অমিত্র সীমান্ত : বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের করুণ বাস্তবতা

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ , চলতি সংখ্যা
কূটনৈতিক সৌজন্যের আড়ালে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের একটি অন্ধকার ও অস্থির সত্য প্রকাশিত হয়। কয়েক দশক ধরে বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এই দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্তটি একটি মারণান্তিক সীমান্তে পরিণত হয়েছে, যেখানে সুসম্পর্কের প্রতিশ্রুতি ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কঠোর কর্মকাণ্ড দ্বারা ব্যর্থ হয়েছে। এই নির্মম বাস্তবতা ভারতের কথিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিশ্রুতির প্রতি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে।
রক্তে রঞ্জিত সীমান্ত : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তটি বিশ্বের অন্যতম মরণান্তিক সীমান্ত হিসেবে পরিচিত। দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত হওয়া সত্ত্বেও এই সীমান্তটি সহিংসতার সমার্থক হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বিএসএফের হাতে। বিএসএফের অতিরিক্ত এবং প্রায়ই প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহারের কারণে শত শত বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিক তাদের জীবন হারিয়েছে বা গুরুতর আহত হয়েছে। ১৪ বছর বয়সী রাসেল মিয়ার মতো নিরীহ জীবনের মৃত্যু-যাকে বিএসএফ সদস্যরা চোখে গুলি করে-ব্যথা ও অবিচারের একটি চিরস্থায়ী চিত্র হিসেবে রয়ে গেছে।
রাসেলের ঘটনা এ ধরনের অনেক ঘটনার একটি, যা একটি ভীতিকর প্রবণতাকে তুলে ধরে। বিএসএফের প্রাথমিক প্রবণতা হচ্ছে প্রথমে গুলি করা, পরে প্রশ্ন করা। রাসেলের মতো নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষদেরও হত্যা করা হয়েছে, যারা কোনো হুমকি সৃষ্টি করেনি। রাসেলকে সীমান্তের কাছে তার পরিবারের গরুর দেখাশোনা করার সময় গুলি করা হয়েছিল। এই ঘটনা এবং অসংখ্য অন্যান্য ঘটনা ভারতের সীমান্ত ব্যবস্থাপনার একটি কঠিন চিত্র তুলে ধরে, যেখানে বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিকদের জীবনকে তুচ্ছতায় দেখা হয়।
ফেলানী খাতুনের ট্র্যাজেডিÑএক বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক : এই শত্রুতার সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি হলো ফেলানী খাতুনের মর্মান্তিক মৃত্যু। ১৪ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি কিশোরী, যাকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছিল, যখন সে তার বাবার সঙ্গে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছিল। তার মৃতদেহ কাঁটাতারের বেড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝুলে ছিল, যা সীমান্তে বিএসএফের হাতে অনেক বাংলাদেশি নাগরিকের মুখোমুখি হওয়া নৃশংসতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং বিচার প্রত্যাশার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ফেলানীর মৃত্যুর জন্য দায়ী সৈনিককে খালাস দেওয়া হয়েছিল। এই রায় শুধু ফেলানীর পরিবারকেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেনি, বরং এটি বাংলাদেশের জনগণের কাছে একটি শীতল বার্তা পাঠিয়েছে : বিএসএফের চোখে তাদের জীবন মূল্যহীন এবং এ ধরনের ঘটনার জন্য জবাবদিহি শুধু এক দূরবর্তী আশা।
সম্প্রতি, গত সপ্তাহে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ১৩ বছর বয়সী স্কুলছাত্রী স্বর্ণা দাস এবং ১৬ বছর বয়সী শ্রী জয়ন্তকে হত্যা করেছে। এই হত্যাকাণ্ডগুলো সীমান্ত বাহিনীর নিষ্ঠুর কাজ এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। প্রতিবার ভারত ভুয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়াই ভুয়া প্রতিশ্রুতি দেয় এই অবৈধ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ব্যাপারে।
বিশ্বাসের ক্ষয় : সীমান্তের সহিংসতা দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষয় করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের অধীনে বাংলাদেশ ভারতকে সাধারণত বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছে, কিন্তু বিএসএফের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে এই ধারণা যে, ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশি স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থ বেশি অগ্রাধিকার পায়।
