
সিলেটের শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য রমজান মাসে ইফতারি। রমজান মাস এলেই মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রচলন, যা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ‘পুড়ির বাড়ি ইস্তারি’ বোঝায়।
যুগ যুগ ধরে সিলেটে রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ একটা আদি প্রথা। নতুন বিয়ে হলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রমজানে একবার, রমজানের মাঝখানে আরেকবার এবং রমজানের শেষ দিকে নতুন জামাইয়ের জন্য কিছু গিফট, জামা-কাপড়সহ তিনবার ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। অঞ্চল ভেদে এর ভিন্নতাও রয়েছে। অনেক এলাকায় শুধু একবার ইফতারি দেওয়া হয়। প্রথম রমজানে নতুন জামাইয়ের জন্য বিভিন্ন ইফতারসামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে বড় থালা দেওয়া হয়। আর এই থালা কেনার জন্য প্রথম রমজানে সিলেটের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে। রমজান মাসজুড়ে ইফতারি দেওয়ার ধুমধাম থাকে।
রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ছাড়াও বোন, ফুফু, ভাগনি ও ভাতিজিদের বাড়িতেও ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। ফুফু ও বোনেরা বুড়ো হয়ে গেলেও ওনাদের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রচলন এখনো আছে। জামাই নিয়ে মেয়ে যদি বিদেশে থাকে, তার পরও সম্মান রক্ষার্থে বাবা-মা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি পাঠিয়ে থাকেন। অনেক সময় মামা-চাচারা বিদেশ থেকে দেশে গেলে ভাগনি ও ভাতিজির বাড়িতেও ইফতারি নিয়ে যান। আমরা ছোটবেলায় মায়ের ইফতারির জন্য অপেক্ষা করতাম, কখন যে মামা ইফতারি নিয়ে আসবেন। চাচিদের ইফতারির জন্যও অপেক্ষা করতাম। রমজান মাস এলেই দেখতাম, বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ইফতারি নিয়ে। হাতে লম্বা লিস্ট, কার কার বাড়িতে ইফতারি দেওয়া হবে, সেখানে সবার নাম লেখা থাকত। ফুফু, মেয়ে, সব ভাগনি ও ভাতিজি কারও নাম লিস্ট থেকে বাদ পড়ত না। সবার বাড়িতে ইফতারি পাঠানো হতো। ছোটবেলায় পাঁচ-সাত মাইল পায়ে হেঁটে বড় বোনের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার কথা আজও মনে পড়ে। আগের দিনে বর্ষার সময় নৌকা বোঝাই করে ইফতারি নিয়ে যাওয়া হতো। আগের দিনে বোনদের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার সময় ছোট ভাইবোনেরা যেত এবং আসার সময় দুলাভাই তাদের গিফট হিসেবে টাকা-পয়সা এবং জামা-কাপড় দিতেন। সিলেটে মেয়ের বিয়েতে একজন উকিল বাবা থাকেন, সেই উকিল বাবারও মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ আজও আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন ইফতারি দেওয়ার ধরনও অনেকটা বদলে গেছে!
