সিন্ডারেলা

প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২৫, ২৩:৫০ , চলতি সংখ্যা
শরীর তখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক গতি পায়নি। ঘুমঘোর কাটেনি। আধো-জাগরণের মাঝে মুখে পানির ঝাপটা দেয় মোনা। বন্ধ চোখ কুঁচকে খানিকটা খোলে। আঁজলা ভরে মুখে পুরে দেওয়া পানি কুলি করে বেসিনে ফেলে আয়নার দিকে তাকায়। আয়নার ভেতর উঁকি দিয়ে হেসে ওঠে তিনটি বালিকা-মুখ। রুমা, দিমা, রেশমা। আলুথালু চুলের মোনার মুখেও মৃদু হাসির রেখা। ঘুম প্রায় উবে গেছে ততক্ষণে। আলতো হাতে চোখের কোণ পরিষ্কার করে ঘন ঘন পানির ঝাপটা দিয়ে আরেকবার আয়নায় তাকায় স্পষ্ট দৃষ্টিতে। ঠোঁটে লেগে থাকা মৃদু হাসির রেখা ক্রমশ বিস্তৃত হয়। এক দিন আগেও সে ছিল হাজার হাজার মাইল দূরের দেশে, আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে। এখন নিজ দেশে, বাবার বাড়িতে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা শহরে।
হোল্ডারে ঝুলে থাকা টাওয়েলে মুখ আলতো করে চেপে চেপে বাড়তি পানি মুছে নেয়। আয়নায় তাকায়। তিনজনের হাসিমুখ উবে গিয়ে মায়ের মুখ ভেসে ওঠে সেখানে। মা-ই শিখিয়েছেন সেই ছোটবেলায়, চাপ চাপ করে আলতোভাবে মুখ মোছার কৌশল।
‘ডলে ঘষে মুখ মোছা যাবে না, এতে পেলব কোমল চামড়ার নিচের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মুখ রুক্ষ হয়ে যায়, বুঝলে?’
বহু বছর আগের মায়ের কণ্ঠস্বর কানে বেজে ওঠে। অভ্যাসটা এই মধ্যবয়সেও রয়ে গেছে মোনার। দিঘল চুল খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে আরেকবার আয়নায় তাকায়। আনমনে বিড়বিড় করে, দিঘল কেশ, লাগছে বেশ...। নাটকের দৃশ্যের ন্যায় মায়ের অবয়ব সরে গিয়ে আয়নার ওপাশে দৃশ্যপটে দৃশ্যমান হয় রুমা, দিমা, রেশমা। মুখে টোনারের ছোঁয়া লাগিয়ে শুকিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় কপালের অস্পষ্ট বলিরেখার দিকে। মধ্য চল্লিশের সদ্য উঁকি দেওয়া বলিরেখা। সময় ছুটে চলেছে এই শহরের পাশ দিয়ে বহমান মেঘনার স্রোতোধারার মতন। বিদেশের দামি ব্র্যান্ডের রেটিনল, সিরাম, অ্যান্টি এজিং ক্রিম, কিছুই সদ্য উদিত বলিরেখার আগমন ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কপাল কুঁচকে আরেকবার বলিরেখার দিকে তাকিয়ে সানস্ক্রিন লোশন মেখে নেয় মুখে। মেহেদি দেওয়া চুলের গোড়ায় উঁকি দিচ্ছে কি শুভ্র চুল? নাহ্। এখনো সেই অর্থে শুভ্র কাশবাগান হয়ে ওঠেনি মাথাটি। হেনা-প্যাক দারুণ কাজে দিয়েছে। কালো কেশের ফাঁকফোকর গলিয়ে দু’একটি সোনালি চুলের আবির্ভাব ভালোই লাগছে। রুমা, দিমা, রেশমাÑওরা হয়তো দেশের আরাম-আয়েশের জীবনে দারুণ আছে। বয়স, সৌন্দর্য, ফ্যাশন ধরে রেখেছে। কে জানে। জানালার বাইরে দূরে সবজিওয়ালার হাঁক। মাছ বিক্রেতাও ডেকে চলেছে অবিরত। দরজায় টোকা দেন মা।
