑশোকের সামাল দিতে কবর দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন যত পারা যায় বিশ্রাম নেওয়া অপরিহার্য, নতুবা শরীর বিধ্বস্ত হয়ে পড়তে পারে। শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম হারানো প্রিয়জনকে হৃদয়ের আরও কাছে টেনে আনে।
সুষম আহার-শোক ও বিষাদ শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই খাদ্য তালিকায় সবকিছুই ভারসাম্যভাবে যোগ করতে হবে।
ব্যায়ামÑশোক ও বিষাদ মানসিক চাপ বা উদ্বেগ সৃষ্টি করে, যা মন ও শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ জন্য প্রতিদিন কিছু হাঁটা, ব্যায়াম করা, সম্ভব হলে কিছু খেলাধুলা করা, পার্কে ঘোরা, নদী বা সমুদ্র দেখতে যাওয়া ইত্যাদি দৈহিক কর্মকাণ্ড মন-শরীর উভয়কেই সুস্থ রাখে।
সহভাগিতাÑপ্রিয়জনকে হারিয়ে মনের, হৃদয়ের দুঃখ, কষ্ট, শোক, ক্রোধ, পরিতাপ, অনুতাপ, আফসোস, আক্ষেপ ইত্যাদি পরিবারের মানুষ, বন্ধু, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী, মানসিক সেবাদানকারী প্রমুখদের মাঝে আস্থাবান মনে হয় এমন দু-একজনের সঙ্গে সহভাগিতা করা উচিত। মনের বিভিন্ন অনুভূতি বিয়োগ-ব্যথারই অংশ, সেগুলো সহভাগিতা করলে শোকের বোঝা বহন করতে সুবিধা হয়, মন হালকা হয়।
ধৈর্য্য-শোক, বিষাদ থেকে আরোগ্য একটা পথযাত্রা, যা সময়ের কলে ধীরে ধীরে চলে। তাই নিজের প্রতি ও অন্যদের প্রতি ধৈর্য্য রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে একটু ছুটি নিয়ে আনন্দময় কিছু করতে হবে, আবার অল্প অল্প করে হাসতে হবে। হারানো প্রিয়জনের কিছু জিনিস (কলম, হাতঘড়ি, রুমাল, চুড়ি ইত্যাদি) সঙ্গে রাখলে তাকে কাছে মনে হবে, মনটা ভালো হতে থাকবে।
ডায়েরি-একটা খাতায় প্রিয়জনের সঙ্গে স্মৃতির কিছু মুহূর্ত লিখলে, তার ফটো, তার সম্বন্ধে লেখার পৃষ্ঠা ইত্যাদি সেই ডায়েরিতে সেঁটে রাখলে এটা ওষুধের মতো কাজ করে।
ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ড-প্রিয়জনকে হারিয়ে সবাই দুঃখ, ব্যথা পায়। তাই নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলে হৃদয়ে মনে শান্তি আসে, স্রষ্টার কাছে বিশ্বাসপূর্বক কিছু চাওয়ার ফল পাওয়া যায়।
‘কবর’ নাটকটা আমাকে স্মৃতির আঁকাবাঁকা বিভিন্ন পথ দিয়ে হাঁটতে সুযোগ করে দিয়েছে, বিশেষ করে কবরে রেখে আসা প্রিয় ও পরিচিতজনদের সঙ্গে বহু ঘটনার। হয়তো আপনাদেরও দেবে। যদি ইদানীং কোনো প্রিয়জনকে কবর দিয়ে থাকেন কিংবা মনে পড়ছে যারা না ফেরার দেশে চলে গেছে তাদের, তাহলে দেখে নিতে পারেন নাটকটা YouTube-এ। আমি এই সুন্দর নাটকের কোনো বিজ্ঞাপন দিচ্ছি না, শুধু একটা উপমা কাহিনি বা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করছি এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সম্পর্কে একজন সাধারণ নাটক-পাগল মানুষ হিসেবে। ইংরেজ সাহিত্যিক, নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘সমগ্র পৃথিবীটা একটা মঞ্চ, এতে সকল পুরুষ ও নারীই বিভিন্ন চরিত্র মাত্র।’ প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকা তাঁর এক গানে জীবনে ও সমাজে অন্যায্যতা ও বৈষম্যের বিষয়ে বলতে গিয়ে বিধাতাকে ‘জীবন নাটকের নাট্যকার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। নাটক যদি জীবনভিত্তিক হয় এবং ক্যামেরার সামনে, পেছনে ও নেপথ্যের কলাকুশলীরা যদি তাদের মেধা, গুণাগুণ, অভিনয়শৈলী পুরোপুরি ঢেলে দেন, তাহলে আমরা তা দেখে শিক্ষালাভ করি, অনুপ্রাণিত হই এবং সান্ত্বনা-শক্তি পাই জীবনসংগ্রামে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার। আমরা বাংলা নাটক নিয়ে গর্বভরে বলতে পারি, বহু নাটক আমাদের উৎসাহিত করেছে এবং করে যাচ্ছে, সেগুলোর মান অনেক উঁচুতে রেখে। নির্মল চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি যেসব লেখক, নির্মাতা, নাটক-কর্মী ও নাট্যশিল্পী আমাদের শিল্পসমৃদ্ধ, চমৎকার, উদ্দীপনাময়, অনুকরণীয় কাজ উপহার দিচ্ছেন, তাদের প্রতি আমরা নাট্যপ্রেমী দর্শকেরা কৃতজ্ঞতাসহ বাহবা জানাই।
কবর জীবনের শেষ অধ্যায়ের ইতি টানতে আমাদের সহায়তা করে। সেটা বোঝানোর জন্য কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে কবরের স্থায়ী বাসিন্দা ইতালির রোম নগরীর ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসীদের ‘কঙ্কালের কবর’ অনুকরণে আমাদের বলে, ‘তুমি এখন যেখানে আছ, সেখানে আমিও একদিন ছিলাম, আমি এখন যেখানে আছি, সেখানে তুমিও একদিন থাকবে।’ কবরে শায়িত সকলে স্বর্গের অনন্ত শান্তি লাভ করুন এবং করুণাময় স্রষ্টার সান্নিধ্যে থাকুন ॥
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।
অন্যান্য দৈনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি চিত্তবিনোদনের কিছুটা সময় আমি কাটাই একজন নাটকপ্রেমী মানুষ হিসেবে বাংলা নাটক দেখে, ঢাকা ও কলকাতা দুই জায়গারই। মনের গভীরে থাকা বিষণ্নতার কারণেই হয়তো-বা সে রকম বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা নাটকগুলোই ইদানীং চোখে পড়ে বেশি, দেখার জন্যও মন টানে, ইচ্ছাও যেন কেমন তীব্র হয়। এ রকমই একটা নাটক আমার মনে যেমন সাড়া জাগিয়েছে, জীবনভিত্তিক গল্প ও অভিনয়ের উচ্চমানে মুগ্ধ হয়েছি, তেমনি আবার মনে সান্ত্বনাও জাগিয়েছে প্রচুর। নাটকটা হলো ‘কবর’।
কবর নাটকটা একটা সত্য কাহিনির ওপর আশ্রয় করে কাল্পনিক পটভূমিতে রচনা করেছেন যোবায়েদ আহসান, তাকে সহযোগিতা করেছেন আলি সিদ্দিক অভি, পরিচালনা করেছেন রাফাত মজুমদার রিংকু। অভিনয় করেছেন ফারহান আহমেদ জোভান, দ্বৈত চরিত্রে তাসনিয়া ফারিন, সমাপ্তি মাসুক, এক মায়ের চরিত্রে আমার প্রিয় অভিনেত্রী মিলি বাসার ও অন্য মায়ের চরিত্রে টুনটুনি সোবাহান, হিমি হাফিজ, হারুণ রসিদ বান্টি, আনোয়ার শাহী, শাফিজ মামুন, মার্জিয়া আক্তার এবং মিতু। গল্পটা সাজানো হয়েছে দুই সামাজিক প্রান্তের দুটি অনাগত শিশুর আত্মীয়দের ঘিরে। দুজন স্বামী ব্যক্তিগতভাবে তাদের স্ত্রীদের খুবই ভালোবাসে। প্রথমবার বাবা হওয়ার প্রতীক্ষায় নানাভাবে উদ্বিগ্ন, তেমনি