
বিশ্ব মুসলিমের দুনিয়ায় বছরের দুটি আনন্দ উৎসবের দিন হচ্ছে একটি ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি ঈদুল আজহা। দুটোই ধর্মীয় বিধান অনুসারীদের জন্য শ্রেষ্ঠ প্রদত্ত নিয়ামত। ঈদ একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। আবার অন্যভাবে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘খুশি হওয়া’। দীর্ঘ এক মাসের কঠিন উপবাস পালনের পর ঈদ আসে মানুষের দোরগোড়ায় আনন্দের বার্তা নিয়ে। এই উপবাস পালনের মাসটির নাম হচ্ছে ‘রমজান’। এই রমজান শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘সাওম’। ‘সিয়াম’ যার অর্থ সংযম। মূলকথা, শুধু উপবাস পালনের ভেতর দিয়েই রোজার মাহাত্ম্য সীমাবদ্ধ নেই। স্বয়ং আল্লাহ চেয়েছেন মানুষ রোজা পালনের ভেতর দিয়ে যেন নিরন্ন মানুষের অভাবের সঙ্গে পরিচয় লাভ করে। আসলে ক্ষুধার্ত মানুষেরা কী করে দিন কাটায়, সেই উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার তাগিদ থেকেই রমজান মাসের আবির্ভাব।
কথিত আছে, ৪০ বছর বয়সের সময় হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ওহি নাজিল হওয়ার পর থেকে মক্কার বিধর্মী মানুষদের অত্যাচারে যখন তাঁর জীবন সংশয় দেখা দিয়েছিল, সেই রকম এক সময়ে আল্লাহর নবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ এবং ওই হিজরতকালীন সময়কে আমলে নিয়েই ‘হিজরি’ সাল গণনা শুরু। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে হজরত ওমর (রা.) এর সময় থেকে হিজরি সালকে গণনশীল হিসেবে ধরা হয়েছিল। তবে হিজরি প্রথম বছরেই রমজান মাসকে রোজা পালনের জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
রমজান মাস আরবি বছরের নবম মাস এবং এই মাসে পবিত্র কোরআন মাজিদ নাজিল হয়েছিল। সে কারণে ওই রমজান মাসের মর্তবা এতটাই বেশি যে বলা হয়ে থাকে, এই মাসের একটি দান অন্য মাসের ৭০টি দানের চেয়ে বেশি ওজনদার। রমজান মাসের রোজা পালনের ইতিহাস তাই ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই শুরু এবং ওই ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই মুসলিম বিশ্বে ঈদ পালনের সূত্রপাত। এই রমজান মাসে ইসলামের ইতিহাসে অনেক বড় বড় ঘটনার জন্ম হয়েছে। তার ভেতরে মক্কা বিজয় এক বড় ঐতিহাসিক ঘটনা। মদিনায় হিজরত করার শত বছর তিন মাস ২৭ দিন পরে বিজয়ীর বেশে আল্লাহর নবী (সা.) বিনা রক্তপাতে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। একপ্রকার বিনা যুদ্ধে বিজয়ী বেশে ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে সেদিন তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। ওই দিন ছিল রমজান মাসের ২১ তারিখ ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি।
ওই রমজান মাসে আরও বড় বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল, যদিও মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য বিজয়ের ঘটনা। একসময় মাথা নিচু করে কাফেরদের হাত থেকে বাঁচার আশা নিয়ে যে নবী (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই তিনি মাত্র সাত বছরের মাথায় বীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন একেবারে বিনা বাধায়। ‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলাম’ গ্রন্থের তথ্য ‘মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই সত্যটাই প্রমাণিত হলো যে মুসলমানদের বিরোধিতা করতে পারে এমন শক্তিশালী উপজাতি দুনিয়ায় আর নেই’। এই মক্কা বিজয়কে সামনে রেখে পবিত্র কোরআন মাজিদে সুরা ফাতেহ-তে মহান আল্লাহ তাঁর নবীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘ইন্না ফাতাহুনা লাকা ফাতহুম মুবিন’। যার অর্থ হলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমার জন্য বিজয় অবধারিত করেছেন।’
এই বিজয় শুধু নবী মোহাম্মদের ব্যক্তিগত অর্জন ছিল না, সারা মুসলিম উম্মাহর জন্যও ছিল গৌরবের এক ইতিহাস। কারণ ওই মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে নবী (সা.) এবং তাঁর প্রদর্শিত ধর্ম চিরদিনের জন্য পৌত্তলিকদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল। ওই সময়ে পবিত্র কাবাগৃহের ভেতরে স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ করে সেখানে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে ইসলামের পুনর্জন্ম হয়েছিল। সুরা বনি ইসরাইলে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হক এসেছে এবং বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় বাতিল হওয়ারই ছিল।’ আসলে ওই মক্কা বিজয়ের ফলে সব আরব উপদ্বীপের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের হাতে এসেছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরী হয়ে উঠেছিল ইসলামের মূল প্রাণকেন্দ্র। একইভাবে ওই রমজান মাসে ইসলামের ইতিহাসে আরও বড় কয়েকটি ঘটনারও জন্ম হয়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বদরের যুদ্ধ। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ ছিল রমজান মাসের ১৭ তারিখ। দ্বিতীয় হিজরি সাল। বদর প্রান্তরে মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মদিনার মুসলমানদের একটা বড় মাপের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, ইতিহাসে যা বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
মূলত নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মাত্র দুই বছরের মাথায় মদিনা অঞ্চলে হজরত মোহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রচারিত ইসলাম ধর্ম ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত লাভ করে, যার ফলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিতে থাকায় মদিনার জীবনপ্রণালি মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মদিনা সনদ নামে একটি ইসলামি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। ৪৭টি ধারা-সংবলিত ওই সনদ প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল মদিনায় বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান কোন্দলকে সম্প্রীতির বন্ধনে নিয়ে এসে মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ওই সনদ ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলমান-এই তিন সম্প্রদায়ের স্বাক্ষর নিয়েই শাণিত হয়েছিল। এর ভেতরে উল্লেখযোগ্য একটি ধারা ছিল মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো একটি গোষ্ঠী অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বাদবাকি সম্প্রদায়ের মানুষেরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। এ ছাড়া মদিনায় বসবাসকারী প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনভাবে অধিকারী হবে। বস্তুত, রাষ্ট্রে মানবতা বিকাশের স্বার্থে এই মদিনা সনদ ছিল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আর মদিনা সনদকে ইতিহাসবিদেরা বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং এই সনদ প্রণয়নের পর সুদীর্ঘ ১৪ বছরের ভেতরে ওই তিন গোত্রের মধ্যে কোনো ধরনের হানাহানির ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি মক্কার বিধর্মীদের ভেতরে একটা বিরূপ মনোভাবের জন্ম দিলেও মদিনার সাধারণ জনজীবনে একটা প্রকৃত জাতিপুঞ্জ গঠনের ধারণা দিয়েছিল। নবী করিম (সা.) তাঁর সারা জীবনের কর্মে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, ইসলামের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আর তা হলো ‘আল্লাহ এক’ এবং প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার সমান।
কিন্তু মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরতের পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত ছিল মদিনার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের প্ররোচনায় মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় দুই হিজরি সালের ১৭ রমজানে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। সময়টা ছিল ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ৮০ মাইল দূরত্বের বদর প্রান্তর উপত্যকায়। যদিও এই যুদ্ধের আগে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের কয়েকটি ছোট ছোট যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল; কিন্তু বদরের যুদ্ধ ছিল ওই দুই সম্প্রদায়ের ভেতরে সংঘটিত একটি বড় মাত্রার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ হয়েছিল মদিনায় হিজরত করার ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরে। কিন্তু মদিনাবাসীর ভেতরকার প্রভাবশালী কিছু বিশ্বাসঘাতকের কারণে হজরতের সৈন্যবাহিনীতে লোকসংখ্যা বেশি ছিল না, মাত্র ৩০০-এর মতো। ঘোড়া ছিল মাত্র দুটি। উট ছিল ৭০টি। অপরদিকে প্রতিপক্ষ কুরাইশদের সৈন্যসংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে, তার মধ্যে সাতজন উষ্ট্রারোহী ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।