সিলেটের ইফতারসামগ্রী অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় একটু ভিন্ন। সিলেটের ইফতারির আইটেম অনেকটাই ট্র্যাডিশনাল। আখনি হলো সিলেটের ইফতারের প্রধান ঐতিহ্য। আখনি কিংবা খিচুড়ি ছাড়া ইফতারের কথা চিন্তাই করা যায় না। সিলেটে ভুনা খিচুড়ি বা পাতলা খিচুড়ি দুটিই খুব প্রসিদ্ধ। আখনি অনেকটা তেহারির স্টাইলে রান্না করা হয়।
আখনি, খিচুড়ির সঙ্গে জিলাপি, ছোলা, পেঁয়াজু এবং মিষ্টান্ন তো আছেই। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে সিলেটের স্পেশাল হচ্ছে আমিত্তি ও খাজা। আরেকটি পপুলার আইটেম হলো বাখরখানি। রমজান মাসে সিলেটে বাখরখানি খুবই জনপ্রিয়। ইফতারের সময় কিংবা রাতে চায়ের সঙ্গে বাখরখানি খাওয়ার প্রচলন আবহমানকাল ধরে চলে আসছে।
রমজান হলো রহমত-বরকতের মাস, সিয়াম সাধনার মাস। রমজান মাসে কাউকে ইফতারি খাওয়ানো অনেক বড় একটি সওয়াবের কাজ। মেয়ের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনেরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী হাসিমুখে যদি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দেন, তাতে দোষের কিছু নেই। নিঃসন্দেহে, এটি একটি ভালো কাজ। ইফতারি দেওয়ার মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন আরও মজবুত হয়। পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। ভাইবোনের মধ্যে অনেক দিন পর মিলন ঘটে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রোজাদারের প্রতিদান সমান প্রতিদান দেওয়া হবে এবং রোজাদারের প্রতিদান থেকেও কোনো প্রতিদান কমানো হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭)
তবে এখন আমাদের সমাজব্যবস্থায় ইফতারি নিয়ে নানা ধরনের অপসংস্কৃতি চলছে। বিশেষ করে, সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রমজানে, দশ রমজানের পরে এবং শেষ রমজানের আগে ইফতারি প্রদানের প্রচলন রয়েছে। এর কোনো যৌক্তিকতা ইসলাম ধর্মে নেই। চাহিদামতো ইফতারসামগ্রী না পেলে কিংবা দেরিতে ইফতারি গেলে মেয়েকে কটু কথা বা গালমন্দ শুনতে হয়, যা ইসলাম ধর্ম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। চরম দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মুসলিম সমাজব্যবস্থায় রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি প্রদান নিয়ে বর্তমানে যে নিয়ম চলমান রয়েছে, তা ইসলামের নামে অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রথায় ধনী পিতা কর্তৃক নিজের আদরের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা মনে হলেও মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা-ভাইয়ের জন্য নানা সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে ইফতারি নিয়ে অনেকটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, কে কত বেশি দিতে পারে! অনেক পরিবার, বিশেষ করে বিত্তবানদের কাছে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রথা ঐতিহ্য মনে হলেও অনেক মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারকে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়।
সিলেটে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি। রমজান মাস এলেই যৌথ পরিবারের বউরা বেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন। যৌথ পরিবারে যদি তিন বউ থাকেন আর প্রথম দুই বউয়ের বাপের বাড়ির অবস্থা যদি ভালো হয়, তাহলে ওনাদের বাপের বাড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের ইফতারসামগ্রী আসে। ইফতারি উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়। খুবই ধুমধাম করে ইফতারির আয়োজন করা হয়। পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে ইফতারি বিতরণ করা হয়। ছোট বউয়ের বাপের বাড়ির অবস্থা যদি ভালো না হয়, পিতা-মাতা অনেক কষ্ট করে চলেন, সংসার কোনো রকমে চলে আর সে জন্য ইফতারি পরিমাণে যদি একটু কম আসে বা ইফতারি আসতে একটু দেরি হলে অনেক সময় শাশুড়ি ও ননদদের কটু কথা শুনতে হয়। কটু কথা না শোনার জন্য অনেক সময় মেয়ে তার বাবা-মাকে আগে থেকেই বলে দেয়, বেশি করে যেন ইফতারি নিয়ে আসেন। মেয়ের সম্মান রক্ষার্থে, মেয়ের মুখ পরিবারের সবার কাছে যাতে উঁচু থাকে, সে জন্য অনেক গরিব পিতা-মাতা তাদের শেষ সম্বল গরু-ছাগল বিক্রি করে কিংবা কারও কাছ থেকে টাকা ঋণ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দিয়ে থাকেন; যা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। অনেক সময় শাশুড়িদের মুখে শোনা যায়, ‘কিতা গো, তোমার বাফর বাড়ি থাকি দেকি আবো ইফতারি আইলো না!’ (তোমার বাবা-মা এখনো ইফতারি পাঠালেন না)। আবার অনেক শাশুড়ি বউকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ওগো তোমার মা-বাফে দেকি ইবার ইফতারি খম দিলা, আমরা সবর ফুইছে না।’ (তোমার বাবা-মা এবার খুবই কম ইফতার দিলেন, যা সবার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না)। এটা একধরনের মানসিক অত্যাচার ও জুলুম।
সামর্থ্য অনুযায়ী খুশিমনে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দিতে ইসলাম কখনো বাধা দেয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে ইফতারি দেওয়াটা অত্যাবশ্যকীয় নয়। আমরা এটাকে বাধ্যতামূলক বানিয়ে ফেলেছি, যা একধরনের জুলুম!
