ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর অর্থ উপার্জন

প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪:৪৮ , চলতি সংখ্যা
অর্থ ছাড়া জীবন চলে না। মানবজীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এসবের জোগান দিতে মানুষকে অর্থ উপার্জনের পন্থা বেছে নিতে হয়। অর্থ উপার্জন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ স্বাভাবিকভাবে দুই ধরনের পেশা অবলম্বন করে থাকেন-চাকরি বা ব্যবসা। তবে সেই চাকরি ও ব্যবসাও হতে হবে বৈধ। আর এ দুটোই হচ্ছে অর্থ উপার্জনের বৈধ পন্থা। অর্থ উপার্জনের মাধ্যম ছাড়া কারও পক্ষেই এসব মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। অর্থনীতি মানবজীবনের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম চালিকাশক্তি। তাই আল্লাহ তায়ালা ফরজ ইবাদত শেষে জীবিকা নির্বাহে উপার্জন করার লক্ষ্যে জমিনে বিচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা : জুমআ ১০)

অন্যদিকে ইসলাম সর্বদা নারীদের শালীন পরিবেশে শিক্ষা, কাজ ও চলাফেরার কথা বলে। শরিয়ত নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে থেকে নারীরা অবশ্যই শিক্ষা অর্জনসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ইসলাম কোথাও নারীকে বন্দী করে রাখার কথা বলেনি। ইসলাম নারীশিক্ষার প্রতি যেমন গুরুত্বারোপ করেছে, তেমনি নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে কাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকারও প্রদান করেছে। কোরআনুল কারিমের সুরা বাকারার ২৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি ব্যবসাকে হালাল করেছি এবং সুদকে হারাম করেছি।’ এই আয়াতে ব্যবসা হালাল হওয়া এবং সুদ হারাম হওয়া নারী-পুরুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। একজন পুরুষ হালাল পন্থায় যেসব ব্যবসা করতে পারবে, নারীও সে ধরনের ব্যবসা করতে পারবে। সে বিবাহিত হোক কিংবা অবিবাহিত। সে তার অর্জিত সম্পদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী। সে কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই তার সম্পত্তির ব্যাপারে সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, যা একজন পুরুষের জন্যও প্রযোজ্য। কোরআন ও হাদিসের কোনো স্থানে নারীর কাজকর্মের ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি। শুধু দুটি বিষয়ের প্রতি সংগত কারণে নির্দেশ দিয়েছে। শর্ত দুটি হলো প্রথমত, ব্যবসা হতে হবে হালাল পদ্ধতিতে ও শরিয়ত নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যে। দ্বিতীয়ত, পর্দা রক্ষা করতে হবে। তা ছাড়া ইসলাম নারীদের সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী কোনো পেশায় নিয়োজিত হতেও নিষেধ করেছে।

বর্তমান যুগ অর্থনৈতিক যুগ। অর্থের প্রয়োজন আজ যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। অর্থ ছাড়া এ যুগের জীবনধারণ তো দূরের কথা, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণও যেন সম্ভব নয়। এমনই এক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে জীবন ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে। তাই পরিবারের একজন লোকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকা, এক ব্যক্তির উপার্জনে গোটা পরিবারের সব রকমের প্রয়োজন পূরণ করা আজ যেন সুদূরপরাহত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের লোকদের মনোভাব এমনই। তারা মনে করে, জীবন বড় কঠিন, সংকটময়, সমস্যাসংকুল। তাই একজন পুরুষের উপার্জনের ওপর নির্ভর না করে ঘরের মেয়েদের-স্ত্রীদের উচিত অর্থোপার্জনের জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়া। এতে করে একদিকে পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে স্বামীর সঙ্গে সহযোগিতা করা হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। অন্যথায় বেচারা স্বামীর একার পক্ষে সংসার সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। অন্যদিকে নারীরাও কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের কর্মক্ষমতার বিকাশ সাধনের সুযোগ পাবে। এ হচ্ছে আধুনিক সমাজের মনস্তত্ত্ব, এর আবেদন যে খুবই আকর্ষণীয় ও অপ্রত্যাখ্যানীয়, তাতে সন্দেহ নেই। এরই ফলে আজ দেখা যাচ্ছে, দলে দলে মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। অফিসে, ব্যবসাকেন্দ্রে, হাসপাতালে, বিমানে, রেডিও, টিভি চ্যানেলে-সর্বত্রই আজ নারীদের প্রচণ্ড ভিড়।

