
কিশোর বয়স থেকেই আমার গুরুজনের নিকট থেকে জ্ঞানবিষয়ক শিক্ষা নেওয়ার একটা অদম্য ইচ্ছে। স্কুলের ক্লাসে অন্যদের তুলনায় ছোট ছিলাম। শিক্ষকের প্রতি যেমন সমীহবোধ ও শ্রদ্ধা ছিল, তেমনি তাঁদেরকে ভয় করতাম। অনেক প্রশ্ন করার ইচ্ছে থাকলেও টিচারদের মাইরের ভয়ে খুব একটা প্রশ্ন করতাম না। মা-বাবাকে তেমন ভয় লাগত না। বিশেষ করে, মাকে মনে হতো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। তাই যেকোনো কিছুর বেশি আবদার থাকত মায়ের কাছে। যখন যা কিছু দরকার পড়ত, মায়ের কাছে চাইলেই সেটির ব্যবস্থা হয়ে যেত।
বাবার নিকট থেকে ঠিকই মা সব ম্যানেজ করে দিতেন।
বাবা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাত দিতে নেই। প্রত্যেকের বিশ্বাসবোধ ও ভালোবাসার মূল্য আছে।’ সেই থেকে আমি পারতপক্ষে অন্যকে আঘাত দিই না। তাই অন্যের মতাদর্শ, ভালোবাসা, পছন্দ ও বিশ্বাসের ওপর খোঁচা দেওয়া (!) আমার স্বভাবের বাইরে। কেন যেন অন্যকে উত্ত্যক্ত করা একদম পছন্দ করি না। কারও মতের বেমিল ঘটতেই পারে। কিন্তু সেসব নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়ানো ঠিক নয়। বন্ধুদের সঙ্গে ছোটখাটো আপত্তি কিংবা প্রতিবাদ করেই ক্ষ্যান্ত থাকার চেষ্টা করি।
আমার বাবা পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে হজ করেছেন। তখন লটারির মাধ্যমে হজের যাত্রী বাছাই হতো। প্রথম বছর তিনি চান্স পেলেন না। পরের বছর বাবা লটারিতে (দ্বিতীয়বারে) জয়ী হয়েছিলেন। তখন উড়োজাহাজের চেয়ে স্টিমারেই বেশির ভাগ মানুষ হজে যেতেন। চট্টগ্রাম নৌবন্দর থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে মক্কায় যেতে হতো। হজ টিমের প্রতিটি জাহাজ সৌদি আরবের প্রধান নৌবন্দর জেদ্দায় নোঙর করত। জেদ্দা থেকে পবিত্র মক্কা, হজব্রত পালন সম্পন্ন করার পর পবিত্র মদিনা শরিফ জিয়ারত শেষে পুনরায় জেদ্দা থেকে দেশে ফেরা পর্যন্ত সব মিলিয়ে সময় লাগত তিন-চার মাস।
মনে আছে, বাবা যেদিন হজব্রত সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরে আসেন, সেদিন ছিল শুক্রবার। লোকে লোকারণ্য ছিল আমাদের বাড়ি। আগে বাবাকে যে রকম জামা-কাপড়ে দেখতাম, সেদিন ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য রকম। শুভ্র-শান্ত সৌম্য সুন্দর মুখাবয়ব। পরনে ধবধবে সাদা সৌদি পোশাক (পা পর্যন্ত লম্বা), মাথায় পাগড়ি ও হাজি রুমালে জড়ানো বাবাকে একনজর দেখে আমি তো অবাক। তাঁকে এমন অবস্থায় দেখে সতিই আমি অনেকটা ভীত এবং বিমোহিত। ছানাবড়া চোখে সব দিক থেকে দৃষ্টি লেগে আছে বাবার দিকে।
অনেক মানুষের সঙ্গে হিন্দুধর্মের কয়েকজন প্রিয় লোকও সেদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বাবা মক্কা শরিফ থেকে অনেক খোরমা-খেজুর ও জমজমের পানি নিয়ে এসেছিলেন। সেসব মূল্যবান বস্তু ও পানীয়ের গুরুত্ব তখন না বুঝতে না পারলেও আমি এখন তা বুঝতে পারছি। পবিত্র কাবাঘরের সন্নিকটস্থ জমজম পানির স্বাদ অপূর্ব, অন্য রকম। এই পানির টেস্ট নিয়ে পৃথিবীতে অনেক গবেষণা হয়েছে। এই পানি কোনো স্বাভাবিক পানীয়ের মতো নয়। জমজমের পানির গুরুত্ব পৃথিবীতে সর্বজনস্বীকৃত। সেই কারণে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও জমজমের পানির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানে। নিয়ত করে এই পানি পান করার পর অনেক কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য হওয়ার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। সেদিন আমাদের গ্রামের হিন্দুরাও বিশেষ ভক্তির সঙ্গে জমজমের পানি পান করেছিলেন। তারাও বিশ্বাস করেছেন, জমজমের পানি পৃথিবীর সাধারণ কোনো জল নয়। নিঃসন্দেহে এটি স্বর্গীয় জল।