আবার আনন্দেও আত্মহারা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে। তবে কর্মক্ষেত্রে দুজনই কিছুটা অসৎ পথের পথিক, যা তারা অন্যদের কাছ থেকে গোপন রাখে। সন্তানসম্ভবা দুই স্ত্রী তাদের পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে দিন অতিবাহিত করে তাদের স্বামীদের ও শাশুড়িদের প্রতি লক্ষ রেখে এবং নিজেদের যথাসাধ্য শারীরিক যত্ন নিয়ে। এই দ্বৈত চরিত্রে তাসনিয়া ফারিন চমৎকার অভিনয় করেছেন, বিশেষ করে দরিদ্র স্ত্রীর চরিত্রে।
নবজাত শিশুদের মৃত্যুতে নতুন দুই মায়ের বিলাপ দেখে সব দর্শকের চোখই অশ্রুসজল হবে। দুই মা/শাশুড়ি তাদের পোয়াতি ছেলেবউদের দেখাশোনা করেন তাদের নিজস্ব সামাজিক শ্রেণিভেদে একজন আধুনিকা ও অন্যজন কুসংস্কারপূর্ণা হিসেবে। সমাপ্তি মাসুক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কারখানার স্বত্বাধিকার হিসেবে কর্মচারীদের প্রতি মালিকসুলভ ব্যবহার, স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ, প্রথমবার বাবা হওয়ার উচ্ছ্বাস এবং খুবই চাওয়ার নবজাত রাজকন্যা মেয়েবাবুকে হারিয়ে শোকার্ত পিতার কান্না ও গাম্ভীর্য। ফারহান আহমেদ জোভান অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মিশে গেছেন তার চরিত্র ড্রাইভার ও দুই নম্বরি কাজে, আবার স্ত্রীর প্রতি মমতা দেখাতে মিষ্টি ও বিরিয়ানি চুরি করাতে এবং ক্ল্যাসিক বা স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার সন্তান হারানোর আর্তনাদ। মৃত শিশুর জন্য কবর কিনতে গিয়ে হারাম টাকা ব্যয় না করার সংলাপ, অনেক চাওয়ার ও গরিবের স্বপ্নের ধন তার ছেলেবাবুকে কবরে শোয়ানোর সময় হৃদয়বিদারক কান্না এবং কবর দেওয়ার সময় সেই শিশুর জ্ঞান ফিরে আসায় তার কান্না শুনে নিজের কান্নাজড়িত কণ্ঠে পরম করুণাময় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো ও সেই জীবিত শিশু হুমায়ুনকে ‘আব্বা’ বলে ডেকে বুকের সঙ্গে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখার দৃশ্যটি প্রতিটি বাবা/মায়ের ও অন্যান্য দর্শকের হৃদয়ের অনেক গভীরে গিয়ে পৌঁছাবে।
তারপর সেই শূন্য কবরে কারখানা মালিকের মেয়েকে দাফন করার সময় মনে জাগে এই চিরন্তন সত্য : ‘দয়াময় স্রষ্টার লীলা বোঝা বড় দায়, কার কবরে কে শোয়।’ একই সময়ে দরিদ্র বাবা শিশুকে তুলে দেয় তার মায়ের কোলে। আমার জানা নেই, পরিচালক রাফাত মজুমদার রিংকু শেষ দৃশ্যের কী রকম নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং এর মহড়া কতবার হয়েছিল, কিন্তু নবজাত শিশু, যে মৃত শিশু (still born) হিসেবে জন্মেছিল, তাকে কোলে নিয়ে জোভান ও তাসনিয়ার মুখের, চোখের ও শারীরিক অভিব্যক্তি, ওদের দুজনের অভিনয়শৈলী যে কত গভীর, তা প্রমাণ করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আপেল মাহমুদ এমিলের সংগীত পরিচালনায়, তারিক তুহিনের কথা ও সুরে এবং শিল্পী পিন্টু ঘোষের কণ্ঠে ‘মুর্দা বাঁচে, জিন্দায় মরে তোমার ইশারায়’ গানটা হৃদয়ে এনে দেবে অনেক প্রশান্তি ও সান্ত্বনা। স্মরণে আসবে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের সেই মহান উক্তি, ‘হে মানব, তুমি ধূলি মাত্র আবার ধূলিতেই মিশে যাবে কিন্তু অন্তিমকালে প্রভু তোমাকে আবার পুনর্জীবিত করবেন।’ অথবা ‘যে আমাতে বিশ্বাস করবে, সে মরলেও জীবিত হয়ে উঠবে।’
