
শুনেছি, ভিতুরাই বোকার মতো সাহসী কাজ করে। যেমন আমি। আমি জীবনে অনেক সাহসী কাজ করেছি। যেমন একদিন কিছু না বুঝেই বরিশাল ছেড়ে ঢাকা পাড়ি জমিয়েছিলাম। জানি কয়েক দিন পরই আবার ফিরে যেতে হবে। কিন্তু না। ফিরিনি। সাহস করে ঢাকায় থেকে গিয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। পকেটে চলার মতো পয়সা নেই। কারণ বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা নিই না। সাহস করে একদিন বিচিত্রার মতো ডাকসাইটে এক পত্রিকা অফিসে ঢুকে পড়লাম। বোকা না হলে মফস্বল থেকে আসা কোনো ভিতু যুবকের ওই অফিসে ঢোকার কথা নয়। সেখানে কাজের সুযোগ হলো। কারণ লেখালেখির অভ্যাস আমার আগে থেকেই ছিল। তারপর একদিন জেসমিন নামের এক রূপসী কন্যার সঙ্গে ক্যাম্পাসে সখ্য হয়ে গেল। সেই কাহিনি সিনেমাতেই সম্ভব। সাহস করে একদিন বিয়ের পিঁড়িতেও বসলাম, তখন আয়-ইনকাম নেই। বিয়ে করেছি টাকা-পয়সা ধার করে। স্ত্রীকে কিছুই তেমন দিতে পারিনি বিয়েতে। কম দামি দুটি শাড়ি, একটি আংটি। দুই সন্তানের পিতাও হলাম একদিন। অসাধারণ দুই সন্তান। তারপর একদিন সাহসে ভর করে চাকরি-বাকরি ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমালাম। ছেলেমেয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি, ঘটা করে বিয়েশাদি করল। এখন আবার সাহস করে ফিরতে চাই যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। ভিতু হলেও এ রকম সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে না।
আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। প্রতিবার মনে হয়েছে আমি হারিয়ে যাব। ভয়ে তটস্থ থাকি। ভয়-ডরের মধ্যেই আমার বসবাস। এসব আমি এনজয় করি। জীবনের সবটুকু দুঃখের না, জীবনের সবটুকু সুখেরও না। তবে জীবনে সুখের ভাগটাই বেশি, সুখের স্মৃতিও বেশি। দুঃখ বা কষ্ট যেটুকু আছে, সেটুকু সুখের স্মৃতি দিয়ে ঢেকে দিলেই হয়। অনেক সুখস্মৃতি মানুষের জীবনে আছে। তাই দুঃখ-কষ্ট নিয়ে এত আদিখ্যেতা করারই-বা কী আছে! সুখ যেমন অন্যকে আন্দোলিত করে, তেমনি দুঃখ অন্যকে বিচলিত করে। আবার সুখ যেমন প্রয়োজন আছে, দুঃখেরও প্রয়োজন আছে। দুঃখ জীবনের উত্তাল তরঙ্গকে স্তিমিত করতে পারে না। তাই হাসার স্বাধীনতা যেমন থাকতে হয়, তেমনি কান্নার স্বাধীনতাও থাকতে হয়।
আমি জানি, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে লড়াই থাকে, সংগ্রাম থাকে। বাঁচার জন্য লড়াই, সংসারের জন্য লড়াই, প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই, সাফল্য লাভের জন্য লড়াই। তেমনি দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে লড়াই, অসুখ-বিসুখের সঙ্গে লড়াই। লড়াই না থাকলে জীবন হতো পানসে। আমি আমার শৈশবকাল থেকেই লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষ। যদিও আমি একটু দুর্বল চিত্তের। কিন্তু বাস্তবে আমি সমুদ্রে সাঁতার কেটে তীরে ওঠা মানুষ। আমার লড়াইটা তেমন দৃশ্যমান নয়। ওটাকে আমি জীবনের অংশ বলে মনে করি। তাই জীবনের সুখ যতটুকু আমাকে আন্দোলিত করে, দুঃখও ঠিক ততটুকু বিচলিত করে। আমি