‘কিরে মোনা, নাশতা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো। বেলা সাড়ে দশটা বেজে গেল।’
কলের জলের শব্দে অস্পষ্ট দূরের মনে হলো মায়ের কণ্ঠস্বর। ‘আসছি মা’ বলেই চুলটা আরেকবার ভেজা হাত দিয়ে টেনে পেছনে আঁটসাঁট করে আঙুলের ডগায় ভ্যাসলিন নিয়ে ঠোঁটে মেখে শেষবারের মতো আয়নায় তাকায় মোনা। আজই খোঁজ নিতে হবে বন্ধুদের। যাদের সঙ্গে দিনের অধিকাংশ সময় কাটত একটা সময়, স্কুলে, কলেজে। কত দিন তাদের সঙ্গে দেখা নেই, কথা নেই, স্পর্শ নেই। নয় বছর, সাত মাস। হয়তো খুব বেশি দিন নয়। কিন্তু এক-জীবনের হিসাবে দীর্ঘ সময়।
রুমা-দিমা দুই যমজ-বোন। ক্লাসে সবার সঙ্গে মেলামেশায় তাদের বেশ আপত্তি বিধায় অন্যদের কাছে দূরের পথে একটি বিন্দুর মতো অদৃশ্য হওয়া কোনো রেলগাড়ি মনে হতো তাদের। সহপাঠীরা আড়ালে তাদের নাম দিয়েছিল টোনা-টুনি। লেখাপড়ায় ভালো, বিত্তশালী বাবার কন্যা। নীল রঙের প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করত। মফস্বল শহরে তখন আর কাউকে গাড়িতে চড়ে স্কুলে আসতে দেখেনি মোনা। দুজন চুল পেছনের দিকে টেনে টাইট করে একই রকম দুই ঝুঁটি বেঁধে আসত। একই রকম ঘড়ি, জুতা। এমনকি স্কুলব্যাগও। যা অন্য সহপাঠী, শিক্ষক সবাইকে ধন্দে ফেলে দিতÑকে রুমা আর কোনটা দিমা। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে একমাত্র মোনার সঙ্গেই টোনা-টুনির ঘনিষ্ঠতা ছিল। মোনার কখনোই রুমা, দিমাকে শনাক্ত করতে বেগ পেতে হয়নি। গার্লস স্কুল থেকে এসএসসির পর তারা উইমেন্স কলেজে ভর্তি হলো। রেশমা আর মোনা কো-এডুকেশনে। অনিন্দ্যসুন্দরী রেশমার জন্য কলেজে কতজন যে পাগল ছিল, সে কথা মনে করে মোনার মুখের কোণে একচিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। পাতে পরোটা, আলুভাজি তুলে দেওয়ার সময় বিষয়টি নজরে পড়ল মায়ের।
‘কিরে, কী ভাবছিস?’
‘মা, রুমা, দিমা, রেশমা, ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে, জানো?’
মা শান্ত দিঘির স্বচ্ছ জলের মতো স্থির চোখে তাকালেন।
‘এই শহরেই আছে। রুমা ওদের পাশের বাসার কমলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, সে তো জানিস।’ মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোনার দিকে তাকান।
‘হোটেলের পরোটা-ভাজি?’ প্লেটের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে মোনা। যেন পৃথিবীর আশ্চর্যতম কিছু দেখল। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে দেয় মায়ের দিকে।
‘আমার পছন্দের নাশতা। অথচ এই সব তুমি একদমই পছন্দ করতে না। ময়লা হাতে বানায়, নাক চুলকে আবার সেই হাতেই ময়দার ডাই তৈরি করে... কত কী বলতে। তবুও ঘেন্না ধরাতে পারতে না, তাই না মা?’
