অ্যা জেনারেল’স ডিলেমা

প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১৩:২৯ , চলতি সংখ্যা
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা বহু বছর পূর্বে সংঘটিত হলেও এ জাতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণের দিক থেকে কখনো পুরোনো (Obsolete) হয় না। ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী লেখক ও গবেষকেরা এসব ঘটনার নতুন দৃষ্টিকোণ (Prespective) নিয়ে আলোকপাত করতে সব সময় সচেষ্ট থাকেন, যা থেকে বের হয়ে আসে ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য ও বিশ্লেষণ, যা ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসের তেমনি এক ঐতিহাসিক ঘটনা বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার বিপ্লব।
বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা দেশের আপামর জনগণের অংশগ্রহণে সংগঠিত ওই বিপ্লবের জোয়ারে ভেসে যায় স্বৈরতন্ত্রের তখতে তাউস। সেই সঙ্গে ওই দুঃশাসনের সঙ্গে জড়িত  স্বৈরশাসক ও তার দোসররা জনতার রুদ্ররোষ থেকে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে দেশে-বিদেশে পালিয়ে ও আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়। স্বৈরতন্ত্রের পতনের শেষ লগ্নে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের মূল কারিগর শেখ হাসিনাকে ভারতে চলে যেতে যিনি সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেন, তিনি হলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তাকে ও তার ভূমিকা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১৯৮৫ সালে অফিসার ক্যাডেট (১৩তম বিএমএ লং কোর্স) হিসেবে ওয়াকার-উজ-জামান যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে তার দীর্ঘ পেশাগত জীবনে ২০২৪ সালের ২৩ জুন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে সেনা সদরে চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএ), প্রধানমন্ত্রীর অধীন আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ও নবম ডিভিশনের জিওসির দায়িত্ব পালন করেন। সেনাপ্রধানের পদে নিয়োগের পর তাকে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ব্রিগেড ও ডিভিশন কমান্ড করার অভিজ্ঞতা না থাকলে তিনি সেনাপ্রধান হতে পারেন না। তা ছাড়া তাকে পদাতিক বাহিনীর অফিসার হতে হয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন এরশাদ আমলের সেনাপ্রধান জেনারেল নূর উদ্দিন। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার ছিলেন।
সেনাবাহিনীতে তরুণ অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে জেনারেল ওয়াকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা কমলিকাকে (পুরো নাম সারাহানাজ কমলিকা রহমান) বিয়ে করেন। সম্পর্কে জেনারেল মুস্তাফিজ শেখ  হাসিনার ফুফা হন। সেই দিক দিয়ে জেনারেল ওয়াকার শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী। অবসর থেকে ফিরিয়ে এনে জেনারেল মুস্তাফিজকে শেখ হাসিনা সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেছিলেন। ভবিষ্যতে সেনাপ্রধান করা হবে, সেই চিন্তা মাথায় রেখে শেখ হাসিনা জেনারেল ওয়াকারকে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন ভাবাটা ভুল হবে না
বৈবাহিক সূত্রে শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ার সূত্রে পারিবারিকভাবে তার সঙ্গে শেখ হাসিনার অন্তরঙ্গতা ও তাদের মধ্যে অহরহ দেখা-সাক্ষাৎ ও নানা অমøমধুর আলাপচারিতা এবং হাস্য কৌতুকের বহু মধুর স্মৃতি জেনারেল ওয়াকারের মনের মণিকোঠায় বিদ্যমান থাকাটাই স্বাভাবিক। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ক্ষমতার মসনদ ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা এমনকি জনতার রুদ্ররোষ থেকে তাকে বাঁচানোর একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে ওঠেন জেনারেল ওয়াকার। সম্ভবত সেই ভরসা থেকেই সে সময় হাসিনা দম্ভভরে উচ্চারণ করেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না, শেখের বেটি কখনো পালায় না।’ বলা নিষ্প্রয়োজন, পরের ঘটনাবলিতে তার সেই দম্ভোক্তি ভুল প্রমাণিত হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে চলে আসে, তখন অনেকের মতো জেনারেল ওয়াকারও অনুধাবন করতে সক্ষম হন, এ যাত্রায় শেখ হাসিনাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। লাখ লাখ জনতার ঢাকা অভিমুখী যাত্রাকে একমাত্র তাদের ওপর নির্বিচার ও বেপরোয়া গুলিবর্ষণ ও ব্যাপক রক্তপাত ছাড়া যে রোধ করা সম্ভব হবে না, সেটা তার বুঝতে বাকি থাকে না। এটা করতে তার পক্ষ থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেওয়া হলেও সেই নির্দেশ কর্তব্যরত সৈনিক ও অফিসাররা মানবেন কি না, তারও নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় ব্যাপক রক্তপাত এড়িয়ে কীভাবে শেখ হাসিনাকে অন্তত প্রাণে বাঁচানো যায়, সেটাই হয়ে ওঠে জেনারেল ওয়াকারের একমাত্র চিন্তা। গুলিবর্ষণ করে শত শত মানুষ হত্যা করে শেখ হাসিনার গদি রক্ষা নাকি তার প্রাণ বাঁচানো, এই দুই বিষয়ের মধ্যে কোনটাকে বেছে নেওয়া শ্রেয় হবে, তা নিয়ে জেনারেল ওয়াকারের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক গভীর দোলাচল, দ্বিধাদ্বন্দ্ব (Dilemma)। সবকিছু বিবেচনা করে তিনি তার প্রাণ বাঁচানোর পথ বেছে নেন। পুরো পরিস্থিতি হাসিনাকে অবহিত করে দেশত্যাগই তার জন্য উত্তম হবে বলে তাকে জানানো হয়। জেনারেল ওয়াকারের পরামর্শ শুনে হাসিনা হতাশা ব্যক্ত করলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে তিনি দেশত্যাগে সম্মত হন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে করে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে তিনি ভারতে চলে যান।
কেউ কেউ হাসিনাকে বিচারের জন্য দেশে না রেখে তার চলে যাওয়ায় সহায়তা করার জন্য জেনারেল ওয়াকারের সমালোচনা করেন। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য, সে সময়কার পরিস্থিতিতে এটা করা হলেও তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রেও সেটা একটা বিষফোড়া হয়ে দাঁড়াত। অত্যন্ত কঠিন ও জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে জেনারেল ওয়াকারের সিদ্ধান্ত ছিল সুবিবেচনাপ্রসূত। সে জন্য তার জন্য রইল অশেষ ধন্যবাদ।
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের তাৎপর্য ও ইতিহাসের কথা বিবেচনায় নিয়ে এই বিপ্লবের পূর্বাপর ঘটনাবলির একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জেনারেল ওয়াকার যদি এ বিষয়ে একটি বই লেখেন, সেটি একটি মহতী প্রয়াস হবে বলে সুধীমহল মনে করেন।
লেখক : কলামিস্ট
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078