আবেগপ্রবণ বলে কষ্টটাকে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করি। কিন্তু সুখটাকে একটু ঢেকে রাখি। আমি আসলে ভালোবাসার কাঙাল। মনে রাখুন জীবন অনেক সুন্দর। জীবনে যেটুকু সুখ পেয়েছেন, যেটুকু দুঃখ পেয়েছেন, যেটুকু অসুখে ভুগেছেন, ততটুকুই পাওয়ার কথা ছিল। এর বেশিও না, কমও না। তাই ওসব নিয়ে বিচলিত না হয়ে সহজভাবে নেওয়াই ভালো। মৃত্যু একবারই হবে। একটি মহান ঘুমের বেশি কিছু না। আমি আমার কষ্টের দিনগুলোতে প্রতিবার অনুভব করি, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই ভালো, অনন্য। মানুষের কোনো তুলনা নেই। মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমার কি কোনো দুঃখ আছে! মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমি কি সুখী! আমি আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমানের দিনগুলোর তুলনা করি এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এই দুইয়ের মাঝে মধ্যবর্তী যে জীবন ছিল আমার; সেখানে অভাব, অনটন, লড়াই, সংগ্রাম, অপমান, অবহেলা, আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না সব ছিল। কী ছিল না সেই জীবনে! সবই ছিল। সেসবেরও ব্যবচ্ছেদ করি। সুখ বা দুঃখ কোনোটাই নিরবচ্ছিন্ন নয় জীবনে। দুটোই জীবনের অংশ। তাই জীবনের বঞ্চনাগুলো নিয়ে আমি কখনো নিজেকে দুঃখিত করে তুলিনি। ভারাক্রান্ত হইনি। নির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী করিনি। বরং আমি যে এখন নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি, সে জন্য নেপথ্যের মানুষগুলোর প্রতি অবনতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই। যারা আমাকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবেসেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, পাশে থেকেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের প্রতি আমার একবুক ভালোবাসা সব সময়। এখনো যারা আমার প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়ায়, ভালোবাসে, মাথায় হাত রাখে, তাদের স্পর্শ আমার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। বাঁচতে শেখায়।
একবার এক ঈদে আমার নতুন জামা ছিল না। পুরোনো জামা ধুয়ে মা ইস্ত্রি করে দিয়েছিল। বাড়ির সবাই নতুন জামা পরে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছে। আমি পুরোনো জামা পরেছি, তাও আমার মনে কষ্ট হয়নি। মা বলেছিল, কষ্ট পেয়ো না। তোমার জন্য দোয়া করি, একদিন তুমি অনেক জামা পরতে পারবে। আমার ছেলেমেয়েরা যে আমাকে এত এত জামা-কাপড় গিফট দেয়, অনেক প্যাকেট দুই বছরেও খোলা হয়নি আমার। যখন ঢাকা শহরে আমার থাকার জায়গা ছিল না, খাওয়ার পয়সা ছিল না, তখন যারা আমার পাশে থেকেছিল, আমি তাদের কথা কী করে ভুলি! প্রথম দিন যে বন্ধুর জামা পরে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার কথা কি ভোলা যায়! বিয়ের সময় যে বন্ধুরা বিভিন্নভাবে হেল্প করেছিল, তারাও থাকে হৃদয়ের গভীরে। এমনই অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে এক জীবনে। ব্যক্তি জড়িয়ে থাকে, ঘটনা জড়িয়ে থাকে। সেখানে বঞ্চনা আর অপমান যেমন থাকে, আনন্দও থাকে। মোটাদাগের সেসব অপমানের কথা মনে করে আমি কখনো নিজের জীবনকে বিষিয়ে তুলিনি। এসব সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এখনো করে। যারা আমাকে তাচ্ছিল্য করেছিল বা অবহেলা, আমি সেই মানুষদের গিয়ে কখনো বলিনি তোমরা আমার সঙ্গে এমন কেন করেছিলে! কেন কষ্ট দিয়েছিলে! বরং সেসব মানুষই যখন আমাকে ভালোবাসে কাছে টানতে চায় বা সম্মান দেখায়, তখন আমি পেছনের সবকিছু ভুলে যাই। হ্যাঁ, কিছু কষ্ট থাকে, যা সহজে ভোলা যায় না। কিছু বঞ্চনা থাকে, যা মনের গভীরে দাগ ফেলে দেয়। সবকিছু মনে রাখলে মানুষ যেমন বাঁচতে পারত না আবার সবকিছু ভুলেও যাওয়া যায় না। ভুলতে পারলে ভালো হতো। ভুলত্রুটি নিয়েই এই জীবন। কিছু মানুষ থাকে সারা জীবনই অন্যকে ছোট করে দেখে, তাচ্ছিল্য করে। এ ধরনের মানুষ আমি অনেক দেখেছি। সেসব মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেছি। কারও সঙ্গে লড়াই করার চেয়ে অ্যাভয়েড করা ভালো সমাধান মনে করি। অনেক কাছের মানুষও আমার সঙ্গে এমন আচরণ করে, দূরের মানুষেরাও করে। আমার প্রতি নির্বিকার থাকে। আমি সব সময় তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। তাদের প্রতি আমি কোনো ক্ষোভ নিয়ে বসে নেই। আমি আমার নিজের মধ্যে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। সেই জগতে আমার বসবাস। বাঁচার জন্য আমাকে এমনটা করতে হয়েছে। এই একাকী জীবনে হঠাৎ হঠাৎ একেকজন আমার জীবনে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়। আমার জগৎটা আলোকিত হয়ে ওঠে। সাধারণ এই জীবনে অসাধারণ অনুভূতি দেয়। সকল গ্লানি মুছে যায়।
এক জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। গুনেও শেষ করা যাবে না সেই সংখ্যা। অনেক সম্পর্ক পথে গড়ে উঠে পথেই মিলিয়ে যায়। বাঁক ঘুরতেই ভুলে যাই আমরা। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে পরিচয়ের সংখ্যা বেড়েছে। শত, হাজার ছাড়িয়ে লাখে পৌঁছেছে। ফলোয়ার বেড়েছে, অনুরাগী বেড়েছে, বন্ধু বেড়েছে। পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রেটি তকমা লেগেছে। নীল ব্যাজ জুড়েছে নামের সঙ্গে। ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব! প্রতাপশালী। আমার ধারণা, মানুষ একসঙ্গে অনেক সম্পর্ক মেনটেইন করতে পারে না। সেটা করতে গেলে কারও সঙ্গেই সঠিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। যেমন সংসারের পাঁচজনকে সমান খুশি করা যায় না। সবাইকে সমান খুশি করতে গেলে কাউকেই খুশি করা হয় না। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয়, সম্পর্কের নামে যেটা গড়ে উঠছে, সেটা একটা ফানুস। কচুপাতার পানি। একদিন হয়তো আবেগমাখা কথা হয়েছে, দুদিন পর ভুলে যায় যে কী কথা হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার সম্পর্ক এমনই আলগা। এই আছে এই নাই। মনে আছে যখন পত্রমিতালি করতাম, তখন একটা চিঠির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কখন ডাকপিয়ন আসবে! পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ডিকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টি শুনলে বুকের মধ্যে একশটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠত। একটা সুগন্ধিমাখা চিঠির আবেদন ছিল অনেক তীব্র। একদিন কাক্সিক্ষত চিঠি না এলে মন বিষণ্ন থাকত। খাওয়াদাওয়া ভুলে যেতাম। ডিভোর্স হয়ে গেলেও মনে হয় আজকাল মানুষের এত মন খারাপ হয় না।
যত বেশি বেশি সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তত ভাঙন বাড়ছে। আমার ফেসবুকের বন্ধুদের অনেকেই ব্রেকআপের কষ্টে ভুগছে। অনেক স্বপ্নের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে হুটহাট সংসার ভেঙে দেওয়ার পরিণতি খুব ভালো হচ্ছে না। সাফারিং হচ্ছে দুই পক্ষেরই। একলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। আবার সম্পর্কের মধ্যে থেকেও অনেক দম্পতি একলা। শরীরে একলা, মনেও একলা। দুটি পাখি একটি ছোট্ট নীড়ে, কেউ কারও পানে চায় না ফিরে টাইপ। এ ধরনের সম্পর্ক আরও দুঃসহ, আরও ভয়াবহ। এক ছাদের নিচে কিন্তু কেউ কারও না। কথায় আছে, পরিচিত হই কোটিক বন্ধু হই গুটিক। সবাই বন্ধু হয় না। হবে না। প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠা এত সহজ নয়। তাই আমি মনে করি, হাজার জন পরিচিত থাকুক কিন্তু বন্ধু হবে গুটিকয়; যাদের প্রতি মনোযোগী হতে পারব। যাদের সঙ্গে শেয়ারিং থাকবে। যার দুঃখে ব্যথিত হবেন, চোখের পানি ফেলবেন। সাফল্যে বুকে টেনে নেবেন, যাকে সম্মান করবেন, ভালোবাসবেন, সব সময় কিছু পাওয়ার আশায় থাকবেন না। আজকাল এমন হয়েছে, মানুষ শুধু পেতে চায়, দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, সেটা যে দিতে জানে সেই বোঝে। চেয়ে নেওয়ার মতো গ্লানিকর আর কিছু নেই। একজন ভালো বন্ধু আপনাকে অনেক কিছু দিতে পারে। একটা ভালো সম্পর্ক স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হয়। আমি নিজে সম্পর্ককে অনেক মূল্য দিই। আমি অল্পে সন্তুষ্ট একজন মানুষ। বন্ধুত্বে সুপিয়ারিটি কমপ্লেক্স থাকা ভালো নয়। আমি বন্ধুদের কাছে খোলা কাগজের মতো। আমার মধ্যে লুকোচুরির কোনো ব্যাপার তেমন নেই। আমার লেখাতেও তা-ই। ভালোবাসাই আমার কাছে মূলকথা।
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো যেমন অনেক সংগ্রামমুখর ছিল, তেমনি পুষ্পের ঘ্রাণে ভরা ছিল, আনন্দের ছিল। স্বপ্ন কাজল মাখা ছিল সেই দিনগুলো। অভাব, অনটন, অপ্রাপ্তি আর টানাপোড়েন ছিল, আবার অনেক মাধুর্যমাখা ছিল। সেই সব মায়ার কাজল পরানো দিনগুলোর কথা কখনো ভোলা যায় না। কৈশোর উত্তীর্ণ সময়টা আলো-আঁধারিতে ভরা থাকে। শরীরে স্বেদ গন্ধ পাওয়া যায়। সে রকম বয়সে আমার চমৎকার সব মানুষের সঙ্গে সখ্য হয়েছিল। নারী-পুরুষ দুই ধরনের মানুষ। বন্ধুরাই আমার জীবনে সব। তারাই প্রেরণা, তারাই আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল। আজীবন বন্ধুরা আমাকে ভালোবাসা দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, আনুকূল্য