
ঘটনাটি ঘটেছিল মিশিগানের একটি স্কুলে। ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর মিশিগানের অক্সফোর্ড হাইস্কুলের এক শিক্ষার্থীর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের শিকারে পরিণত হয়ে ওইদিন ঘটনাস্থলে চারজন শিক্ষার্থী প্রাণ দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রায়ই বিভিন্ন স্টেটের স্কুলসমূহে কিশোর শিক্ষার্থীর গুলিতে অনেক কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু ঘটে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অনেকটাই ডালভাতের মতো সহজ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে ১৮০ দিনের মতো স্কুল খোলা থাকে। আর সেই হিসাবে গড়ে প্রতি আট দিনের মধ্যে একটি না একটি স্কুলে এ ধরনের হামলা বা হামলা-পরবর্তী হতাহতের ঘটনা ঘটতেই থাকে।
১৯৭০ সাল থেকে পরবর্তী সময়ের মধ্যে এ ধরনের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহতের সংখ্যা ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছিল। সেই হিসাব অনুযায়ী ওই সময়ে ৯৪টির মতো ঘটনা ঘটেছিল। এর আগে ১৯৮৬ সালে এ হতাহতের সংখ্যা ছিল ৫৯টির মতো। তার আরও কয়েক বছর আগে, অর্থাৎ সত্তরের দশকে হতাহতের সংখ্যা ছিল ৩৫টিরও নিচে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ‘স্কুল আর্মস’-এর জরিপের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে ১২০টি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। একইভাবে সিএনএন ২০২০ সালে আরও এক জরিপের ভিত্তিতে উল্লেখ করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি পরিবারের ৪৪ শতাংশ মানুষ ঘরে অস্ত্র রাখে। অন্য এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য হলো সারা দুনিয়ায় ৮৫ কোটি ৭০ লাখ বেসামরিক মানুষের হাতে অস্ত্র রয়েছে। তার মধ্যে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ বা ৪৪ শতাংশের মালিকানা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের দখলে।
এই অবাধে বন্দুক বহন বা ব্যবহারের পেছনে রয়েছে দেশটির সংবিধান প্রণীত দ্বিতীয় সংশোধনীর মূল বক্তব্য। যেখানে বলা হয়েছে, ১৮ ঊর্ধ্ব যেকোনো ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে বন্দুক বহনের অধিকার রাখে এবং সংবিধান প্রণীত এই অধিকার হরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কোনোভাবেই বাধা সৃষ্টির কারণ হতে পারে না।
মার্কিনিদের কাছে সংবিধানস্বীকৃত এই অধিকার এখন অনেকটা মানুষের মৌলিক অধিকারের সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বলা হয়ে থাকে, আমেরিকায় মানুষের চেয়ে বন্দুকের সংখ্যা বেশি। এ বিষয়ে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অভিমত হলো শুধু ২০২০ সালে দেশের ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অস্ত্র কিনেছিল। এফবিআইয়ের মতে, গত কয়েক বছরের তুলনায় এই সংখ্যাটা ছিল সর্বোচ্চ। এই বেচা-কেনার সহজলভ্যতার কারণে শুধু আঠারো ঊর্ধ্ব নয়, তার চেয়েও কম বয়সী কিশোরদের হাতেও এখন অস্ত্র চলে গেছে। শুধু কিশোর-কিশোর নয়, তার চেয়ে কম বয়সী, অর্থাৎ একটি শিশুর খেলার সামগ্রীর ভেতরেও এখন বন্দুক থাকে। খেলার বন্দুক নয়, সত্যিকারের বন্দুক! তার একটি উদাহরণ হলো গত বছর ভার্জিনিয়ার একটি বাড়িতে ক্রীড়ারত অবুঝ এক শিশুর গুলিতে পিতার আহত হওয়ার খবর। অভিভাবকেরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। যেমন গত বছর ভার্জিনিয়ার একটি প্রাথমিক স্কুলে একজন মা তার সন্তানকে ঘরে নিয়ে আসতে গেলে অপেক্ষারত আরও একজন মায়ের পকেটে থাকা বন্দুকের গুলি অসাবধানতাবশত আগেরজনের ওপর আঘাত হানে। গুরুতর আহত সেই মাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল সেই সময়।
যুক্তরাষ্ট্রের সব স্টেটেই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে থাকে। তবে এদিক দিয়ে এগিয়ে আছে রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসি। বন্দুক হামলায় হতাহতের দিকে ওই নগরীটি এখন ব্রাজিলের সমান। বলা হয়ে থাকে, বন্দুক হামলায় নিহতের সংখ্যা অনুযায়ী ব্রাজিলের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে। তবে সামগ্রিকভাবে দুনিয়ায় এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাস শুটিং বা নির্বিচারে গুলিবর্ষণের বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে শীর্ষস্থানটি দখলে রেখেছে বহু বছর ধরে। তার কিন্তু নজির হলো ম্যাস শুটিংয়ে হতাহতের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কানাডার তুলনায় আটগুণ বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় ২২ গুণ আর অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় ২৩ গুণ বেশি এগিয়ে আছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে যে পরিমাণ গোলাগুলির কারণে সহপাঠীর হাতে সহপাঠীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, এককথায় তা আরও ভয়াবহ। ২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মর্মান্তিক বন্দুক হামলায় দক্ষিণ কোরিয়া বংশোদ্ভূত ২৩ বছর বয়সী যুবক চু সিউ হুইয়ের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩১ জন তরুণ-তরুণী। এ পর্যন্ত এ ঘটনাই সবচেয়ে বড় ও মর্মান্তিক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। তার পরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা হলো কানেকটিকাটের স্যান্ড হুক অ্যালিমেন্টারি স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে মোট ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন অপর এক শিক্ষার্থীর এলোপাতাড়ি গুলিতে। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১২ সালে।
১৯৯৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ ধনের ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৩ বারের মতো। ক্রমে ক্রমে সংখ্যাটির বৃদ্ধি এতটাই বেড়েছে যে এখন বিষয়টি অনেকটাই ডালভাতের মতো সহজ হয়ে উঠেছে। কেবল হতাহতের পরে একটি নাই হয়ে যাওয়া শিশুর পরিবার জানে কী হারাল তারা! বাদবাকি প্রশাসনিক পরিধিতে কিছুদিন ঘটনার ছায়া বুদবুদের মতো জেগে থাকলেও অল্পদিনের মধ্যে তাও আর মনে থাকে না কারোই।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, শুধু ২০২০ সালে এই এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের কারণে চার হাজারের মতো শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। যাদের বয়স ১৯-এর মধ্যে। আর ২০১৯ সালের চেয়ে সেই হিসাবটি ৩৩.৪ শতাংশ বেশি।
এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সেনাসদস্যদের চাইতে শিশুমৃত্যুর হার বেশি’ শিরোনামে। সেই প্রতিবেদনে তারা দেখিয়েছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সহযোগে যুদ্ধক্ষেত্রে যে পরিমাণ সেনাসদস্য মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি স্কুল গোয়িং শিশুর মৃত্যু হচ্ছে শুধু এসব বন্দুক হামলায়। ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাসদস্যদের চেয়ে এসব শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি হচ্ছে ৪০ গুণ বেশি।
এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে আবার বর্ণবিদ্বেষের বিষয়টিও সামনে চলে আসছে। যেমন গত বছরের মে মাসের ২৪ তারিখ টেক্সাসের এক স্কুলে, রব অ্যালিমেন্টারি, সন্দেহভাজন এক স্প্যানিশ যুবকের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারিয়েছিল ১৯ জন শিশু ছাড়াও দুজন শিক্ষক। মোট ২১ জন মানুষের হতাহতের ঘটনায় পুলিশকে অনেকটাই বিভ্রান্ত মূর্তিতে দেখা গেছে। ঘটনা ঘটার আধা ঘণ্টা পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ এলেও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছিল তারা। এই দেরির পেছনে কর্তব্যরত এক পুলিশকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশপ্রধানের দিকে অঙ্গুলি তুলতেও দেখা গিয়েছিল সেই সময়।
রব অ্যালিমেন্টারি স্কুলের পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিল হিস্পানিক বা ল্যাটিনো, অর্থাৎ সাদা আমেরিকান নয়। ফলে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার পেছনে এই ‘বর্ণবাদ’ একটি কারণ ছিল বলে নিহতদের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠেছিল সে সময়।
লেখাটির সূচনাতে মিশিগানের একটি স্কুলে সহপাঠীর এলোপাতাড়ি গুলিতে চার শিক্ষার্থীর মৃত্যু-সংক্রান্ত যে আলোচনার সূত্রপাত করতে চেয়েছিলাম, সচেতন পাঠকমাত্রই বিষয়টিকে একটি হালকা ঘটনা কিংবা উপহাসের বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আনতেই পারেন। সেখানে একজনের গুলিতে ২৩ জন মুহূর্তেই নাই হয়ে যান। সে ধরনের এক দেশের এক স্কুলে চারজন শিশু মারা যাওয়াটা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে না! আসলে মিশিগানের এক আদালতে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিশোর, ১৭ বছর বয়সী, ইয়ান ক্রাম্বলেকে গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলেও ঘটনাটি আরও বড় এক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর তা হলো সংশ্লিষ্ট আদালতের জুরিবোর্ড ওই কিশোরের মাকে অনিচ্ছাকৃত নরহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতের জুরিবোর্ড শুধু অপরাধীর মা নন, বাবাকেও দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছেন। মামলাটির রায় ঘোষিত হবে আগামী ৯ এপ্রিল। বিচারে খুনির মা জেনিফারের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। খুনি কিশোরের পিতা জেমসের সামনের মাসে আলাদাভাবে বিচার হওয়ার কথা। যে ৯ এমএম এসআইজি হ্যান্ডগান দিয়ে ইয়ান তার স্কুলের সহপাঠীদের খুন করেছিল, সেই বন্দুকটি ইয়ানের মা-বাবা উপহার হিসেবে কিনে দিয়েছিলেন ছেলেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ছেলের অপরাধের কারণে মা-বাবাকে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত করে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার ঘটনা এটিই প্রথম। মিশিগানের জুরিবোর্ড সেই সাহস দেখিয়ে আদালতের রায়কে ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত করলেন। এ রায় ওই ধরনের শিশুহত্যা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে কি না-সেটিই এখন দেখার বিষয়।
১৯৭০ সাল থেকে পরবর্তী সময়ের মধ্যে এ ধরনের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহতের সংখ্যা ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছিল। সেই হিসাব অনুযায়ী ওই সময়ে ৯৪টির মতো ঘটনা ঘটেছিল। এর আগে ১৯৮৬ সালে এ হতাহতের সংখ্যা ছিল ৫৯টির মতো। তার আরও কয়েক বছর আগে, অর্থাৎ সত্তরের দশকে হতাহতের সংখ্যা ছিল ৩৫টিরও নিচে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ‘স্কুল আর্মস’-এর জরিপের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে ১২০টি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। একইভাবে সিএনএন ২০২০ সালে আরও এক জরিপের ভিত্তিতে উল্লেখ করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি পরিবারের ৪৪ শতাংশ মানুষ ঘরে অস্ত্র রাখে। অন্য এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য হলো সারা দুনিয়ায় ৮৫ কোটি ৭০ লাখ বেসামরিক মানুষের হাতে অস্ত্র রয়েছে। তার মধ্যে ৩৯ কোটি ৩০ লাখ বা ৪৪ শতাংশের মালিকানা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের দখলে।
এই অবাধে বন্দুক বহন বা ব্যবহারের পেছনে রয়েছে দেশটির সংবিধান প্রণীত দ্বিতীয় সংশোধনীর মূল বক্তব্য। যেখানে বলা হয়েছে, ১৮ ঊর্ধ্ব যেকোনো ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে বন্দুক বহনের অধিকার রাখে এবং সংবিধান প্রণীত এই অধিকার হরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কোনোভাবেই বাধা সৃষ্টির কারণ হতে পারে না।
মার্কিনিদের কাছে সংবিধানস্বীকৃত এই অধিকার এখন অনেকটা মানুষের মৌলিক অধিকারের সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বলা হয়ে থাকে, আমেরিকায় মানুষের চেয়ে বন্দুকের সংখ্যা বেশি। এ বিষয়ে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অভিমত হলো শুধু ২০২০ সালে দেশের ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অস্ত্র কিনেছিল। এফবিআইয়ের মতে, গত কয়েক বছরের তুলনায় এই সংখ্যাটা ছিল সর্বোচ্চ। এই বেচা-কেনার সহজলভ্যতার কারণে শুধু আঠারো ঊর্ধ্ব নয়, তার চেয়েও কম বয়সী কিশোরদের হাতেও এখন অস্ত্র চলে গেছে। শুধু কিশোর-কিশোর নয়, তার চেয়ে কম বয়সী, অর্থাৎ একটি শিশুর খেলার সামগ্রীর ভেতরেও এখন বন্দুক থাকে। খেলার বন্দুক নয়, সত্যিকারের বন্দুক! তার একটি উদাহরণ হলো গত বছর ভার্জিনিয়ার একটি বাড়িতে ক্রীড়ারত অবুঝ এক শিশুর গুলিতে পিতার আহত হওয়ার খবর। অভিভাবকেরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। যেমন গত বছর ভার্জিনিয়ার একটি প্রাথমিক স্কুলে একজন মা তার সন্তানকে ঘরে নিয়ে আসতে গেলে অপেক্ষারত আরও একজন মায়ের পকেটে থাকা বন্দুকের গুলি অসাবধানতাবশত আগেরজনের ওপর আঘাত হানে। গুরুতর আহত সেই মাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল সেই সময়।
যুক্তরাষ্ট্রের সব স্টেটেই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে থাকে। তবে এদিক দিয়ে এগিয়ে আছে রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসি। বন্দুক হামলায় হতাহতের দিকে ওই নগরীটি এখন ব্রাজিলের সমান। বলা হয়ে থাকে, বন্দুক হামলায় নিহতের সংখ্যা অনুযায়ী ব্রাজিলের অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে। তবে সামগ্রিকভাবে দুনিয়ায় এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাস শুটিং বা নির্বিচারে গুলিবর্ষণের বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে শীর্ষস্থানটি দখলে রেখেছে বহু বছর ধরে। তার কিন্তু নজির হলো