এ সম্পর্কে দুটো প্রশ্ন অত্যন্ত মৌলিক। একটি পারিবারিক-সামাজিক ও নৈতিক আর দ্বিতীয়টি নিতান্তই অর্থনৈতিক। নারীসমাজ আজ যে ঘর ছেড়ে অর্থোপার্জন কেন্দ্রসমূহে ভিড় জমাচ্ছে, তার বাস্তব ফলটা যে কী হচ্ছে, তা আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। পরিবারের মেয়েরা নিজেদের শিশুসন্তানকে ঘরে রেখে দিয়ে কিংবা কাজের লোকের হাতে ছেড়ে দিয়ে অফিসে, বিপণিতে উপস্থিত হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে দিন-রাতের প্রায় সময়ই শিশুসন্তানেরা মায়ের স্নেহবঞ্চিত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। আর তারা প্রকৃতপক্ষে লালিত-পালিত হচ্ছে কাজের লোকদের কাছে। ধাত্রী-আয়া আর চাকর-চাকরানিরা যে সন্তানের মা নয়, মায়ের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করাও তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়, এ কথা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। অথচ ছোট ছোট মানবশিশুদের পক্ষে মানুষ হিসেবে লালিত-পালিত হওয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে মায়ের স্নেহ-দরদ ও বাৎসল্যপূর্ণ ক্রোড়।

অন্যদিকে স্বামীও উপার্জনের জন্য বের হয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে স্ত্রীও। স্বামী এক অফিসে, স্ত্রী অপর অফিসে। স্বামী এক কারখানায়, স্ত্রী অপর কারখানায়। স্বামী এক দোকানে, স্ত্রী অপর এক দোকানে। স্বামী এক জায়গায় ভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে কাজ করছে, আর স্ত্রী অপর এক স্থানে ভিন্ন পুরুষের সঙ্গে মিলে রুজি-রোজগারে ব্যস্ত হয়ে আছে। জীবনের একটি বৃহত্তম ক্ষেত্রে স্বামী আর স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের বন্ধনে ফাটল ধরা, ছেদ আসা যে অতি স্বাভাবিক, তা বলে বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না। এতে করে না স্বামীত্ব রক্ষা পায়, না থাকে স্ত্রীর বিশ্বস্ততা। উভয়ই অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিজস্ব পদ ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে আত্মচিন্তায় মশগুল। প্রত্যেকেরই মনস্তত্ত্ব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবধারায় চালিত ও প্রতিফলিত হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। অতঃপর বাকি থাকে শুধু যৌন মিলনের প্রয়োজন পূরণ করার কাজটুকু। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভের পর এই সাধারণ কাজে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হওয়া কতটুকু সম্ভব, বিশেষত বাইরে যখন সুযোগ-সুবিধার কোনো অভাব নেই। বস্তুত, এরূপ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণ ক্ষীণ হয়ে আসতে বাধ্য। অতঃপর এমন অবস্থা দেখা দেবে, যখন পরিচয়ের ক্ষেত্রে তারা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী হলেও কার্যত তারা এক ঘরে রাত যাপনকারী দুই নারী-পুরুষ মাত্র। আর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তাদের ক্ষেত্রে বিচিত্র কিছু নয়। পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি, নির্লিপ্ততা, গভীর প্রেম-ভালোবাসা শূন্য হয়ে বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থোপার্জনের যন্ত্রবিশেষে পরিণত হয়ে পড়ে। এ ধরনের জীবনযাপনের এ এক অতি স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়।

