পাতার বাঁশি

প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৩ , চলতি সংখ্যা
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে বাতাসের তীব্রতাও আছে। বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ছে সুমির চোখে-মুখে। চলন্ত বাসের জানালার পাশে বসেই বৃষ্টি পড়ার দৃশ্যগুলো উপভোগ করছে সে। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় নাম না-জানা গাছগুলো কেমন যেন পরিবেশটাকে মোহনীয় করে তুলেছে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে এসেছে। ঢাকায় এক দিন অবস্থান করার পর বাসে করে যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে।
দীর্ঘ ৩০ বছর পর দেশে ফেরা। সবকিছুই সুমির কাছে অচেনা মনে হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে নানা টানাপোড়েনে আর দেশে ফেরা হয়নি। বৈধ কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে করতেই চলে গেল এই দীর্ঘ সময়।
একমাত্র পুত্রসন্তান বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে। স্বামী মারা গেছে বছর দুয়েক হলো। এখন একা একাই কাটে তার জীবন। কত দিন ভেবেছে দেশে আসবে, কিন্তু আসা আর হয়নি। অসুস্থ স্বামীর সেবা করতে করতেই চলে গেল জীবনের বেশ কিছুটা সময়। সংসারের বোঝা তাকে বেশ ক্লান্ত করে ফেলেছে। একসময় স্বামীকে আর ধরে রাখা গেল না। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলেই গেল। তারপর তার শেষ অবলম্বন ছিল পুত্র। সেও একদিন ভিনদেশি একটি মেয়েকে বিয়ে করে ঘর ছাড়ল।
যাদের মায়ায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো পার করে দিয়েছে, তারাই আজ তাকে ছেড়ে চলে গেল। একজন পরপারে, অন্যজন ঘর ছেড়ে। সুমি এখন একা। তাই এবার দেশের জন্য মনটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। দেশে বৃদ্ধা মা এবং এক ভাই আছে। এই দীর্ঘ সময়ে মা-বাবা তাকে কতবার দেখতে চেয়েছে, কিন্তু আসা আর হয়নি। বাবা একসময় ‘সুমি সুমি’ করতে করতে মরেই গেল।
সুমির বুক ফেটে কান্না আসছে। এত দিন সে কান্নারও সময় পায়নি। আজ যেন সব বাঁধ ভেঙে কান্নার স্রোতোধারা বয়ে চলছে তার দু’চোখ বেয়ে।
বৃষ্টির পানিতে সেই কান্নার লোনাজল মিলেমিশে একাকার।
‘জানালাটা বন্ধ করেন। পানিতে ভিইজা যাইতাছেন তো!’ বাসের হেলপারের কথায় সংবিৎ ফিরে পায় সুমি।
‘ও আচ্ছা’ বলে বাসের জানালাটা নামিয়ে দেয়। বৃষ্টির পানিতে সে অনেকখানি ভিজে গেছে। তার কাছে ভালোই লাগছিল। কত দিন বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। ছোটবেলায় কত ভিজেছে। ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে কতবার আম কুড়িয়েছে। বৃষ্টি এলেই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আহা, কী সুন্দর শৈশব। আবার কি ফিরে পাওয়া যাবে!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। বৃষ্টি কমে আকাশে একটি লাল আভা তৈরি হয়েছে। দূরে রংধনু দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখার জন্য জানালাটা একটু খুলে দেয়। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা মনপ্রাণ শীতল করে দিল মুহূর্তেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য ডুবে আবার অন্ধকার হয়ে গেল। জানালাটা এবার বন্ধ করে দিয়ে বাসের সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল।
বাস ছুটে চলছে দুরন্ত গতিতে। সেই সঙ্গে তার মনটাও ছুটে চলছে অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে। আহা, কী সুখের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে, ঈদে-পুজোয় গ্রামজুড়ে যে উৎসব আবহ সৃষ্টি হতো, তা কি এখনো হয়? মেলায় মুড়ি, মুড়কি, নাড়ু, কাচের চুড়ি, লাল-নীল চুলের ফিতা, মিঠাই আরও কত কী। মনে পড়ে পাতার বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে পুরো বাড়ি মাতিয়ে তুলত। পাতার বাঁশির সেই আওয়াজটা এখনো কানে বাজে।
