মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় এবং পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচারণ

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১১:১৩ , চলতি সংখ্যা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মহান ভাষা আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি। ১৯৪৮ সালে শুরু ভাষা আন্দোলনের ১৯৫২ সালের চূড়ান্ত পর্যায়ে একুশে ফেব্রুয়ারির চরম মুহূর্তে যে মাতৃভাষা বাংলার সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার ভাষা শহীদদের তাজা রক্তে যে বীজ বপন করা হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য আন্দোলন ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের কার্যক্রম, ’৬২-এর শিক্ষা সম্মেলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয় লাভের পরও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরের ষড়যন্ত্রমূলক অনীহা অতীতের পুঞ্জীভূত বঞ্চনার সাথে বর্তমান বঞ্চনা যুক্ত হয়ে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত এবং দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্ম বিসর্জন ও দুই লাখেরও অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে আমাদের বিজয় ও কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৪টা : ৩১ মিনিটের সময়ে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তথা বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা উল্লেখিত দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ঘটনাবহুল অন্যান্য ইতিহাস। ইতিহাস মানুষ সৃষ্টি করে না। মানুষ সৃষ্টি করে ইতিহাস। ইতিহাস জীবনের অনুসঙ্গ। শুধু একটা যুদ্ধ জয় স্বাধীনতা নয়। একটি জাতির সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির সার্বিক নাম হচ্ছে স্বাধীনতা। তাই বঙ্গবন্ধুর ’৭১-এর ৭ই মার্চের কৌশলী ইঙ্গিতময় ঐতিহাসিক ভাষণ ইতিহাসের মহাকাব্য ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। প্রত্যেক জাতির জীবনে ইতিহাস এক অমূল্য সম্পদ। এই অমূল্য সম্পদের সৃষ্টি হয়ে থাকে কোন একটি দুর্লভ মুহূর্তকে কেন্দ্র করে। একুশে ফেব্রুয়ারি সেই দুর্লভ মুহূর্ত, যার ফলে এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সেই একুশেরই সুবর্ণ ফসল। অন্য কথায় বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনই স্বাধীনতার গোড়া পত্তন ও পটভূমি।

উপরোক্ত ভূমিকা দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসাবে ’৭১- এর স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় আর পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণের ইতিবৃত্তের স্মৃতিচারণ করছি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, শক্তিশালী সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের বিজয় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মহামন্ত্র এবং আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল, বীরত্ব ও ত্যাগ স্বীকার এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করতেই হবে এই দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা তাদের সফলতা এনে দেয়। ন্যূনতম অস্ত্র চালানোর অভিজ্ঞতাও যাদের ছিল না সে সব লোকজনও সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে তা অতুলনীয়। 

এ কথা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দ্রিয়া গান্ধীর সমর্থনে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা ও সহায়তা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত করেছে। ভারত সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার হাত বাড়ায় এবং বাঙালি শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় প্রদান করে। অবশ্য ভারতের স্বার্থ ছিল এই সুযোগে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়া। সে যেভাবেই হোক আমরা সহযোগিতা পেয়েছি তাতে কৃতজ্ঞ।

বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মহামন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে ২৬ শে মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রকাশ্য ঘোষণাক্রমে। ডিসেম্বর, ১৯৭০ এর নির্বাচনের বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পরও পাকিস্তানি সামরিক শাসকের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ২৫শে মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর নিশংসভাবে গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। তারপর ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে পাকবাহিনীর পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রেসকোর্স ময়দানে দলিলে স্বাক্ষর সংবলিত ঘটনাপ্রবাহ খুবই রোমাঞ্চকর। ৩ ডিসেম্বর শেষ রাতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সম্মিলিত আক্রমণ শুরু করার পর পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে পড়ে। ৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডঃ আব্দুল মালিক যুদ্ধবিরতির জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটা আবেদন পেশ করেন। ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ৯ ডিসেম্বর জেনারেল এ. এ. খান নিয়াজি, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর আত্মসমর্পণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ১৩ই ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ১৪ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় ভারতীয় বিমানবাহিনী গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় আক্রমণ করে। গভর্নর ড. মালিক ভীত হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে রেডক্রসের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এ সময় পাকিস্তানিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। নিয়াজি আত্মসমর্পণ করতে নারাজ থাকলেও এ ঘটনার পর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হন। ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা প্রচারিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় আত্মসমর্পণের সময় নির্ধারিত। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়। একই সময় ভারতীয় বাহিনী তাদের বহর নিয়ে শহরের উপকণ্ঠে এসে পৌঁছায়। জেনারেল নিয়াজি ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য সময় এর মেয়াদ ৬ ঘণ্টা বৃদ্ধির অনুরোধ করেন এবং তাদের নিরাপদে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়টা চান। এরপর বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর প্রচারিত হয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারিত হয় রেসকোর্স ময়দান। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এরপর আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর হবে এবং জেনারেল নিয়াজি তাঁর অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল অরোরাকে হস্তান্তর করবেন। আত্মসমর্পণ কাজের জন্য ঢাকা ক্লাব থেকে মাত্র দুটি চেয়ার ও একটি টেবিল আনা হলো। একটি চেয়ারে জেনারেল নিয়াজি ও অন্যটিতে জেনারেল অরোরা বসলেন। সে সময় রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ৩০ মিনিট। আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে আসা হলো। প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান জেনারেল নিয়াজি এবং পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা স্বাক্ষর করলেন। স্বাক্ষর শেষে উভয়ে উঠে দাঁড়ান। আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী জেনারেল নিয়াজি নিজের রিভলবারটি কাঁপা কাঁপা হাতে অত্যন্ত বিষণ্নতার সাথে জেনারেল অরোরার কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানের সৈন্য ও কর্মকর্তাদের কর্ডন করেক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কৌশলগত স্বাধীনতার ডাক এবং গ্রেফতারের প্রাক্কালে ২৬ মার্চ এর প্রথম প্রহরে ইপিআর ওয়ারলেসে স্বাধীনতার প্রকাশ্য ও চূড়ান্ত ঘোষণা বাস্তবে রূপায়িত হলো মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।
মজার বিষয় হলো যে রেইচ কোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু কৌশলী ইঙ্গিতময় ভাষায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সে একই স্থানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বরের শেষের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পারে পরাজয় সুনিশ্চিত তখন একদিকে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুতি, অপরদিকে দেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, আলশামস্ ও রাজাকারদের যোগসাজশে ১৩-১৪ ডিসেম্বর দেশের জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচারে নৃশংসভাবে হত্যাযোগ্য চালায়। এই ভয়াবহ মর্মান্তিক ঘটনা স্মৃতিতে ভাস্বর হতেই ব্যথিত চিত্তে বিশেষভাবে মর্মাহত হই। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাক হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা এবং সমাপ্তিকালে মেধাশূন্যকল্পে বুদ্ধিজীবী হত্যা ইতিহাসে সর্বকালের নিষ্ঠুরতম ভয়াবহ মর্মান্তিক ঘটনা।

উল্লেখ করা যেতে পারে মেধাশূন্য করে আমাদের স্বাধীন দেশকে অকার্যকর করার পাকিস্তানিদের যে অপপ্রয়াস তার বিনিময়ে আজ পাকিস্তানের অধঃপতন, দুর্গতি, দুর্দশা এবং নিরসনে পরোক্ষভাবে আমাদের উন্নত বাংলাদেশের সাহায্য প্রার্থী। একেই বলে যেমন দুষ্কর্ম তেমন ফল।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভাষা আন্দোলনেরই সুবর্ণ ফসল। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা একাকার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। তাই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, অকথ্য নির্যাতন ও জেল-জুলুমের শিকার ভাষাসৈনিক হিসেবে এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণে স্বাধীন মাতৃভূমির প্রতিষ্ঠার যে অনুভূতি তা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাই না।
লেখক : ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক একুশে পদকপ্রাপ্ত ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত
 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078