উইন্ডো শপিং বিষণ্নতা নিয়ন্ত্রণে এক সহায়ক থেরাপি

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:০৪ , চলতি সংখ্যা
আজকের লেখার প্রসঙ্গ উইন্ডো শপিং। পৃথিবীর বড় বড় ব্যস্ত শহরে যারা বসবাস করেন, তাদের ওই শপিং সম্বন্ধে কমবেশি ধারণা আছে। বিপণিবিতানে কোনো কিছু না কিনে ঘোরাফেরাকে সাধারণভাবে উইন্ডো শপিং হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। তবে এই শপিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত যারা, তাদের বেলায় বিরক্তিকর বাড়তি সময় কাটানোর এক সহজ উপায়। যেখানে বিনা খরচে সময়ের অপচয় করা যায়। বৃহত্তর অর্থে এর সংজ্ঞা বড় শহরের বিখ্যাত শপিংমলে দামি দামি রিটেলস, যা নতুন মার্কেটে এসেছে তা নিরীক্ষণ করা ও মানসিক চাপ হালকা করার প্রয়োজনেও মানুষ উইন্ডো শপিংয়ে সময় ব্যয় করে থাকেন। অনলাইনেও উইন্ডো শপিংয়ের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে নরনারীর মধ্যে, তবে নারীদের মধ্যে এর প্রবণতা অনেক গুণ বেশি।

ষোড়শ শতাব্দী থেকে উইন্ডো শপিংয়ের প্রাথমিক কার্যক্রম পরিলক্ষিত। ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে যদিও ওইসব কার্যক্রমের উৎপত্তির প্রবণতা দেখা দিয়েছিল তবু শপিংয়ের সময় কাটানোর বাস্তব রূপায়ণ কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে। বিংশ শতাব্দীর কিছু ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান তাদের স্টোরের সম্মুখে স্বচ্ছ গ্লাস ইনস্টল করে তার ভেতরের অংশে লোভনীয় জিনিসপত্র রেখে দিয়ে খদ্দরের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। অনেকের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনে প্রথম জানালার গ্লাস উৎপাদিত হলে তা বিলাসবহুল বিপণির সম্মুখে গ্লাসের শোকেস হিসেবে ব্যবহার শুরু হয় এবং তার ভেতরে মূল্যবান দ্রব্যাদি রাখার মাধ্যমে পথচারীর দৃষ্টিনন্দিত করে তাদের মনোযোগ কাড়া হতো। ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপে উইন্ডো শপিংয়ের বিস্তার ঘটতে লাগল এবং তারই ধারাবাহিকতায় এখন এই আধুনিকতার যুগে এসে অনলাইন শপিংয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে মডার্ন ট্র্যাডিশনে রূপান্তরিত হয়েছে। মেগা শহরের মলগুলোতে এখন দুই ধরনের শপার দেখতে পাওয়া যায়। তার একটি আসল ক্রেতা, অন্যটি দেখে দেখে সময় কাটানোর ক্রেতা।

হেরি গর্ডন স্যালফ্রিজকে উইন্ডো ডিসপ্লের প্রবর্তক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাজ্যে উইন্ডো ড্রেসিং প্রদর্শনীর মাধ্যমে তিনি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পরিবেশ সৃষ্টি করেন। বিপণিবিতানের সম্মুখভাগে গ্লাসের ভেতরের এই আকর্ষণীয় ডিসপ্লেও একটি শিল্প, যা বাণিজ্যিক শিল্পসৌন্দর্যের উৎকর্ষ দিয়ে ব্যবসার গতিকে বেগবান করার উদ্যোগময় অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সম্মন্ধে কথিত আছে : ‘The American millionaireÕs aim was to make an art of window display and upgrade window dressing.’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের গ্লাসনির্মিত প্রদর্শিত জানালাকক্ষে যুদ্ধের সর্বশেষ সংবাদ রেখে দিয়ে পথচারীর মনোযোগ আকর্ষণ করত। যুদ্ধের খবর দেখতে গিয়ে দর্শকেরা ধীরে ধীরে উইন্ডো ডিসপ্লের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং নতুন নতুন জিনিসগুলো জানালায় দেখার জন্য স্টোরের সামনে ভিড় জমাতে লাগল। পরিশেষে উইন্ডো শপিংয়ের সংস্কৃতি সংক্রমিত হয়ে সমগ্র ইউরোপ হয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল।

সিএনএনের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে সেরা ১২টি শহর আছে, যেগুলো শপিংয়ের জন্য বিখ্যাত। পাশাপাশি উইন্ডো শপিংয়ের বেলায়ও তথ্যটি সমানভাবে প্রযোজ্য। অত্যাধুনিক বিলাসবহুল পণ্যদ্রব্য যেহেতু সকলের জন্য নয়, সেহেতু সীমিত আয়ের মানুষের জন্য উইন্ডো শপিংয়ের ব্যবস্থা তো রয়েছে বটে। ১২টি শহর হচ্ছে নিউইয়র্ক, টোকিও, লন্ডন, কুয়ালালামপুর, প্যারিস, হংকং, বুয়েনেস আইরেস, ভিয়েনা, দুবাই, মাদ্রিদ, মিলান ও সিউল।