মায়ের চোখ ছলছল জলে ভরে ওঠে। ধরা গলায় বলে ওঠেন, ‘তোর পছন্দের হোটেলের পরোটা-ভাজি, কত দিন খাস নাই।’
এক টুকরো পরোটায় আলুভাজি পেঁচিয়ে পোঁটলার মতো আকৃতি দিয়ে মুখে পুরে চিবোতে থাকে মোনা। অদ্ভুত স্বাদের অনুভূতিতে ভরে গেল মুখের ভেতরটা। এই অমৃত পৃথিবীর কোথাও পায়নি সে। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে কিংবা কানাডার ডাউনটাউন, কোথাও না। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায় মোনা। পুবের জানালা দিয়ে আসা সকালের তির্যক কিরণ মায়ের মুখজুড়ে। অপার্থিব এক মায়াময় মুখ, যেন শুভ্রতা আর পবিত্রতার প্রতীক। মাকে স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপ্সরী মনে হয় মোনার।
‘রুমা আর কমলকে ওদের দুই পরিবার শেষ অবধি মেনে নিয়েছে?’ মোনার কৌতূহলী প্রশ্ন।
মা জানালা দিয়ে আসা রোদে পিঠ পেতে দিয়ে মোড়ায় বসে কচুর লতি ছিলতে ছিলতে খানিকটা বিষণ্ন হয়ে ওঠেন।
‘না রে, হিন্দু-মুসলিম বিয়ে। কে-ইবা মেনে নেবে? রুমা ইসলাম ধর্ম পালন করে। আর কমল পূজা করে। তা ছাড়া ওদের অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। রুমা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করে সংসার চালায়। লেখাপড়া তো আর শেষ করতে পারেনি।’
‘ওদের সন্তানেরা?’
পরোটার শেষ টুকরোয় কামড় বসিয়ে মায়ের দিকে তাকায় মোনা উত্তরের অপেক্ষায়।
‘মেয়ে দুটো মায়ের সঙ্গে ঈদ উদ্্যাপন করে। বাবার সঙ্গে পুজো দিতে মন্দিরে যায়।’ মায়ের কণ্ঠে হতাশা। ‘ওরা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী হলো না বলে স্কুলেও বুলিংয়ের শিকার হতে হয়।’
মোনা চায়ের কাপে সামান্য চিনি মিশিয়ে নাড়তে থাকে অবিরত, যেন অনন্তকাল ধরে নাড়ছে। চামচের টুংটাং আওয়াজ আর ঘূর্ণনের মাঝে তলিয়ে যেতে যেতে কোথাও হারিয়ে যায় সে। আমেরিকায় তার সহকর্মী আব্দুল্লাহ আর আরতির মুখ ভেসে ওঠে। দুই ধর্মের দুজন মানুষ। তারা লিভ টুগেদার করত। একই বাসায় স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করত। সে সংসারে সপ্তাহান্তে বন্ধুদের দাওয়াত করত। রমজানের দিনে আরতি ইফতার বানিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে আব্দুল্লাহর জন্য নিয়ে আসত কর্মস্থলে। তা সত্ত্বেও তাদের সম্পর্কটি শেষ অবধি টেকেনি। শেষের দিকের দিনগুলোতে আরতিকে বেশ বিষণ্ন মনে হতো। এক ফাগুন-বিকেলে জল টলোমলো চোখে মোনার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘জানো মোনা, আমি ইসলাম ধর্মকে সম্মান করি। আমি ঘরে দুর্গার ছবি টাঙালে আব্দুল্লাহ সহ্য করতে পারে না। ছিঁড়ে ফেলে। অথচ সে ঘরের দেয়ালে আল্লাহর ছবি টানিয়ে রাখে। আমি কিচ্ছু বলি না।’ মোনা অবাক হয়েছিল। অস্ফুটে বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহর ছবি!’ তার চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়।
আরতি বিষয়টি খোলাসা করেছিল, ‘ওই যে, আরবি লেখা দোয়া আছে না...?’ ততক্ষণে মোনা বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছিল।
মোনা চায়ের কাপের ঘূর্ণনের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন অনন্তকাল যাবৎ ঘুরছে মহাবিশ্ব।
