স্মৃতির আলপনায় আঁকা

প্রকাশ : ৩০ অগাস্ট ২০২৫, ১৫:৪৩ , চলতি সংখ্যা
বরিশালের রাস্তা, দরগাবাড়ির মসজিদ যেখানে জুমার নামাজ পড়তাম, বিবির পুকুর, বুকভিলা, পাবলিক লাইব্রেরি, অভিরুচি আর বিউটি সিনেমা হল, কীর্তনখোলা নদী, নুরিয়া হাই স্কুল, বিএম কলেজে আমার সহপাঠী, বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব, উদীচী, মালেক ভাইয়ের মালাই আইসক্রিম, রহিম ভাইয়ের ঘটিগরম, নারায়ণের চুল কাটা, বরিশালের মিষ্টি মুড়ি আর ঘোল, শশী মিষ্টান্ন ভান্ডারের রসগোল¬া, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ ডাক্তারদের সুন্দরী কন্যা, আমার বন্ধুদের আর মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের বইগুলো মিস করি। বরিশালে যখন ছিলাম, সব চাহিদা পূরণ হতো না বটে, তা সত্ত্বেও জীবন ছিল অনেক আনন্দের। একটা আনন্দের শিহরন কুলকুল বয়ে যেত সব সময়। আমার বোন সাজুর শ্বশুরবাড়ি ভাটিখানা গেলেই কত কী খেতে দিত। বলত, জসিম, তুই কিন্তু মাছের মাথা খেতে ভালোবাসিস, বড় শোল মাছ আনাইছি বা বলত, আম তোর পছন্দ, আজকে তুই দুইটা ফজলি আম খাবি, ঘরবরনের রসমালাই তোর পছন্দ, সেটাও আনাইছি। বড় আপার দোয়ারিকার বাড়িতে যেতাম, কত সুন্দর বাড়ি ছিল বড় আপার। কত কী ছিল। ধান ছিল, আখের রস ছিল, সেই রস দিয়ে গুড় হতো। তরমুজ ছিল, বাঙ্গি ছিল আর ছিল আপার হাতের অসাধারণ গুড়ের পায়েস। তিন-চার দিন ধরে খেতাম সেসব। আপা মুরগির মাংস দিয়ে চালের রুটি করে দিতেন। আপাদের সেই বাড়ি আজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে ঢাপরকাঠি যেতাম বছরান্তে। সেখানে আমার মামাতো আর খালাতো ভাইবোনেরা ছিল অগুনতি। ওদের সঙ্গে খেলতাম, ঘুড়ি ওড়াতাম, নৌকা বাইতাম, মাছ ধরতে যেতাম। ছোট মামার সঙ্গে কলসকাঠির হাটে যেতাম। লাঠি লজেন্স কিনে দিতেন। মেজো মামা শীতকালে ঠান্ডা পানিতে ডুব দিয়ে কই মাছ ধরতেন। বড় মামা ফজরের আজান দিতেন খুব ভোরে, আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম...। অদ্ভুত এক অনুভূতি হতো শেষ রাতের নিস্তব্ধতায় আজানের ধ্বনি শুনে। সেসব মিস করি খুব। বড় খালাকে খুব মিস করি। মনে আছে, একবার বড় খালার তোশকের নিচ থেকে পাঁচ টাকা না বলে নিয়েছিলাম। বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলাম আমি। আপাতঃ আমি একটু ভিতু, একটু অভিমানী, আমার মধ্যে প্রচুর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকার পরও আমি জীবনে অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেগুলো পূর্বাপর পরিণতি না ভেবে নিয়েছি। বরিশাল থেকে ঢাকায় আসা বা ঢাকা ছেড়ে সুদূর কানাডা আসাটাও তেমনি এক চ্যালেঞ্জ। অটোয়া থেকে যেদিন টরন্টো মুভ হলাম, সেটাও সহজ ছিল না। এমনকি জেসমিনকে বিয়ে করাটাও এক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ঢাকায় এসেছিলাম শুধু লেখক হব এই স্বপ্ন নিয়ে, অথচ তখন আমি ঢাকার অনেক কিছুই চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না। জীবন এভাবেই এগিয়ে চলে, কিছুই থেমে থাকে না। জীবনের কষ্ট আর না-পাওয়াগুলো সহনীয় হয়ে যায়।