দিয়েছে। আমার কষ্টের দিনে পরম মমতায় পাশে থেকেছে। পরবর্তীকালে কেমন করে জানি না অনেকের সঙ্গেই বিচ্ছিন্নতা এসেছে। হতে পারে আমার ব্যস্ততা বা বিদেশ চলে আসার কারণে এমনটা হয়েছে। সব দোষ আমার। আবার তাদেরও দায় আছে। তবে আমার দিক থেকে চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হয়নি। তাদেরকে খুঁজে বেড়াই আমি। এই মানুষেরা আমার জীবনে ভালোবাসার ডালি নিয়ে এসেছিল। আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছিল, ভালোবাসা শিখিয়েছিল, বন্ধুত্ব আর প্রেমের স্বরূপ চিনেছিলাম। কখনো সেটা চিঠিপত্রের মাধ্যমে, কখনো ব্যক্তিগতভাবে। আজকে যেটা ভার্চুয়াল, সেটা একসময় ঘটত পত্রের মাধ্যমে। চিঠিপত্রের আবেদন আমার জীবনে ব্যাপক ছিল। (চলবে)
আমি অনেক দেশ ঘুরেছি। প্রতিবার মনে হয়েছে আমি হারিয়ে যাব। ভয়ে তটস্থ থাকি। ভয়-ডরের মধ্যেই আমার বসবাস। এসব আমি এনজয় করি। জীবনের সবটুকু দুঃখের না, জীবনের সবটুকু সুখেরও না। তবে জীবনে সুখের ভাগটাই বেশি, সুখের স্মৃতিও বেশি। দুঃখ বা কষ্ট যেটুকু আছে, সেটুকু সুখের স্মৃতি দিয়ে ঢেকে দিলেই হয়। অনেক সুখস্মৃতি মানুষের জীবনে আছে। তাই দুঃখ-কষ্ট নিয়ে এত আদিখ্যেতা করারই-বা কী আছে! সুখ যেমন অন্যকে আন্দোলিত করে, তেমনি দুঃখ অন্যকে বিচলিত করে। আবার সুখ যেমন প্রয়োজন আছে, দুঃখেরও প্রয়োজন আছে। দুঃখ জীবনের উত্তাল তরঙ্গকে স্তিমিত করতে পারে না। তাই হাসার স্বাধীনতা যেমন থাকতে হয়, তেমনি কান্নার স্বাধীনতাও থাকতে হয়।
আমি জানি, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে লড়াই থাকে, সংগ্রাম থাকে। বাঁচার জন্য লড়াই, সংসারের জন্য লড়াই, প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই, সাফল্য লাভের জন্য লড়াই। তেমনি দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে লড়াই, অসুখ-বিসুখের সঙ্গে লড়াই। লড়াই না থাকলে জীবন হতো পানসে। আমি আমার শৈশবকাল থেকেই লড়াই করে বেঁচে থাকা মানুষ। যদিও আমি একটু দুর্বল চিত্তের। কিন্তু বাস্তবে আমি সমুদ্রে সাঁতার কেটে তীরে ওঠা মানুষ। আমার লড়াইটা তেমন দৃশ্যমান নয়। ওটাকে আমি জীবনের অংশ বলে মনে করি। তাই জীবনের সুখ যতটুকু আমাকে আন্দোলিত করে, দুঃখও ঠিক ততটুকু বিচলিত করে। আমি আবেগপ্রবণ বলে কষ্টটাকে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করি। কিন্তু সুখটাকে একটু ঢেকে রাখি। আমি আসলে ভালোবাসার কাঙাল। মনে রাখুন জীবন অনেক সুন্দর। জীবনে যেটুকু সুখ পেয়েছেন, যেটুকু দুঃখ পেয়েছেন, যেটুকু অসুখে ভুগেছেন, ততটুকুই পাওয়ার কথা ছিল। এর বেশিও না, কমও না। তাই ওসব নিয়ে বিচলিত না হয়ে সহজভাবে নেওয়াই ভালো। মৃত্যু একবারই হবে। একটি মহান ঘুমের বেশি কিছু না। আমি আমার কষ্টের দিনগুলোতে প্রতিবার অনুভব করি, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই ভালো, অনন্য। মানুষের কোনো তুলনা নেই। মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমার কি কোনো দুঃখ আছে! মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, আমি