তখন থেকেই কারও বিশ্বাসের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করিনি। আমাদের গ্রাম এবং বাজারের হিন্দুদের অনেক পূজা-পার্বণে যোগদান করেছি। পরবর্তী সময়ে ঢাকায়ও হিন্দু-বৌদ্ধদের অনুষ্ঠানে যোগদান করেছি। বাবা কখনো বাধা দেননি। মানুষের যেকোনো বিশ্বাসেরই মূল্য আছে। তাকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। বাবার প্রতি সেদিন মানুষের অসাধারণ ভক্তি, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বড় হওয়ার পর সেটি আরও বেশি উপলব্ধ হতে থাকে। একজন তীর্থভূমের মানুষকে কাছে পাওয়ার খুশিতে অনেকের আনন্দাশ্রু দেখে অবাক ও বিস্মিত হয়েছি।
মানুষের বিশ্বাসের মূল্য আছে। আমাদের উচিত অন্য যেকোনো মানুষের বিশ্বাসের দীপ্তি ও মতাদর্শের ওপর শ্রদ্ধাবোধ থাকা। আমার বাবা আলহাজ লুৎফর রহমান পণ্ডিত সেটি সারা জীবন রক্ষা করেছেন।
বাবার মুখে আরবদেশের কথা, মক্কা নগরের পবিত্র কাবাঘর, মদিনার মসজিদে নববির কত গল্প শুনেছি, তা শেষ করা যাবে না। জীবনের একটা সময় তিনি কথায় কথায় দ্বীন-ধর্মের কথা বলতেন। মানবধর্ম প্রদর্শন এবং মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও উপকারের কথা বলতেন।
পবিত্র মক্কা-মদিনার দীর্ঘ সফরের সময় তিনি ইসলামের ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেছেন। মক্কা ও মদিনার মরু অঞ্চল ও পাহাড়ের বর্ণনা করেছেন। পাহাড়ের কোলে ঘেঁষা খেজুর বাগান পরিদর্শন এবং গাছ থেকে সুমিষ্ট খোরমা-খেজুর ও জমজম পানি পান করার গল্প শুনেছি বাবার কাছে। মরুভূমির উট, দুম্বা, মেষ ও ছাগলের পাল মাঝে মাঝে শুকনো-সবুজ পাথরকুঞ্চিত পথপ্রান্তরের কথাও শুনেছি। আরও শুনেছি রুক্ষতামগ্ন মরুপ্রান্তর আর বহুবিচিত্র পর্বতশৃঙ্গ ও পাহাড়ের কথা।
ফিরে আসি তরুণতম ছাত্রজীবনের স্মৃতিতে। ছাত্রজীবনে বহির্বিশ্বে স্কলারশিপ নিয়ে যখন রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম, প্রথম সেমিস্টার নানা রকম টেনশন এবং পড়াশোনা ইত্যাদি চাপের মধ্যে কাটল। প্রথম সেমিস্টার শেষে তিন সপ্তাহের ছুটি পেলাম। শহরের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বন্ধুরা খবর পেয়ে দেখা করা ছিল ছুটির বিরাট অংশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কেউ কেউ ক্যাম্পাসে আসত। অনেক আনন্দ হতো। বন্ধুদের সঙ্গে কোলাহল উতরে আবার একা হয়ে যেতাম। তখনই মনে পড়ে যেত কৈশোরকাল। মা, মাটি, মানুষ ও সতত বয়ে চলা জন্মভূমির স্মৃতি। কোলাহলময় ঢাকা শহর, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের বৈচিত্র্যময় স্মৃতিগুলো মনের ভেতর তোলপাড় করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি অসম্ভব স্মৃতিকাতর। প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাওয়ার তীব্র টানে ঘুম হতো না। রুমমেট নাক ডেকে ঘুমাত। আমি মাঝরাতে ডানহিলের প্যাকেট নিয়ে টিভিরুমে চলে যেতাম।
অতীতের ফুলেভরা দিনগুলো সব সময় সঙ্গে নিয়েই কেটে গেল জীবনের পুরো সময়। বিদেশে মা ও বাবার জন্য মন কাঁদত। রিয়াদে যাওয়ার পর সৌদিদের আরব্য সংস্কৃতির মরুময়তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারতাম না। প্রবাসের আলো ঝলমল চকচকে পরিবেশ পেয়েও সর্বদা স্বদেশই আমার কাছে অর্থময়।
এরই মধ্যে প্রথম সেমিস্টার শেষে দুই সপ্তাহের ছুটি হলো। এই বন্ধে দেশে যাওয়া কঠিন। অন্য দেশে যাওয়ারও সুযোগ নেই। কেননা পাসপোর্ট ইউনিভার্সিটিতে। লোকাল রেসিডেন্সিয়াল কার্ডকে আরবিতে বলে আকামা। সেটি আরবের বৈধ কার্ড। সমগ্র সৌদি আরবের যেকোনো স্থানে সেটি চলে। অনেকে আরবের পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে নিকটজনের কাছে যান। কেউ যান আবার মক্কা-মদিনা জিয়ারতে।
আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ১০ দিনের জন্য মক্কা-মদিনায় যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম। পবিত্র মক্কায় ওমরাহ পালন শেষে মদিনা শরিফ জিয়ারত করার পর রিয়াদে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমার রুমমেট ছিল সৌদি। নাম আবদুল্লাহ আল শেহরি। তার বাড়ি রিয়াদ শহর থেকে ৭০০ মাইল দূরের আল-কাসিম শহরে। বন্ধুবর আমির খসরু, আবু জাফর ত্বোহা আরও কয়েকজন ছাত্র ভিন্নভাবে সেখানে গিয়েছে এবং মক্কায় তাদের সঙ্গে আমাদেরও দেখা হয়েছে। সেই বন্ধে চার দিন হোটেলে ছিলাম। বাকি দুই দিন ছিলাম মক্কার উম্মুল ক্বোরা ইউনিভার্সিটিতে। উদ্দেশ্য, ওখানকার বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখা। পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত ক্যাম্পাস থেকে পবিত্র হেরা পর্বতসহ কয়েকটি ঐতিহাসিক পাহাড় কাছাকাছি। আমি কৌতূহলে পাহাড়ের সঙ্গে সখ্যের স্বপ্নে বিভোর।
আরবের পথে-প্রান্তরে পাহাড়ের অভাব নেই। যেখানেই যাই পাহাড় থাকবেই। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ যেমন সবুজে আকীর্ণ ছায়াঘেরা সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সহজ-সরল মাটি ও মানুষের দেশ, আর পাহাড়ের বিষয় এলে নয়নাভিরাম পার্বত্য চট্টগ্রামের স্মৃতি তো মনে পড়বেই। এ ছাড়া গ্রাম-বাংলার বৈচিত্র্য মনোহর গাছগাছালিময় বনভূমি, মাঠঘাট, নদী-নালার অপূর্ব দৃশ্য নিত্যকার খেলায় মগ্ন থাকে। তেমনি মরুর দেশ সৌদি আরবকেও পাহাড় ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আরবের পথ-ঘাট হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য মাথায় নিয়ে আরবদেশগুলো টিকে আছে। দিন যত যায়, ততই সৌদিতে বসবাসকারীকে পাহাড় টানবেই। পাহাড়ের টানে আমার ভেতর কেমন যেন উন্মাদনা ও ব্যাকুলতা।
আশির দশকের তরুণতম সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। সে সময় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ছাড়াও মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি এলাকা এবং বান্দরবানের বনজ স্রোতস্বিনীর অপার সৌন্দর্য দেখেছি। পাহাড়ের কোলে কোলে বিচিত্র বনভূমির দ্যোতনা পর্যবেক্ষণ করেছি। পার্বত্য অঞ্চলের ঝার-ঝরনার নিয়ত লীলাভূমির মঠ-আশ্রমের কত রকমের দৃশ্যপট অবলোকন করেছি। বাংলাদেশে আমাদের পাহাড়গুলো মাটির স্তূপের সদাহাস্যে হরিৎবর্ণ এবং সবুজে আকীর্ণ দণ্ডায়মান। শ্যামলীময়তার রূপে তারা জঙ্গলাকীর্ণের লতাপাতায় জড়ানো থাকতে অভ্যস্ত। পাহাড়ের কোলে বিছানো মাটির চাদরে শুধু সবুজের ছড়াছড়ি। সর্বত্র লতাগুল্ম, ঘাসপাতা, চাষের জমি, গাছগাছালির অনিন্দ্যসুন্দর পরিবেশ। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও পাহাড়ধসে ঢলে পড়ে ধবংসস্তূপের রূপ নিয়ে অনেকের জীবনসংহারও করে ফেলে।
কিন্তু আরবের পাহাড় বাংলাদেশের পাহাড়ের মতো নয়। আরবদেশের পাহাড়গুলো সর্বত্র ছড়ানো হাজার বছরের কিংবদন্তি হয়ে দণ্ডায়মান। মক্কা-মদিনার পাহাড়গুলো অচঞ্চল। রুক্ষতার কাঠিন্যের মতো স্থিরকায় দণ্ডায়মান। ভয়াবহ গরমের গা পোড়ানো উত্তপ্ততায় যেন তপ্তরোদের ক্রুদ্ধতার মতো খাঁ খাঁ করে। শত সহস্র বছর ধরে দণ্ডায়মান উঁচু পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে নগরায়ণের আওতায় কিংবা শহরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য অথবা ভূমি সম্প্রসারণের উন্মাদনায় সৌদি সরকার নির্দয়ভাবে সে দেশের পাহাড়গুলোকে ধূলিসাৎ করছে। কোথাও কোথাও পাহাড়ের গা কেটে রাস্তা ও সড়ক বের করা হয়েছে। কোথাও শহরের শোভাবর্ধনে মক্কা ও মদিনার অনেক ঐতিহাসিক পাহাড় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আঁকাবাঁকা পথ আর যানবাহন-বাহিত সড়ক মিশে গেছে মহাসড়কে।
