শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং মহান বিজয় দিবস

প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৮ , চলতি সংখ্যা
১৯৭১ সাল। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর। একাত্তরের প্রতিটি দিন ও সময় ছিল ভয়াল উৎকণ্ঠ ও আতঙ্কময়। স্বপ্নময় প্রত্যাশা, সম্ভাবনা ও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের সংকল্পে সমগ্র বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী এতই হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে পৃথিবীতে এ ধরনের নৃশংসতাকে হিটলারের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করা যায়। একাত্তরের ২৫ মার্চ পাক হানাদারদের অমানবিকতা ও গণহত্যা ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক কালো অধ্যায়। সেই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিভীষিকাময় চিত্র বিশ্বের গণমাধ্যমসমূহে প্রচারিত হয়েছিল।
এসব কারণেই আমাদের নিরীহ শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীগণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের জিঘাংসার শিকার হয়েছেন। সত্যি বলতে কি, এক বছরের চেয়ে কম সময়ে এত বেশিসংখ্যক সর্বস্তরের মানুষ, জ্ঞানী-গুণী ও বুদ্ধিজীবী নিধনের উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর ঘটেনি।
প্রকাশ থাকে যে, দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নের ফলে স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে একাত্তরের ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র দেখে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানায়। তবে সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন থেকে বিরত থাকে। কিন্তু স্বাধীনতার মহান মুক্তিযুদ্ধ ক্ষিপ্রগতিতে এক মরণপণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়।
দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ব্যাপক রক্তপাত ও লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে পাকিস্তানিদের নিশ্চিত পরাজয় ঘনীভূত হয়ে আসে।
সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে, তখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা বিভিন্ন রকম হীন কৌশল অবলম্বন করে এবং বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
তাদের সঙ্গে সহযোগিতায় থাকে হানাদারদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর দেশীয় লোকেরা। পাকিস্তান আর্মিদের সেই সুবিধাভোগীরা বাংলাদেশের পেশাজীবী, সংস্কৃতিসেবী, সুশীল শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করে হানাদার বাহিনীর হাতে দেয়!
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুদিন পূর্বে (১৪ ডিসেম্বর) পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলশামস ও আলবদর বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, দার্শনিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও শিল্প-সংগীতের সঙ্গে জড়িত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কবি ও সাহিত্যিকদের গভীর রাতে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। অতঃপর অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার হীন চক্রান্তে পরিকল্পিতভাবেই নিষ্ঠুরতম কায়দায় সেই বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানের গণকবরে দেশের নিরপরাধ পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। প্রকাশ থাকে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় যতই ঘনিয়ে আসছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ততই বেপরোয়া, নির্দয় ও পাশবিক হয়ে উঠেছিল।
১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর শহীদদের নিকটাত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের স্বজনদের মৃতদেহ শনাক্ত করেন। অনেকে চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান। যাদের কোনো সন্ধান মেলেনি। ঠিক তেমনই অনেক মায়ের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যাদের অনেকেই ফিরে আসেননি।
বলাবাহুল্য, একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় বর্বর গণহত্যা এবং একই সঙ্গে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাটি ছিল। যার ফলে পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালীন খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়। এই পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মাত্র কয়েক দিন আগে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আলবদর ও আলশামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে, যেখানে এসব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে এ কাজের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।
হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উদ্ধারকৃত অনেকের চোখ ও হাত-পা বাঁধা রক্তাক্ত দেহে ছিল আঘাতের চিহ্ন। কারও কারও শরীরে একাধিক গুলি এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাইয়ের মাধ্যমে অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। দেশের সেসব শিক্ষিত সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদেরকে নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞের পূর্বে কীভাবে তাদের প্রতি পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তার আলামত ও তথ্য পাওয়া যায়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের নিরপরাধ সাধারণ জনগণের ওপর নির্মম অত্যাচার, নিপীড়ন এবং নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং বিভীষিকাময় হত্যালীলা সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা চির ঘৃণিত ও ধিক্কৃত।
