স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের প্রত্যাশা

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১২:১৭ , চলতি সংখ্যা
স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের মুক্তি ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধানতম সিঁড়ি। একটি জাতি, দেশ, রাষ্ট্র এবং নিজস্ব ভূখণ্ডে জনগণের স্বকীয়তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং গণমানুষের মুক্তির জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন হয়। স্বাধীতার বিধান ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি এবং সেখানে স্বাধীনভাবে বসবাসের জন্য মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সঠিকভাবে নিরাপদ থাকতে পারাই মূলত গণমানুষের মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতা মানবিকতার অন্যতম ভিত্তি, যার প্রধান লক্ষ্য হলো নিজস্ব সম্মান ও মর্যাদাবোধ নিয়ে স্বস্তিকর পরিবেশে বেঁচে থাকা। স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিসত্তার একটি ন্যূনতম অধিকার, যেখানে মানুষ শান্তিময় জীবনযাপন করবে।
সমাজে মানুষের অধিকার নিশ্চিত না থাকলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেখানে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা থাকে না। কোনো দেশে স্বাধীনতা না থাকলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং সামগ্রিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে আসে। দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি হয়।

যেকোনো পরাধীন রাষ্ট্র কিংবা অঞ্চলে স্বাধীনতার জন্য মানুষকে ব্যাকুল, উদগ্রীব ও উৎকণ্ঠিত থাকতে হয়। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও নির্যাতনের কবলে সব সময় পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের মানুষের ওপর ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসকের নিপীড়ন-নির্যাতন চলে। যেখানে গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষের জন্য মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। মানুষ বাধ্য হয় স্বাধীনতাসংগ্রাম ও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। পৃথিবীতে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।

মানুষ মাত্রই তার স্বকীয়তামূলক নাগরিক অধিকার থাকা প্রয়োজন। মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দরকার। যেখানে একটি দেশের সার্বভৌমত্বের স্বাধীনতা থাকবে। স্বাধীনভাবে মানুষের কথা বলার অধিকার থাকবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নীতিমালা অনুযায়ী জনকল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা চালু ও বহাল থাকবে।

প্রত্যেক মানুষ তার নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে স্বস্তিকর ও শান্তিময় জীবনযাপন করবে। এটাই স্বাধীনতার মূল প্রতিপাদ্য এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য। যে রাষ্ট্র অথবা সমাজে মানুষের স্বাধীনতা এবং কথা বলার অধিকার থাকে না, সেটিই মূলত একধরনের পরাধীনতা। সেখানে গণমানুষের অধিকার বিঘ্নিত হয়, বাধাগ্রস্ত হয়। সেখানে রাষ্ট্রতান্ত্রিক শোষণ ও নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে যায়। সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার থেকে মুক্তির জন্য এবং স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্বাধীনতাসংগ্রাম ও যুদ্ধ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। পরাধীনতার হাত থেকে রক্ষা করার স্বাধীনতা আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।

তবে স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যা খুশি তা করে বেড়ানো যাবে। কোনো নিয়মনীতি না মেনে যেমন খুশি তেমন চলার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা হলো শৃঙ্খলাবদ্ধ সুশীল জীবন। স্বাধীনতা হচ্ছে একে অপরের মধ্যকার সহনশীলতা, সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজবদ্ধ জীবনযাপন। মানুষের মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে মানবিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনেই স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে হয়।

মানবতার বিপক্ষে যেকোনো মানববিধ্বংসী উগ্রতা ও পৈশাচিকতা হচ্ছে মানববিধ্বংসী উন্মাদনা। স্বাধীনতার মূল দাবি হলো গণমানুষের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থার প্রচলন।
সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই পৃথিবীতে মানুষকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ও মুক্তির জন্য লড়াই করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও লড়াই ছাড়া কোথাও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পায় না। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ও যুদ্ধ করতে হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মতো ভারতবর্ষের স্বাধীনতারও রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস। উপমহাদেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রাম ও লড়াইয়ে অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ এবং রক্তক্ষরণের মধ্যেই কেটে গেছে কয়েকশ বছর।