মাত্র ৩০০ জন সৈন্য নিয়ে আল্লাহর নবী (সা.) পরম করুণাময়ের ওপর ভরসা করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যখন তাঁর সঙ্গের সাহাবিরা কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রেই আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি মারফত জানিয়ে দেওয়া হলো, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা...।’
কার্যত সেটাই হয়েছিল। বিরাট এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হজরতের বাহিনীর জয়লাভের যে কাহিনি, সেটা প্রমাণ করেছিল দুনিয়ায় সত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টা স্বয়ং আল্লাহই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কারণ এই যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই যুদ্ধে কুরাইশদের নেতা আবু জাহেলসহ মোট ৭০ জন নিহত হয়েছিল এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছিল। অন্যদিকে নবী (সা.) বাহিনীর মাত্র ১৪ জন সৈন্য শাহাদাতবরণ করেছিলেন। এই যুদ্ধে মুসলমানদের যদি পরাজয়কে মেনে নিতে হতো, তাহলে দুনিয়া থেকে ইসলাম চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ইতিহাসবিদদের মতে, এই বদরের যুদ্ধ ছিল অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের ওপর মহান আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের বিজয় এবং যুদ্ধে কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয় তাদের সীমাহীন অহংকারকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। এই বিজয়টা ইতিহাসের আলোকে এতটাই মর্যাদাবান ঘটনায় পরিণত হয়েছিল যে পরবর্তী সময়কালে একটা অহংকারের উপমায় পরিণত হয়েছিল সত্যাশ্রয়ী মানুষের কাছে। যেমন ১৯৭৩ সালে যখন মিসর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তখন মিসর সেই যুদ্ধের নামকরণ করেছিল ‘অপারেশন বদর’ নামে। একইভাবে আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন বদর’। মহান আল্লাহ মুসলমানদের ওই বিরাট জয়কে রমজান মাসের জন্য সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারণ ওই বদরের যুদ্ধের পরের ১০০ বছরে আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়াও ইউরোপের কিয়দংশসহ পূর্বের ভারতবর্ষের ওপর ইসলামের পতাকা উড়িয়েছিলেন মুসলিম সেনাপতিরা। ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল তখন দেশ-বিদেশের অনেক জনপদে নাম না-জানা মানুষেরা। আর সে কারণেই ইসলামের ইতিহাসে এই রমজান মাসের মর্যদা মহান স্রষ্টা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৩০ দিনের উপবাস পালনের পুরস্কার হিসেবে তিনিই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘রোজাদারদের জন্য আমি নিজে পুরস্কার দেব।’ প্রখ্যাত এক হাদিসের বর্ণনামতে, জান্নাতে ‘রায়্যান’ নামক একটি দরজা রয়েছে, কেবল রোজা পালনকারীরাই সেই দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। আরও বলা হয়েছে, রমজান মাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর শৃঙ্খলিত করে দেওয়া হবে শয়তানকে।
এই রমজান মাসকে বলা হয় কোরআন নাজিলের মাস। কোরআন নাজিল হয়েছিল মূলত নবী করিম (সা.) এর মারফতে। মক্কা নগরীর হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় প্রথম জিবরাইল ফেরেশতা ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, সেই সময় তিনি প্রথমে নবী (সা.) কে সুরা আলাক্ব-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত পাঠ করে শোনান। আয়াতগুলোর ভেতরে প্রথমে ছিল এক. ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল লাজি খালাক্ব’, অর্থাৎ পাঠ করো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন...। কাকে সৃষ্টি করেছেন, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি সেই আয়াতে। জিবরাইল ফেরেশতা নবীকে (সা.) জড়িয়ে ধরে বললেন, ইকরা পড়ো। নবীর উত্তর ছিল, আমি পড়তে জানি না। ফেরেশতা আবারও বললেন পড়ো। যথারীতি দ্বিতীয়বার উত্তর দিয়েছিলেন, আমি তো পড়তে জানি না। তিনবার একই কথা বললেন জিবরাইল (আ.)। তিনবারই সেই একই জবাব দিয়েছিলেন আল্লাহর নবী (সা.), আমি পড়তে জানি না। এবার ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে জড়িয়ে ধরে বললেন, পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ‘আলাক’ থেকে। আলাক হচ্ছে ‘আলাকাহ’ শব্দের বহুবচন। অর্থাৎ জমাটবাঁধা রক্ত। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি একবিন্দু রক্ত থেকে। এই আয়াতের মাধ্যমে নবীর কাছে বাণীবাহক ফেরেশতা মহান আল্লাহর ওহি নিয়ে পৃথিবীতে প্রথম আগমন করেছিলেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় পবিত্র কোরআন ক্রমান্বয়ে নাজিল হয়েছে নবী করিম (সা.) এর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত। এ পর্যন্ত কোরআন একমাত্র গ্রন্থ, যা নাজিলের পর থেকে এ পর্যন্ত গ্রন্থটির একটি শব্দও বিকৃত হয়নি এবং এ সম্পর্কে স্বয়ং স্রষ্টা নিজেই বলেছেন, ‘আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক (আয়াত ১৫ : ৯)।