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তায়ালা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ (তিরমিজি : ২৫১১)
খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেক পিতা-মাতার সামর্থ্য না থাকায় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দিতে অপারগতা, দেরিতে ইফতারি পাঠানো কিংবা ইফতারি পরিমাণে কম দেওয়া-এগুলো নিয়ে অনেক মেয়েকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়! এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও ঘটে!
২০২১ সালের ৮ মে শনিবার সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার উসমানপুর ইউনিয়নে রমজান মাসে ইফতারসামগ্রীতে স্বামীর জন্য পৃথক থালা সাজানো না থাকা এবং ঈদুল ফিতরে নতুন জামাকাপড় না দেওয়ায় স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতনে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা শরিফা বেগমের (২০) মৃত্যু হয়।
আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালের ১১ মে। ইফতারি নিয়ে শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার জের ধরে সিলেটের জৈন্তাপুরে এক নববধূর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেন নববধূ হেলেনা বেগম (২০)।
এই ঐতিহ্যের কারণে অনেক মা-বাবাকে রমজান মাস এলেই দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। অনেক বাবাকে মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার জন্য শেষ সম্বল গরু-ছাগল বিক্রি করতে হয়, অন্যের কাছ থেকে টাকা ঋণ করতে হয়। রমজান মাসে অনেক মা-বোনের চেহারা মলিন হয়ে যায়। অনেকে নীরবে-নিভৃতে চোখের জল ফেলেন! যে প্রথার কারণে অনেকের সুন্দর সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। যে ঐতিহ্যের কারণে হেলেনার মতো মেয়েকে আত্মহত্যা করতে হয়। এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু খুবই দুঃখজনক!
কিছু কিছু লোভী জামাই, ননদ এবং স্বার্থান্বেষী শাশুড়ির কারণে সিলেটের শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য ‘পুড়ির বাড়ি ইস্তারি’ আজ অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ! সামান্য একটু ইফতারির জন্য আপনি আপনার স্ত্রীকে অপমান করেন। কাঙালের মতো বসে থাকেন একটু ইফতারি খাওয়ার জন্য। ইফতারি পরিমাণে একটু কম হলে বা ইফতারি দিতে একটু দেরি হলে আপনি, আপনার বোন, আপনার মা স্ত্রীকে কটু কথা বলেন, অপমান করেন, অপদস্থ করেন, অত্যাচার করেন! আপনি সবার কাছে প্রশংসা কুড়াতে চান, সম্মান নিয়ে থাকতে চান। আপনার স্ত্রীকেও সম্মান করা এবং সবার সামনে স্ত্রীর সম্মান যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেটা দেখার দায়িত্বও আপনার।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। আর যদি তাকে তোমার অপছন্দও হয়, তবু তুমি যা অপছন্দ করছ আল্লাহ তাতে সীমাহীন কল্যাণ দিয়ে দেবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯)
যদি দেখেন শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো নয়, ওনারা কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন, সামান্য আয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে, পরিষ্কারভাবে বলে দিনÑকোনো ইফতারি লাগবে না। আর এই কাজটা করতে হবে আমাদের মতো জামাইদেরকেই। প্রয়োজনে আপনি আপনার মা, বাবা, বোনকে বুঝিয়ে বলুন। না বলতে শিখুন। একজন বাবা-মা অনেক কষ্টে লালন-পালন করে ছোট থেকে বড় করে কলিজার টুকরা মেয়েটাকে আপনার কাছে সোপর্দ করল। আপনি আর কী চান? সামর্থ্য থাকলে বাজার থেকে দামি ইফতারসামগ্রী কিনে শ্বশুরবাড়ি দিয়ে আসুন। তাতে অনেক সওয়াব হবে। মনে রাখবেন ‘জামাই’ বাবু, আপনিও একদিন মেয়ের বাবা হবেন আর ‘ননদ’, আপনিও একদিন মেয়ের মা হবেন! আর শাশুড়ি, আপনারও তো হয়তো-বা মেয়ে আছে!