সুমির এবারের আসার সময়টা নির্ধারণ করা হয়েছে বৈশাখকে সামনে রেখে। তার ইচ্ছে এবারের পহেলা বৈশাখে নতুন শাড়ি পরে মেলায় যাবে। হাতভরে চুড়ি কিনবে, বেলি ফুলের মালা কিনবে, মনভরে মেলায় কেনাকাটা করবে। পাতার বাঁশিও একটা কিনবে। কবে থেকে পাতার বাঁশির আওয়াজ শোনা হয় না। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, খেয়াল করতে পারেনি। হেলপারের কথায় ঘুম ভেঙে যায় সুমির।
‘সবাই রেডি হোন, আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব।’
সুমি উঠে বসে। জানালাটা আবার খোলে। এবার সূর্যোদয়ের অদ্ভুত দৃশ্যটা তাকে অবাক করে। কত দিন সূর্যোদয় দেখা হয় না।
সুমি বাস থেকে নামে। সেখানে আগে থেকেই তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে বোনকে রিসিভ করার জন্য। সুমি তার ভাইয়ের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সেই ছোট্ট ভাইটি এখন অনেক বড়। চেহারায় অনেক পরিবর্তন। কিছুতেই মেলাতে পারে না। ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, এটা কোন জায়গা, এটা কি আমাদের সেই মধুপুর বাজার? সুমির ভাই বলল, হ্যাঁ, এটাই তো আমাদের সেই বাজার। এখানে আমরা বাবার সঙ্গে কতবার এসেছি। তোমার মনে নেই।
সুমি কিছুটা আনমনে হয়ে ছিল। বাজার সম্পূর্ণ পরিবর্তন। দালানকোঠা হয়েছে। এখানে কিছু বড় বড় গাছ ছিল, যে গাছের নিচে হাটবারের দিন বাউলগানের আসর বসত। আরও কত কী।
যেতে যেতে ভাই বলল, তাড়াতাড়ি চলো, মা তোমার জন্য সারা রাত ঘুমায়নি। আমাকেও ঘুমাতে দেয়নি। যদি তুমি অনেক আগেই এসে পড়ো, তাই। তোমার জন্য কত রকমের পিঠা বানিয়েছে। পছন্দের রান্না করেছে। আমাদের ছুঁতেও দেয়নি। বলে, আমার মেয়ে আসবে, তার জন্য এসব।
সুমি কিছু বলে না। দ্রুত পা চালায়। কত দিন মাকে দেখা হয়নি।
মা-মেয়ে কতক্ষণ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছিল, তা ঠিক মনে নেই। মা তো অঝোর ধারায় কান্না করছিল। আর সুমি মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের শরীরের সেই চিরচেনা ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করছিল। ৩০ বছর আগের সেই ঘ্রাণ অবিকল। শুধু শরীরটা পরিবর্তন হয়েছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়েছে। চোখেও আজকাল কম দেখে। তবু সুমিকে বলছে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস না, শুকিয়ে গেছিস মা অনেক। নাতিকে নিয়ে এলি না। ওর মুখটাও দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল রে মা।
সুমি কেমন করে বলবে যে তার নাতি আর তার সঙ্গে নেই। বিয়ে করে দূরে চলে গেছে। তবু হাসিমাখা মুখ নিয়ে বলল, ও তো পড়ালেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত, তাই আসতে পারেনি। পরে একসময় আসবে।
সুমির মা বলল, ‘ও।’ ঠিক আছে মা, হাত-মুখ ধুয়ে আগে কিছু খা। তারপর গল্প করা যাবে। আগামীকাল আবার পহেলা বৈশাখ। আজকে চৈত্র সংক্রান্তি।
লম্বা একটা ঘুম দিয়ে যখন সুমি উঠল, তখন দেখতে পেল তার পাশেই মা বসে আছে। সঙ্গে ভাইয়ের দুই ছেলেমেয়ে। মায়ের আবদার, তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেতে হবে। তার পছন্দের সব খাবার। সঙ্গে আছে নানা রকমের পিঠা। ভাইয়ের ছোট মেয়েটি বলতে লাগল, ‘ফুপি, তাড়াতাড়ি খাইয়া লন। আপনারে নিয়া গ্রামে ঘুরতে যামু। আজকে চৈত্র সংক্রান্তি। কত নাচ-গান হইব। আপনারে লইয়া ঘুরমু।’
সুমির মনে পড়ে, ছোট্টবেলায় বাবার হাত ধরে চৈত্র সংক্রান্তির দিন গ্রামের উৎসবে যেত। হঠাৎ মা বলে, সুমি, মা এইডা খা তো। মঙ্গল হইব।
সুমি : কী এইটা?
