উজান ঢাকির মাঠে

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৪, ১৮:৫৪ , চলতি সংখ্যা
খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে ফজরের নামাজ আদায় করে দরজার ছিটকিনিটা খুলতেই মনটা ভরে গেল তিথির। আহা কি শান্ত সবুজ চারপাশ। অনেকদিন পর এমন একটা স্নিগ্ধ সকাল দেখার সুযোগ হলো। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব রেখে গ্রামের বাড়িতে এসেছে দু’দিনের জন্য। বাড়িতে এখন তেমন কেউই থাকে না, বাবা-মা দু’জনেই গত হয়েছেন। এক বছরের ব্যবধানে হারাতে হয়েছে দু’জনকে। বাড়িতে এলে মনটা একা একা হু হু করে কাঁদে। সবকিছু থেকেও মনে হয় কোথাও কিছু নেই। এদুটো দিন তার। এই সময়টুকুর ভাগ সে কাউকেই দিতে চায় না। একান্ত আপন সময় কাটাতে চায় সে। পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে কত শত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। টুকটুক করে হেঁটে এগুতেই শুনতে পায় কত রকমের পাখির ডাক। হাঁস মুরগি ছেড়ে দেয়া হয়েছে, ওরা খক খক করে আধার খাচ্ছে। হাঁসগুলো পুকুরে নামার উদ্দেশ্যে দল বেঁধে যাচ্ছে। লাকড়ির চুলার একটা গন্ধ আসছে নাকে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে গিয়ে বসে তিথি। একটা কলাপাতা ছিঁড়ে তাতে পা দুটো ভাঁজ করে বসে থাকে। কি মনে করে পেছন পেছন একটা কুকুরও এসেছে, কুকুরটা সম্ভবত পাশের বাড়ির। তিথিকে বসতে দেখে একটু দূরে সেও গিয়ে বসে থাকলো। তিথি ওর কাণ্ডকারখানা দেখে একা একা হাসে আর বলে, ‘কি রে তোরও একলা সময় কাটাতে ইচ্ছে হয় আমার মতো।’
নদীটা একটা বড় নদীর শাখা, চুপচাপ বয়ে চলে, তেমন বিস্তৃতও না। তবে মজার ব্যাপার হলো নদীর পানি দুই রকমের, একপাশে ঘোলা আর একপাশে টলটলে স্বচ্ছ পানি। সৃষ্টিকর্তার কত রকমের সৌন্দর্য চিন্তা। একটা বরই গাছের ডালে দুটো মুনিয়া পাশাপাশি বসে আছে। লাল মুনিয়া দেখতে কী অপরূপ! পুরো গায়ের রঙ লাল, শুধু পাখা দুটো ধূসর তার ওপর সাদা সাদা ফোঁটা দেয়া। কী নিপুণ করে রঙ করা, দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছে, দু’জন মিলে কী যেন গল্প করছে, কতদিন পর দেখা হয়েছে তাদের। সকালের মিষ্টি বাতাস আর নদীর কুলকুল ধ্বনিতে তিথির একটা তন্দ্রা ভাব হচ্ছে। মনে হলো সে যেন ডালে বসে থাকা মুনিয়াদের কথা শুনতে পাচ্ছে।
-কেমন আছ মীনা?
-এই তো ভালো। এখানে ফুলে ফুলে ভরা বাগান পুরো বছর জুড়েই বসন্ত, আর তোমার ওখানে?
-আমার এখানেও সুন্দর আবহাওয়া ফুলে ফুলে ভরা চারিপাশ ঝিরিঝিরি বাতাস, মিষ্টি সুবাস ছড়াতে থাকে সবসময়। এখানে সবই আছে মীনা, শুধু তুমি নাই।
-আমার এখানেও কোনোকিছুর অভাব নাই আজিজ, শুধু তুমি ছাড়া।
-মীনা তোমার মনে আছে, তোমাকে আমি পেয়েছিলাম বৈশাখের প্রথম দিনে। পহেলা বৈশাখ ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ। বৈশাখী ঝড়, লণ্ডভণ্ড সবকিছু। সেই সাথে আমার মনের মধ্যেও চলছিল উথাল পাথাল ঝড় বৃষ্টি, তোমাকে পাওয়ার আনন্দে। সবুজ বেনারশিতে তোমাকে অপরূপা লেগেছিল সেদিন। মস্ত বড় একটা খোঁপা করে তোমার রেশমি সোনালি চুলে সবাই সেদিন গুঁজে দিয়েছিল বেলি ফুলের মালা চিন্দন দিয়ে। আলপনা করেছিলে তোমার কপালে। ছোটখাটো একটা মানুষ তুমি। দুধে আলতা গায়ের রঙ ছিল তোমার। মাথার চুল গড়িয়ে পড়ত হাঁটুরও নিচে। নীল রঙের চোখের অধিকারিনী ছিলে তুমি, ওমন সুন্দর চোখ সারাজীবনে আর একটিও দেখিনি আমি। একজন শান্ত স্বভাবের পরী এসেছিল আমার ঘরে সেদিন। তোমার বয়স তখন সবে চৌদ্দ।