‘পুড়ির বাড়ি ইস্তারি’ অর্থাৎ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি-এটা সিলেটের শত বছরের ঐতিহ্য। এই ইফতারি দেওয়ার রীতিনীতি আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এই ঐতিহ্যকে ধারণ এবং লালন করতে গিয়ে যেন কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে, ইফতারি নিয়ে যেন কোনো বোনকে আর কটু কথা শুনতে না হয়, কোনো গালি শুনতে না হয়, কোনো বাবা কিংবা ভাইকে যেন গরু বা ছাগল বিক্রি করতে না হয়, টাকা যেন ঋণ করতে না হয়, কোনো বোনকে যেন আর আত্মহত্যা করতে না হয়, সে জন্য আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য আমাদের জামাইদেরকে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। এই ফিতনার যুগে আল্লাহ আমাদের সবাইকে যেন সঠিকভাবে বোঝার তৌফিক দান করেন।
লেখক : গবেষক ও সাহিত্যিক, টরেন্টো, কানাডা।
যুগ যুগ ধরে সিলেটে রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ একটা আদি প্রথা। নতুন বিয়ে হলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রমজানে একবার, রমজানের মাঝখানে আরেকবার এবং রমজানের শেষ দিকে নতুন জামাইয়ের জন্য কিছু গিফট, জামা-কাপড়সহ তিনবার ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। অঞ্চল ভেদে এর ভিন্নতাও রয়েছে। অনেক এলাকায় শুধু একবার ইফতারি দেওয়া হয়। প্রথম রমজানে নতুন জামাইয়ের জন্য বিভিন্ন ইফতারসামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে বড় থালা দেওয়া হয়। আর এই থালা কেনার জন্য প্রথম রমজানে সিলেটের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও মিষ্টির দোকানগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে। রমজান মাসজুড়ে ইফতারি দেওয়ার ধুমধাম থাকে।
রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ছাড়াও বোন, ফুফু, ভাগনি ও ভাতিজিদের বাড়িতেও ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। ফুফু ও বোনেরা বুড়ো হয়ে গেলেও ওনাদের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রচলন এখনো আছে। জামাই নিয়ে মেয়ে যদি বিদেশে থাকে, তার পরও সম্মান রক্ষার্থে বাবা-মা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি পাঠিয়ে থাকেন। অনেক সময় মামা-চাচারা বিদেশ থেকে দেশে গেলে ভাগনি ও ভাতিজির বাড়িতেও ইফতারি নিয়ে যান। আমরা ছোটবেলায় মায়ের ইফতারির জন্য অপেক্ষা করতাম, কখন যে মামা ইফতারি নিয়ে আসবেন। চাচিদের ইফতারির জন্যও অপেক্ষা করতাম। রমজান মাস এলেই দেখতাম, বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ইফতারি নিয়ে। হাতে লম্বা লিস্ট, কার কার বাড়িতে ইফতারি দেওয়া হবে, সেখানে সবার নাম লেখা থাকত। ফুফু, মেয়ে, সব ভাগনি ও ভাতিজি কারও নাম লিস্ট থেকে বাদ পড়ত না। সবার বাড়িতে ইফতারি পাঠানো হতো। ছোটবেলায় পাঁচ-সাত মাইল পায়ে হেঁটে বড় বোনের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার কথা আজও মনে পড়ে। আগের দিনে বর্ষার সময় নৌকা বোঝাই করে ইফতারি নিয়ে যাওয়া হতো। আগের দিনে বোনদের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার সময় ছোট ভাইবোনেরা যেত এবং আসার সময় দুলাভাই তাদের গিফট হিসেবে টাকা-পয়সা এবং জামা-কাপড় দিতেন। সিলেটে মেয়ের বিয়েতে একজন উকিল বাবা থাকেন, সেই উকিল বাবারও মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ আজও আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন ইফতারি দেওয়ার ধরনও অনেকটা বদলে গেছে!