বাংলার সর্বশেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা ভারতবর্ষে দুইশ বছর শোষণ-নিপীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন ও নির্মম দমননীতি চালায়। তখন সেখানকার মানুষের জন্য ব্রিটিশদের হটানোর আন্দোলনে স্বাধীনতাসংগ্রাম করা জরুরি হয়ে পড়ে। মানুষ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম ও যুদ্ধ শুরু করে দেয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধ ক্রমাগত চলতে থাকে এবং অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর অবশেষে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়। ভারতবর্ষ ও উপমহাদেশ ছেড়ে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান মানে দুটি দেশ স্বাধীন হলেও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র দুটির বর্ণ-বৈষম্যমূলক নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। বরং মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার বিনষ্ট হয়। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মুক্তি এবং নানাবিধ কারণে মানুষের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে নানা রকম নৈরাজ্য, ফ্যাসিবাদ, উগ্রতা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং ধর্মীয় উন্মাদনা বহাল রয়েছে। মেঘালয়, আসাম, পাঞ্জাব, কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গণমানুষের অধিকার বিনষ্ট ও বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে সেসব অঞ্চলে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম চলছে, নির্যাতন ও নিপীড়নমূলক সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটছে।

অন্যদিকে পাকিস্তান নামক দেশটিতেও শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক শাসন চালু হয়। বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তান নামক দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোষণ ও নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়। যেহেতু তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের হাতেই ছিল মূলত রাষ্ট্রপুঞ্জের সামগ্রিক ক্ষমতা। তারা তাদের নিজস্ব খেয়াল-খুশিমতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপরই বেশি ছড়ি ঘোরাতে থাকে। এতদঞ্চলে বৈষম্যমূলক শাসনকাজ চালু হয়।

পাকিস্তান সরকার সে সময় আমাদের শিক্ষা-সামাজিকতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এমনকি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসহ সর্বক্ষেত্রেই পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিপীড়ন চালিয়ে যেতে থাকে। তৎকালীন রাষ্ট্রের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকার বিনষ্ট করে। জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব বাংলার জনগণের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং মাতৃভাষা বাংলার ওপর আঘাত করে বসে।

শুধু তা-ই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় অধিকার খর্ব করে। বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। শিক্ষা, সামাজিকতা ও চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে একধরনের পেষণনীতি চাপিয়ে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার হরণ করে। দেশের জনকল্যাণমুখী সুশীল রাজনীতিকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে রাখে। নানা রকম শোষণপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উচ্চাভিলাষী পাকিস্তানি শাসকেরা স্বৈরতন্ত্রী কায়দায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি অত্যাচার-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন ও অবহেলার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

পাকিস্তানি শাসকদের নানাবিধ নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রাম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমাগত ক্ষিপ্রতর হয় এবং সেটি গণজাগরণে রূপ নেয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কালো পঁচিশের রাতে ঢাকা শহরের মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে এবং ভয়ংকরভাবে গণহত্যায় রূপ নেয়। কালো পঁচিশের রাতে গণহত্যার মধ্যেই গভীর রাতে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা হয়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় সমগ্র জাতি স্তব্ধ হয়ে যায়। গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়ে জনগণের জীবন ও রাজনীতিতে একধরনের নিস্তব্ধতা নেমে আসে।

এ অবস্থায় পরদিন ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেওয়া হয়। আগেই উল্লেখিত হয়েছে, পূর্ব বাংলায় দীর্ঘ দিনের শোষণ, নিপীড়ন এবং সর্বশেষ হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রতিরোধে এবং স্বাধীনতাসংগ্রামের পটভূমিকায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। কেননা ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হওয়ার পর ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোকের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটে। দুই লাখের অধিক মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয় এবং হানাদারের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়ে অনেকে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায়। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করে।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের দীর্ঘ শাসনামলের বৈষম্যপূর্ণ আচরণ, নির্যাতন ও শোষণ-নিপীড়ণের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনে মার্চ মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্চ মাসের প্রতিটি দিন ও প্রতিক্ষণ খুবই তাৎপর্যময়। মার্চ মাস আমাদের জনসাধারণের জাগরণ ও স্বাধীনতার মাস। কেননা এই আগুনঝরা মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসক ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া সরকার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনিদির্ষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও ছাত্রসমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদে ২ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-জনতার উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষিত হয়। ৩ মার্চ সমগ্র দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। একই দিন (৩ মার্চ) ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু এক বিশাল জনসভায় সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
একপর্যায়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যপূর্ণ আচরণ, জুলুম, নিপীড়নসহ সামগ্রিক দিক থেকে এক অনিশ্চিত ধূম্রজাল ও ঘনঘটার মধ্যে একাত্তরের সাতই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান তথা বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সম্মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সুদীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। সারা দেশের জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একপর্যায়ে ওই সমাবেশ পরিণত হয় মহা জনসমুদ্রে। দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সেই মহাসমাবেশে যোগদান করেন।