-আর আজিজ তুমিও তো তখন ছিলে ২২ বছরের টগবগে যুবক। ব্রুনাই থেকে সদ্য পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরলে। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো হালকা সোনালি চুল ছিল তোমার। দারুণ সুদর্শন, কথাবার্তায় পটু একজন মানুষ। দেশ, দুনিয়া, রাজনীতি সবকিছু নিয়ে দারুণ আগ্রহ তোমার। তোমার সাথে কথায় পেরে উঠতে পারত না কেউই।
-জানো মীনা, আমাকে সবাই বলতো আমি নাকি খুব স্ত্রৈন, মনে করত ভয় পেয়েই হয়তো আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু বোকারা তো জানে না, ভয় পেয়ে কখনো কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে না। আমি যে তোমার মোহে মোহিত থাকতাম দিনমান, তা তো ওরা বুঝত না।
ওরা যে যাই বলুক না কেন আজিজ আমি তো জানতাম বৈশাখের সেই প্রথমদিন থেকে শেষ পর্যন্ত তুমিই আমার কাছে ছিলে, আমার পাশে ছিলে।
-তুমি বরাবরই খুব আহ্লাদি ছিলে তোমার বাবা চাচার কাছে। তোমাকে আনার সময় আমিও মনে মনে ভেবেছিলাম মাথায় তুলে রাখব তোমায়। সওদাগরের মেয়ে তুমি, ছিলেন সামান্য অহংকারীও। সবকিছুতে নিখুঁত সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াতে। নিজেকে ও চারপাশকে পরিপাটি করে রাখতে সবসময়।
-তা তো ঠিকই, আমাকে তুমি মাথায় তুলে রেখেছিলে। সেদিনও শেষ বেলায় তুমিই তো আমাকে পানি খাওয়ালে।
-কিন্তু মীনা, তুমি তো আমাকে একা রেখে ঠিকই চলে গিয়েছিলে। তুমি যাওয়ার পরে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি ঠিকই দুটো চায়ের কাপ সাজানো। তোমার আর আমার। সকাল হলেই একসাথে চা খাওয়ার কথা ছিল আমাদের। তুমি আইড় মাছ খুব পছন্দ করতে, আমি পুরো বাজার ঘুরে তোমার জন্য এনেছিলাম, তুমি তো না খেয়েই চলে গেলে। কিন্তু খুব মনোযোগ দিয়ে রান্না করেছিলে হালকা ঝোলের দুই টুকরো মাছ। জানো মীনা, যে রাস্তা দিয়ে সবুজ বেনারসি পরিয়ে তোমাকে ঘরে তুলেছিলাম, সেই রাস্তা দিয়েই শরৎ শুভ্র পোশাকে রেখে এসেছি তোমাকে উজান ঢাকির টিলার পাশের মাঠে। সবসময় পছন্দ করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা। একদম তোমার পছন্দমতো জায়গাতেই আমি রেখে এসেছি তোমাকে। কিন্তু তুমি যাওয়ার পর আমি একবছরও থাকতে পারিনি তোমায় ছেড়ে, এমন না যে আমার কোনো অযত্ন হচ্ছিল। কিন্তু তুমি ছাড়া আমিতো অসম্পূর্ণ, আমার বাগান শূন্য।
-তুমি আমাকে কখনোই অযত্ন করোনি আজিজ, এখানেও এনে রেখেছ ছায়া সুনিবিড় শ্যামল মাঠের মাঝে। এখানে দোয়েল ডাকে, বেলি, গন্ধরাজ, কামিনী, হাছনাহেনা সবই ফোটে। কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়ে তোমার আর আমার উপরে। তুমিও তো শুয়ে আছ আমার পাশাপাশি মাটির ঘরে। শুধু ছুঁয়ে দেখতে পারি না একজন আরেকজনকে। আবার কবে একসাথে হব আমরা? হাত ধরাধরি করে পুকুরের সিঁড়ি ভেঙ্গে নামব, আমার পছন্দের আইড় মাছ আর বেলি আনবে তুমি।
তিথির মনে হলো, হঠাৎ তার তন্দ্রাভাব কেটে গেছে, চোখ খুলতেই দেখতে পেল পাখি দুটো আর ডালে বসা নেই। পেছনে যে কুকুরটা বসা ছিল সেও চলে গেছে। কেমন একটা গা ছমছম অনুভূতি হলো তিথির, আস্তে করে উঠে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল সে। কতদিন মা বাবাকে দেখে না। বাড়ির ছোট মেয়ে, কত আদর আর আহ্লাদে দিন কেটেছে তার। একা একা হাঁটে আর বিড়বিড় করে ডাকতে থাকে মা, মাগো, মা। বাবা, বাবাগো, কতদিন দেখি না তোমাদের।
লেখক : কথাশিল্পী।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078