সুদীর্ঘ ১৯০ বছরের সশস্ত্র সংগ্রাম, নির্যাতন-নিগ্রহ, জেল-জুলুম, অত্যাচার-নিষ্পেষণ ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের লৌহশৃঙ্খল মুক্ত হয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে। ধর্মের অজুহাত দিয়ে বিভক্ত ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে নিয়ে ১৪ আগস্ট সাবেক পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটেছিল। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ধুরন্ধর সভাপতি কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সুসম্পর্কের কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে বেঙ্গল মুসলিম লীগের নেতা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ রাজনীতিবিদের যৌক্তিক দাবিমালাকে চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল। এরই পরিণতিতে হাত ফসকে কলকাতা পাকিস্তানের হাতছাড়া হয়ে গেল এবং করাচি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানীর মর্যাদা লাভ করল। প্রতিষ্ঠালগ্নের সেই বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদাদানের দাবিতে সর্বপ্রথম বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ বাঙালি দামাল ছেলের বুকের রক্তে ঢাকার পিচঢালা রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তি, স্বায়ত্তশাসনসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক দেশপ্রেমিক বাঙালি নেতা জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কারাগারে কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কুপরামর্শ ও কারসাজিতে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। এরই ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে মানবসভ্যতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় মুক্তিকামী জনতার সর্বাপেক্ষা গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। অবশেষে ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতি, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ৯৬ হাজার হানাদার পাকবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল।
দুর্ভাগ্যক্রমে অর্থনৈতিক চরম ধ্বংসস্তূপের ওপর দণ্ডায়মান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অল্প দিনেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ধূম্রজাল বুনতে লাগল। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের স্বার্থান্বেষী ও বুভুক্ষু রাজনীতিবিদেরা বিহারিদের সহায়-সম্পদ, সরকারি কোষাগার, ত্রাণসামগ্রী, খাল-বিল-নদী-নালা সবকিছু গোগ্রাসে গেলা ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি কর আমজনতাকে চরম দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার মাটিতে সশরীরে প্রত্যাবর্তন করলেও দেশের ক্রম অবক্ষয় ও মাৎস্যন্যায় দশার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। বরং শেখ মণি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মুজিববাদী ছাত্রলীগ, জাসদ ও জাসদ ছাত্রলীগের জন্ম হলো। আর শেষ রক্ষা হিসেবে শেখ মুজিব অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে এবং রক্ষীবাহিনী গঠন, বাকশাল প্রতিষ্ঠাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেও অত্যাসন্ন ধ্বংস ঠেকাতে ব্যর্থ হলেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেখ মণি ও বেগম মুজিবের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডে বিভাজন-বিভক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল, প্রতিশোধপরায়ণতার পটভূমিতে গুপ্তহত্যার পরিবেশ তৈরি হলো এবং পণ্যসামগ্রীর দাম হু হু করে বৃদ্ধি পেয়ে জনদুর্ভোগ তুঙ্গে উঠল। এ পর্যায়ে শেখ মুজিব দিনে দিনে জাতীয় নেতার স্থলে আওয়ামী ও পরিশেষে পারিবারিক নেতায় পরিণত হলেন। বিরোধীদের কঠোর হস্তে দমনে লাল ঘোড়া দাবড়ানোর ঘোষণা দিলেন, রক্ষীবাহিনী নামে নিজস্ব বাহিনী গঠন করলেন এবং সিরাজ শিকদারসহ অনেককে নির্বিচারে খুনও করা হয়। ক্রম অবনতিশীল জনপ্রিয়তার চরম মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু মুজিব আজীবনের চিরবিশ্বস্ত সহচর তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক দেশপ্রেমিক দলীয় নেতা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। যাহোক, একদিকে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ দেশবাসীর প্রাণহানি, অন্যদিকে সারা জীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি হওয়ার দুরভিসন্ধি ও বাকশাল গঠনের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত সপরিজনে শেখ মুজিবের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিল বলে রাজনৈতিক বিদগ্ধজনের ধারণা। অনেকের বিশ্বাস, শেখ মুজিবের জাতীয় নেতা থেকে দলীয় তথা পারিবারিক নেতা বা স্বৈরাচারী হওয়ার পেছনে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক ফায়দালোভী, উচ্ছিষ্টভোগী, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও বশংবদ সর্বদা ইন্ধন জুগিয়েছিল। অথচ ১৫ আগস্টের পর এসব স্তাবক ও ইন্ধনদাতা রাতারাতি মুজিব কোট ছেড়ে প্রথমে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাফারি গায়ে রীতিমতো জিয়াভক্ত বনে গিয়েছিল। যাহোক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কার্যকালে ক্যু-পাল্টা ক্যু, সেনা অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে জিয়ার প্রাণহানির কাহিনি কারও অজানা নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জেনারেল