কি সুখী! আমি আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমানের দিনগুলোর তুলনা করি এবং এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। এই দুইয়ের মাঝে মধ্যবর্তী যে জীবন ছিল আমার; সেখানে অভাব, অনটন, লড়াই, সংগ্রাম, অপমান, অবহেলা, আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্না সব ছিল। কী ছিল না সেই জীবনে! সবই ছিল। সেসবেরও ব্যবচ্ছেদ করি। সুখ বা দুঃখ কোনোটাই নিরবচ্ছিন্ন নয় জীবনে। দুটোই জীবনের অংশ। তাই জীবনের বঞ্চনাগুলো নিয়ে আমি কখনো নিজেকে দুঃখিত করে তুলিনি। ভারাক্রান্ত হইনি। নির্দিষ্টভাবে কাউকে দায়ী করিনি। বরং আমি যে এখন নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছি, সে জন্য নেপথ্যের মানুষগুলোর প্রতি অবনতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই। যারা আমাকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবেসেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, পাশে থেকেছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, তাদের প্রতি আমার একবুক ভালোবাসা সব সময়। এখনো যারা আমার প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়ায়, ভালোবাসে, মাথায় হাত রাখে, তাদের স্পর্শ আমার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। বাঁচতে শেখায়।
একবার এক ঈদে আমার নতুন জামা ছিল না। পুরোনো জামা ধুয়ে মা ইস্ত্রি করে দিয়েছিল। বাড়ির সবাই নতুন জামা পরে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছে। আমি পুরোনো জামা পরেছি, তাও আমার মনে কষ্ট হয়নি। মা বলেছিল, কষ্ট পেয়ো না। তোমার জন্য দোয়া করি, একদিন তুমি অনেক জামা পরতে পারবে। আমার ছেলেমেয়েরা যে আমাকে এত এত জামা-কাপড় গিফট দেয়, অনেক প্যাকেট দুই বছরেও খোলা হয়নি আমার। যখন ঢাকা শহরে আমার থাকার জায়গা ছিল না, খাওয়ার পয়সা ছিল না, তখন যারা আমার পাশে থেকেছিল, আমি তাদের কথা কী করে ভুলি! প্রথম দিন যে বন্ধুর জামা পরে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার কথা কি ভোলা যায়! বিয়ের সময় যে বন্ধুরা বিভিন্নভাবে হেল্প করেছিল, তারাও থাকে হৃদয়ের গভীরে। এমনই অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে এক জীবনে। ব্যক্তি জড়িয়ে থাকে, ঘটনা জড়িয়ে থাকে। সেখানে বঞ্চনা আর অপমান যেমন থাকে, আনন্দও থাকে। মোটাদাগের সেসব অপমানের কথা মনে করে আমি কখনো নিজের জীবনকে বিষিয়ে তুলিনি। এসব সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এখনো করে। যারা আমাকে তাচ্ছিল্য করেছিল বা অবহেলা, আমি সেই মানুষদের গিয়ে কখনো বলিনি তোমরা আমার সঙ্গে এমন কেন করেছিলে! কেন কষ্ট দিয়েছিলে! বরং সেসব মানুষই যখন আমাকে ভালোবাসে কাছে টানতে চায় বা সম্মান দেখায়, তখন আমি পেছনের সবকিছু ভুলে যাই। হ্যাঁ, কিছু কষ্ট থাকে, যা সহজে ভোলা যায় না। কিছু বঞ্চনা থাকে, যা মনের গভীরে দাগ ফেলে দেয়। সবকিছু মনে রাখলে মানুষ যেমন বাঁচতে পারত না আবার সবকিছু ভুলেও যাওয়া যায় না। ভুলতে