মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৫, ০০:০২ , চলতি সংখ্যা
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ হ্যাঁ, চিরসত্য কথা, বারবার প্রতিফলিত আমাদের সকল কাজে। চিন্তা করলে দেখা যায়, কোনো ক্ষেত্রে নারী পুরুষের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জন্মের সূচনায় নারীর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যখন পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বর আক্রমণ করে, তখন দেশের নারী-পুরুষ সবার মনে এক দৃঢ় সংকল্প আসে, যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে।
এর পর থেকে শুরু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা এবং প্রশিক্ষণ। যে যেভাবে পারেন যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদেরই একজন হচ্ছেন আশালতা বৈদ্য। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে দুঃসাহসী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নারী কমান্ডার, যিনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। আসুন, স্বাধীনতার মাসে মহীয়সী সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের গল্প শুনি।
১৯৭১ সালে আশালতা বৈদ্য ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিন রাজাকাররা তাদের বাড়িতে বাবা হরিপদ বৈদ্যর কাছে চিঠি দিল, ‘আপনার দুটো মেয়ে আছে, ওদেরকে পাক বাহিনীর কাছে তুলে দিতে হবে, অন্যথায় পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে হবে।’ দুই মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি পেয়ে হরিপদ বাবু ও স্ত্রী সরলাময়ী ভারতে চলে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকেন। দিনও ঠিক হলো। মঙ্গলবার চলে যাবেন, তার ঠিক এক দিন আগে সোমবার রাতে এই ঘটনা জেনে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন এলেন হরিপদ বৈদ্যর বাড়িতে। হরিপদ বৈদ্যকে বললেন, ‘মাস্টার বাবু, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, একজনকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আমাকে দিতে হবে।’ পেছন থেকে আশালতা বলে উঠল, ‘বাবা, আমি যাব যুদ্ধে।’ হেমায়েত উদ্দিন বললেন, ‘এই তো পেয়ে গেছি।’ মেয়ের আগ্রহ দেখে বাবাও আর আপত্তি করলেন না। শুধু বললেন, ‘ও নিজে থেকে যুদ্ধে যেতে চাইলে আমি অবশ্যই বাধা দেব না, দেশের জন্য ওকে আমি উৎসর্গ করলাম।’
আশালতাকে নিজের মাতৃভূমিতে থেকে দেশমাতৃকা তথা মা-বোনের সম্মান রক্ষার্থে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন হেমায়েত উদ্দিন। আশালতা উদ্বুদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। হেমায়েত উদ্দিন খুশি হলেন। আশালতাকে কাছে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন এবং বললেন, ‘তুই কালকে সকালবেলা ৩০-৪০/৪০-৫০ জন মেয়ে গুছিয়ে লেবুবাড়ি স্কুলে আসবি, পারবি?’ আশালতা জানালেন পারবেন।
হেমায়েত উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বলেছেন, এ কথা শুনে অন্যরা সবাই সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাজি হলো। ছোট দুই বোন এবং ভাই হরগোবিন্দসহ মোট ৪৫ জন সহপাঠী ও প্রতিবেশী মেয়েকে নিয়ে তিনি লাটেঙ্গা লেবুবাড়ি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে উপস্থিত হলেন।
আশালতা বৈদ্যর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়। ১৬ বছর বয়সী আশালতা ৮ ও ৯ নং সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাব-সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত মহিলা বাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে ৩৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য। নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গেরিলা দলকে। তিনি তাদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হেমায়েত বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় বরিশালের হেরেকান্দি হাইস্কুলে ও লেবুবাড়ি প্রাইমারি স্কুলে। স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণে আশালতা বৈদ্য অস্ত্র পরিচালনা এবং যুদ্ধকৌশলের ওপর আশ্চর্যজনক পারদর্শিতা লাভ করেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণে সেখানে ফার্স্ট হলেন।
এরপর অংশগ্রহণ করলেন বেশ কয়েকটা যুদ্ধে, যার মধ্যে কলাবাড়ি যুদ্ধ, হরিণাহাটি যুদ্ধ, রামশীল পয়সার হাট যুদ্ধ অন্যতম।
আশালতার সাহসিকতায় ক্যাম্পের ২৪ জন নারীকে নিয়ে হেমায়েত উদ্দিনের আদেশে আলাদা একটা নারী কমান্ডো তৈরি করা হয়েছিল, যার নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে। তাদের কাজ ছিল শত্রুর অবস্থান রেকি করা, ছদ্মবেশে গেরিলা আক্রমণ করা এবং সুইসাইড স্কোয়াড হিসেবে কাজ করা। আশালতাসহ তার কমান্ডের সবাই সুইসাইড স্কোয়াড হিসেবে কাজ করার জন্য ছিলেন সদা প্রস্তুত।
রামশীল নদীপাড়ে একদিন লঞ্চে করে রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আসে। সেখানে আশালতা এবং তার সহযোদ্ধাদের তিন ঘণ্টারও বেশি সময় যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জয় হয়েছিল সেদিন।
গোপালগঞ্জে ছোটখাটো অনেক গেরিলা যুদ্ধ ছাড়াও ২২টি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আশালতা বৈদ্য। শুধু প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন নিজ হাতে। এই অপ্রতিরোধ্য নারীযোদ্ধা সেদিন যুদ্ধকেই ধ্যানজ্ঞান করেছিলেন।
স্বাধীনতার পর তাদের টিম শরণার্থীদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন। স্বাধীন দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা শেষ করেন। ১৯৮০-এর দশকে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘সূর্যমুখী সংস্থা’। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তিনি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আশালতা বৈদ্য তার বৈচিত্র্যময় জীবনের সেবামূলক কাজের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বাছাই কমিটিতে মনোয়ন পেয়েছিলেন। যদিও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় উপাধি পাননি। তেমন কেউ চেনেও না তাকে।

 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078