এখানে উল্লেখ্য, শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন ১৯৫৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষাসৈনিকদের পাকিস্তান সরকার গোপনে কবর দিতে চেয়েছিল। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই প্রতিবাদী নাটকের কাহিনি। আরণ্যক নাট্যদল তাদের যাত্রা শুরু করেছিল ‘কবর’ নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে। তবে এই নাটক লেখা ও কারাগারের ভেতরে ও বাইরে এর মঞ্চায়ন সবই ঐতিহাসিক ঘটনা এবং সেটা ইতিহাসে বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই আমাদের এর তাৎপর্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বর্ণনা করতে পারবেন।
কবর আমাদের কাছে অপরিচিত কিছু নয়। আমরা সবাই বাবা বা মা, অথবা অন্য কোনো আত্মীয় পরিজন, কাউকে না কাউকে মৃত্যুর কাছে হারিয়েছি এবং তাদের মরদেহকে কবরে শুইয়ে রেখে এসেছি। তাদের আর না দেখতে পাওয়া, না ফেরার দেশে চলে যাওয়া এখনো আমাদের পীড়া দেয়, হৃদয় ভারাক্রান্ত করে। মৃত্যুদিবসে কিংবা অন্য কোনো দিনে তাদের কবরে যাই, প্রার্থনা, মোনাজাত করি, ফুল রেখে আসি। কারণ তাদের এখনো ভালবাসি। বাঙালির গর্ব, সর্বজনশ্রদ্ধেয় পল্লিকবি জসীমউদ্্দীন তাঁর ‘কবর’ কবিতার মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন সম্পর্কের গুরুত্ব, ভালোবাসার মাহাত্ম্য এবং কবরের মর্যাদা।
কবর কোনো ভয়ের জায়গা নয়, বরং শান্তির জায়গা, দুঃখ পাওয়ার স্থান বটে, তবে সবারই অন্তিম গন্তব্যস্থান। সন্ধ্যা কিংবা অমাবশ্যার রাতে কবরস্থানকে ভয় লাগতে পারে, তবে সে ভয় আসে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কিছু ভূত-পেতনির গল্প ছোটবেলায় পড়া থেকে। অনেকে শেষ গন্তব্যের স্থান আগেই নির্ধারণ করে রাখেন, এমনকি খরচপাতিও পরিশোধ করে রাখেন, যাতে পরিবারে সিদ্ধান্ত নিতে কোনো রকম উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা না হয়। তবে এটা ঠিক, কার কখন, কোথায় মৃত্যু হবে ও কোথায় কবর বা দাফন হবে, কেউই জানে না। এমনকি কীভাবে যে কবরের ব্যবস্থা হবে, কার জন্য প্রস্তুত করে রাখা কবরে কে শায়িত হবে, সবই পরম দয়াময় স্রষ্টার ওপরই নির্ভর করে।
কবর আমাদের নিজেকে চিনতে শেখায়, জীবনের আসল সত্যগুলো শেখায়। কবরে কিছুই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় নাÑবাড়ি, গাড়ি, সম্পদ কিছুই না। শুধু মাটির দেহটি, আর কিছু না। বহু বছর আগে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় হলিক্রস বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে হলি রোজারি গির্জায় ও মাদার তেরেসার নির্মল হৃদয় আশ্রমে