পারলে ভালো হতো। ভুলত্রুটি নিয়েই এই জীবন। কিছু মানুষ থাকে সারা জীবনই অন্যকে ছোট করে দেখে, তাচ্ছিল্য করে। এ ধরনের মানুষ আমি অনেক দেখেছি। সেসব মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেছি। কারও সঙ্গে লড়াই করার চেয়ে অ্যাভয়েড করা ভালো সমাধান মনে করি। অনেক কাছের মানুষও আমার সঙ্গে এমন আচরণ করে, দূরের মানুষেরাও করে। আমার প্রতি নির্বিকার থাকে। আমি সব সময় তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই। তাদের প্রতি আমি কোনো ক্ষোভ নিয়ে বসে নেই। আমি আমার নিজের মধ্যে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। সেই জগতে আমার বসবাস। বাঁচার জন্য আমাকে এমনটা করতে হয়েছে। এই একাকী জীবনে হঠাৎ হঠাৎ একেকজন আমার জীবনে দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়। আমার জগৎটা আলোকিত হয়ে ওঠে। সাধারণ এই জীবনে অসাধারণ অনুভূতি দেয়। সকল গ্লানি মুছে যায়।
এক জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। গুনেও শেষ করা যাবে না সেই সংখ্যা। অনেক সম্পর্ক পথে গড়ে উঠে পথেই মিলিয়ে যায়। বাঁক ঘুরতেই ভুলে যাই আমরা। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে পরিচয়ের সংখ্যা বেড়েছে। শত, হাজার ছাড়িয়ে লাখে পৌঁছেছে। ফলোয়ার বেড়েছে, অনুরাগী বেড়েছে, বন্ধু বেড়েছে। পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রেটি তকমা লেগেছে। নীল ব্যাজ জুড়েছে নামের সঙ্গে। ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব! প্রতাপশালী। আমার ধারণা, মানুষ একসঙ্গে অনেক সম্পর্ক মেনটেইন করতে পারে না। সেটা করতে গেলে কারও সঙ্গেই সঠিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। যেমন সংসারের পাঁচজনকে সমান খুশি করা যায় না। সবাইকে সমান খুশি করতে গেলে কাউকেই খুশি করা হয় না। হাতের পাঁচটি আঙুল যেমন সমান নয়, সম্পর্কের নামে যেটা গড়ে উঠছে, সেটা একটা ফানুস। কচুপাতার পানি। একদিন হয়তো আবেগমাখা কথা হয়েছে, দুদিন পর ভুলে যায় যে কী কথা হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার সম্পর্ক এমনই আলগা। এই আছে এই নাই। মনে আছে যখন পত্রমিতালি করতাম, তখন একটা চিঠির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কখন ডাকপিয়ন আসবে! পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ডিকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টি শুনলে বুকের মধ্যে একশটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে উঠত। একটা সুগন্ধিমাখা চিঠির আবেদন ছিল অনেক তীব্র। একদিন কাক্সিক্ষত চিঠি না এলে মন বিষণ্ন থাকত। খাওয়াদাওয়া ভুলে যেতাম। ডিভোর্স হয়ে গেলেও মনে হয় আজকাল মানুষের এত মন খারাপ হয় না।