‘কিরে, চা ঠান্ডা হয়ে গেল তো’, মোনার সংবিৎ ফেরে মায়ের তাগিদে। ‘বুঝলি মোনা, রুমাটা অল্প বয়সে ভুল করে জীবনটা এলোমেলো করে ফেলল। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারল না। শত হলেও সমাজ বলে কথা। কিন্তু দ্যাখ, দিমা কিন্তু বেশ আছে। বাবা-মা দেখেশুনে ভালো পরিবারে বিয়ে দিয়েছে। অর্থ-বিত্ত, নাম-ডাক, সুখ সবকিছুতেই ভরপুর জীবন তার।’ মায়ের কণ্ঠে স্বস্তি।
‘আর রেশমা? রেশমা কেমন আছে? ওদের সঙ্গে একদিন অবশ্যই দেখা করতে হবে।’
মোনার প্রশ্নে মা নিরুত্তর, যেন শুনতে পাননি। তার হাত চলছে মেশিনের মতো দ্রুত গতিতে। কুটা, ধোয়া, রান্না, সাহায্যকারীকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া, ডাল ব্ল্যান্ড করা, ছোলাবুট ভেজানো। রাতে সাহ্্রি খেয়ে কাল থেকে রমজান শুরু। কত বছর পর এবার দেশে রোজা ও ঈদ পালন করবে মোনা। কত বছর পর সেই আগের চিত্র, ছোটবেলার দিনগুলোর আমেজ খোঁজার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু কত কী-ই তো হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। দাদু নেই। বাবাও চলে গেছেন কোন সুদূরে, আকাশের ওই পারে।
দুপুরের পর মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে মোনা। ছোটবেলায় যেমন করে লতার মতো জড়িয়ে প্যাঁচিয়ে থাকত, ঠিক তেমন। মা উপুড় হয়ে আধশোয়া হয়ে কাগজ-কলমে কিছু লিখছেন। সেই কারুকার্যখচিত লোহাকাঠের তৈরি পালঙ্ক। সাপের মতো প্যাঁচানো চার কোণে চারটি মোটা স্ট্যান্ড মশারি টানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। শুধু বদলেছে ঘরের পর্দা। আগে অফ হোয়াইটের ওপর বাদামি ফ্লোরাল প্রিন্টের পর্দা ছিল। এখন এক কালারের। ধূসর আর নীল রঙের ছোঁয়া ঘরময়। সেই নীলাভ-ধূসর আবহের অলস দুপুরের নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙে যায় মোনার ঘুম জড়িয়ে আসা কণ্ঠস্বরে।
‘কী লেখালেখি করছ, মা?’
‘যাদের জাকাত দেব, সেই লিস্ট করছি।’ মায়ের মুখজুড়ে গাম্ভীর্য। মা কি বাবার কথা মনে করছেন? গতবার রমজানেও বাবা বেঁচে ছিলেন। জাকাত কাকে কাকে দেবেন, সে নিয়ে কী তুমুল মতবিরোধ। বাবা বলতেন, ‘তোর মা যাদের জাকাত দেয়, তারা কেউ তা পাওয়ার উপযুক্ত নয়।’ মা অভিযোগ করতেন, ‘তোর আব্বা যাদের জাকাত দেয়, তারা কেউ নামাজ পড়ে না।’ মোনা দূরদেশে ফোনের অন্য প্রান্ত হতে বাবা-মায়ের অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ শুনে মনে মনে হাসত। কিন্তু আজ সেই সব মনে করে বিষণ্ন হয়ে উঠল।
বাইরে একটি একলা কাক ডেকে ওঠে। তারপর আরও একটি। আরও একটি। সমস্বরে একদল কাক কা কা রবে সমস্ত পৃথিবীর থেমে থাকা দুপুরকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মোনা কান খাড়া করে আরও গভীরভাবে শোনার চেষ্টা করে, যেন বিরহী বিষণ্ন কোনো সুরের মূর্ছনায় ভেসে চলেছে জীবন ও জগৎ। কতকাল পর কাকের করুণ ডাক কানে বেজে উঠল আর্তনাদের মতো।
‘মনে হয় ইলেকট্রিক তারে আটকেছে কোনো কাক। আর অন্যরা স্বজাতি হারানোর বেদনায় অন্তহীন কেঁদে চলেছে রে?’ মায়ের কণ্ঠে অজানা শঙ্কা।