স্বেচ্ছাসেবী ছিলাম। তখনকার পালক পুরোহিত ফাদার পিটার বি. রোজারিও একদিন বললেন, একটা শিশু মারা গেছে এবং তার বাবা-মা খুবই গরিব, তাই অন্য কোনো কবরস্থানে কবর কেনা তাদের সামর্থ্যরে বাইরে, এ জন্য আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদেরই বিনা পয়সায় কবরের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমরা দুজন স্বেচ্ছাসেবী কবর খোঁড়ায় লেগে গেলাম। ভরদুপুরে কোদাল দিয়ে মাটি কেটে তা আবার কবরের পাশেই স্তূপ করতে লাগলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, গরমে শরীর ঘামছিল বটে, কিন্তু ক্লান্তি লাগছিল না। বেশ কিছু খোঁড়া হয়ে গেলে, কবরে নেমে মাটি কেটে ঝুড়িতে ভরে তা উঁচু করে আমার বন্ধুর হাতে দিলে, ও সেটা মাটির স্তূপে রেখে খালি ঝুড়ি আবার আমার কাছে দিত। এর মাঝে কবরে একটু বসে ঝুড়ির অপেক্ষা করতে গিয়ে একটু আশপাশে চোখ বোলালামÑআমার ডানে, বামে, সামনে, পেছনে ও নিচে খয়েরি-লালচে রঙের মাটির দেয়াল, আমাদের দুজনের দ্বারা সদ্য কাটা। কোনো আড়ম্বর নেই, কোনো রকম সাজসজ্জা নেই, দেয়ালে প্রিয়জনের বা অন্য কোনো ছবি নেই, শুধু এখানে-সেখানে কোনো গাছের শিকড়-বাকড় কিছু বেরিয়ে আছে। এটাই তাহলে আমাদের শেষ ঘর!! যেভাবে আমরা পৃথিবীতে এসেছিলাম শূন্য হস্তে, সেভাবেই আবার ফিরে যাব খালি হাতে। জন্মের সময় আমরা কাঁদি, অন্যরা স্বস্তিতে ও আনন্দে হাসে, এমনকি মাও তার প্রসববেদনা ভুলে গিয়ে হাসে। মৃত্যুর পরে কবরে নামালে আমরা হাসব আর ওরা কি কাঁদবে? উপরে তাকালাম, শুধু একচিলতে আকাশ দেখা যায়, দু’পাশের মাটির দেয়াল ছাড়িয়ে অনেক উপরে। কী সুন্দর নীল আকাশ! দু-একটা সাদা রঙের মেঘ ভেসে যাচ্ছে, যেন মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো তাড়া নেই, সময়ের কোনো পরিমাপ নেই। মাটি, মেঘ আর আকাশÑএদের রঙের মাঝে আমার কাছে আকাশের রংকেই সুন্দর লাগছে, প্রিয় মনে হচ্ছে। নীল রঙের আরও কত কিছু যে আমার প্রিয়, তা মনে পড়ছেÑনীল পেনসিল, যা দিয়ে ছবি আঁকি; ফাউন্টেন পেনের নীল কালি, যা দিয়ে সবকিছুই লিখি কলেজের পরীক্ষা থেকে শুরু করে পত্রিকায় ছাপানোর অযোগ্য কবিতা পর্যন্ত। সমুদ্রের নীল জল দেখার ভীষণ ইচ্ছা। আরও একটা পছন্দ আছে, সেটা হলো নীল শাড়ি। প্রিয় কাউকে নীল শাড়িতে দেখলে মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যায়। কবর আমাদের কত কিছু শেখায়, এমনকি প্রিয় রং পর্যন্ত। তবে যখন আমাকে কবরে নামানো হবে, তখন তো আমার চোখ কিছু দেখবে না। সেই দিন আসার আগ পর্যন্ত নীল আকাশকে ভালোবাসব।