যত বেশি বেশি সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তত ভাঙন বাড়ছে। আমার ফেসবুকের বন্ধুদের অনেকেই ব্রেকআপের কষ্টে ভুগছে। অনেক স্বপ্নের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে হুটহাট সংসার ভেঙে দেওয়ার পরিণতি খুব ভালো হচ্ছে না। সাফারিং হচ্ছে দুই পক্ষেরই। একলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। আবার সম্পর্কের মধ্যে থেকেও অনেক দম্পতি একলা। শরীরে একলা, মনেও একলা। দুটি পাখি একটি ছোট্ট নীড়ে, কেউ কারও পানে চায় না ফিরে টাইপ। এ ধরনের সম্পর্ক আরও দুঃসহ, আরও ভয়াবহ। এক ছাদের নিচে কিন্তু কেউ কারও না। কথায় আছে, পরিচিত হই কোটিক বন্ধু হই গুটিক। সবাই বন্ধু হয় না। হবে না। প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠা এত সহজ নয়। তাই আমি মনে করি, হাজার জন পরিচিত থাকুক কিন্তু বন্ধু হবে গুটিকয়; যাদের প্রতি মনোযোগী হতে পারব। যাদের সঙ্গে শেয়ারিং থাকবে। যার দুঃখে ব্যথিত হবেন, চোখের পানি ফেলবেন। সাফল্যে বুকে টেনে নেবেন, যাকে সম্মান করবেন, ভালোবাসবেন, সব সময় কিছু পাওয়ার আশায় থাকবেন না। আজকাল এমন হয়েছে, মানুষ শুধু পেতে চায়, দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। দেওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, সেটা যে দিতে জানে সেই বোঝে। চেয়ে নেওয়ার মতো গ্লানিকর আর কিছু নেই। একজন ভালো বন্ধু আপনাকে অনেক কিছু দিতে পারে। একটা ভালো সম্পর্ক স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হয়। আমি নিজে সম্পর্ককে অনেক মূল্য দিই। আমি অল্পে সন্তুষ্ট একজন মানুষ। বন্ধুত্বে সুপিয়ারিটি কমপ্লেক্স থাকা ভালো নয়। আমি বন্ধুদের কাছে খোলা কাগজের মতো। আমার মধ্যে লুকোচুরির কোনো ব্যাপার তেমন নেই। আমার লেখাতেও তা-ই। ভালোবাসাই আমার কাছে মূলকথা।
আমার শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো যেমন অনেক সংগ্রামমুখর ছিল, তেমনি পুষ্পের ঘ্রাণে ভরা ছিল, আনন্দের ছিল। স্বপ্ন কাজল মাখা ছিল সেই দিনগুলো। অভাব, অনটন, অপ্রাপ্তি আর টানাপোড়েন ছিল, আবার অনেক মাধুর্যমাখা ছিল। সেই সব মায়ার কাজল পরানো দিনগুলোর কথা কখনো ভোলা যায় না। কৈশোর উত্তীর্ণ সময়টা আলো-আঁধারিতে ভরা থাকে। শরীরে স্বেদ গন্ধ পাওয়া যায়। সে রকম বয়সে আমার চমৎকার সব মানুষের সঙ্গে সখ্য হয়েছিল। নারী-পুরুষ দুই ধরনের মানুষ। বন্ধুরাই আমার জীবনে সব। তারাই প্রেরণা, তারাই আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল। আজীবন বন্ধুরা আমাকে ভালোবাসা দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে, আনুকূল্য দিয়েছে। আমার কষ্টের দিনে পরম মমতায় পাশে থেকেছে। পরবর্তীকালে কেমন করে জানি না অনেকের সঙ্গেই বিচ্ছিন্নতা এসেছে। হতে পারে আমার ব্যস্ততা বা বিদেশ চলে আসার কারণে এমনটা হয়েছে। সব দোষ আমার। আবার তাদেরও দায় আছে। তবে আমার দিক থেকে চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল হয়নি। তাদেরকে খুঁজে বেড়াই আমি। এই মানুষেরা আমার জীবনে ভালোবাসার ডালি নিয়ে এসেছিল। আমাকে আলোর পথ দেখিয়েছিল, ভালোবাসা শিখিয়েছিল, বন্ধুত্ব আর প্রেমের স্বরূপ চিনেছিলাম। কখনো সেটা চিঠিপত্রের মাধ্যমে, কখনো ব্যক্তিগতভাবে। আজকে যেটা ভার্চুয়াল, সেটা একসময় ঘটত পত্রের মাধ্যমে। চিঠিপত্রের আবেদন আমার জীবনে ব্যাপক ছিল। (চলবে)