সেদিনকার ভাষণটি ছিল মূলত বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক রাজনৈতিক জীবনের একটি চূড়ান্ত অধ্যায়। যেখানে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের যোগ্যতর সমীরেখা টানা হয়। সেই ভাষণের মূল প্রেরণা ছিল পাকিস্তান সরকারের সব অতাচ্যার, অবিচার, নিপীড়ন ও আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করা। স্বাধীনতার জন্য যার যা আছে, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। একাত্তরের সাতই মার্চের পর পাকিস্তান শাসকদের বেপরোয়া অ্যাকশনে সারা দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, গ্রেফতার, জুলুম, নির্যাতন শুরু হয়।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ছিল বাঙালি জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা, অন্ধকারাচ্ছন্ন এক চরমতম অধ্যায়। ২৫ মার্চের কালো রাতে ঢাকা শহরের ঘুমন্ত মানুষের ওপর তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ন্যক্কারজনক বর্বরোচিত হামলা শুরু হয়। ঢাকা শহর ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরে হানাদারদের বর্বরোচিত হামলার মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয় এক ঘোরতর বিপদের দিকে। পাকিস্তানি শত্রু সৈন্যদের নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞে সমগ্র ঢাকা শহর পরিগণিত হয়েছিল একটি মৃত নগরীতে। ঢাকাসহ দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও পৈশাচিকতার তাণ্ডব। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা ছিল ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক জঘন্যতম গণহত্যা।

২৫ মার্চের পর সমগ্র দেশ একধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি ও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়। শহর ছেড়ে অনেক রাজনৈতিক নেতা অন্যত্র গিয়ে আত্মগোপন করেন। অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। ফলে সারা দেশে নেমে আসে অন্ধকার এবং জনমনে দেখা দেয় চরম উৎকণ্ঠা।
২৬ মার্চ প্রভাতে কুয়াশায় যখন বাংলার পত্রপল্লব মমতার নির্যাসে মাখামাখি, অন্ধকার ঘুচে আলোকরশ্মির উঁকিঝুঁকি, সেই দুঃসময়ে বাংলাদেশের এক দুর্গম পর্বতের গহিন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ধ্বনিত হয়। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে সেই আহ্বান এতই তেজস্বী ও ক্ষিপ্রতর ছিল, যার প্রতিপাদ্যÑবাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই ঘোষণায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর (তিন বাহিনীর) সকল সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার (পূর্ব বাংলার), সরকারি লোকজনসহ সর্বস্তরের জনগণকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। স্বাধীনতার প্রত্যাশায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সেই আহ্বানটি যেন সমগ্র দেশের দুর্যোগপূর্ণ ঘোর অমানিশাময় অন্ধকার বিদূরণের সঞ্জীবনী শক্তি এবং সমুদ্ভাসিত আলোর ঝলকানি। মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সেই খবর ইথারে ইথারে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার আনাচ-কানাচে, পথে-প্রান্তরে তথা সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

অবশেষে তৎকালীন পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রী সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বাঙালি সশস্ত্র বাহিনী তথা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার বাহিনীসহ প্রায় সকল সিভিল সার্ভিসের লোকসহ সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মহান জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার সমগ্র দেশে নয়জন সেক্টর কমান্ডার ঘোষণা করে। একই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবীর কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী। সমগ্র দেশে মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

২৬ ও ২৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর সামরিক বাহিনীসহ তৎকালীন সরকারের অধীন সবাই (পাকিস্তান সরকারের আজ্ঞাবাহী গুটিকতক সুবিধাবাদী ও রাজাকার, আল বদও ছাড়া) পাকিস্তানের সরকারি বাহিনী থেকে বের হয়ে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সরকারি-বেসরকারি মানুষ সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি শাসকদের সকল প্রকার লোভ, সুবিধা ও স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সকল সেক্টর কমান্ডার এবং তাঁদের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়ে শাহাদাতবরণ করেন। সেই সঙ্গে অগণিত নারী ও শিশু হানাদারদের পৈশাচিক অত্যাচারের শিকার হন এবং মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
এ কথা সত্যি, তখন শুধু রাজনীতিবিদদের ওপর ভর করে বসে থাকলে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো না। বরং আরও বেশি বিপজ্জনক ও বিলম্বিত হয়ে পড়ত। আবার রাজনীতিবিদদের গাইডলাইন না থাকলেও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ হয়তো এত সহজে সফলকাম হতো না। স্বাধীনতা অর্জন বিলম্বিত হতো এবং দেশময় হত্যাযজ্ঞ ও সংঘাতের মাত্রা বেড়ে যেত। অতএব, কোনো রাষ্ট্র কিংবা দেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য (স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ব্যতীত) সর্বস্তরের মানুষেরই রয়েছে বিরাট অবদান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী গোলামি শাসন চালু হওয়ার পর থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে যেমন ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তেমনি পাকিস্তানি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলাকালীনও স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামে বাংলা ভাষাভাষী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার অভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার উন্নয়ন ঘটেনি। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে পালায় পালায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একই রকম ধারাবাহিকতায় বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ সহিংস ও সংঘাতময় হয়ে উঠেছে।