সিলেটের ইফতারসামগ্রী অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় একটু ভিন্ন। সিলেটের ইফতারির আইটেম অনেকটাই ট্র্যাডিশনাল। আখনি হলো সিলেটের ইফতারের প্রধান ঐতিহ্য। আখনি কিংবা খিচুড়ি ছাড়া ইফতারের কথা চিন্তাই করা যায় না। সিলেটে ভুনা খিচুড়ি বা পাতলা খিচুড়ি দুটিই খুব প্রসিদ্ধ। আখনি অনেকটা তেহারির স্টাইলে রান্না করা হয়।
আখনি, খিচুড়ির সঙ্গে জিলাপি, ছোলা, পেঁয়াজু এবং মিষ্টান্ন তো আছেই। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে সিলেটের স্পেশাল হচ্ছে আমিত্তি ও খাজা। আরেকটি পপুলার আইটেম হলো বাখরখানি। রমজান মাসে সিলেটে বাখরখানি খুবই জনপ্রিয়। ইফতারের সময় কিংবা রাতে চায়ের সঙ্গে বাখরখানি খাওয়ার প্রচলন আবহমানকাল ধরে চলে আসছে।
রমজান হলো রহমত-বরকতের মাস, সিয়াম সাধনার মাস। রমজান মাসে কাউকে ইফতারি খাওয়ানো অনেক বড় একটি সওয়াবের কাজ। মেয়ের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনেরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী হাসিমুখে যদি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দেন, তাতে দোষের কিছু নেই। নিঃসন্দেহে, এটি একটি ভালো কাজ। ইফতারি দেওয়ার মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন আরও মজবুত হয়। পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়। ভাইবোনের মধ্যে অনেক দিন পর মিলন ঘটে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রোজাদারের প্রতিদান সমান প্রতিদান দেওয়া হবে এবং রোজাদারের প্রতিদান থেকেও কোনো প্রতিদান কমানো হবে না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭)
তবে এখন আমাদের সমাজব্যবস্থায় ইফতারি নিয়ে নানা ধরনের অপসংস্কৃতি চলছে। বিশেষ করে, সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে প্রথম রমজানে, দশ রমজানের পরে এবং শেষ রমজানের আগে ইফতারি প্রদানের প্রচলন রয়েছে। এর কোনো যৌক্তিকতা ইসলাম ধর্মে নেই। চাহিদামতো ইফতারসামগ্রী না পেলে কিংবা দেরিতে ইফতারি গেলে মেয়েকে কটু কথা বা গালমন্দ শুনতে হয়, যা ইসলাম ধর্ম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। চরম দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মুসলিম সমাজব্যবস্থায় রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি প্রদান নিয়ে বর্তমানে যে নিয়ম চলমান রয়েছে, তা ইসলামের নামে অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রথায় ধনী পিতা কর্তৃক নিজের আদরের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা মনে হলেও মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা-ভাইয়ের জন্য নানা সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে ইফতারি নিয়ে অনেকটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, কে কত বেশি দিতে পারে! অনেক পরিবার, বিশেষ করে বিত্তবানদের কাছে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রথা ঐতিহ্য মনে হলেও অনেক মধ্যবিত্ত ও গরিব পরিবারকে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়।