১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি আমরা সেই সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মনে করে ভারাক্রান্ত হয়ে যাই। তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে বিপুল ভাবগাম্ভীর্য ও শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার-পরিজনের কথা আমরা কতটুকু মনে রাখি। বরং দুঃখজনকভাবে উল্লেখ করতে হয়, স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন এবং নিরপেক্ষভাবে তাঁদের পরিবারের সঠিক পরিসংখ্যান নিরূপণ করা হয়নি। আরও বেশি বেদনাদায়ক হলো, অনেক শহীদ পরিবারের খোঁজও রাখা হয়নি। এভাবে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও অবহেলিত হয়েছেন। রাজনৈতিক বিরোধের জের হিসেবে সরকারের লেজুড়বৃত্তির বাইরে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ে ক্ষমতার অনেক পালাবদল ঘটেছে। রণাঙ্গনের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং সারা দেশের হানাদার বাহিনী কর্তৃক হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক তালিকা প্রণীত হয়নি। অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারেরও খবর নেওয়া হয়নি। একইভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারেরও খবর নেওয়া হয়নি। এটি লজ্জাজনক ও গ্লানিকর। রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে এবং রাজনীতির গণ্ডির মধ্য দিয়ে যতটুকু না করলেই নয় (!) দায়সারাগোছে ততটুকুই পালন করা হয়ে থাকে। প্রকৃতার্থে এখনো সকল শহীদ পরিবারের প্রতি সমানভাবে মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়নি।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, স্বাধীনতার পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেক পরিবারের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। স্বামীহারা বিধবা স্ত্রী, সন্তানহারা মা অথবা পিতা-মাতা হারানো সন্তান দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনে অনেকে পথের ভিখারিতে পরিণত হয়েছেন। অনেকে পাকিস্তানিদের নির্মমতা ও পাশবিকতার শিকার হয়েছেন, পাগল হয়ে গেছেন। কোথাও কোথাও শহীদ পরিবারের সদস্যরা পুষ্টিকর খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। স্বাধীনতার পর সামান্য সংখ্যক শহীদ পরিবারের প্রসঙ্গ থাকলেও সকলের প্রতি সমানভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। অনেকে অবহেলার শিকার হয়েছেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের মধ্যে যারা কিছুটা সচ্ছল ছিলেন, সেসব শোকাগ্রস্ত পরিবারের বিধবা স্ত্রী, সন্তান কিংবা মা-বোনেরা শোককে শক্তিতে পরিণত করে সরকারি আনুকূল্য ছাড়াই সংসারকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। অনেকেই দুঃখ-কষ্ট ও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তাদের সন্তানকে মানুষ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সেসব পরিবারের অপরিসীম ত্যাগ এবং যারা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন (!), তাদের পরিবারের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। এটি দুঃখজনক এবং আমাদের জন্য গ্লানিকর।
এ ছাড়া লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে গণমানুষের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণার্থে সর্বক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। এটা কোনো সুশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতির সংজ্ঞায় পড়ে না। এ প্রসঙ্গে প্লেটোর একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে। প্লেটো বলেছেন, ‘স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গৌরব। সুতরাং একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই স্বাধীন মানুষেরা বসবাসের ইচ্ছা করবে।’
আমাদের মনে রাখা দরকার, স্বাধীন রাষ্ট্র্রে জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকার না থাকলে স্বাধীনতার মূল্য থাকে না এবং তা অর্থহীন হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রপুঞ্জের জবাবদিহি হচ্ছে স্বাধীনতার সৌন্দর্য। বিগত হাসিনা সরকারের আমলে গণতন্ত্রের সেই সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়েছে। সরকারের খামখেয়ালিপনা ও একপেশে নীতির ফলে ক্ষুণ্ন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
সর্বস্তরের জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বিত হয়েছে। মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন জুলুম ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিতে সমগ্র প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার গণমানুষের সঙ্গে আগেকার সরকারসমূহের মতো প্রতারণা করবে না। দলমত-নির্বিশেষে গণমানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে বেগবান করে তুলবে। তিক্ত হলেও সত্যি, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা আরও বেশি ক্ষমতাবান হয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা রকম দলন-পীড়নের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়েই কেটেছে গণমানুষের জীবন-জীবিকা। সুশীল রাজনীতির পরিবর্তে রাজনীতিতে একধরনের উগ্রতা, উৎকট শক্তি ও বখাটেপনার উদ্ভব ঘটেছে। ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজন, চাটুকার শ্রেণি সমাজের মোড়ল সেজে বসেছে এবং রাতারাতি বিত্তবান হয়েছে। চোর-বাটপার, স্বাধীনতাবিরোধী, তোষামোদকারী এমনকি দাগি সন্ত্রাসী রাঘববোয়াল বনে গেছে।