জিয়ার কার্যকালেও স্তাবক, পঞ্চমুখে কৃত্রিম প্রশংসাকারী, বংশবদ কম ছিল বললে সত্যের অপলাপ হবে। জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা ইসলাম ধর্মমতে পরচর্চা বা গিবতের পর্যায়ে পড়ে। তবে দেশবাসীকে ধোঁকা দিয়ে উদ্ভট দেশপ্রেমিক সাজার অভিনব পদ্ধতি হিসেবে এরশাদের সাইকেলে চড়ে অফিস গমনের দৃশ্য দেশবাসী ইহজনমেও ভুলবেন না। আবার এরশাদের স্বৈরাচারিতা তুঙ্গে ওঠায় এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি দেশের মাটিতে এরশাদভক্তের সংখ্যা নেহাত কম বললে ভুল বলা হবে। সর্বশেষ এশিয়ার লৌহমানবী হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী এবং রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টে দেশত্যাগে বাধ্য স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার উত্থান-পতনের নিখুঁত বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। মুজিব-বন্দনা, মুজিববর্ষ পালন, মুজিব পরিবারকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরস্থায়ী করার লক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ অর্থের শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল, তা শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। সবিস্ময়ে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবর্তক, প্রতিষ্ঠাতা বা জনকরা ছিলেন ১৯৭৫, ১৯৮১ ও ১৯৯০ পূর্ববর্তী সময়ের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান। মনে পড়ে, ১৯৭০ এর দশকে মানুষের চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ নিয়ে চট্টগ্রামের আলেম সমাজ খণ্ডযুদ্ধ বাধিয়েছিলেন। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবর্ণ যুগে বর্তমানে বাংলাদেশও মহাশূন্য অভিযান যুগে পা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রী এবং বিশাল কর্মীবাহিনী দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষদের দূরদর্শন, নীতি-আদর্শ এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ শতকের শেষ পাদের দিগ্্দর্শন-প্রযুক্তি-চিন্তাচেতনা-ভাবাদর্শ এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতিকে একুশ শতকের চাহিদা মেটানোর কতটুকু উপযোগী করে গড়ে তোলা যাবে, তার বিচারের দায়িত্ব দেশের ১২ কোটি ভোটার এবং পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করা হলো।
যাহোক, প্রায় দুই হাজার প্রাণহানি এবং ২০ সহস্রাধিক পঙ্গুর তাজা রক্তের সোপান বেয়ে বাংলাদেশের বিগত ৫২ বছরের ইতিহাসে এবারই সর্বপ্রথম একজন আন্তর্জাতিক প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। অতীতের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নমস্য বা পরিচিত ছিলেন কি না, তা আমার সীমিত জ্ঞানবুদ্ধির আলোকে জানা নেই। আবার উপদেষ্টামণ্ডলীর সিংহভাগই লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, পলিতকেশ, প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী। ইতিমধ্যে তাদের গৃহীত অনেক পদক্ষেপ বিশ্ব পরিমণ্ডলে যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে। জানামতে, নির্বাচনের আগেই ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পুুনর্গঠন এবং অত্যাবশ্যকীয় জাতীয় সংস্কার সাধনের গুরুদায়িত্ব পালনের মহান ব্রতকে সামনে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণ করেছিলেন। বিগত ১০০ দিনে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের শপথ-পরিপন্থী কোনো কর্মকাণ্ডের খবর পত্রিকার পাতায় মেলেনি। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চড়া দাম, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, বখাটেদের উৎপাত, ক্ষেত্রবিশেষে নতুন চাঁদাবাজদের উত্থান ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ডে মানুষ অসুবিধায় থাকলেও মোটেও আশাহত নন। সামনে তারা আশার আলো দেখছেন। অথচ চর্বিতচর্বণ মনে হলেও বলতে হচ্ছে, চাঁদাবাজি, মুনাফাখোরি, সিন্ডিকেট প্রথা, ইয়াবা ব্যবসা, মাদক সেবন, নানা ধরনের অনাসৃষ্টি এবং কেলেঙ্কারির সঙ্গে আমরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে জড়িত বা এসব অপকর্মের মদদদাতা। তাই সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশবাসীকে, বিশেষত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশকে অপরাধমুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এদিকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, জাতীয় কাক্সিক্ষত সংস্কারের পূর্বে চাপের মুখে নির্বাচন অনুষ্ঠান মূলত নতুন স্বৈরাচারের আগমন প্রশস্ত করবে এবং দেশবাসীকে শোষণ-নিষ্পেষণের উত্তপ্ত কড়াই থেকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবে। সমন্বয়কদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা এবং ছাত্র-জনতা ও সর্বস্তরের দেশবাসীর সর্বাত্মক ত্যাগের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদেরকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। পক্ষান্তরে ইতিমধ্যে দিল্লি থেকে নানাবিধ ফরমান জারি হচ্ছে, পতিত সরকারের সমর্থকেরা পুনর্গঠিত হওয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জোরদার হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণ বেশি দিন মেনে নেবে না ইত্যাদি তর্জন-গর্জনে দেশের বাতাস উত্তরোত্তর ভারাক্রান্ত হচ্ছে। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে রাজনীতির ভাগ্যাকাশে আবারও শকুনির আনাগোনা হিসেবে অভিহিত করলে ভুল বলা হবে কি?