এমনই সব পাহাড়-পর্বতের কোলে কোলে স্নিগ্ধ সকালের সন্ধ্যার গোধূলিতে সুবর্ণরেখার রূপ যেমন পাগল করে তোলে, তেমনি মনের ভেতরকার সকল কষ্ট ও উত্তাপকে শীতল করে দেয়। সতেজ ও সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে হৃদয়ের আঙিনা। যেদিকে চোখ যায়, নীলাভ আকাশতলের স্তরে স্তরে পর্বতমালার নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলির অত্যাশ্চর্য মুগ্ধতার অপূর্ব আকর্ষণ ছড়ানো। বিকেলের মায়াজড়ানো রাঙারোদের ছায়ায় ছায়ায় গা পোড়ানো গরমের উত্তাপও যেন সুন্দরের মায়াময়তায়।
আমার কাছে সেসব আকর্ষণ দুর্নিবার। মরুর নিষিক্ত অঞ্চলের বাঁকে বাঁকে চিরায়ত খেজুর বাগানের দৃশ্যাবলি ও মাঝে মাঝে সবুজের আভরণ যেন বাংলাদেশের শ্যামল রূপের স্নিগ্ধ ছোঁয়ার গন্ধ পাই।
পাহাড়ের প্রতি যাদের টান আছে, তারা অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলে পর্বতমালার দেশ সৌদি আরবের মরু অঞ্চল ও পাহাড়গুলো সে রকম নয়। সন্ধ্যার গোধূলি কিংবা ভোরের স্নিগ্ধালোকের পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি আমার কাছে অন্য রকম মনে হয়। ওইসব পাহাড়ের নয়নজুড়ানো দৃশ্যপট সাতসকালে দেখা যায় ভোরের হিমেলছায়-নরম আলোয় ঝলকিত। খরদুপুরে তাতানো রোদে সূর্যালোকের প্রখরতায় হাতছোঁয়ানো মরুপ্রান্তর। স্নিগ্ধ সকালের রোদের ঝিলিক। পাহাড় বেয়ে ভূতলের কোলঘেঁষা তার হরিৎছায়া। আর দিবসের সুঠাম সূর্য তার সকল উত্তপ্ততার অবসান ঘটিয়ে যখন অস্তপ্রায়, অস্তমিত সূর্যের লালচে আভায় গোধূলিময় সন্ধ্যায় মমতার মাখামাখি। মমতার পরশ ছুঁয়ে রাত আসে।
মক্কার আজিজিয়া সড়ক পেরিয়ে পর্বতঘেরা শুষ্ক-শুকনো পথ বেয়ে আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখছি। বিচিত্র লীলাভূমি আরবের পথ-প্রান্তর। ছোট-বড় কালো পাথর মাঝে মাঝে বিরাটকায় আস্ত পাথরের টিলা। সকালের মিষ্টি রোদ হরিৎরাঙানো বেলাভূমি আর মরুর হাওয়াখচিত দৃশ্য দেখে প্রাচীন আরবের প্রেমে কবি ইমরুল কায়েসের দুটি লাইন মনে পড়ছে-
‘যে টিলার উপর
উত্তরের বায়ু ও বাতায়ন
স্তরে স্তরে বালির স্তর
দক্ষিণা বায়ু সেইসব কৃত্রিম মুছে
নিয়ে যায় পুরোনো স্মৃতির নিকট আঁধারে।’
উম্মুল কোরা ক্যাফেটরিয়া থেকে আমরা সকালের নাশতা সেরে নিয়েছি। সেখান থেকে ১৫ মিনিটের ড্রাইভ। এতক্ষণে অনেক পাহাড়-পর্বত ছাড়িয়ে আমরা হেরা পর্বতের কাছে চলে এসেছি। কাছে মনে হলেও আসলে কাছে নয়।
পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট টোল ও চায়ের দোকান আছে। সেখানে আমরা কফি পান করে নিলাম। সৌদি আরবে কফির স্বাদ অন্য রকম। ব্ল্যাক কপি ছাড়াও সৌদিদের প্রিয় কফি কাহওয়া। অনেকটা গ্রিন টির কালার। একটি ইয়েমেনি চায়ের দোকানে চিকেন স্যান্ডউইচ ও কফি পান করলাম।
অতঃপর চললাম হেরা পর্বতের দিকে। বিশ্বনবীর (দ.) ধ্যানমগ্নতার সেই ঐতিহাসিক হেরা পর্বতের নুরের আলো যেন সবাইকে টানছে! শুধু আমরাই নই, অন্য দেশের লোকেরাও রয়েছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন দেশের দর্শনার্থীরা হেরা পর্বতের উচ্চ শিখরের সেই ঐতিহাসিক গুহায় আরোহণ করে থাকেন। পাহাড়ের পাদদেশ আর উপত্যকার কোলে কোলে দূর্বা-ধুবলা-লতাপাতার ছিটেফোঁটা চড়ে বেড়ানো মেষপালের চিরায়ত দৃশ্য। রৌদ্রপ্রখর পর্বতাঞ্চল আর পাহাড়ের কোলে বিরাজ করে ধর্মবিশ্বাসের লীলায়িত ছায়াপথ ও স্নিগ্ধ বিশ্বাসের শরণ। যেখানে রয়েছে চিরায়ত সৌন্দর্যের স্বর্গীয় মুগ্ধতা। আরও আছে হৃদয়সিক্ত মোহময়তা, পরিতৃপ্তি ও আনন্দের ফল্গুধারা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।