‘কবর’ নাটকটির শেষ অংশটা দেখতে দেখতে যার জন্য কবর খুঁড়েছিলাম, সেই শিশুটির কথা মনে হচ্ছিল বারবার। দাফনের সাদা কাপড়ে জড়ানো ছিল ছোট্ট শরীরটা, মুখটাও দেখতে পাইনি, ছেলেবাবু না মেয়েবাবু তাও জানা হয়নি। ওর বাপ-মায়ের মতো আমিও যেন স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কখনো কখনো কবর আমাদের মূক করে রাখে, নীরবতায় বিদায় জানাতে। ছোট্টমণি তুমি শান্তিতে ঘুমাও, তোমার জন্য দোয়া/প্রার্থনা করি। আমার বাবা-মাও মূক ছিলেন আমার নয় মাসের ভাই কলিন্সকে কবরে রেখে এসে, সেটাও সেই একই কবরস্থানে। শিশুসন্তানকে হারানোর বেদনা তাঁরা নীরবে বয়ে গেছেন সারাটা জীবন, কিন্তু সেই বেদনাকে আমাদের স্পর্শ করতে দেননি কখনো। কবর একটা গ্রন্থাগারের মতোই নীরবে জ্ঞানদান করে যায়। আমাদের উচিত চুপ থেকে, নীরবতা পালন করে সে জ্ঞানকে মাথা পেতে বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করা।
কবর সবার ভাগ্যে জোটে না। যুদ্ধ, মহামারি, বোমা বিস্ফোরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদিতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়ে গণকবরে সমাহিত হন কিংবা তাদের মৃতদেহের কোনো কিছুই অবশিষ্ট পাওয়া যায় না কবর দেওয়ার মতো। সাইক্লোন, টাইফুনে বহু মানুষ ভেসে যায় সাগরে। অনেক মরদেহ আর পাওয়া যায় না, সামুদ্রিক প্রাণীর খাদ্য হয়ে কিংবা জলেই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের স্তূপ থেকে অনেককেই উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। প্রতিদিনই অনেক শিশু মায়ের গর্ভ থেকেই চিরবিদায় নেয়, Miscarriage-এ কত শিশু দিনের আলো দেখতে পায় না, মায়ের কোনো স্বাস্থ্যগত কারণে কিংবা অপ্রত্যাশিত কোনো পরিস্থিতির জন্য তারা মাতৃগর্ভে পূর্ণভাবে গঠিত হওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেয়। বেশ কিছু প্রিয়জনের এ রকম দুঃখের সময়ে তাদের সঙ্গে সহভাগী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। মা তো অবশ্যই, বাবাও অনাগত সন্তানকে হারিয়ে বিষাদ ও হতাশার অন্ধকারে পড়ে যায়। অনেক পরিবারে শাশুড়ি কিংবা অন্যরা শিশুহীনা মাকে অনেক দোষারোপ করে, হেয়প্রতিপন্ন করে, খোঁটা দিয়ে বলে সন্তানসম্ভবা অবস্থায় সে সাবধানে থাকেনি, নিজের যত্ন নেয়নি।
এটা করা একেবারেই অনুচিত ও অনৈতিক। এই সময় দরকার মা, বাবা এমনকি পুরো পরিবারের জন্যই ভালোবাসাপূর্ণ ব্যবহার, ইতিবাচক কথাবার্তা, শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা ও সহায়তা। অভিজ্ঞ মা ও বাবাদের উচিত তাঁদের miscarriage-এর মাধ্যমে সন্তান হারানোর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ও এর মধ্য থেকে আরোগ্য হওয়ার পথ ও পন্থা সম্প্রতি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সহভাগিতা করে তাদের সাহায্য করা। এটা অনেক বড় একটা আত্মিক দয়ার কাজ। আবার অন্যদিকে প্রতিদিন অনেক শিশু ভ্রুন অবস্থাতেই তাদের মা-বাবার জীবনের জটিল কোনো পরিস্থিতিতে মা কিংবা মা-বাবার অথবা পারিবারিক সিদ্ধান্তে গর্ভপাতের মতো মহাপাপের মাধ্যমে জন্ম নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আইনগতভাবে স্বীকৃত হলেও নৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে গর্ভপাত অনুচিত। তাই জটিল অবস্থায় নিমজ্জিত ভাবী মাকে ও বাবাকে গর্ভপাতের আগেই বয়োজ্যেষ্ঠদের সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া গুরুদায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতেও কোনো দোষারোপের মধ্যে না গিয়ে তাদের কাছে আরোগ্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সবার। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে এই শিশুরা জন্মাতে যেমন পারে না, আবার এরা কবরও পায় না, তাদের মা-বাবা, প্রিয়জনেরা বিদায়ও জানাতে পারে না।