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
দুর্ভাগ্যক্রমে অর্থনৈতিক চরম ধ্বংসস্তূপের ওপর দণ্ডায়মান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অল্প দিনেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ধূম্রজাল বুনতে লাগল। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের স্বার্থান্বেষী ও বুভুক্ষু রাজনীতিবিদেরা বিহারিদের সহায়-সম্পদ, সরকারি কোষাগার, ত্রাণসামগ্রী, খাল-বিল-নদী-নালা সবকিছু গোগ্রাসে গেলা ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি কর আমজনতাকে চরম দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলার মাটিতে সশরীরে প্রত্যাবর্তন করলেও দেশের ক্রম অবক্ষয় ও মাৎস্যন্যায় দশার বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। বরং শেখ মণি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মুজিববাদী ছাত্রলীগ, জাসদ ও জাসদ ছাত্রলীগের জন্ম হলো। আর শেষ রক্ষা হিসেবে শেখ মুজিব অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়ে এবং রক্ষীবাহিনী গঠন, বাকশাল প্রতিষ্ঠাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেও অত্যাসন্ন ধ্বংস ঠেকাতে ব্যর্থ হলেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শেখ মণি ও বেগম মুজিবের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর্মকাণ্ডে বিভাজন-বিভক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেল, প্রতিশোধপরায়ণতার পটভূমিতে গুপ্তহত্যার পরিবেশ তৈরি হলো এবং পণ্যসামগ্রীর দাম হু হু করে বৃদ্ধি পেয়ে জনদুর্ভোগ তুঙ্গে উঠল। এ পর্যায়ে শেখ মুজিব দিনে দিনে জাতীয় নেতার স্থলে আওয়ামী ও পরিশেষে পারিবারিক নেতায় পরিণত হলেন। বিরোধীদের কঠোর হস্তে দমনে লাল ঘোড়া দাবড়ানোর ঘোষণা দিলেন, রক্ষীবাহিনী নামে নিজস্ব বাহিনী গঠন করলেন এবং সিরাজ শিকদারসহ অনেককে নির্বিচারে খুনও করা হয়। ক্রম অবনতিশীল জনপ্রিয়তার চরম মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু মুজিব আজীবনের চিরবিশ্বস্ত সহচর তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক দেশপ্রেমিক দলীয় নেতা থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরত্ব সৃষ্টি করলেন। যাহোক, একদিকে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ দেশবাসীর প্রাণহানি, অন্যদিকে সারা জীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি হওয়ার দুরভিসন্ধি ও বাকশাল গঠনের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত সপরিজনে শেখ মুজিবের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছিল বলে রাজনৈতিক বিদগ্ধজনের ধারণা। অনেকের বিশ্বাস, শেখ মুজিবের জাতীয় নেতা থেকে দলীয় তথা পারিবারিক নেতা বা স্বৈরাচারী হওয়ার পেছনে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক ফায়দালোভী, উচ্ছিষ্টভোগী, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও বশংবদ সর্বদা ইন্ধন জুগিয়েছিল। অথচ ১৫ আগস্টের পর এসব স্তাবক ও ইন্ধনদাতা রাতারাতি মুজিব কোট ছেড়ে প্রথমে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাফারি গায়ে রীতিমতো জিয়াভক্ত বনে গিয়েছিল। যাহোক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কার্যকালে ক্যু-পাল্টা ক্যু, সেনা অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে জিয়ার প্রাণহানির কাহিনি কারও অজানা নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জেনারেল জিয়ার কার্যকালেও স্তাবক, পঞ্চমুখে কৃত্রিম প্রশংসাকারী, বংশবদ কম ছিল বললে সত্যের অপলাপ হবে। জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা ইসলাম ধর্মমতে পরচর্চা বা গিবতের পর্যায়ে পড়ে। তবে দেশবাসীকে ধোঁকা দিয়ে উদ্ভট দেশপ্রেমিক সাজার অভিনব পদ্ধতি হিসেবে এরশাদের সাইকেলে চড়ে অফিস গমনের দৃশ্য দেশবাসী ইহজনমেও ভুলবেন না। আবার এরশাদের স্বৈরাচারিতা তুঙ্গে ওঠায় এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি দেশের মাটিতে এরশাদভক্তের সংখ্যা নেহাত কম বললে ভুল বলা হবে। সর্বশেষ এশিয়ার লৌহমানবী হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী এবং রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টে দেশত্যাগে বাধ্য স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার উত্থান-পতনের নিখুঁত বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। মুজিব-বন্দনা, মুজিববর্ষ পালন, মুজিব পরিবারকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরস্থায়ী করার লক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের কী পরিমাণ অর্থের শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল, তা শ্বেতপত্র আকারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। সবিস্ময়ে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান লব্ধপ্রতিষ্ঠ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবর্তক, প্রতিষ্ঠাতা বা জনকরা ছিলেন ১৯৭৫, ১৯৮১ ও ১৯৯০ পূর্ববর্তী সময়ের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান। মনে পড়ে, ১৯৭০ এর দশকে মানুষের চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ নিয়ে চট্টগ্রামের আলেম সমাজ খণ্ডযুদ্ধ বাধিয়েছিলেন। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবর্ণ যুগে বর্তমানে বাংলাদেশও মহাশূন্য অভিযান যুগে পা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রী এবং বিশাল কর্মীবাহিনী দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষদের দূরদর্শন, নীতি-আদর্শ এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ শতকের শেষ পাদের দিগ্্দর্শন-প্রযুক্তি-চিন্তাচেতনা-ভাবাদর্শ এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতিকে একুশ শতকের চাহিদা মেটানোর কতটুকু উপযোগী করে গড়ে তোলা যাবে, তার বিচারের দায়িত্ব দেশের ১২ কোটি ভোটার এবং পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করা হলো।
যাহোক, প্রায় দুই হাজার প্রাণহানি এবং ২০ সহস্রাধিক পঙ্গুর তাজা রক্তের সোপান বেয়ে বাংলাদেশের বিগত ৫২ বছরের ইতিহাসে এবারই সর্বপ্রথম একজন আন্তর্জাতিক প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। অতীতের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নমস্য বা পরিচিত ছিলেন কি না, তা আমার সীমিত জ্ঞানবুদ্ধির আলোকে জানা নেই। আবার উপদেষ্টামণ্ডলীর সিংহভাগই লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, পলিতকেশ, প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী। ইতিমধ্যে তাদের গৃহীত অনেক পদক্ষেপ বিশ্ব পরিমণ্ডলে যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়েছে। জানামতে, নির্বাচনের আগেই ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পুুনর্গঠন এবং অত্যাবশ্যকীয় জাতীয় সংস্কার সাধনের গুরুদায়িত্ব পালনের মহান ব্রতকে সামনে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা শপথ গ্রহণ করেছিলেন। বিগত ১০০ দিনে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের শপথ-পরিপন্থী কোনো কর্মকাণ্ডের খবর পত্রিকার পাতায় মেলেনি। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চড়া দাম, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, বখাটেদের উৎপাত, ক্ষেত্রবিশেষে নতুন চাঁদাবাজদের উত্থান ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ডে মানুষ অসুবিধায় থাকলেও মোটেও আশাহত নন। সামনে তারা আশার আলো দেখছেন। অথচ চর্বিতচর্বণ মনে হলেও বলতে হচ্ছে, চাঁদাবাজি, মুনাফাখোরি, সিন্ডিকেট প্রথা, ইয়াবা ব্যবসা, মাদক সেবন, নানা ধরনের অনাসৃষ্টি এবং কেলেঙ্কারির সঙ্গে আমরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষাভাবে জড়িত বা এসব অপকর্মের মদদদাতা। তাই সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশবাসীকে, বিশেষত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশকে অপরাধমুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এদিকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, জাতীয় কাক্সিক্ষত সংস্কারের পূর্বে চাপের মুখে নির্বাচন অনুষ্ঠান মূলত নতুন স্বৈরাচারের আগমন প্রশস্ত করবে এবং দেশবাসীকে শোষণ-নিষ্পেষণের উত্তপ্ত কড়াই থেকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবে। সমন্বয়কদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা এবং ছাত্র-জনতা ও সর্বস্তরের দেশবাসীর সর্বাত্মক ত্যাগের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদেরকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। পক্ষান্তরে ইতিমধ্যে দিল্লি থেকে নানাবিধ ফরমান জারি হচ্ছে, পতিত সরকারের সমর্থকেরা পুনর্গঠিত হওয়ার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জোরদার হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণ বেশি দিন মেনে নেবে না ইত্যাদি তর্জন-গর্জনে দেশের বাতাস উত্তরোত্তর ভারাক্রান্ত হচ্ছে। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে রাজনীতির ভাগ্যাকাশে আবারও শকুনির আনাগোনা হিসেবে অভিহিত করলে ভুল বলা হবে কি?
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।