ইতিহাসের শিক্ষা হলো কোনো স্বাধীন দেশে যদি গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে, রাষ্ট্রপুঞ্জ ও সমাজে জনসাধারণের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। জনকল্যাণমুখী রাজনীতির আদর্শ নীতি বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রশাসনে দলীয় প্রাধান্যে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রবিরোধী মানববিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক পেশিশক্তির উদ্ভব ঘটে।
কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের মূল্যবোধ না থাকলে সে দেশের রাজনীতিতে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। সমাজে অশান্তি, নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করে এবং নৈতিক অবক্ষয় নেমে আসে। সমাজে অপরাধপ্রবণতা ও অরাজকতা বেড়ে যায়।

বর্তমান পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস ও যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতিতে বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া দেশের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অস্থিরতায় জনজীবনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, হানাহানি এবং বিচারবহির্ভূত গুম ও হত্যাকাণ্ড দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ভয়াবহতা ও বিষাদময়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সমগ্র দেশের অর্থনৈতিক মন্দাভাব এবং দ্রব্যমূল্যের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতির ফলে সমগ্র অরাজকতা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কবলে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থনৈতিক ধস এবং বৈষম্য নেমে এসেছে। ফলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস এবং অরাজকতা বেড়ে গেছে। প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বৈদেশিক মুদ্রার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন ঘটছে। অপরদিকে প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় একটি সংঘবদ্ধ দুষ্টচক্রের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীন দেশের জন্য এসব অনাচারবৃত্তি সুখকর দিক নয়।
সমাজবিজ্ঞানের একটি অনিবার্য ও অন্যতম শাখা হচ্ছে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল প্রতিপাদ্য হলো মানুষ এবং জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রপুঞ্জে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন। উন্নয়নশীল দেশের মূল শক্তি হচ্ছে সে দেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাপনা। গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন, যে শাসনব্যবস্থায় জনগণের হাতে ক্ষমতা থাকে। জনগণের মাধ্যমে তাদের সম্পৃক্ততামূলক ভোটে নির্বাচিত সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বশীল সরকারই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থাপনাই মূলত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধশীল করে তোলে। যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে মানবতা থাকে না। সেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব হয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। দুখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেটি অনুপস্থিত।

পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মূল সংজ্ঞায় সরকার হলো জনগণের সেবক। যারা জনসাধারণের কল্যাণ অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করে। আর সরকারের কাজ হচ্ছে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসাধারণের কল্যাণের পথকে সুগম করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা অক্ষুণ্ন রাখার মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষভাবে জনস্বার্থে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা। রাজনীতির আসল থিম হচ্ছে জনগণের অধিকার রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার অনুকূলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমকে গতিশীল রাখা।
ইতিহাসের কাজ হচ্ছে সত্যকে তুলে ধরা। সত্যের নিঃসংকোচ বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃত সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যার আয়ু বেশি দিন টিকে থাকে না। দার্শনিক রবসন বলেছেন, ‘মিথ্যা এবং মিথ্যাবাদী সব সময় সত্যকেই ভয় পায়। সত্য কখনো মিথ্যাকে ভয় পায় না।’