প্রথম যেদিন হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর কাছে ওই ওহি নাজিল হয়েছিল, ওই দিন ছিল রমজান মাস। ক্রমান্বয়ে নবীর নবুয়তপ্রাপ্তির পরবর্তী ২৩ বছর ধরে মানবজীবনের সমুদয় বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এবং সমস্যার সমাধানসহ সব প্রশ্নের মীমাংসা সংবলিত পবিত্র ওই আসমানি গ্রন্থটি নবুয়ত লাভের ২৩ বছরে ৪৮ জন সাহাবি তা লেখার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। প্রাথমিক যুগে গাছের ছালে, খেজুরগাছের বাকলে কিংবা পাথরে লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো। এভাবে পবিত্র ওই গ্রন্থটি নবী জীবিতাবস্থায় একটি গ্রন্থ হিসেবে প্রস্তুত হওয়ার অবস্থায় উপনীত হলেও মূলত তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) এর খেলাফতকালে গ্রন্থাকারে কোরআনের লিখিত সংকলন প্রকাশিত হয়, যা ছিল নবী (সা.) এর ওফাতের প্রায় ২০ বছর পরের ঘটনা। খলিফা ওসমান (রা.) কর্তৃক প্রামাণ্য পাণ্ডুলিপি তৈরির পর আগের করা অন্য পাণ্ডুলিপিগুলো নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওসমান হত্যাকাণ্ডের সময় ওই পাণ্ডুলিপিগুলো নষ্ট করে দেওয়ার বিষয়ে জনমত একটা বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছিল। বিষয়টাকে ওসমান (রা.)-এর দুঃসাহস হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস দেখিয়েছেন কেউ কেউ। তা সত্যের ইতিহাসের আলোকে হজরত ওসমান (রা.) কোরআনকে পরিপূর্ণ রূপে পবিত্র গ্রন্থরূপে পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। ওই পবিত্র গ্রন্থই হচ্ছে মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান।
বলা হয়ে থাকে, মানুষের জীবনের এমন কোনো সমস্যা নেই, যার সমাধান দেয়নি কোরআন। নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর দেখলেন, সেখানকার অধিবাসীরা, বিশেষ করে ইহুদি সম্প্রদায় বছরে দুটি উৎসব পালন করে। একটি হচ্ছে নওরোজ এবং অন্যটি মেহেরজান। শরতের পূর্ণিমা উৎসবের নাম নওরোজ আর বসন্তকালের পূর্ণিমাকালীন উৎসবের নাম মেহেরজান। নবী করিম (সা.) এই দুটি উৎসবকে বাতিল ঘোষণা করে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহত্তর আনন্দ উৎসবের ঘোষণা দিলে দ্বিতীয় হিজরি সালের ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ মদিনায় প্রথম ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছিল। ইসলামের প্রসার এবং প্রচারের ফলে সারা দুনিয়ায় যখন মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো ঘটনা ঘটে, তখন থেকেই মুসলিম উম্মাহ এই দুই ঈদকে নিজের আবেগের এবং ত্যাগের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছিল। ঈদুল ফিতর তেমনি এক উৎসবের নাম, যার পেছনে সর্বজনীন একটা মানবতাবোধের বহিঃপ্রকাশ কাজ করেছে। মহান আল্লাহ চেয়েছেন ৩০ দিন উপবাস পালনের ভেতর দিয়ে যেন সামর্থ্যবান মানুষের দরিদ্র শ্রেণির মানুষের উপবাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। কষ্টের ভেতর দিয়ে তারা দিন যাপন করে থাকেন। তার সঙ্গে মূলত সাক্ষাৎ ঘটে রোজদারদের। সে কাজ ইচ্ছা করলেই করা যায়। অর্থাৎ একজন রোজাদার মুসলমান একটা পানিপূর্ণ গ্লাস হাত দিয়ে ধরে থাকার পরও যখন শুধু স্রষ্টার সন্তুষ্টির আশায় পানি পান করা থেকে বিরত থাকেন, সেই দৃশ্যকে সাক্ষী রেখেই স্বয়ং স্রষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, রোজা শুধু আমার জন্য, আর আমি তার পুরস্কার দেব।
এবারকার ঈদ উদযাপিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন ফিলিস্তিনের মুসলিম সম্প্রদায়কে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা নিয়ে বিশ্বের তাবৎ পরাশক্তিগুলো একযোগে কাজ করছে। গাজার নিরীহ মানুষ, শিশু ও নারী সবাই এখন চরম থেকে চরমতম এক সময় পার করছেন, যার অপর নাম হচ্ছে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা। কোনোই সাহায্যকারী নেই সেইসব মৃত্যুপথযাত্রীদের চেয়ে দেখা ছাড়া। প্রতিদিন শুধু মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একই অবস্থা ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ্যে ঘটছে। মোদি সরকারের ইচ্ছার কাছে নিজেদের বলিদান দিয়েই যাচ্ছেন অসহায় মুসলমানরা। বিভিন্ন শহরে থাকা মসজিদগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। নামাজরত অবস্থায় একজন মুসলমান এতটাই অসহায় এখন সিজদাটা শেষ করারও অবকাশ দিতে রাজি নয় যেন কেউ। লাঠির আঘাতে মুখ-মাথা থেঁতলে দিচ্ছে তারা সেই নামাজির। মহান স্রষ্টা নিশ্চয় দেখছেন সবকিছুই। সবাইকে ঈদ মোবারক।