মা : নিমের পাতা।
মা : ভুইলা গেছিস মা। চৈত্র সংক্রান্তিতে তিতা কিছু খাইতে হয়। তোরে ছোট্টবেলায় কত খাওয়াইছি।
সুমি : আমি খাইছি?
মা : হ, তয় খাইতে চাস নাই। জোর কইরা খাওয়াইছি। নে মা, একটু খা।
সুমি হাঁ করে খেয়ে নেয়। নিম পাতা ভাজি। অনেক তিতা। তবে আজ যেন অমৃত লাগছে। একটুও তিতা লাগছে না। একদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ বেয়ে পানি পড়ে।
বিকেলবেলা গ্রামের কিছুটা পথ হেঁটেছে। এবার বিশ্রাম নেবে। আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। একটু মেলায় যাবে, ঘুরে দেখবে।
মায়ের সঙ্গে সারা রাত বসে বসে কত গল্প করল। সকল আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নিল। কে মারা গেল, কার কোথায় বিয়ে হলো, কাদের আর্থিক সমস্যা আছে, কারা হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি।
‘আচ্ছা মা, মনে আছে, ছোট্টবেলায় পাতার বাঁশি আমার অনেক প্রিয় ছিল। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতাম পাতার বাঁশির পোঁ পোঁ আওয়াজে। আর তুমি কত বকা দিতে। বাবা আমাকে অনেক আদর করত। আর তুমি বাবাকে বকা দিতে।’
মায়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। বলে, ‘আয় মা, তোর চুলটা চিরুনি দিয়ে একটু আঁচড়ে দিই। দুইটা বেণি করে দিই।’
সুমীর কী যে ভালো লাগছে, যেন স্বর্গীয় সুখ ভর করছে তার দেহমনে।
গ্রামের চেহারা বদলে গিয়েছে। আগের মতো আর মায়ায় আটকায় না। সবই যেন কৃত্রিম হয়ে গেছে। তবে মায়ের মমতা সেই আগের মতোই আছে। মায়ের কাছে যেন এখনো সেই ছোট্ট শিশুটিই রয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে দুই মাস পেরিয়ে গেল। এবার ফেরার পালা। মা শুধু সারাক্ষণ কাঁদে আর বলে, কবে আবার আসব। সুমিরও মন কাঁদে। একবার ভাবে বাংলাদেশে থেকেই যাবে। আবার ভাবে তার একমাত্র ছেলে আমেরিকায় থাকে। না থাকুক তার কাছে, তবু তো একই জায়গায় আছে। এটাই তার সান্তÍ¡না। মায়ের মন খুবই দুর্বল, মায়াময়।
বিদায় নিয়ে সুমি চলে যাচ্ছে। সবাই কাঁদছে। মা ঘরের দরজা পেরিয়ে পুকুরপাড়ে আমগাছের নিচ পর্যন্ত চলে এসেছে। সুমির চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে, তা সুমি জানে। সুমি পেছনে তাকাতে পারছে না। শরীর যেন অনেক ক্লান্ত লাগছে। আবার দ্রুত পায়ে পথ চলে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকছে। তার ভাইয়ের ছোট্ট মেয়েটি দৌড়ে আসছে। সুমি দাঁড়ায়, পেছনে তাকায়। দেখে, মা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
‘ফুপি ফুপি, দাদু তোমার জন্য এইটা দিছে। দিতে ভুইলা গেছিল।’ বলেই সুমির হাতে কিছু একটা দেয়। সুমি হাতে নিয়ে দেখে একটা পাতার বাঁশি। সুমির চোখ বেয়ে জল আসে। সে পাতার বাঁশিতে ফুঁ দেয়। কিন্তু এই বাঁশির সুর আগের মতো আর মনে হয় না। কেমন যেন করুণ সুর ভেসে আসে। যেখানে মিশে আছে মায়ের দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার, বুকফাটা আর্তনাদ।
লেখক : সম্পাদক, ইউএস বাংলা নিউজ, নিউইয়র্ক
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078