বাবার নিকট থেকে ঠিকই মা সব ম্যানেজ করে দিতেন।
বাবা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষের বিশ্বাসের ওপর আঘাত দিতে নেই। প্রত্যেকের বিশ্বাসবোধ ও ভালোবাসার মূল্য আছে।’ সেই থেকে আমি পারতপক্ষে অন্যকে আঘাত দিই না। তাই অন্যের মতাদর্শ, ভালোবাসা, পছন্দ ও বিশ্বাসের ওপর খোঁচা দেওয়া (!) আমার স্বভাবের বাইরে। কেন যেন অন্যকে উত্ত্যক্ত করা একদম পছন্দ করি না। কারও মতের বেমিল ঘটতেই পারে। কিন্তু সেসব নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়ানো ঠিক নয়। বন্ধুদের সঙ্গে ছোটখাটো আপত্তি কিংবা প্রতিবাদ করেই ক্ষ্যান্ত থাকার চেষ্টা করি।
আমার বাবা পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে হজ করেছেন। তখন লটারির মাধ্যমে হজের যাত্রী বাছাই হতো। প্রথম বছর তিনি চান্স পেলেন না। পরের বছর বাবা লটারিতে (দ্বিতীয়বারে) জয়ী হয়েছিলেন। তখন উড়োজাহাজের চেয়ে স্টিমারেই বেশির ভাগ মানুষ হজে যেতেন। চট্টগ্রাম নৌবন্দর থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে মক্কায় যেতে হতো। হজ টিমের প্রতিটি জাহাজ সৌদি আরবের প্রধান নৌবন্দর জেদ্দায় নোঙর করত। জেদ্দা থেকে পবিত্র মক্কা, হজব্রত পালন সম্পন্ন করার পর পবিত্র মদিনা শরিফ জিয়ারত শেষে পুনরায় জেদ্দা থেকে দেশে ফেরা পর্যন্ত সব মিলিয়ে সময় লাগত তিন-চার মাস।
মনে আছে, বাবা যেদিন হজব্রত সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরে আসেন, সেদিন ছিল শুক্রবার। লোকে লোকারণ্য ছিল আমাদের বাড়ি। আগে বাবাকে যে রকম জামা-কাপড়ে দেখতাম, সেদিন ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য রকম। শুভ্র-শান্ত সৌম্য সুন্দর মুখাবয়ব। পরনে ধবধবে সাদা সৌদি পোশাক (পা পর্যন্ত লম্বা), মাথায় পাগড়ি ও হাজি রুমালে জড়ানো বাবাকে একনজর দেখে আমি তো অবাক। তাঁকে এমন অবস্থায় দেখে সতিই আমি অনেকটা ভীত এবং বিমোহিত। ছানাবড়া চোখে সব দিক থেকে দৃষ্টি লেগে আছে বাবার দিকে।
অনেক মানুষের সঙ্গে হিন্দুধর্মের কয়েকজন প্রিয় লোকও সেদিন বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বাবা মক্কা শরিফ থেকে অনেক খোরমা-খেজুর ও জমজমের পানি নিয়ে এসেছিলেন। সেসব মূল্যবান বস্তু ও পানীয়ের গুরুত্ব তখন না বুঝতে না পারলেও আমি এখন তা বুঝতে পারছি। পবিত্র কাবাঘরের সন্নিকটস্থ জমজম পানির স্বাদ অপূর্ব, অন্য রকম। এই পানির টেস্ট নিয়ে পৃথিবীতে অনেক গবেষণা হয়েছে। এই পানি কোনো স্বাভাবিক পানীয়ের মতো নয়। জমজমের পানির গুরুত্ব পৃথিবীতে সর্বজনস্বীকৃত। সেই কারণে অন্য ধর্মের অনুসারীরাও জমজমের পানির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানে। নিয়ত করে এই পানি পান করার পর অনেক কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য হওয়ার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। সেদিন আমাদের গ্রামের হিন্দুরাও বিশেষ ভক্তির সঙ্গে জমজমের পানি পান করেছিলেন। তারাও বিশ্বাস করেছেন, জমজমের পানি পৃথিবীর সাধারণ কোনো জল নয়। নিঃসন্দেহে এটি স্বর্গীয় জল।