কবর যেমন শোক দেয়, কবরে শায়িত প্রিয়জনের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলার সুযোগ দেয়, তেমনি আবার পরিদর্শনকারীকেও যেন অনেক কিছু বলে। বিজ্ঞ ব্যক্তির মতোই বলে নিজের যত্ন নিতে, কারণ শোক, বিষাদ মানুষকে ভীষণ ক্লান্ত করে তোলে। শোক যেন শরীরে একটা খোলা ক্ষত, একে পরিষ্কার রাখতে হয়, প্রতিদিন ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করতে হয়, তবেই না তা শুকিয়ে আরোগ্যের দিকে যাবে। এ সময়ে কয়েকটি করণীয় বিষয় হলো :
অশ্রুÑপ্রিয়জনকে হারিয়ে যে অশ্রুপাত হয়, তা পবিত্র। কারণ তা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সেটা দুর্বলতার প্রকাশ নয় বরং ভালোবাসার শক্তির প্রকাশ। হাজারো শব্দের চাইতে এক ফোঁটা অশ্রু সবকিছু বলে দেয়। তাই কান্নায়, অশ্রু বর্ষণে বাধা নেই, লজ্জা নেই, গোপনীয়তা নেই।
বিশ্রামÑশোকের সামাল দিতে কবর দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা হয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন যত পারা যায় বিশ্রাম নেওয়া অপরিহার্য, নতুবা শরীর বিধ্বস্ত হয়ে পড়তে পারে। শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম হারানো প্রিয়জনকে হৃদয়ের আরও কাছে টেনে আনে।
সুষম আহার-শোক ও বিষাদ শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই খাদ্য তালিকায় সবকিছুই ভারসাম্যভাবে যোগ করতে হবে।
ব্যায়ামÑশোক ও বিষাদ মানসিক চাপ বা উদ্বেগ সৃষ্টি করে, যা মন ও শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ জন্য প্রতিদিন কিছু হাঁটা, ব্যায়াম করা, সম্ভব হলে কিছু খেলাধুলা করা, পার্কে ঘোরা, নদী বা সমুদ্র দেখতে যাওয়া ইত্যাদি দৈহিক কর্মকাণ্ড মন-শরীর উভয়কেই সুস্থ রাখে।
সহভাগিতাÑপ্রিয়জনকে হারিয়ে মনের, হৃদয়ের দুঃখ, কষ্ট, শোক, ক্রোধ, পরিতাপ, অনুতাপ, আফসোস, আক্ষেপ ইত্যাদি পরিবারের মানুষ, বন্ধু, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী, মানসিক সেবাদানকারী প্রমুখদের মাঝে আস্থাবান মনে হয় এমন দু-একজনের সঙ্গে সহভাগিতা করা উচিত। মনের বিভিন্ন অনুভূতি বিয়োগ-ব্যথারই অংশ, সেগুলো সহভাগিতা করলে শোকের বোঝা বহন করতে সুবিধা হয়, মন হালকা হয়।
ধৈর্য্য-শোক, বিষাদ থেকে আরোগ্য একটা পথযাত্রা, যা সময়ের কলে ধীরে ধীরে চলে। তাই নিজের প্রতি ও অন্যদের প্রতি ধৈর্য্য রাখতে হবে। মাঝেমধ্যে একটু ছুটি নিয়ে আনন্দময় কিছু করতে হবে, আবার অল্প অল্প করে হাসতে হবে। হারানো প্রিয়জনের কিছু জিনিস (কলম, হাতঘড়ি, রুমাল, চুড়ি ইত্যাদি) সঙ্গে রাখলে তাকে কাছে মনে হবে, মনটা ভালো হতে থাকবে।