সিলেটে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি। রমজান মাস এলেই যৌথ পরিবারের বউরা বেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন। যৌথ পরিবারে যদি তিন বউ থাকেন আর প্রথম দুই বউয়ের বাপের বাড়ির অবস্থা যদি ভালো হয়, তাহলে ওনাদের বাপের বাড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের ইফতারসামগ্রী আসে। ইফতারি উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়। খুবই ধুমধাম করে ইফতারির আয়োজন করা হয়। পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে ইফতারি বিতরণ করা হয়। ছোট বউয়ের বাপের বাড়ির অবস্থা যদি ভালো না হয়, পিতা-মাতা অনেক কষ্ট করে চলেন, সংসার কোনো রকমে চলে আর সে জন্য ইফতারি পরিমাণে যদি একটু কম আসে বা ইফতারি আসতে একটু দেরি হলে অনেক সময় শাশুড়ি ও ননদদের কটু কথা শুনতে হয়। কটু কথা না শোনার জন্য অনেক সময় মেয়ে তার বাবা-মাকে আগে থেকেই বলে দেয়, বেশি করে যেন ইফতারি নিয়ে আসেন। মেয়ের সম্মান রক্ষার্থে, মেয়ের মুখ পরিবারের সবার কাছে যাতে উঁচু থাকে, সে জন্য অনেক গরিব পিতা-মাতা তাদের শেষ সম্বল গরু-ছাগল বিক্রি করে কিংবা কারও কাছ থেকে টাকা ঋণ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দিয়ে থাকেন; যা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। অনেক সময় শাশুড়িদের মুখে শোনা যায়, ‘কিতা গো, তোমার বাফর বাড়ি থাকি দেকি আবো ইফতারি আইলো না!’ (তোমার বাবা-মা এখনো ইফতারি পাঠালেন না)। আবার অনেক শাশুড়ি বউকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ওগো তোমার মা-বাফে দেকি ইবার ইফতারি খম দিলা, আমরা সবর ফুইছে না।’ (তোমার বাবা-মা এবার খুবই কম ইফতার দিলেন, যা সবার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না)। এটা একধরনের মানসিক অত্যাচার ও জুলুম।
সামর্থ্য অনুযায়ী খুশিমনে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দিতে ইসলাম কখনো বাধা দেয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে ইফতারি দেওয়াটা অত্যাবশ্যকীয় নয়। আমরা এটাকে বাধ্যতামূলক বানিয়ে ফেলেছি, যা একধরনের জুলুম!
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তায়ালা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ (তিরমিজি : ২৫১১)
খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেক পিতা-মাতার সামর্থ্য না থাকায় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি দিতে অপারগতা, দেরিতে ইফতারি পাঠানো কিংবা ইফতারি পরিমাণে কম দেওয়া-এগুলো নিয়ে অনেক মেয়েকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়! এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও ঘটে!
২০২১ সালের ৮ মে শনিবার সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার উসমানপুর ইউনিয়নে রমজান মাসে ইফতারসামগ্রীতে স্বামীর জন্য পৃথক থালা সাজানো না থাকা এবং ঈদুল ফিতরে নতুন জামাকাপড় না দেওয়ায় স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতনে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা শরিফা বেগমের (২০) মৃত্যু হয়।
আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালের ১১ মে। ইফতারি নিয়ে শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার জের ধরে সিলেটের জৈন্তাপুরে এক নববধূর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রশি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেন নববধূ হেলেনা বেগম (২০)।
এই ঐতিহ্যের কারণে অনেক মা-বাবাকে রমজান মাস এলেই দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। অনেক বাবাকে মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার জন্য শেষ সম্বল গরু-ছাগল বিক্রি করতে হয়, অন্যের কাছ থেকে টাকা ঋণ করতে হয়। রমজান মাসে অনেক মা-বোনের চেহারা মলিন হয়ে যায়। অনেকে নীরবে-নিভৃতে চোখের জল ফেলেন! যে প্রথার কারণে অনেকের সুন্দর সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। যে ঐতিহ্যের কারণে হেলেনার মতো মেয়েকে আত্মহত্যা করতে হয়। এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু খুবই দুঃখজনক!
