নিউইয়র্কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের  তালিকা প্রণয়ন সময়ের দাবি 

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪, ২১:১৬ , চলতি সংখ্যা
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর। দীর্ঘ এই সময়ে বাংলাদেশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রণয়ন করতে পারেনি কোনো সরকার। যখনই যে সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করেছে, তা শুদ্ধ ছিল না। বরং অমুক্তিযোদ্ধা ও বিতর্কিতরা জায়গা করে নিয়েছে সেই তালিকায়। এসব নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে চাপা কান্না রয়েছে। কষ্টও রয়েছে বহুগুণ। কখনো তারা ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। 
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন সময়ের দাবি, তেমনি প্রবাসেও দাবি উঠেছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা করার। কারণ এই প্রবাসে কে আসল, আর কে ভূয়া তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বরং, ভূয়াদের দাপট ও আস্ফালনে বাংলাদেশি কমিউনিটি একদিকে যেমন অতীষ্ঠ, অন্যদিকে হচ্ছে বিব্রত। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলছেন, প্রবাসে দিন দিন ভূয়াদের বিস্তৃতি ঘটছে। এমনকী এই প্রবাসে কৌশলে মুক্তিযোদ্ধা তৈরির কারখানা করেছে একটি চক্র, যারা নিজেরাও ভূয়া। প্রকৃত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন পদ-পদবী দিয়ে ভূইফোঁড় সংগঠন করে সেখানে ভূয়াদের নিয়ে দল ভারী করছে। ধীরে ধীরে তাদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করা হচ্ছে। 
তারা বলছেন, বিশ্বের রাজধানী হিসাবে পরিচিত নিউইয়র্ক শহরে জীবনধারণ অনেক ব্যয়বহুল। সবাই ছুটছেন জীবিকার খোঁজে, সেখানে কারা এক সময় কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কে ভূয়া? এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে চক্রটি। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অথচ ভূয়ারা এখনো সতেজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বয়স কত ছিল, সেই হিসাব করলেই বেরিয়ে আসে প্রকৃত রহস্য। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ঠিকানাকে জানান, ভূয়াদের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তিনি একটি প্রবাদ টেনে বলেন, অঙ্গে অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ লাগাবো কোথায়? যাদের কাছে বলবো, তাদের বেশিরভাগই ভুয়া, আবার তাদের অনেকেই ভূয়াদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশ স্বাধীন করতে রণাঙ্গনে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছেন, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন এই প্রবাসে। বার্ধক্যের ভাড়ে তারা আজ ন্যুব্জ। অনেকেই একা চলতে পারেন না। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তারা দেখছেন- এই প্রবাসে কিছু ‘দুষ্টুলোক’ নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনের আসন দখল করছেন। কমিউনিটির কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাদের অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উত্তরীয় পরিয়ে দিচ্ছেন। তখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মনটা ঢুঁকড়ে কেঁদে ওঠে। 
তিনি বলেন, কোথাও কেউ প্রতিবাদ করছেন না। প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসছে না। যারা প্রতিবাদ করবেন, ভূয়াদের রুখে দাঁড়াবেন, সেই মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্মও এই প্রবাসে অনেকটাই বিভ্রান্ত। কারণ তাদের ভেতরেও কৌশলে ঢুকে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি। সর্বত্র ভূয়াদের জয়-জয়কার। এই ভূয়াদের কব্জায় এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এসব ভূয়ারা কেউ ঢুকে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায়, কেউ লিখছেন স্বাধীনতার কবিতা, কেউ করছেন আবৃত্তি। সোস্যাল মিডিয়ায় ‘কপি-পেস্ট’ করছে মুক্তিযুদ্ধের নিশানা। অথচ ‘কেউটে সাপের বাচ্চা’ যেমন বিষধর, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী এসব প্রজন্ম প্রবাসে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ভূয়াদের মত করেই। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলেন- ‘আমাদের শরীরে শক্তি নেই প্রতিবাদ করার। নতুন প্রজন্মও এগিয়ে আসছে না। এভাবে সবাই চুপ থাকলে এই প্রবাসে ৫৩ বছর পরও ভূয়ারা মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেবে। হয়তো পরপারে আমাদের এই দৃশ্য দেখতে হবে। সচেতন প্রবাসীদের উচিত ভূয়াদের বর্জন করা।’
বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসাধীন ম্যানহাটনের একটি হাসপাতালে। স্বচ্ছল স্বজনেরা তার পাশে সার্বক্ষণিক রয়েছেন। নাম প্রকাশ করতে চাইলেও পরিবারের সদস্যরা অনিচ্ছুক। ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বললেন- প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বয়সের কারণে ভালো নেই। অথচ কিছু ভূয়া এই প্রবাসে রীতিমত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজেদের শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, বিভিন্ন সংগঠন খুলে তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের ভন্ডামির লাগাম টেনে ধরার যেন কেউ নেই। 