ইসলামে নারীরা হচ্ছে ঘরের রানি। আর কোনো রানি কখনো একাকী নিজের ইচ্ছামতো কোথাও যান না, যেতে পারেন না তাদের গুরুত্বের জন্য। তারা কোথাও যেতে হলে সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য লোকজন থাকে। সেরূপ মুসলিম নারীদেরও বেপর্দা হয়ে কিংবা মাহরাম ছাড়া একাকী ভ্রমণের ক্ষেত্রে (নির্দিষ্ট দূরত্বে) অনুৎসাহিত করা হয়েছে। কাজেই ইসলামের এসব মৌলিক বিধিবিধানকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।
ইসলাম নারীর ওপর অর্থনৈতিক কোনো দায়দায়িত্ব চাপায়নি। পরিবারের আর্থিক দায়দায়িত্ব বহন করা পুরুষের ওপর অর্পিত হয়েছে। সেহেতু নারীকে তার জীবিকার জন্য চাকরি করার প্রয়োজন নেই, তবে পুরুষের উপার্জন যদি সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট না হয় এবং প্রকৃত অভাবের সময়, সংকটকালে উভয়েই চাকরি করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে এমন অবস্থায়ও নারীর স্বাধীনতা রয়েছে। ইচ্ছা করলে সে বাইরে চাকরি করতে পারে, ইচ্ছা করলে নাও করতে পারে। কিন্তু কেউ জোর করে তার ঘাড়ে চাকরির বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে না। চাকরি না করে পুরুষের উপার্জন ভোগ করা তার অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তার ঘাড়ে উপার্জনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়, জুলুম। নারীর চাকরি করার অধিকার অবশ্যই আছে। ইসলাম নারীকে বাইরে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। কারণ, ইসলাম বাস্তবভিত্তিক ধর্ম। এর পরিধি অত্যন্ত বিস্তৃত, এর আয়তন অতি ব্যাপক। তা মানবীয় প্রয়োজনেও জীবনের সর্বাবস্থায় সাড়া দেয়। অনেক মহিলাকে বাইরে কাজ করতে হয়। বিভিন্ন পরিস্থিতি তাদেরকে বাইরে কাজ করতে বাধ্য করে। যেমন করে বাবা মারা গেলে মাকে চাকরি করতে হয়, চাকরি করে এতিম ছেলেমেয়েদের মুখে দু-মুঠো ভাত তুলে দিতে হয়। কোনো গরিব যুবতীর বিয়েশাদি না হলে তাকে চাকরি করে জীবন বাঁচাতে হয়। কিন্তু যাদের সংসার সচ্ছল, স্বামী বা ভাই চাকরি করে, তাদের সংসারেই প্রচুর কাজ রয়ে গেছে। তাদের বাইরে কাজ করার সময় ও সুযোগ কোথায়?

যাদের পুরুষেরা সারা দিন বাইরে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করে, তাদের জন্য বাড়িতে একটা শান্তিপূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশ, একটা আরামদায়ক প্রতিবেশ সরবরাহ করা নারীর দায়িত্ব। ইসলামের অসাধারণ সৌন্দর্যগুলোর মধ্যে একটা সৌন্দর্য এই যে, পুরুষকে উপার্জন, রক্ষণাবেক্ষণ ও নারীর ভরণপোষণের কাজে নিয়োজিত রেখে নারী জাতিকে এসব দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। আর নারীর ওপর পুরুষের জন্য শান্তিপূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশ সৃষ্টি করা, গর্ভে সন্তান ধারণ করা, সন্তান জন্ম দেওয়া, তাদের লালন-পালন করা, শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে আদর্শ নাগরিকরূপে গড়ে তোলা ইত্যাদির এক লম্বা ধারাবাহিক কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে একজন নারীর প্রধান কাজ ও প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীধর্ম ও মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা। এ গুরুদায়িত্বের ওপর যদি তার ওপর নিজের ভরণপোষণের জন্য এবং ছেলেমেয়েদের উপার্জনের প্রচণ্ড কষ্ট-ক্লেশের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে সেটা হবে নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, স্বামীর খেদমত করা, সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা, মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা নারীদের অবশ্যকর্তব্য। যেমন সন্তান গর্ভে ধারণ করা, তাদের সুশিক্ষা দান করা, তাদের চরিত্র গঠন করা ও ভবিষ্যৎ জীবনের উন্নতি সাধন করা ইত্যাদির জন্য নারী জাতিকে তিনি উৎসাহিত করেছেন। তা ছাড়া ঘর গোছানো, ঘর সাজানো, রান্নাবান্না করা, কাপড় সেলাই করা ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজের এত ব্যাপক দায়িত্ব প্রকৃতিগতভাবেই নারী জাতির ওপর ন্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে।

যা হোক, ইসলামে নারী জাতির মূল্য, সমাজে তাদের গুরুত্ব ও মানুষ হিসেবে তাদের কৃতকার্যতার পরিমাণ নির্ণয় করা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন নীতিতে। আর তা হলো খোদাভীতি ও তার আনুগত্য স্বীকার করা, স্বামীর প্রতি তার কর্তব্য পালন করা, সন্তান গর্ভে ধারণ করা, তাদের লালন-পালন ও শিক্ষাদীক্ষা দেওয়ার যেসব দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে, সেসব পূর্ণ করা।

লেখক : তালিবে ইলম ও প্রাবন্ধিক।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078