অনেক সামান্য ব্যাপার আমার কাছে জগতের আশ্চর্য জিনিস মনে হতো। এখনো সেই বিস্ময় রয়ে গেছে আমার মধ্যে। আমি মানুষের সবকিছু মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমি একটা স্থিরচিত্রের মতো, যেন একটা অকার্যকর প্রাণী হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে ভূমিষ্ট হলাম। আগে যেমন ভাবতাম, আমি কে! আমার গন্তব্য কী! কেন এই পৃথিবীতে এলাম! কোথায় যাব আবার! এখনো তা-ই ভাবি। এখনো আমি প্রতিদিন ভাবি, আমার কিছু করা দরকার ছিল। কিন্তু আমি জানি, কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। যা কিছু করছি মনে হয় এসব তো করার কথা নয়। কী করলে ‘কিছু করা’ হবে, তাও জানি না। এক অনিশ্চিত ভুতুড়ে মানুষের জীবন পার করছি। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে আমার মেজো ভাইয়ের সঙ্গে বাজারে যেতাম। বাংলাবাজার নাম ছিল বাজারটির। আমি যেন বাজার করাটা শিখি, তাই আমাকে নিয়ে যেত। মা আমাকে কখনো একলা বাজারে পাঠাতেন না। তার ধারণা ছিল, আমি এসব কিছুই পারব না। ভুলভাল কিনে নিয়ে আসব। দু-একবার এমন হয়েছেও। আজও আমি বাজারের কথা শুনলে আঁতকে উঠি। এখনো বাজারে গেলে জেসমিনের পেছন পেছন ট্রলি নিয়ে ঘুরি। আমি কিছু পছন্দ করলে জেসমিন বলবে, তোমার চয়েস জঘন্য! আমি আমার নিজের কাপড়চোপরও ঠিকঠাকমতো কিনতে পারি না। এমনকি কাপড় নির্বাচনেও আমার পরামর্শ দরকার হয়।

আমি কোনো কিছু গুছিয়ে করতে পারি না কখনো। যখন যেটা করা উচিত, সেটাও করতে পারি না। প্রায়ই ভুল করি। কোনো প্রতিভাও নেই। নিজেকে তুলে ধরতে পারি না যথাযথভাবে। আমার এমনটা মনে হয়। কমপ্লেক্সে ভুগি। কারও নজরে পড়ার মতো নয়। যখন একা হই, তখন ভাবি, কত সাধারণ এই আমার জীবন, কত সাধারণ আমার চাওয়া-পাওয়া! আমার শৈশব-কৈশোর ছিল সহজ আর সরলতায় ভরা। সবার ছোট ছিলাম বলে আমার প্রতি ভাইবোনদের ভালোবাসা ছিল, পক্ষপাত ছিল। আমাকে কখনো কোনো কাজ করতে হতো না। আমি একটু অভিমানী ছিলাম। এখনো আমি তেমন রয়ে গেছি। আমার অভিমান এখনো বাচ্চাদের পর্যায়ে রয়ে গেছে। তখন মাকে ঘিরেই আমার সব স্বপ্ন গড়ে উঠেছিল। কোনো কিছু দরকার হলেই মায়ের শরণাপন্ন হতাম। সব চাহিদা যে মা পূরণ করতে পারতেন, তা নয়। আমাদের সময় কম-বেশি সব সংসারেই অভাব ছিল, টানাপোড়েন ছিল। মা যে সব সময় আমাকে বুঝতে পারতেন, তা নয়। ওভাবেই আমি বেড়ে উঠেছি। আর দশটা কিশোরের মতো আমি হাসি খেলি খাই ঘুমাই। কোনো বৈশিষ্ট্য নেই সেই জীবনে। তখন থেকেই আমি খুব স্পর্শকাতর ছিলাম। মানুষের জীবনে বেঁচে থাকাটাই যে একটা সংকট, সেটা আমি বুঝেছিলাম। অনুভূতিপ্রবণ মানুষের এমনই হয়। লেখালেখির খেয়াল এসেছিল এই সংকট থেকে। খুব বইপড়ার অভ্যাস হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। নিজের কষ্টগুলো টের পেতাম আমি। বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতাম। কেন যে আমার এমন হতো, আজও জানি না। পারাপারের ললিতের মতো মাঝে মাঝে আমার মাথায় আকাশ ঢুকে পড়ে। তখন আমার পাগল পাগল লাগে। কোনো কিছু আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না। আমি সব সময় মুক্তির মধ্যে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। স্বাধীনতায় বাঁচতে চেয়েছি। আবার স্বাধীনতাও আমাকে সুখ দিতে পারে না। সুখ আর দুঃখের অনুভূতিটাই বড্ড গোলমেলে। সেই সব কারণে আমাকে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। আমিও নিজেকে বোঝাতে পারিনি। অন্যকে বুঝতে পারিনি। কথা শেয়ার করার মতো কেউ ছিল না আমার। বরিশালের জীবনে আমি একা। এক অজানা আকর্ষণে, অচেনা নেশায় বরিশাল ছাড়লাম একদিন। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য বা কিছু হওয়ার কোনো চিন্তা মাথায় নেই। শূন্য হাতে একাকী বেরিয়ে পড়লাম। শুধু নিজের কথাগুলো নিজেকে বলার জন্য, বেঁচে থাকতে হলে একটা অবলম্বন দরকার আমার। তাই ঠিক করলাম, আমি লিখব। লেখালেখিই আমাকে তৃপ্তি দিতে পারবে। তারপর একদিন জানলাম, পৃথিবী নামক জায়গাটা বড্ড কঠিন এক স্থান। এর পদে পদে রয়েছে ভয়, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তা। কোনো কিছুই সহজে ঘটে না জীবনে। আবার পথ চলতে চলতে এ-ও জানলাম, পথের বাঁকে বাঁকে ভয় ও শঙ্কার পাশাপাশি ভালোবাসা আর নির্ভরতাও রয়েছে।

আমার মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অনেক অসম্পূর্ণতা রয়েছে। নিজেকে কখনোই যোগ্য করে তুলতে পারিনি। সবাই সব পারে না। সবাই সব পায় না। আমার চারপাশের মানুষদের প্রতিনিয়ত যে এক লড়াই দেখি সফলতার জন্য, ক্ষমতার জন্য, সেই সব থেকে আমি হাজার মাইল দূরে পড়ে আছি। আমি কখনোই তাদের মতো হতে পারব না। আমি সেসব জেনে গেছি। সে জন্য আমার কোনো অনুতাপ নেই, জীবন ফেনানো নেই। আমি আমার মতোই বেঁচে থাকতে চাই। এই তুচ্ছ জীবন নিয়েই পথ চলছি। ঘাটে ঘাটে নোঙর ভেড়াই আমি। আজ এখানে কাল সেখানে। আমি কোথাও স্থির হতে পারিনি। আমার মা বলতেন, তুমি একটা পাখি, এই দেখি, আবার দেখি নাই। এই বলে মা কাঁদতেন। কেউ কারও জন্য কাঁদে না আজকাল। একমাত্র মা-বাবাই সন্তানের জন্য কাঁদেন। একমাত্র মা-বাবাই সন্তানের জন্য অপেক্ষা করেন। আমার জন্য কেউ যে অপেক্ষা করে না, সে জন্য আমার অনেক নির্ভার লাগে নিজেকে। যখন আমি বরিশাল ছিলাম, তখন সব সময় ভাবতাম, এই গণ্ডিবদ্ধ জীবনেই আমার সমাপ্তি ঘটবে! কিন্তু আমি মুক্তি চাইতাম। কীভাবে মুক্তি পাব, তা জানতাম না। সেই থেকে ছুটে চলা শুরু হলো। নিজের অজান্তে জীবন থেকে জীবনের বাইরে চলে গেলাম। বরিশাল থেকে ঢাকা চলে গেলাম। ঢাকা থেকে অটোয়া। সেখান থেকে টরন্টো। কিশের নেশায় এই ছুটে চলা, তাও জানি না। টরন্টো থেকে প্রতিবছর ঢাকা যাই। বইয়ের নেশায় আসি। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে আসি। বই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। কখনো বরিশাল ছুটে যাই। মা-বাবার কবরের কাছে যাই। ওখানেই শান্তি। তারপর আবার ফিরে যাই।রোজার সময়ের কথা মনে আছে। মাঘ মাসের হাড়-কাঁপানো শীত। কাঁথা বা কম্বলে শীত মানতে চাইত না। টিনের ঘরের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ত। মনে হতো, কে যেন বরফ ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু মায়ের বুকের মধ্যে মধ্যে ঘুমাতাম বলে শীত টের পেতাম না। মায়ের শরীরের উষ্ণতায় সব ঠান্ডা, ডর-ভয় দূর হয়ে যেত। সেই বয়সে বিদেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না। একটু বড় হয়ে বই পড়ে অনেক কিছু জেনেছি। ভ্রমণকাহিনি পড়তাম খুব। বই না পড়লে বাইরের পৃথিবীর প্রতি আগ্রহ জন্মাত না। বরিশালেই থাকতাম হয়তো। মায়ের কাছে থাকতাম। মায়ের কাছেই থাকার কথা ছিল। মা ভাবতেই পারেননি, আমি কখনো তার কাছ ছাড়া হতে পারি। সবার ছোট ছিলাম বলে মা চোখে চোখে রাখতেন। কিন্তু কেমন করে আমি একদিন দূরের মানুষ হয়ে গেলাম। আমি দূরের একজন হতে চাইনি কখনো। রোজা এলেই শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে যাই আমি। মায়ের কাছে ফিরে যাই। সেই টিনের ঘর, এক-দুই টাকার হিসাব, এক-দুই পদের রান্না। সাধারণ দু-একটা মসলা দিয়ে সেই রান্না করতেন মা। মায়ের হাতের সেই রান্নাই ছিল অমৃত সমান। মা যা পাতে দিতেন, গাপুসগুপুস খেয়ে ফেলতাম। মনে হতো আরও খাই। পেট ভরেনি তো! মা বলতেন, আমার নাকি চোখের খিদা। ভোররাতে উঠতাম সাহ্রি খেতে। প্রায়ই মা জাগাতেন না। টের পেতাম, মা পাশে নেই। কিন্তু আমি উঠে পড়তাম। কনকনে শীতের রাতে চুলা জ্বেলে ভাত-তরকারি গরম করতেন মা। কখনো শোল বা মেনি মাছ থাকত। ডালও কি থাকত না! থাকত। সব শেষে একটু দুধ-কলা দিতেন মা। গরুর খাঁটি দুধ। খাওয়া শেষ হলে দূরে মসজিদে আজানের সুমধুর সুর ভেসে আসত। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম..। এই শব্দ কটি শুনলেই মনটা কেমন উদাস হয়ে যেত। সুদূরের ডাক পেতাম যেন। তখন আমার বয়স সাত-আট। সেই বালক বয়সেই মনে হতো, এত সুন্দর ধ্বনি কীভাবে আবিষ্কৃত হলো! মৌলভির কাছে কোরআন পড়ি আমরা বাড়ির ছেলেরা। কাছারি ঘরে মৌলভি সাহেব থাকেন। সফেদ পবিত্র চেহারার একজন মানুষ। শেষ রাতে মা অজু করে ফজরের নামাজে দাঁড়াতেন, জায়নামাজে বসে মা কখনো লুকিয়ে কাঁদতেন। আমি টের পেতাম। কেন কাঁদতেন মা! হয়তো বাবার কথা মনে পড়ত। আমার দুই বছর বয়সে মা বিধবা হন। আমি আবার ঘুমিয়ে যেতাম। দুপুরের দিকে কখনো মা জিজ্ঞেস করতেন, রাতে পেট ভরেছিল! রোজা রাখতে খারাপ লাগছে! কষ্ট হচ্ছে না তো! কষ্ট হলে ভেঙে ফেলো। এখনো রোজা করি কিন্তু মা নেই। (চলবে)
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041