কিছু কিছু লোভী জামাই, ননদ এবং স্বার্থান্বেষী শাশুড়ির কারণে সিলেটের শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য ‘পুড়ির বাড়ি ইস্তারি’ আজ অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ! সামান্য একটু ইফতারির জন্য আপনি আপনার স্ত্রীকে অপমান করেন। কাঙালের মতো বসে থাকেন একটু ইফতারি খাওয়ার জন্য। ইফতারি পরিমাণে একটু কম হলে বা ইফতারি দিতে একটু দেরি হলে আপনি, আপনার বোন, আপনার মা স্ত্রীকে কটু কথা বলেন, অপমান করেন, অপদস্থ করেন, অত্যাচার করেন! আপনি সবার কাছে প্রশংসা কুড়াতে চান, সম্মান নিয়ে থাকতে চান। আপনার স্ত্রীকেও সম্মান করা এবং সবার সামনে স্ত্রীর সম্মান যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেটা দেখার দায়িত্বও আপনার।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। আর যদি তাকে তোমার অপছন্দও হয়, তবু তুমি যা অপছন্দ করছ আল্লাহ তাতে সীমাহীন কল্যাণ দিয়ে দেবেন।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৯)
যদি দেখেন শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো নয়, ওনারা কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন, সামান্য আয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে, পরিষ্কারভাবে বলে দিনÑকোনো ইফতারি লাগবে না। আর এই কাজটা করতে হবে আমাদের মতো জামাইদেরকেই। প্রয়োজনে আপনি আপনার মা, বাবা, বোনকে বুঝিয়ে বলুন। না বলতে শিখুন। একজন বাবা-মা অনেক কষ্টে লালন-পালন করে ছোট থেকে বড় করে কলিজার টুকরা মেয়েটাকে আপনার কাছে সোপর্দ করল। আপনি আর কী চান? সামর্থ্য থাকলে বাজার থেকে দামি ইফতারসামগ্রী কিনে শ্বশুরবাড়ি দিয়ে আসুন। তাতে অনেক সওয়াব হবে। মনে রাখবেন ‘জামাই’ বাবু, আপনিও একদিন মেয়ের বাবা হবেন আর ‘ননদ’, আপনিও একদিন মেয়ের মা হবেন! আর শাশুড়ি, আপনারও তো হয়তো-বা মেয়ে আছে!
‘পুড়ির বাড়ি ইস্তারি’ অর্থাৎ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ইফতারি-এটা সিলেটের শত বছরের ঐতিহ্য। এই ইফতারি দেওয়ার রীতিনীতি আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এই ঐতিহ্যকে ধারণ এবং লালন করতে গিয়ে যেন কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে, ইফতারি নিয়ে যেন কোনো বোনকে আর কটু কথা শুনতে না হয়, কোনো গালি শুনতে না হয়, কোনো বাবা কিংবা ভাইকে যেন গরু বা ছাগল বিক্রি করতে না হয়, টাকা যেন ঋণ করতে না হয়, কোনো বোনকে যেন আর আত্মহত্যা করতে না হয়, সে জন্য আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য আমাদের জামাইদেরকে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। এই ফিতনার যুগে আল্লাহ আমাদের সবাইকে যেন সঠিকভাবে বোঝার তৌফিক দান করেন।
লেখক : গবেষক ও সাহিত্যিক, টরেন্টো, কানাডা।