যারা বিত্তবান, ভ্রমণবিলাসী ও কেনাকাটায় আভিজাত্যের বিনোদন খোঁজেন, তাদের জন্য উত্তম গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আর মার্কিন মুল্লুকে যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, তাদের বেলায়ও তাদের মতো করে কনজুমারিজমের স্বাদ কমবেশি আছে বৈকি। আয়ের কথা বিবেচনায় এনে অনেকেই ভোগবিলাসী জীবন ত্যাগ করতে পারেন না বলেই অনেক আমেরিকান ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাই তারা বর্তমানের ভোগবিলাসের মধ্যেই যৌবনকে উপভোগ করে থাকে। যৌবন যেখানে নেই, জীবনের মানে সেখানে অর্থহীন মনে করে তারা। মিতব্যয়ী হলে তাদের অনেকেই বিত্তবান হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু তারা সঞ্চয় করতে গিয়ে যৌবনকে বিসর্জন দিতে রাজি নয় বলেই তারা বর্তমানকে ভোগবিলাসের ব্যস্ততায় জীবনকে কানায় কানায় উপভোগ করতে চায়। এই আমেরিকানরা বড় বড় মলে কেনাকাটায় ও রেস্তোরাঁয় অর্থের ঢল নামায় বলেই সাধারণ মানুষ তার সামর্থ্য খোঁজে পায়। মেগা শহরগুলোর জীবনযাত্রার তারতম্যের প্রবাহ এভাবেই নগর সংস্কৃতির সঙ্গে বিলীন হয়ে আছে।

আমেরিকানরা যেমন ভোজনবিলাসী, তেমনি তারা শপারহলিক অর্থাৎ কেনাকাটার জন্য পাগল। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কেনাকাটায় নেশার মতো অভ্যস্ত। এমনও শুনেছি, কী কিনল তা ঘরে গিয়ে খুলেও দেখে না। সেই সঙ্গে যারা উইন্ডো শপিং পাগল, তারা তো সময় পেলেই ছুটে শপিংমলে। সারা দিন হন্যে হয়ে এক স্টোর থেকে অন্য স্টোরে জিনিসপত্র দেখে বেড়াবে অথচ কিছুই কিনবে না। মোটেই কেনে না এ কথা বলা সমীচীন হবে না। মাঝেমধ্যে তারা দু-একটা জিনিস ক্রয় করে বটে, তাও যদি ক্লিয়ারেন্স সেলে কিছু থাকে। অনেকে আবার অত্যাধুনিক রিটেল আইটেমের জন্য আসক্ত, যা শপিং সেন্টারে নতুন আসে তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য দোকানে দোকানে ঘোরাফেরাকে পছন্দ করে। হলিডে এলে তো এর প্রবণতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। বড় বড় মল ও রাস্তার পাশের দোকানগুলোর উইন্ডো ডিসপ্লে নতুন প্রডাক্টের ডিজাইনে সুসজ্জিত হয়ে ওঠে। এই বিশাল দেশে বছরজুড়ে হলিডে আর বিশেষ ডের অভাব নেই। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য বিপণিবিতানগুলোর আকর্ষণীয়, মোহনীয় প্রলোভন দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে শপকিপারদের ওয়ালেটের দিকে। উইন্ডো শপিংয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো দিনগুলো হচ্ছে হলিডে ও ফেডারেল ছুটির দিন। তার চেয়েও উত্তম দিনগুলো হচ্ছে হলিডের ঠিক পরের দিনগুলো। কারণ, ওই দিনগুলোতে প্রায় ৫০% থেকে ৭৫% শতাংশ ছাড়ে জিনিসপত্র পাওয়া যায়। উইন্ডো শপাররা ভালো করেই জানে, কখন কোথায় ওইসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করা যায়। তারা এও জানে, আগামী শীতের কাপড় সস্তায় কেনার সুবর্ণ সময় হচ্ছে একটা ঋতুর বিদায়লগ্ন। তেমনি একই অনুসরণ গ্রীষ্মের কাপড়চোপড়ের বেলায়ও। খ্রিস্টমাস ডে এলে নিউইয়র্কের চেহারা বদলে যায় বাণিজ্যিক সাজসজ্জায়। সেই সঙ্গে নতুন বছরের সাজসজ্জা। বিলাসবহুল স্টোরসহ সস্তা দোকানপাট সেজে ওঠে এক অপূর্ব দৃষ্টিকাড়া আকর্ষণে। হলিডে উপলক্ষে পর্যটকদের সংখ্যাও তীব্র হারে বেড়ে ওঠে। নিউইয়র্ক পোস্টের ২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী, এ-যাবৎ নিউইয়র্কের পর্যটকের সংখ্যা বছরে ৬১ মিলিয়ন। ওই বিপুল সংখ্যক মানুষের ভিড়ে শহরটি জনকোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে। এ নিয়ে বিদগ্ধজনের অনেক মন্তব্যের মধ্যে যে মন্তব্যটি উপরিউক্ত বিষয়ের সঙ্গে উপযুক্ত বলে মনে করি, সেটি হলো : ‘The town has so much diversity in style and interpretations of chic.’ —Stella Lee (New York based fashion editor and stylist). তিনি আরও মন্তব্য করে বলেছেন, ‘You can find pieces from every possible era spanning the entire last century of fashion history.’ ফিফথ অ্যাভিনিউ ও মেডিসন অ্যাভিনিউয়ের মিডটাউনের ফুটপাত দিয়ে হাঁটলে দেখা যাবে, ফেশনের বৈচিত্র্যময় প্রডাক্টগুলো সুসজ্জিত উইন্ডো ডিসপ্লের মধ্যে হাতছানি দিয়ে পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ফিফথ অ্যাভিনিউর ৫৯তম রাস্তা থেকে ৯৬তম সড়কের নিক নাম ‘মিলিয়নিয়ার রো’। আভিজাত্যের সড়কপথে হেঁটে হেঁটে উইন্ডো শপিং করতে আলাদা মজা আছে। কোনো কিছু না কিনে একরকম কল্পনার সুখসাম্রাজ্যে বিচরণ করা যায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষদেরও দেখতে পাওয়া যায়। অনেক বছরব্যাপী ওই অভিজাত এলাকায় কাজ করেছি। দুপুরের ৪৫ মিনিটের ব্রেকে অনেক উইন্ডো শপিং করেছি এবং সুযোগ-সুবিধামতো ছাড়মূল্যে কিছু কেনাকাটাও করেছি। সব ধরনের কেনাকাটা ও উইন্ডো শপিংয়ের জন্য নিউইয়র্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিখ্যাত শহর হচ্ছে লস অ্যাঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, শিকাগো, সিয়াটল, মায়ামি, লাস ভেগাস, চার্লস্টন, হিউস্টন, ওরল্যান্ডো ও বস্টন।