সমগ্র দেশে দুর্নীতির সয়লাব এবং কালো টাকার বদৌলতে অনেকে হয়ে গেছে আঙুল ফুলে কলাগাছ। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বল্গাহীনভাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সেসব লুণ্ঠিত অর্থ ফেরত আনার দ্রুত ব্যবস্থা প্রয়োজন। পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় অপরাধীদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেসব অপরাধীর বিচার হওয়া প্রয়োজন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে বর্তমানে চুয়ান্ন বছরে পড়েছে। বিগত দিনগুলোর মূল্যায়নে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সমৃদ্ধি যতটা না বেড়েছে, তার চেয়ে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে বিশেষ শ্রেণির ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা। লেজুড়ভিত্তিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও আমলাদের বিত্ত-বৈভবের আকাশচুম্বী প্রাচুর্যতা ঘটেছে।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও তৃণমূল পর্যায়ের সকল মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। সর্বস্তরের রাষ্ট্রপুঞ্জের জবাবদিহি, নাগরিক জীবনের স্বস্তি ও নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। সমগ্র দেশে বখাটেপনা ও সামাজিক অবক্ষয় ও পাশবিকতার পরিবৃদ্ধি ঘটেছে। সমাজ থেকে সম্মানবোধ হ্রাস পেয়ে উগ্রতা ও নির্দয় আচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কুসংস্কারের অক্টোপাসে বেড়ে গেছে প্রকৃত ধর্মের অবমাননা, উন্মাদনা, ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড ও উগ্র মৌলবাদ।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সুশীল রাজনীতি এবং গণমানুষের কল্যাণকর সার্থক রাজনীতির আদর্শধারা ধ্বংস হয়ে গেছে। জনতার ভাগ্যের উন্নয়ন ও কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষমতার লোভে রাজনীতি হয়ে গেছে রাষ্ট্রক্ষমতাকেন্দ্রিক। একবার ক্ষমতা পাইলে আর কেউ নামতে চায় না এবং তাকে ক্ষমতা থেকে নামানো যায় না।
তবে চব্বিশের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে রাষ্ট্রক্ষমতায় যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে, তাদের দিকে এখন সকল নাগরিকের চোখ। গণমানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন কতটুকু হবে, সেটি ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
সমাজে চেপে থাকা বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সমতার ভিত্তিতে প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের এবং সচেতন নাগরিকদের। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্রজনতার বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকার সেই দিকগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেবে বলে প্রত্যাশা করি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মনে করলে হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তেমনি ১৯২৪-এর গণ-আন্দোলনে যে পরিমাণ ছাত্র-জনতা ও সর্বস্তরের গণমানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, আমরা তাদের প্রতি গভীর সমবেদনা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।
একইভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে এ-যাবৎ যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, সেসব শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আজকের বিজয় দিবসে এবং মহান শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সকল মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদের প্রতি সমান মর্যাদা প্রদান করা উচিত।
নিরপেক্ষভাবে সমগ্র দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সঠিক পরিসংখ্যান প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করা হোক এবং তাদের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হোক। তবেই মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের প্রতি আমাদের দায় ও ঋণ কিছুটা হলেও পরিশোধিত হবে।
পৃথিবীতে স্বাধীনতাসংগ্রামীদের রক্ত বৃথা যায় না। সে রকমই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের ত্যাগ ও রক্ত বৃথা যায়নি। ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মহান বিজয় দিবসে আমরা যেমন আনন্দ-উৎসবে একেবারে গা ভাসিয়ে না দিয়ে আজকের এই দিনে আমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করি এবং পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করি। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সম্মান, মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে গণমাধ্যমে যখন কোনো শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের দুর্দশার খবর আসে, তখন খুব কষ্ট লাগে। রাষ্ট্রপুঞ্জ তাঁদের যথাযথ সম্মান দিতে যেন কার্পণ্য না করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শন এবং সকল নাগরিকের প্রতি আমরা যেন সমান আচরণ করি। আসুন, আমরা সকল শহীদ পরিবারের কল্যাণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সমান মর্যাদা প্রদানে এগিয়ে আসি। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী সকল শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা। সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক


 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078