মোনা নিশ্চুপ পড়ে রইল। চোখভর্তি ঘুম। জেট ল্যাগ কাটেনি এখনো। ঘুমঘোরে বন্ধু পারুলের কথা মনে পড়ছিল। গভীর সমুদ্রে আচমকা লাফিয়ে উঠে আবার তলিয়ে যাওয়া ডলফিনের মতোই হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিয়ে ওঠে বহুকাল আগের প্রিয় মুখগুলো। দেখা হলে স্নিগ্ধ চেহারার মৃদুভাষী পারুলের মুখের অভিব্যক্তি কেমন হবে? সে কি প্রবল উচ্ছ্বাসে বুলেটের গতিতে কাছে এসে জড়িয়ে ধরবে? কেমন হবে মুহূর্তটা? অথচ এই পারুলকে একসময় বড় বেশি হিংসে হতো মোনার। লুকানো হিংসে। কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারত না। সচ্ছল পরিবারে সাত ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন পারুল। বড় আদরের। সাত ভাই চম্পা জাগোরে... গান থেকেই তার নাম পারুল রাখা হয়েছিল। মোনার ভাইবোন নেই বলে আক্ষেপ হতো। মনে মনে খুব চাইত, ইশ, পারুলের মতো তারও যদি এতগুলো ভাই থাকত, কতই-না আদর পেত। ঈদে, জন্মদিনে কতগুলো উপহার পেত, যেমনটি পারুল পায়। অনার্স পড়ার সময় পারুলের পরিবার অনেক দেখেশুনে তাকে বিত্তশালী পরিবারে পাত্রস্থ করেছে। সেই থেকে পারুলকে কেন যেন ধীরে ধীরে শীতের কুয়াশার মতো অস্পষ্ট মনে হতে থাকে। যেমনটি চলন্ত গাড়ির সাইড মিররে তাকালে পেছনের পথটি দূরে, বহুদূরে সরে যেতে থাকে, তেমন। আগের মতো মিশতে খানিকটা গাঢ় অস্বস্তি হতো মোনার। সেই সব বহু আগের কথা। এখন এই মধ্য চল্লিশে এসে কেন পুরোনো কথা ভাবছে, মনে হতেই নিজেকে মৃদু তিরস্কার করে মোনা।
শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করাসহ নানান সামাজিকতায় অনেকটা সময় দৌড়ে পালিয়ে যায়। হিসাবের সময় এত দ্রুত পালায়, যেন আঁজলাভরা জল আঙুলের ফাঁকফোকর গলিয়ে কোথাও হাওয়া হয়ে যায়। আর এক সপ্তাহ পরই ফিরে যেতে হবে মোনাকে। স্বামী, সংসার, সন্তানের কাছে। সুদূর নিউইয়র্কে।
রমজান মাস প্রায় শেষের দিকে। শেষরাতে সাহ্্রি খেয়ে ঘুমাতে হয় বিধায় বেলা করে ঘুম ভাঙে মোনার। কর্মস্থলে যেতে হয় না। স্বামী, সন্তানের খাবার তৈরি করতে হয় না। বিদেশ বিভুঁইয়ের রুদ্ধশ্বাস ব্যস্ততা নেই। কত দিন পর দেশে কাটানো কটি দিন নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছে সে। কিন্তু আজ সকাল সকাল কোলাহল আর হইচইয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে মোনা। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়। এত হট্টগোল কেন? ঘুমঘোর কেটে যেতেই বুঝল, মা জাকাত বিলিবণ্টন করছেন। একে অন্যকে খবর দিতে দিতে অগণন লোক জড়ো হয়েছে। শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই কার আগে কে নেবে, সেই প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় শরিক হয়নি একজন। হুড়োহুড়ি নেই কোনো তার। এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সে বড় ঘোমটার আড়ালে। আবছায়া অবয়ব। ভিড় কমে এলে মা ঘোমটা-টানা নারীকে কাছে ডেকে নেন। সযত্নে আগলে রাখা ব্যাগটি বুঝিয়ে দেন। সঙ্গে সাদা খাম। সে সন্তর্পণে স্থান ত্যাগ করে দ্রুততার সঙ্গে।
এত ঝকমকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের শুরু, তবু কেমন এক গুমোট ছায়ার মতো ছেঁড়া মেঘ চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল যেন। মোনা মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই মা কেমন যেন কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে ইতস্তত করে বললেন, ‘মানুষের দিন সব সময় এক রকম যায় না, বুঝলি মোনা? গত কয়েক বছর হয় ওর খুব টানাপোড়েন চলছে।’
‘কার কথা বলছ, মা?’
