বাবার  স্মৃতি

প্রকাশ : ১৩ জুন ২০২৪, ১৫:২৮ , চলতি সংখ্যা
আমার বাবা এ কে এম আবদুল হালিম, ডাকনাম মানিক। তদানীন্তন ত্রিপুরা (পরে কুমিল্লা) জেলার নবীনগর থানার প্রত্যন্ত গ্রাম মাঝিয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন। দাদা বন্দে আলী মাস্টারের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। দাদার মৃত্যুর পর স্থানীয় হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে পরিবারের হাল ধরার জন্য কলকাতায় গিয়ে ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশে যোগদান করেন। দেশ বিভাগের পর দেশে ফিরে এসে বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাব-ইন্সপেক্টর (দারোগা) পদে আসীন হন। চাকরিজীবনের প্রায় সারাটা সময় কাটিয়েছেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন থানায়। অবসর গ্রহণের আগে দুই বছর কাজ করেছেন ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চে।
আর ১০ জন বাবার মতো সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন শুধু ছেলেমেয়েকে বড় করা, লেখাপড়া শেখানো ও পরিবারের সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থে। তারা তার সঙ্গে মিশেছেন, তারা তাকে না ভালোবেসে পারেননি। তিনি তার থানা এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সব সময় ওঠা-বসা করতেন। তারা কেউ ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক, কলেজের অধ্যাপক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ। মনে পড়ে গফরগাঁও থানার সামনের সড়কের হোমিও চিকিৎসক শামসুল হুদা ছিলেন বাবার অন্যতম একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার সঙ্গে বাবাকে প্রায়ই চায়ের আড্ডায় গল্পগুজব করতে দেখেছি। বাবার বন্ধু হিসেবে আমরাও ডাক্তার সাহেবের অপার স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি।
আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন, বন্ধুবৎসল, সদালাপী ও পরোপকারী একজন মানুষ। একমাত্র ছোট ভাইকে তিনি টাঙ্গাইলে নিয়ে এসে করটিয়া কলেজে ভর্তি করেন। সেখান থেকে তিনি স্নাতক পাস করে ঢাকায় সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। একমাত্র বোনকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে প্রিয় বোনকে দেখার জন্য মাসে অন্তত দু-তিনবার পায়ে হেঁটে বোনের মালিবাগের বাসায় চলে যেতেন। বোনের কাছেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত আদরের ভাই। তিনিও প্রায়ই আমাদের কলাবাগানের বাসায় এসে ভাইয়ের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যেতেন। বোনের সন্তানদের প্রতিও বাবার ছিল অপার স্নেহ-ভালোবাসা।
গফরগাঁওয়ের ইসলামিয়া হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে আমাকে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়। পরীক্ষার জন্য আমাকে কয়েক দিনের জন্য ময়মনসিংহ শহরে থাকতে হবে। সরকারি কাজে ব্যস্ততার জন্য বাবার পক্ষে আমাকে নিয়ে ময়মনসিংহে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সে জন্য তিনি ঢাকায় অবস্থানরত আমার ফুপাতো ভাই হুমায়ুন ভাইকে ডেকে পাঠালেন। বাবা ময়মনসিংহ শহরে তার এক বন্ধুর বাসায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। যথাসময়ে হুমায়ুন ভাই আমাকে ময়মনসিংহ শহরে নিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে কয়েক দিন সেখানে থেকে পরীক্ষা দেওয়ার কাজ শেষ করি। পরীক্ষার শেষ দিনে সন্ধ্যায় ট্রেনে গফরগাঁও ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও সেই চিন্তা বাদ দিই। শহরে এসেছি আর সিনেমা না দেখে চলে যাব, সেটা কী করে হয়!
হুমায়ুন ভাইকে সে কথা জানাতে তিনি রাজি হলেন পরদিন ফিরে যেতে। পরদিন শহরের দুটি সিনেমা হলে (অলকা ও ছায়াবাণী) সকাল ও দুপুরের শোতে সিনেমা দেখে আমরা ট্রেনে রাতে বাড়ি ফিরে আসি। বাংলা ছবি দেখার ইচ্ছা থাকলেও দুই হলেই উর্দু ছবি চলার কারণে উর্দু ছবিই দেখতে বাধ্য হই।
বাড়ি ফিরে বাবার সঙ্গে দেখা হলে তিনি কিছুই বললেন না। বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে এসেছি, সেটাই ছিল তার তৃপ্তির বিষয়। পুরো বৃত্তান্ত শোনার পর তার মুখে যে ভাবটি ফুটে উঠেছিল, তার মর্মার্থ ছিল, বাব্বা, তোরা পারিসও বটে!
বাজার-সদাই করতে গেলে ছোট ভাই শেলি অধিকাংশ সময় বাবার সঙ্গী হতো। দু-একবার আমারও তার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বাজার শেষে রেস্তোরাঁয় নিয়ে তিনি আমাদের চা-শিঙাড়া খাওয়াতেন। বাবার সঙ্গে বসে খেতে কত যে ভালো লাগত, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। জাম্বুরা দিয়ে বল খেলি দেখে একবার তিনি আমাদের একটা ভালো ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে এ ধরনের কত শত মধুর স্মৃতি রয়েছে, যেগুলো বাবার মৃত্যুর ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মনে সমুজ্জ্বল রয়েছে। আসলে His quiet love spoke louder than words.
বাবা ছিলেন একজন ভোজনরসিক মানুষ। কই, শিং ও মাগুর ছিল তার অত্যন্ত প্রিয় মাছ। এসব মাছ দিয়ে আমার স্ত্রীর রান্না করা খাবার তিনি খুব পছন্দ করতেন। সে কথা তিনি আমার মায়ের সামনে জানিয়ে বলতেন, তোমার রান্না তোমার শাশুড়ির চেয়ে ভালো।
বাবা গান শুনতে বড় ভালোবাসতেন। গ্রামোফোন যন্ত্রে তিনি রেকর্ড চালিয়ে গান শুনতেন। নিজের মেয়েকে গান শেখানোর জন্য মাস্টার রেখে দিয়েছিলেন। যদিও নানা কারণে পরে আমার বোন গানের চর্চা আর অব্যাহত রাখতে পারেনি।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে (ব্রেন হেমারেজ) আক্রান্ত হয়ে তিনি মাত্র ৬৫ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। আমি ও আমার স্ত্রী যখন শেষবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে দেখতে যাই, তখন তার চোখ ছিল খোলা আর মুখ প্রশান্তিময়। মনে পড়ে, তার হাতটা ধরে মাথায় হাত বুলিয়েছিলাম। জীবিত মানুষের মধ্যে ব্যথা-বেদনা না থাকাটা একটা সৌভাগ্যের বিষয়। সুখের বিষয় তিনি ব্যথা-বেদনামুক্ত ছিলেন।
মার্কিন অভিনেতা ও গায়ক পল পিটারসেন ‘My Dad’ নামে একটি গান গেয়েছেন। গানের কয়েকটি লাইন ছিল এ রকম : He isn’t much in the eyes of the world, he will never make history but he is the world to me.
গানের কথাগুলোর সঙ্গে বাবার প্রতি আমার অনুভূতির অনেক মিল খুঁজে পাই।
লেখক : কলামিস্ট
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041