তখন থেকেই কারও বিশ্বাসের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করিনি। আমাদের গ্রাম এবং বাজারের হিন্দুদের অনেক পূজা-পার্বণে যোগদান করেছি। পরবর্তী সময়ে ঢাকায়ও হিন্দু-বৌদ্ধদের অনুষ্ঠানে যোগদান করেছি। বাবা কখনো বাধা দেননি। মানুষের যেকোনো বিশ্বাসেরই মূল্য আছে। তাকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। বাবার প্রতি সেদিন মানুষের অসাধারণ ভক্তি, শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বড় হওয়ার পর সেটি আরও বেশি উপলব্ধ হতে থাকে। একজন তীর্থভূমের মানুষকে কাছে পাওয়ার খুশিতে অনেকের আনন্দাশ্রু দেখে অবাক ও বিস্মিত হয়েছি।
মানুষের বিশ্বাসের মূল্য আছে। আমাদের উচিত অন্য যেকোনো মানুষের বিশ্বাসের দীপ্তি ও মতাদর্শের ওপর শ্রদ্ধাবোধ থাকা। আমার বাবা আলহাজ লুৎফর রহমান পণ্ডিত সেটি সারা জীবন রক্ষা করেছেন।
বাবার মুখে আরবদেশের কথা, মক্কা নগরের পবিত্র কাবাঘর, মদিনার মসজিদে নববির কত গল্প শুনেছি, তা শেষ করা যাবে না। জীবনের একটা সময় তিনি কথায় কথায় দ্বীন-ধর্মের কথা বলতেন। মানবধর্ম প্রদর্শন এবং মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও উপকারের কথা বলতেন।
পবিত্র মক্কা-মদিনার দীর্ঘ সফরের সময় তিনি ইসলামের ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করেছেন। মক্কা ও মদিনার মরু অঞ্চল ও পাহাড়ের বর্ণনা করেছেন। পাহাড়ের কোলে ঘেঁষা খেজুর বাগান পরিদর্শন এবং গাছ থেকে সুমিষ্ট খোরমা-খেজুর ও জমজম পানি পান করার গল্প শুনেছি বাবার কাছে। মরুভূমির উট, দুম্বা, মেষ ও ছাগলের পাল মাঝে মাঝে শুকনো-সবুজ পাথরকুঞ্চিত পথপ্রান্তরের কথাও শুনেছি। আরও শুনেছি রুক্ষতামগ্ন মরুপ্রান্তর আর বহুবিচিত্র পর্বতশৃঙ্গ ও পাহাড়ের কথা।
ফিরে আসি তরুণতম ছাত্রজীবনের স্মৃতিতে। ছাত্রজীবনে বহির্বিশ্বে স্কলারশিপ নিয়ে যখন রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম, প্রথম সেমিস্টার নানা রকম টেনশন এবং পড়াশোনা ইত্যাদি চাপের মধ্যে কাটল। প্রথম সেমিস্টার শেষে তিন সপ্তাহের ছুটি পেলাম। শহরের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বন্ধুরা খবর পেয়ে দেখা করা ছিল ছুটির বিরাট অংশ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কেউ কেউ ক্যাম্পাসে আসত। অনেক আনন্দ হতো। বন্ধুদের সঙ্গে কোলাহল উতরে আবার একা হয়ে যেতাম। তখনই মনে পড়ে যেত কৈশোরকাল। মা, মাটি, মানুষ ও সতত বয়ে চলা জন্মভূমির স্মৃতি। কোলাহলময় ঢাকা শহর, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের বৈচিত্র্যময় স্মৃতিগুলো মনের ভেতর তোলপাড় করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি অসম্ভব স্মৃতিকাতর। প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাওয়ার তীব্র টানে ঘুম হতো না। রুমমেট নাক ডেকে ঘুমাত। আমি মাঝরাতে ডানহিলের প্যাকেট নিয়ে টিভিরুমে চলে যেতাম।
অতীতের ফুলেভরা দিনগুলো সব সময় সঙ্গে নিয়েই কেটে গেল জীবনের পুরো সময়। বিদেশে মা ও বাবার জন্য মন কাঁদত। রিয়াদে যাওয়ার পর সৌদিদের আরব্য সংস্কৃতির মরুময়তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারতাম না। প্রবাসের আলো ঝলমল চকচকে পরিবেশ পেয়েও সর্বদা স্বদেশই আমার কাছে অর্থময়।
এরই মধ্যে প্রথম সেমিস্টার শেষে দুই সপ্তাহের ছুটি হলো। এই বন্ধে দেশে যাওয়া কঠিন। অন্য দেশে যাওয়ারও সুযোগ নেই। কেননা পাসপোর্ট ইউনিভার্সিটিতে। লোকাল রেসিডেন্সিয়াল কার্ডকে আরবিতে বলে আকামা। সেটি আরবের বৈধ কার্ড। সমগ্র সৌদি আরবের যেকোনো স্থানে সেটি চলে। অনেকে আরবের পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে নিকটজনের কাছে যান। কেউ যান আবার মক্কা-মদিনা জিয়ারতে।
আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ১০ দিনের জন্য মক্কা-মদিনায় যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম। পবিত্র মক্কায় ওমরাহ পালন শেষে মদিনা শরিফ জিয়ারত করার পর রিয়াদে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আমার রুমমেট ছিল সৌদি। নাম আবদুল্লাহ আল শেহরি। তার বাড়ি রিয়াদ শহর থেকে ৭০০ মাইল দূরের আল-কাসিম শহরে। বন্ধুবর আমির খসরু, আবু জাফর ত্বোহা আরও কয়েকজন ছাত্র ভিন্নভাবে সেখানে গিয়েছে এবং মক্কায় তাদের সঙ্গে আমাদেরও দেখা হয়েছে। সেই বন্ধে চার দিন হোটেলে ছিলাম। বাকি দুই দিন ছিলাম মক্কার উম্মুল ক্বোরা ইউনিভার্সিটিতে। উদ্দেশ্য, ওখানকার বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখা। পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত ক্যাম্পাস থেকে পবিত্র হেরা পর্বতসহ কয়েকটি ঐতিহাসিক পাহাড় কাছাকাছি। আমি কৌতূহলে পাহাড়ের সঙ্গে সখ্যের স্বপ্নে বিভোর।
আরবের পথে-প্রান্তরে পাহাড়ের অভাব নেই। যেখানেই যাই পাহাড় থাকবেই। আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ যেমন সবুজে আকীর্ণ ছায়াঘেরা সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সহজ-সরল মাটি ও মানুষের দেশ, আর পাহাড়ের বিষয় এলে নয়নাভিরাম পার্বত্য চট্টগ্রামের স্মৃতি তো মনে পড়বেই। এ ছাড়া গ্রাম-বাংলার বৈচিত্র্য মনোহর গাছগাছালিময় বনভূমি, মাঠঘাট, নদী-নালার অপূর্ব দৃশ্য নিত্যকার খেলায় মগ্ন থাকে। তেমনি মরুর দেশ সৌদি আরবকেও পাহাড় ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আরবের পথ-ঘাট হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য মাথায় নিয়ে আরবদেশগুলো টিকে আছে। দিন যত যায়, ততই সৌদিতে বসবাসকারীকে পাহাড় টানবেই। পাহাড়ের টানে আমার ভেতর কেমন যেন উন্মাদনা ও ব্যাকুলতা।
আশির দশকের তরুণতম সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। সে সময় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ছাড়াও মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি এলাকা এবং বান্দরবানের বনজ স্রোতস্বিনীর অপার সৌন্দর্য দেখেছি। পাহাড়ের কোলে কোলে বিচিত্র বনভূমির দ্যোতনা পর্যবেক্ষণ করেছি। পার্বত্য অঞ্চলের ঝার-ঝরনার নিয়ত লীলাভূমির মঠ-আশ্রমের কত রকমের দৃশ্যপট অবলোকন করেছি। বাংলাদেশে আমাদের পাহাড়গুলো মাটির স্তূপের সদাহাস্যে হরিৎবর্ণ এবং সবুজে আকীর্ণ দণ্ডায়মান। শ্যামলীময়তার রূপে তারা জঙ্গলাকীর্ণের লতাপাতায় জড়ানো থাকতে অভ্যস্ত। পাহাড়ের কোলে বিছানো মাটির চাদরে শুধু সবুজের ছড়াছড়ি। সর্বত্র লতাগুল্ম, ঘাসপাতা, চাষের জমি, গাছগাছালির অনিন্দ্যসুন্দর পরিবেশ। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও পাহাড়ধসে ঢলে পড়ে ধবংসস্তূপের রূপ নিয়ে অনেকের জীবনসংহারও করে ফেলে।
কিন্তু আরবের পাহাড় বাংলাদেশের পাহাড়ের মতো নয়। আরবদেশের পাহাড়গুলো সর্বত্র ছড়ানো হাজার বছরের কিংবদন্তি হয়ে দণ্ডায়মান। মক্কা-মদিনার পাহাড়গুলো অচঞ্চল। রুক্ষতার কাঠিন্যের মতো স্থিরকায় দণ্ডায়মান। ভয়াবহ গরমের গা পোড়ানো উত্তপ্ততায় যেন তপ্তরোদের ক্রুদ্ধতার মতো খাঁ খাঁ করে। শত সহস্র বছর ধরে দণ্ডায়মান উঁচু পাহাড় ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে নগরায়ণের আওতায় কিংবা শহরের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য অথবা ভূমি সম্প্রসারণের উন্মাদনায় সৌদি সরকার নির্দয়ভাবে সে দেশের পাহাড়গুলোকে ধূলিসাৎ করছে। কোথাও কোথাও পাহাড়ের গা কেটে রাস্তা ও সড়ক বের করা হয়েছে। কোথাও শহরের শোভাবর্ধনে মক্কা ও মদিনার অনেক ঐতিহাসিক পাহাড় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আঁকাবাঁকা পথ আর যানবাহন-বাহিত সড়ক মিশে গেছে মহাসড়কে।