কথিত আছে, ৪০ বছর বয়সের সময় হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ওহি নাজিল হওয়ার পর থেকে মক্কার বিধর্মী মানুষদের অত্যাচারে যখন তাঁর জীবন সংশয় দেখা দিয়েছিল, সেই রকম এক সময়ে আল্লাহর নবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ এবং ওই হিজরতকালীন সময়কে আমলে নিয়েই ‘হিজরি’ সাল গণনা শুরু। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে হজরত ওমর (রা.) এর সময় থেকে হিজরি সালকে গণনশীল হিসেবে ধরা হয়েছিল। তবে হিজরি প্রথম বছরেই রমজান মাসকে রোজা পালনের জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
রমজান মাস আরবি বছরের নবম মাস এবং এই মাসে পবিত্র কোরআন মাজিদ নাজিল হয়েছিল। সে কারণে ওই রমজান মাসের মর্তবা এতটাই বেশি যে বলা হয়ে থাকে, এই মাসের একটি দান অন্য মাসের ৭০টি দানের চেয়ে বেশি ওজনদার। রমজান মাসের রোজা পালনের ইতিহাস তাই ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই শুরু এবং ওই ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই মুসলিম বিশ্বে ঈদ পালনের সূত্রপাত। এই রমজান মাসে ইসলামের ইতিহাসে অনেক বড় বড় ঘটনার জন্ম হয়েছে। তার ভেতরে মক্কা বিজয় এক বড় ঐতিহাসিক ঘটনা। মদিনায় হিজরত করার শত বছর তিন মাস ২৭ দিন পরে বিজয়ীর বেশে আল্লাহর নবী (সা.) বিনা রক্তপাতে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। একপ্রকার বিনা যুদ্ধে বিজয়ী বেশে ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে সেদিন তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। ওই দিন ছিল রমজান মাসের ২১ তারিখ ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি।
ওই রমজান মাসে আরও বড় বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল, যদিও মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য বিজয়ের ঘটনা। একসময় মাথা নিচু করে কাফেরদের হাত থেকে বাঁচার আশা নিয়ে যে নবী (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই তিনি মাত্র সাত বছরের মাথায় বীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন একেবারে বিনা বাধায়। ‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলাম’ গ্রন্থের তথ্য ‘মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই সত্যটাই প্রমাণিত হলো যে মুসলমানদের বিরোধিতা করতে পারে এমন শক্তিশালী উপজাতি দুনিয়ায় আর নেই’। এই মক্কা বিজয়কে সামনে রেখে পবিত্র কোরআন মাজিদে সুরা ফাতেহ-তে মহান আল্লাহ তাঁর নবীর উদ্দেশে বলেছেন, ‘ইন্না ফাতাহুনা লাকা ফাতহুম মুবিন’। যার অর্থ হলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমার জন্য বিজয় অবধারিত করেছেন।’
এই বিজয় শুধু নবী মোহাম্মদের ব্যক্তিগত অর্জন ছিল না, সারা মুসলিম উম্মাহর জন্যও ছিল গৌরবের এক ইতিহাস। কারণ ওই মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে নবী (সা.) এবং তাঁর প্রদর্শিত ধর্ম চিরদিনের জন্য পৌত্তলিকদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল। ওই সময়ে পবিত্র কাবাগৃহের ভেতরে স্থাপিত ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ করে সেখানে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে ইসলামের পুনর্জন্ম হয়েছিল। সুরা বনি ইসরাইলে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হক এসেছে এবং বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় বাতিল হওয়ারই ছিল।’ আসলে ওই মক্কা বিজয়ের ফলে সব আরব উপদ্বীপের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের হাতে এসেছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরী হয়ে উঠেছিল ইসলামের মূল প্রাণকেন্দ্র। একইভাবে ওই রমজান মাসে ইসলামের ইতিহাসে আরও বড় কয়েকটি ঘটনারও জন্ম হয়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বদরের যুদ্ধ। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ ছিল রমজান মাসের ১৭ তারিখ। দ্বিতীয় হিজরি সাল। বদর প্রান্তরে মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মদিনার মুসলমানদের একটা বড় মাপের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, ইতিহাসে যা বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