অতএব, স্বাধীনতার প্রশ্নে যার যতটুকু অবদান রয়েছে, তার সঠিক মূল্যায়নে আমাদের সত্যের পক্ষে থাকা উচিত। আমরা যেন একে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং পরস্পরের প্রতি সহনশীল থাকি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও মানবকল্যাণে অবদানকারীদের কথা যেন ভুলে না যাই। কৃতজ্ঞতা হচ্ছে মানুষের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি না থাকলে মানুষের মাঝে মানবিক প্রেরণা সৃষ্টি হয় না। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অবদানের সঠিক মূল্যায়ন যেন সত্য ও সুন্দরের পথে ধাবিত হয়। গুটিকতক স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আল-বদর ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের অবদানকে যেন সঠিক মূল্যায়ন করা হয়।
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে পেশাজীবী রাজনীতিবিদদের যেমন অবদান রয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহণকারী কোনো মুক্তিযোদ্ধার অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। সত্যের স্বীকৃতি এবং কৃতজ্ঞতাবোধের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে মানবদর্শনের অন্যতম ভিত্তি।

আমাদের মনে রাখা দরকার, গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতিতে পদ্ধতিগত মতবিরোধ থাকতে পাওে কিন্তু গণতন্ত্র, দেশ, সমাজ ও জনগণের কল্যাণে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হয়। সাম্য ও সম্প্রীতি হচ্ছে মানবতার প্রধান গুণ। স্বাধীনতার মূলকথা হলো জনকল্যাণমুখী চিন্তা এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ফলপ্রসূ কার্যক্রম। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায় বিচারবোধ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার শ্রদ্ধাশীল থাকার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করাই স্বাধীনতার মূল শিক্ষা।
স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও মা-বোনের ত্যাগ ও তাঁদের অবদানের কথা সর্বদাই স্বীকার করি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

মার্চ মাস আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতার মাস। বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুক্তির মাস। দুর্নীতিমুক্ত ও সন্ত্রাসবিরোধী গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার অঙ্গীকারের মাস। সবার উচিত, দলমত-নির্বিশেষে সকল প্রকার বৈষম্য ও রাজনৈতিক হানাহানির ঊর্ধ্বে থেকে মহান স্বাধীনতা দিবসের ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখা এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বাধীনতা দিবস পালন করা।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক, বিমাসহ বাণিজ্যিক খাতের সকল দেউলিয়াত্ব ও নৈরাজ্যকর অবস্থা বিদূরিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল রাখতে হবে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য সকল চোর-বাটপার ও লুটেরাদের বিচার হওয়া উচিত। যারা দেশের কোটি কোটি টাকা চুরি ও পাচার করার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। স্বাধীনতার মাসে তাদের তালিকা প্রকাশ করে বিচার করার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়াই এখন সময়ের দাবি। সমগ্র দেশে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার অধীনে সুশীল রাজনৈতিক কার্যক্রম হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। রাষ্ট্রকাঠামোর জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম এবং সুশীল রাজনীতির স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে গণতান্ত্রিক চর্চার কোনো বিকল্প নেই।

এ ছাড়া প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা নিজ দেশে চরম হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগটি সব সময় মিডিয়ায় আসে। যাদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি চালু রয়েছে, তাদের অনেকেই দেশে নানা ধরনের প্রাণহানিমূলক হুমকি ও হয়রানির চরম অবহেলার শিকার হন। স্থানীয় ও সরকারদলীয় মাস্তান ও সন্ত্রাসীর হুমকির মুখে অনেক প্রবাসীর জীবন বিপন্ন হয়। দেশে অনেকের বিনিয়োগকৃত সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যায়। রাষ্ট্রপুঞ্জে জনগণের নিরাপত্তাহীনতা এবং নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে দেশে স্বাধীনতার কোনো মূল্য এবং মর্যাদা থাকে না। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের দায়িত্ব হলো রাষ্ট্র ও সমাজে চলমান সংঘাতময় অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সঠিক ভূমিকা রাখা। প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
স্বাধীন দেশের প্রশাসন ও সরকারি নির্দেশনা জনকল্যাণ ও জনস্বার্থে নিবেদিত হতে হয়। জনগণের কল্যাণের বাইরে যেকোনো ফ্যাসিবাদ, উগ্রতা ও গণনিপীড়নমূলক রাষ্ট্রীয় আচরণই মানবতাবিরোধী কাজ। তেমনি স্বাধীনতা সংরক্ষণ করার জন্য সকল নাগরিককেও ন্যায়বিচার ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক যেন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পান। সাম্য-মৈত্রীর বন্ধনে দলমত-নির্বিশেষে সবাই যেন নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ ও নিশ্চয়তা ভোগ করতে পারেন। নিজস্ব মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে শান্তিতে বসবাস করতে পারেন। তা-ই হোক আজকের প্রত্যাশা। সবাইকে মহান স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078