মা সহজ ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালেন। বেঁচে যাওয়া কয়েকটি ব্যাগ টেবিলের এক পাশে রাখতে যাচ্ছিলেন। এক মুহূর্তের জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন।
‘পারুলের কথা বলছি।’
‘পারুল!’ মোনা অস্ফুটে উচ্চারণ করল।
‘তোর সঙ্গে দেখা করতে সংকোচ বোধ করছে। লজ্জা পাচ্ছে।’
ব্যাগগুলো টেবিলের এক পাশে রেখে খুব সহজ ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালেন মা। মোনার নিরুত্তাপ মুখ মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সে নির্বাক তাকিয়ে রয় মায়ের মুখের দিকে বাকি কথাটুকু শুনবে, সে আশায়।
‘পারুলের দু-দুবার যমজ সন্তান হয়েছে। প্রথম দুটি কন্যা। পরের দুটি পুত্র। দুই বছরের ব্যবধানে চারটি সন্তান। খাওয়া-পরার অভাব ছিল না। অবস্থাপন্ন পরিবার। কিন্তু ওই যে, প্রবল আত্মসম্মান বোধ। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে কয়েক বছর আগে। স্বামীটা পরনারীতে আসক্ত। বাইরে রাত কাটায়। সুরা পান করে। কদিন ঘরে ফেরে না। যখন ফিরে পারুলকে বেধড়ক মারে। সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ওই পরিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে পারুল।’
‘পারুলের ভাইয়েরা আছে না?’ মোনার কণ্ঠে উদ্বেগ। মা কারুকার্যখচিত পালঙ্কে বালিশে হেলান দিয়ে ক্লান্তিকর শরীর এলিয়ে দেন।
‘থাকলে কী হবে? সবার যার যার সংসার আছে না? পাঁচজন মানুষের দায়িত্ব কে নেবে?’ মা এমনভাবে কথাটি বললেন, যেন জগতের অন্য সব আটপৌরে বিষয়ের মতো স্বাভাবিক ঘটনা।
‘এখন চলছে কী করে?’ নিঃসাড় হয়ে আসা হাত দুটো দিয়ে পালঙ্কের প্যাঁচানো স্ট্যান্ড ধরে মায়ের মাথার দিকের পাশে দাঁড়ায় মোনা।
‘পরোটা, ডালপুরি বানিয়ে হোটেলে সাপ্লাই দেয়। ভাইয়েরা কিছু সাহায্য করে। তুই টাকা পাঠালে সেখান থেকে আমিও কিছু দিই।’
জানালার বাইরে মফস্বল শহরের উদ্ভান্ত পথের দিকে তাকিয়ে থাকে মোনা। ধুলো, ধোঁয়া, শব্দের পথ। একদলা দুঃখবোধ মোনার ভেতরটা তাড়িত করে। হঠাৎ ঝড়ের মতো ধুলো-ওড়া শহরটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে যেন। শিমুল তুলার মতো বাতাসে উড়ে বেড়ায় অগণন স্মৃতি। আর তা ধরার জন্য মোনা পিছু পিছু ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছে। অন্তহীন।
-নিউইয়র্ক
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078