মূলত নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মাত্র দুই বছরের মাথায় মদিনা অঞ্চলে হজরত মোহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রচারিত ইসলাম ধর্ম ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত লাভ করে, যার ফলে অন্য ধর্মাবলম্বীরা ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিতে থাকায় মদিনার জীবনপ্রণালি মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মদিনা সনদ নামে একটি ইসলামি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। ৪৭টি ধারা-সংবলিত ওই সনদ প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল মদিনায় বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান কোন্দলকে সম্প্রীতির বন্ধনে নিয়ে এসে মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। ওই সনদ ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলমান-এই তিন সম্প্রদায়ের স্বাক্ষর নিয়েই শাণিত হয়েছিল। এর ভেতরে উল্লেখযোগ্য একটি ধারা ছিল মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো একটি গোষ্ঠী অন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হলে বাদবাকি সম্প্রদায়ের মানুষেরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করবে। এ ছাড়া মদিনায় বসবাসকারী প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনভাবে অধিকারী হবে। বস্তুত, রাষ্ট্রে মানবতা বিকাশের স্বার্থে এই মদিনা সনদ ছিল হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আর মদিনা সনদকে ইতিহাসবিদেরা বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং এই সনদ প্রণয়নের পর সুদীর্ঘ ১৪ বছরের ভেতরে ওই তিন গোত্রের মধ্যে কোনো ধরনের হানাহানির ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি মক্কার বিধর্মীদের ভেতরে একটা বিরূপ মনোভাবের জন্ম দিলেও মদিনার সাধারণ জনজীবনে একটা প্রকৃত জাতিপুঞ্জ গঠনের ধারণা দিয়েছিল। নবী করিম (সা.) তাঁর সারা জীবনের কর্মে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, ইসলামের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আর তা হলো ‘আল্লাহ এক’ এবং প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার সমান।
কিন্তু মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরতের পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত ছিল মদিনার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের প্ররোচনায় মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় দুই হিজরি সালের ১৭ রমজানে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। সময়টা ছিল ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ৮০ মাইল দূরত্বের বদর প্রান্তর উপত্যকায়। যদিও এই যুদ্ধের আগে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের কয়েকটি ছোট ছোট যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল; কিন্তু বদরের যুদ্ধ ছিল ওই দুই সম্প্রদায়ের ভেতরে সংঘটিত একটি বড় মাত্রার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ হয়েছিল মদিনায় হিজরত করার ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরে। কিন্তু মদিনাবাসীর ভেতরকার প্রভাবশালী কিছু বিশ্বাসঘাতকের কারণে হজরতের সৈন্যবাহিনীতে লোকসংখ্যা বেশি ছিল না, মাত্র ৩০০-এর মতো। ঘোড়া ছিল মাত্র দুটি। উট ছিল ৭০টি। অপরদিকে প্রতিপক্ষ কুরাইশদের সৈন্যসংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে, তার মধ্যে সাতজন উষ্ট্রারোহী ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।
মাত্র ৩০০ জন সৈন্য নিয়ে আল্লাহর নবী (সা.) পরম করুণাময়ের ওপর ভরসা করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যখন তাঁর সঙ্গের সাহাবিরা কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রেই আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি মারফত জানিয়ে দেওয়া হলো, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা...।’