উইন্ডো শপিং শুধু কেনাকাটা না করে সময় কাটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর উপকারিতাও রয়েছে, যা উল্লেখ করার মতো। কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য এ ধরনের শপিং তাদের মানসিক চাপ  থেকে বিরত রাখতে ট্রেস বাস্টারের ভূমিকা পালন করে থাকে। কেনাকাটার ব্যাপারে ওইসব খদ্দেরকে মিতব্যয়ী হতে সাহায্য করে। বিভিন্ন মলে গিয়ে উইন্ডো শপিং করার ভালো দিকটি হচ্ছে সব ধরনের পণ্যদ্রব্য সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা যায়। এই অভিজ্ঞতাকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা যায় ভবিষ্যতে যেকোনো পণ্যদ্রব্য কেনার জন্য। কেননা, কেনার ব্যাপারে দ্রব্যমূল্যের ওঠানামার ওপর তুলনামূলক ধারণা থাকলে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। প্রযুক্তির এই যুগে উইন্ডো শপিং সহজ হয়ে গিয়েছে। যার ফলে মলগুলোতে মানুষের ভিড় অনেক গুণ হ্রাস পেয়েছে। ঘরে বসে অনলাইনে উইন্ডো শপিং সহজ হলেও সশরীরে মলে গিয়ে শপিং করলে শরীরচর্চার বাড়তি উপকারিতা রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে হ্যারি গর্ডন সেলফ্রিজের আবিষ্কৃত রিটেল থেরাপি নামে যে কথাটি প্রচলিত রয়েছে, তা থেকেও জানা যায়, এর উপকারিতার সুফল অনেকেই পেয়েছেন। এই থেরাপির চিন্তাভাবনা যদিও ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছে তবু এর নামের বহিঃপ্রচার ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের খ্রিস্টমাস ডের ইভেন্টে প্রকাশিত ১৭৬ বছরের পুরোনো পত্রিকা ‘শিকাগো ট্রিবিউন’ এর মাধ্যমে। যেখানে ‘রিটেল থেরাপি’ বাক্যটি ব্যবহৃত হয়েছিল। দৈনিক শিকাগো ট্রিবিউনে প্রকাশিত বাক্যগুলো ছিল : ‘We’ve become a nation measuring out our lives in shopping bags and nursing our phychich ills through retail therapy.’

কোনো কিছু কেনাকাটা বা না কিনে সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন মল বা বিপণিবিতানে ঘুরে বেড়ানো মানসিক রোগীদের জন্য একটি ভালো থেরাপি। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একে ‘রিটেল থেরাপি’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। ওই থেরাপি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছেও। The journal of consumer phychology-র ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের একটি গবেষণায় যা বলা হয়েছে, ‘Retail therapy not only makes people happier immediately, but it can also fight lingering sadness.’
অতএব, উইন্ডো শপিংয়ে সময়ের অযথা অপব্যবহার আর শপিং করে অর্থের অপচয় হয়, এমন ধারণা পোষণকে চিকিৎসাবিজ্ঞান সমর্থন করে না। যে যা-ই বলুক, উইন্ডো শপিং বিষণ্নতা নিয়ন্ত্রণে নাগরিক জীবনযাপনের জন্য এক সহায়ক থেরাপি।

-নিউইয়র্ক, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078