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত প্রবাসের একটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এর আগে ঠিকানাকে জানিয়েছেন, তারা শিগগিরই কিছু একটা করবেন। ভূয়াদের মুখোশ উম্মোচন করবেন। ওই সংগঠনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা জানিয়েছেন, আগে প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অনেক সম্মান পেতাম। এখন ভূয়াদের দাপটে নিজেরই লজ্জা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রবাসে ভূয়াদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের দৌরাত্ম এখন সর্বত্র। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ খুঁজতে হবে।’ 
তিন মাস পেরিয়ে গেলেও ভূয়াদের ব্যাপারে কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি সংগঠনটি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংগঠনটির একজন শীর্ষস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বলেন, এটা খুব কঠিন কাজ। 
প্রবাসে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা চুপচাপ আছেন। ইমিগ্রেশন জটিলতাসহ নানান কারণে দেশে যেতে পারছেন না। এ রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা দূরে থাক, স্বীকৃতিও মিলছে না।  
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউইয়র্কে বসবাসরত একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়াছড়ি। কে আসল আর কে ভূয়া কেউ তো চ্যালেঞ্জ করছেন না। এসব নিয়ে কথা বলতেই এখন খারাপ লাগে। তার মতে- নিউইয়র্কে কমপক্ষে ৪০ জনের একটি দুষ্টচক্র আছে, যারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে চলছে। আসলে তারা ভূয়া। 
একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিভিন্ন সময় ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আসেন। তারা এসে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন। বক্তৃতা দেন। এরপর চলেও যান। কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলেন না। 
কমিউনিটির পরিচিত মুখ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ প্রতিবেদককে বলেন, একাত্তরে যাঁরা অস্ত্র হাতে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণ বিতরণসহ যাঁরা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছেন, কলকাতায় স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালকমণ্ডলী, সাংবাদিক, ভাষ্যকার ও শিল্পীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যারা অস্ত্র হাতে মাঠ পর্যায়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের চার ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর নিয়মিত সদস্যবৃন্দ। এরা আগে থেকেই অস্ত্র ব্যবহারে এমনকী সম্মুখ সমরাভিযানে প্রশিক্ষিত ছিলেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ‘নিয়মিত বাহিনী’র সদস্য।
দ্বিতীয়ত: সাধারণ মানুষ যাঁরা বাংলাদশ থেকে ভারতে গিয়েছিলেন এবং ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অস্ত্র চালনা, বিস্ফোরকদ্রব্যের ব্যবহার ও গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশলে প্রশিক্ষণ লাভের পর দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করেছিলেন। সংখ্যায় তারাই সর্বাধিক। তাদের বলা হতো ‘গণবাহিনী’। সামরিক প্রশিক্ষণের পরই তাদের হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ।
টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর আব্দুল কাদেরর সিদ্দীকীর (বীর উত্তম) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর লোকজনও মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অধিকাংশই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের ভেতরই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তারা। তবে, কেবল ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নতুনভাবে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে না ফিরে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তাদের পৃথকভাবে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মুজিব বাহিনী’। জীবন বাজি রেখে এসব মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছেন। অথচ এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে যারা কোনোদিন যুদ্ধ করেননি, তারা সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিতে অসৎ পথে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা গুমড়ে কেঁদে ওঠেন। 
বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস, নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন এবং বাংলাদেশ কনস্যুলেট বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানে প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু এই আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানকে। 
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানানোর পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি দূতাবাস ও কনস্যুলেটে ফোন করে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন এবং একে অন্যকে ভূয়া বলেন। এমনকী অনুষ্ঠানে বসার আসন নিয়ে কথিত মুক্তিযোদ্ধারা ঠেলাধাক্কা শুরু করেন। এসব দেখে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা চুপচাপ হয়ে যান। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, এসব সমস্যার কারণে আমরা আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে খুব সমস্যায় পড়ছি। এসবের সমাধান কোথায় এবং কে দিতে পারনে তাও জানি না। 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078