এই বাড়তে থাকা অবিশ্বাস অযৌক্তিক নয়। বিএসএফের কর্মকাণ্ড, যা কেবল হত্যাকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিকদের অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত, ভারতীয় নেতৃত্বের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিপরীতে একটি কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরে। অ-প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও হত্যা অব্যাহত রয়েছে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে গুরুতর সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব : সীমান্তের সহিংসতা ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘন মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে তুলে ধরে। যদিও ভারত সরকার বারবার এই ঘটনাগুলোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে এবং ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের জন্য বিচার এখনো অধরা।
এই নিষ্ক্রিয়তা ভারতের নেতৃত্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। এটি একটি বৃহত্তর সমস্যাও উন্মোচন করে : কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাস্তব ক্ষেত্রে কোনো অর্থবহ পরিবর্তনে পরিণত হতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার, যা প্রায়ই ভারতীয় স্বার্থের প্রতি অতিমাত্রায় অনুকূল হিসেবে দেখা হয়, তার নাগরিকদের রক্ষা করতে এবং ভারতের কাছ থেকে জবাবদিহি দাবি করতে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য সমালোচিত হয়েছে।
সুসম্পর্ক বজায় রাখার কিছু সুপারিশ
১. সীমান্তে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা : সীমান্তে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের জন্য যথাযথ তদন্ত ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা উচিত। ভারতকে তার বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান বজায় রাখতে হবে।
২. কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা কমানো : সীমান্ত ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিয়মিত ও ফলপ্রসূ কূটনৈতিক আলোচনা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক পুনর্গঠন করা সম্ভব। আলোচনার পর কার্যকর পদক্ষেপসমূহ অবশ্যই নিতে হবে, তা না হলে পূর্বের মতো হত্যাকাণ্ড ঘটতেই থাকবে। ভারতকে এ ব্যাপারে আরও বেশি কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে, নইলে দীর্ঘদিনের বিরাজমান এই সমস্যার সমাধান হবে না।
৩. অ-প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা : ভারতের পক্ষ থেকে অ-প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি পুনর্বহাল করতে হবে, যাতে সীমান্তে সহিংসতা কমে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার জনগণের ওপর যাতে অহেতুক কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার না করে, সে ব্যাপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া প্রয়োজন।
৪. সীমান্তের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা : সীমান্তে বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য উভয় দেশের সরকারের আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উপসংহার : শুধুই নামের বন্ধুত্ব?
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার একটি মডেল হিসেবে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রায়ই প্রশংসিত হয়। তবে সীমান্তে চলমান সহিংসতা ভিন্ন গল্প বলেÑএক. বন্ধুত্বের গল্প, যা কথার মধ্যে বিদ্যমান, কিন্তু বাস্তবে নয়। বিএসএফ যত দিন পর্যন্ত দায়মুক্তির সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশিদের জীবনকে তুচ্ছতায় দেখা হবে, তত দিন পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক গভীর ত্রুটিযুক্ত থাকবে। ভারতকে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং বাংলাদেশের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। অন্ততপক্ষে, ভালো প্রতিবেশী হিসেবে আচরণ করতে হবে, যদি বন্ধুত্ব না-ই করতে পারে। কারণ বাংলাদেশের জনগণ গত ৫৩ বছরে তাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছে, যেখানে ভারত ব্যর্থ হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে কোনো বন্ধুত্বের সম্ভাবনা নেই।
সীমান্তের আশপাশে বসবাসকারী মানুষের জন্য বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি সামান্য অর্থ বহন করে, যখন তাদের দৈনন্দিন বাস্তবতা ভীতি ও সহিংসতায় পরিপূর্ণ। যতক্ষণ না ভারত তার সীমান্ত বাহিনীর কর্মকাণ্ড মোকাবিলা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয় এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুত্ব শুধুই একটি বিভ্রম হিসেবে থেকে যাবে।
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078