এমনই সব পাহাড়-পর্বতের কোলে কোলে স্নিগ্ধ সকালের সন্ধ্যার গোধূলিতে সুবর্ণরেখার রূপ যেমন পাগল করে তোলে, তেমনি মনের ভেতরকার সকল কষ্ট ও উত্তাপকে শীতল করে দেয়। সতেজ ও সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে হৃদয়ের আঙিনা। যেদিকে চোখ যায়, নীলাভ আকাশতলের স্তরে স্তরে পর্বতমালার নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলির অত্যাশ্চর্য মুগ্ধতার অপূর্ব আকর্ষণ ছড়ানো। বিকেলের মায়াজড়ানো রাঙারোদের ছায়ায় ছায়ায় গা পোড়ানো গরমের উত্তাপও যেন সুন্দরের মায়াময়তায়।
আমার কাছে সেসব আকর্ষণ দুর্নিবার। মরুর নিষিক্ত অঞ্চলের বাঁকে বাঁকে চিরায়ত খেজুর বাগানের দৃশ্যাবলি ও মাঝে মাঝে সবুজের আভরণ যেন বাংলাদেশের শ্যামল রূপের স্নিগ্ধ ছোঁয়ার গন্ধ পাই।
পাহাড়ের প্রতি যাদের টান আছে, তারা অন্তর্দৃষ্টিতে দেখলে পর্বতমালার দেশ সৌদি আরবের মরু অঞ্চল ও পাহাড়গুলো সে রকম নয়। সন্ধ্যার গোধূলি কিংবা ভোরের স্নিগ্ধালোকের পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি আমার কাছে অন্য রকম মনে হয়। ওইসব পাহাড়ের নয়নজুড়ানো দৃশ্যপট সাতসকালে দেখা যায় ভোরের হিমেলছায়-নরম আলোয় ঝলকিত। খরদুপুরে তাতানো রোদে সূর্যালোকের প্রখরতায় হাতছোঁয়ানো মরুপ্রান্তর। স্নিগ্ধ সকালের রোদের ঝিলিক। পাহাড় বেয়ে ভূতলের কোলঘেঁষা তার হরিৎছায়া। আর দিবসের সুঠাম সূর্য তার সকল উত্তপ্ততার অবসান ঘটিয়ে যখন অস্তপ্রায়, অস্তমিত সূর্যের লালচে আভায় গোধূলিময় সন্ধ্যায় মমতার মাখামাখি। মমতার পরশ ছুঁয়ে রাত আসে।
মক্কার আজিজিয়া সড়ক পেরিয়ে পর্বতঘেরা শুষ্ক-শুকনো পথ বেয়ে আমরা পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখছি। বিচিত্র লীলাভূমি আরবের পথ-প্রান্তর। ছোট-বড় কালো পাথর মাঝে মাঝে বিরাটকায় আস্ত পাথরের টিলা। সকালের মিষ্টি রোদ হরিৎরাঙানো বেলাভূমি আর মরুর হাওয়াখচিত দৃশ্য দেখে প্রাচীন আরবের প্রেমে কবি ইমরুল কায়েসের দুটি লাইন মনে পড়ছে-
‘যে টিলার উপর
উত্তরের বায়ু ও বাতায়ন
স্তরে স্তরে বালির স্তর
দক্ষিণা বায়ু সেইসব কৃত্রিম মুছে
নিয়ে যায় পুরোনো স্মৃতির নিকট আঁধারে।’
উম্মুল কোরা ক্যাফেটরিয়া থেকে আমরা সকালের নাশতা সেরে নিয়েছি। সেখান থেকে ১৫ মিনিটের ড্রাইভ। এতক্ষণে অনেক পাহাড়-পর্বত ছাড়িয়ে আমরা হেরা পর্বতের কাছে চলে এসেছি। কাছে মনে হলেও আসলে কাছে নয়।
পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট টোল ও চায়ের দোকান আছে। সেখানে আমরা কফি পান করে নিলাম। সৌদি আরবে কফির স্বাদ অন্য রকম। ব্ল্যাক কপি ছাড়াও সৌদিদের প্রিয় কফি কাহওয়া। অনেকটা গ্রিন টির কালার। একটি ইয়েমেনি চায়ের দোকানে চিকেন স্যান্ডউইচ ও কফি পান করলাম।
অতঃপর চললাম হেরা পর্বতের দিকে। বিশ্বনবীর (দ.) ধ্যানমগ্নতার সেই ঐতিহাসিক হেরা পর্বতের নুরের আলো যেন সবাইকে টানছে! শুধু আমরাই নই, অন্য দেশের লোকেরাও রয়েছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন দেশের দর্শনার্থীরা হেরা পর্বতের উচ্চ শিখরের সেই ঐতিহাসিক গুহায় আরোহণ করে থাকেন। পাহাড়ের পাদদেশ আর উপত্যকার কোলে কোলে দূর্বা-ধুবলা-লতাপাতার ছিটেফোঁটা চড়ে বেড়ানো মেষপালের চিরায়ত দৃশ্য। রৌদ্রপ্রখর পর্বতাঞ্চল আর পাহাড়ের কোলে বিরাজ করে ধর্মবিশ্বাসের লীলায়িত ছায়াপথ ও স্নিগ্ধ বিশ্বাসের শরণ। যেখানে রয়েছে চিরায়ত সৌন্দর্যের স্বর্গীয় মুগ্ধতা। আরও আছে হৃদয়সিক্ত মোহময়তা, পরিতৃপ্তি ও আনন্দের ফল্গুধারা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।