ডায়েরি-একটা খাতায় প্রিয়জনের সঙ্গে স্মৃতির কিছু মুহূর্ত লিখলে, তার ফটো, তার সম্বন্ধে লেখার পৃষ্ঠা ইত্যাদি সেই ডায়েরিতে সেঁটে রাখলে এটা ওষুধের মতো কাজ করে।
ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ড-প্রিয়জনকে হারিয়ে সবাই দুঃখ, ব্যথা পায়। তাই নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডে অংশগ্রহণ করলে হৃদয়ে মনে শান্তি আসে, স্রষ্টার কাছে বিশ্বাসপূর্বক কিছু চাওয়ার ফল পাওয়া যায়।
‘কবর’ নাটকটা আমাকে স্মৃতির আঁকাবাঁকা বিভিন্ন পথ দিয়ে হাঁটতে সুযোগ করে দিয়েছে, বিশেষ করে কবরে রেখে আসা প্রিয় ও পরিচিতজনদের সঙ্গে বহু ঘটনার। হয়তো আপনাদেরও দেবে। যদি ইদানীং কোনো প্রিয়জনকে কবর দিয়ে থাকেন কিংবা মনে পড়ছে যারা না ফেরার দেশে চলে গেছে তাদের, তাহলে দেখে নিতে পারেন নাটকটা YouTube-এ। আমি এই সুন্দর নাটকের কোনো বিজ্ঞাপন দিচ্ছি না, শুধু একটা উপমা কাহিনি বা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করছি এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সম্পর্কে একজন সাধারণ নাটক-পাগল মানুষ হিসেবে। ইংরেজ সাহিত্যিক, নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘সমগ্র পৃথিবীটা একটা মঞ্চ, এতে সকল পুরুষ ও নারীই বিভিন্ন চরিত্র মাত্র।’ প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকা তাঁর এক গানে জীবনে ও সমাজে অন্যায্যতা ও বৈষম্যের বিষয়ে বলতে গিয়ে বিধাতাকে ‘জীবন নাটকের নাট্যকার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। নাটক যদি জীবনভিত্তিক হয় এবং ক্যামেরার সামনে, পেছনে ও নেপথ্যের কলাকুশলীরা যদি তাদের মেধা, গুণাগুণ, অভিনয়শৈলী পুরোপুরি ঢেলে দেন, তাহলে আমরা তা দেখে শিক্ষালাভ করি, অনুপ্রাণিত হই এবং সান্ত্বনা-শক্তি পাই জীবনসংগ্রামে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাওয়ার। আমরা বাংলা নাটক নিয়ে গর্বভরে বলতে পারি, বহু নাটক আমাদের উৎসাহিত করেছে এবং করে যাচ্ছে, সেগুলোর মান অনেক উঁচুতে রেখে। নির্মল চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি যেসব লেখক, নির্মাতা, নাটক-কর্মী ও নাট্যশিল্পী আমাদের শিল্পসমৃদ্ধ, চমৎকার, উদ্দীপনাময়, অনুকরণীয় কাজ উপহার দিচ্ছেন, তাদের প্রতি আমরা নাট্যপ্রেমী দর্শকেরা কৃতজ্ঞতাসহ বাহবা জানাই।
কবর জীবনের শেষ অধ্যায়ের ইতি টানতে আমাদের সহায়তা করে। সেটা বোঝানোর জন্য কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে কবরের স্থায়ী বাসিন্দা ইতালির রোম নগরীর ফ্রান্সিসকান সন্ন্যাসীদের ‘কঙ্কালের কবর’ অনুকরণে আমাদের বলে, ‘তুমি এখন যেখানে আছ, সেখানে আমিও একদিন ছিলাম, আমি এখন যেখানে আছি, সেখানে তুমিও একদিন থাকবে।’ কবরে শায়িত সকলে স্বর্গের অনন্ত শান্তি লাভ করুন এবং করুণাময় স্রষ্টার সান্নিধ্যে থাকুন ॥
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, নটরডেমিয়ান, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।