কার্যত সেটাই হয়েছিল। বিরাট এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হজরতের বাহিনীর জয়লাভের যে কাহিনি, সেটা প্রমাণ করেছিল দুনিয়ায় সত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টা স্বয়ং আল্লাহই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কারণ এই যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই যুদ্ধে কুরাইশদের নেতা আবু জাহেলসহ মোট ৭০ জন নিহত হয়েছিল এবং ৭০ জন বন্দী হয়েছিল। অন্যদিকে নবী (সা.) বাহিনীর মাত্র ১৪ জন সৈন্য শাহাদাতবরণ করেছিলেন। এই যুদ্ধে মুসলমানদের যদি পরাজয়কে মেনে নিতে হতো, তাহলে দুনিয়া থেকে ইসলাম চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ইতিহাসবিদদের মতে, এই বদরের যুদ্ধ ছিল অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের ওপর মহান আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের বিজয় এবং যুদ্ধে কুরাইশদের শোচনীয় পরাজয় তাদের সীমাহীন অহংকারকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। এই বিজয়টা ইতিহাসের আলোকে এতটাই মর্যাদাবান ঘটনায় পরিণত হয়েছিল যে পরবর্তী সময়কালে একটা অহংকারের উপমায় পরিণত হয়েছিল সত্যাশ্রয়ী মানুষের কাছে। যেমন ১৯৭৩ সালে যখন মিসর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তখন মিসর সেই যুদ্ধের নামকরণ করেছিল ‘অপারেশন বদর’ নামে। একইভাবে আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন বদর’। মহান আল্লাহ মুসলমানদের ওই বিরাট জয়কে রমজান মাসের জন্য সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কারণ ওই বদরের যুদ্ধের পরের ১০০ বছরে আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়াও ইউরোপের কিয়দংশসহ পূর্বের ভারতবর্ষের ওপর ইসলামের পতাকা উড়িয়েছিলেন মুসলিম সেনাপতিরা। ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল তখন দেশ-বিদেশের অনেক জনপদে নাম না-জানা মানুষেরা। আর সে কারণেই ইসলামের ইতিহাসে এই রমজান মাসের মর্যদা মহান স্রষ্টা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৩০ দিনের উপবাস পালনের পুরস্কার হিসেবে তিনিই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘রোজাদারদের জন্য আমি নিজে পুরস্কার দেব।’ প্রখ্যাত এক হাদিসের বর্ণনামতে, জান্নাতে ‘রায়্যান’ নামক একটি দরজা রয়েছে, কেবল রোজা পালনকারীরাই সেই দরজা দিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। আরও বলা হয়েছে, রমজান মাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর শৃঙ্খলিত করে দেওয়া হবে শয়তানকে।
এই রমজান মাসকে বলা হয় কোরআন নাজিলের মাস। কোরআন নাজিল হয়েছিল মূলত নবী করিম (সা.) এর মারফতে। মক্কা নগরীর হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় প্রথম জিবরাইল ফেরেশতা ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন মহানবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, সেই সময় তিনি প্রথমে নবী (সা.) কে সুরা আলাক্ব-এর প্রথম পাঁচটি আয়াত পাঠ করে শোনান। আয়াতগুলোর ভেতরে প্রথমে ছিল এক. ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল লাজি খালাক্ব’, অর্থাৎ পাঠ করো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন...। কাকে সৃষ্টি করেছেন, সেই সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি সেই আয়াতে। জিবরাইল ফেরেশতা নবীকে (সা.) জড়িয়ে ধরে বললেন, ইকরা পড়ো। নবীর উত্তর ছিল, আমি পড়তে জানি না। ফেরেশতা আবারও বললেন পড়ো। যথারীতি দ্বিতীয়বার উত্তর দিয়েছিলেন, আমি তো পড়তে জানি না। তিনবার একই কথা বললেন জিবরাইল (আ.)। তিনবারই সেই একই জবাব দিয়েছিলেন আল্লাহর নবী (সা.), আমি পড়তে জানি না। এবার ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে জড়িয়ে ধরে বললেন, পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ‘আলাক’ থেকে। আলাক হচ্ছে ‘আলাকাহ’ শব্দের বহুবচন। অর্থাৎ জমাটবাঁধা রক্ত। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তিনি একবিন্দু রক্ত থেকে। এই আয়াতের মাধ্যমে নবীর কাছে বাণীবাহক ফেরেশতা মহান আল্লাহর ওহি নিয়ে পৃথিবীতে প্রথম আগমন করেছিলেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় পবিত্র কোরআন ক্রমান্বয়ে নাজিল হয়েছে নবী করিম (সা.) এর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত। এ পর্যন্ত কোরআন একমাত্র গ্রন্থ, যা নাজিলের পর থেকে এ পর্যন্ত গ্রন্থটির একটি শব্দও বিকৃত হয়নি এবং এ সম্পর্কে স্বয়ং স্রষ্টা নিজেই বলেছেন, ‘আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক (আয়াত ১৫ : ৯)।
প্রথম যেদিন হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর কাছে ওই ওহি নাজিল হয়েছিল, ওই দিন ছিল রমজান মাস। ক্রমান্বয়ে নবীর নবুয়তপ্রাপ্তির পরবর্তী ২৩ বছর ধরে মানবজীবনের সমুদয় বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এবং সমস্যার সমাধানসহ সব প্রশ্নের মীমাংসা সংবলিত পবিত্র ওই আসমানি গ্রন্থটি নবুয়ত লাভের ২৩ বছরে ৪৮ জন সাহাবি তা লেখার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। প্রাথমিক যুগে গাছের ছালে, খেজুরগাছের বাকলে কিংবা পাথরে লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো। এভাবে পবিত্র ওই গ্রন্থটি নবী জীবিতাবস্থায় একটি গ্রন্থ হিসেবে প্রস্তুত হওয়ার অবস্থায় উপনীত হলেও মূলত তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) এর খেলাফতকালে গ্রন্থাকারে কোরআনের লিখিত সংকলন প্রকাশিত হয়, যা ছিল নবী (সা.) এর ওফাতের প্রায় ২০ বছর পরের ঘটনা। খলিফা ওসমান (রা.) কর্তৃক প্রামাণ্য পাণ্ডুলিপি তৈরির পর আগের করা অন্য পাণ্ডুলিপিগুলো নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওসমান হত্যাকাণ্ডের সময় ওই পাণ্ডুলিপিগুলো নষ্ট করে দেওয়ার বিষয়ে জনমত একটা বিরুদ্ধ অবস্থান নিয়েছিল। বিষয়টাকে ওসমান (রা.)-এর দুঃসাহস হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস দেখিয়েছেন কেউ কেউ। তা সত্যের ইতিহাসের আলোকে হজরত ওসমান (রা.) কোরআনকে পরিপূর্ণ রূপে পবিত্র গ্রন্থরূপে পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। ওই পবিত্র গ্রন্থই হচ্ছে মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান।
বলা হয়ে থাকে, মানুষের জীবনের এমন কোনো সমস্যা নেই, যার সমাধান দেয়নি কোরআন। নবী করিম (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর দেখলেন, সেখানকার অধিবাসীরা, বিশেষ করে ইহুদি সম্প্রদায় বছরে দুটি উৎসব পালন করে। একটি হচ্ছে নওরোজ এবং অন্যটি মেহেরজান। শরতের পূর্ণিমা উৎসবের নাম নওরোজ আর বসন্তকালের পূর্ণিমাকালীন উৎসবের নাম মেহেরজান। নবী করিম (সা.) এই দুটি উৎসবকে বাতিল ঘোষণা করে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহত্তর আনন্দ উৎসবের ঘোষণা দিলে দ্বিতীয় হিজরি সালের ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ মদিনায় প্রথম ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছিল। ইসলামের প্রসার এবং প্রচারের ফলে সারা দুনিয়ায় যখন মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো ঘটনা ঘটে, তখন থেকেই মুসলিম উম্মাহ এই দুই ঈদকে নিজের আবেগের এবং ত্যাগের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছিল। ঈদুল ফিতর তেমনি এক উৎসবের নাম, যার পেছনে সর্বজনীন একটা মানবতাবোধের বহিঃপ্রকাশ কাজ করেছে। মহান আল্লাহ চেয়েছেন ৩০ দিন উপবাস পালনের ভেতর দিয়ে যেন সামর্থ্যবান মানুষের দরিদ্র শ্রেণির মানুষের উপবাসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। কষ্টের ভেতর দিয়ে তারা দিন যাপন করে থাকেন। তার সঙ্গে মূলত সাক্ষাৎ ঘটে রোজদারদের। সে কাজ ইচ্ছা করলেই করা যায়। অর্থাৎ একজন রোজাদার মুসলমান একটা পানিপূর্ণ গ্লাস হাত দিয়ে ধরে থাকার পরও যখন শুধু স্রষ্টার সন্তুষ্টির আশায় পানি পান করা থেকে বিরত থাকেন, সেই দৃশ্যকে সাক্ষী রেখেই স্বয়ং স্রষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, রোজা শুধু আমার জন্য, আর আমি তার পুরস্কার দেব।
এবারকার ঈদ উদযাপিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন ফিলিস্তিনের মুসলিম সম্প্রদায়কে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা নিয়ে বিশ্বের তাবৎ পরাশক্তিগুলো একযোগে কাজ করছে। গাজার নিরীহ মানুষ, শিশু ও নারী সবাই এখন চরম থেকে চরমতম এক সময় পার করছেন, যার অপর নাম হচ্ছে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা। কোনোই সাহায্যকারী নেই সেইসব মৃত্যুপথযাত্রীদের চেয়ে দেখা ছাড়া। প্রতিদিন শুধু মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একই অবস্থা ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ্যে ঘটছে। মোদি সরকারের ইচ্ছার কাছে নিজেদের বলিদান দিয়েই যাচ্ছেন অসহায় মুসলমানরা। বিভিন্ন শহরে থাকা মসজিদগুলো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। নামাজরত অবস্থায় একজন মুসলমান এতটাই অসহায় এখন সিজদাটা শেষ করারও অবকাশ দিতে রাজি নয় যেন কেউ। লাঠির আঘাতে মুখ-মাথা থেঁতলে দিচ্ছে তারা সেই নামাজির। মহান স্রষ্টা নিশ্চয় দেখছেন সবকিছুই। সবাইকে ঈদ মোবারক।