ম্যাস শুটিংয়ে হতাহতের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কানাডার তুলনায় আটগুণ বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় ২২ গুণ আর অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় ২৩ গুণ বেশি এগিয়ে আছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে যে পরিমাণ গোলাগুলির কারণে সহপাঠীর হাতে সহপাঠীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, এককথায় তা আরও ভয়াবহ। ২০০৭ সালের ১৬ এপ্রিল ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মর্মান্তিক বন্দুক হামলায় দক্ষিণ কোরিয়া বংশোদ্ভূত ২৩ বছর বয়সী যুবক চু সিউ হুইয়ের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৩১ জন তরুণ-তরুণী। এ পর্যন্ত এ ঘটনাই সবচেয়ে বড় ও মর্মান্তিক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। তার পরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা হলো কানেকটিকাটের স্যান্ড হুক অ্যালিমেন্টারি স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক মিলিয়ে মোট ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন অপর এক শিক্ষার্থীর এলোপাতাড়ি গুলিতে। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১২ সালে।
১৯৯৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ ধনের ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৩ বারের মতো। ক্রমে ক্রমে সংখ্যাটির বৃদ্ধি এতটাই বেড়েছে যে এখন বিষয়টি অনেকটাই ডালভাতের মতো সহজ হয়ে উঠেছে। কেবল হতাহতের পরে একটি নাই হয়ে যাওয়া শিশুর পরিবার জানে কী হারাল তারা! বাদবাকি প্রশাসনিক পরিধিতে কিছুদিন ঘটনার ছায়া বুদবুদের মতো জেগে থাকলেও অল্পদিনের মধ্যে তাও আর মনে থাকে না কারোই।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, শুধু ২০২০ সালে এই এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের কারণে চার হাজারের মতো শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। যাদের বয়স ১৯-এর মধ্যে। আর ২০১৯ সালের চেয়ে সেই হিসাবটি ৩৩.৪ শতাংশ বেশি।
এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সেনাসদস্যদের চাইতে শিশুমৃত্যুর হার বেশি’ শিরোনামে। সেই প্রতিবেদনে তারা দেখিয়েছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সহযোগে যুদ্ধক্ষেত্রে যে পরিমাণ সেনাসদস্য মৃত্যুঝুঁকিতে থাকে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি স্কুল গোয়িং শিশুর মৃত্যু হচ্ছে শুধু এসব বন্দুক হামলায়। ওয়াশিংটন পোস্টের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাসদস্যদের চেয়ে এসব শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি হচ্ছে ৪০ গুণ বেশি।
এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে আবার বর্ণবিদ্বেষের বিষয়টিও সামনে চলে আসছে। যেমন গত বছরের মে মাসের ২৪ তারিখ টেক্সাসের এক স্কুলে, রব অ্যালিমেন্টারি, সন্দেহভাজন এক স্প্যানিশ যুবকের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারিয়েছিল ১৯ জন শিশু ছাড়াও দুজন শিক্ষক। মোট ২১ জন মানুষের হতাহতের ঘটনায় পুলিশকে অনেকটাই বিভ্রান্ত মূর্তিতে দেখা গেছে। ঘটনা ঘটার আধা ঘণ্টা পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ এলেও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছিল তারা। এই দেরির পেছনে কর্তব্যরত এক পুলিশকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশপ্রধানের দিকে অঙ্গুলি তুলতেও দেখা গিয়েছিল সেই সময়।
রব অ্যালিমেন্টারি স্কুলের পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিল হিস্পানিক বা ল্যাটিনো, অর্থাৎ সাদা আমেরিকান নয়। ফলে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার পেছনে এই ‘বর্ণবাদ’ একটি কারণ ছিল বলে নিহতদের পরিবার থেকে অভিযোগ উঠেছিল সে সময়।
লেখাটির সূচনাতে মিশিগানের একটি স্কুলে সহপাঠীর এলোপাতাড়ি গুলিতে চার শিক্ষার্থীর মৃত্যু-সংক্রান্ত যে আলোচনার সূত্রপাত করতে চেয়েছিলাম, সচেতন পাঠকমাত্রই বিষয়টিকে একটি হালকা ঘটনা কিংবা উপহাসের বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আনতেই পারেন। সেখানে একজনের গুলিতে ২৩ জন মুহূর্তেই নাই হয়ে যান। সে ধরনের এক দেশের এক স্কুলে চারজন শিশু মারা যাওয়াটা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে না! আসলে মিশিগানের এক আদালতে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিশোর, ১৭ বছর বয়সী, ইয়ান ক্রাম্বলেকে গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলেও ঘটনাটি আরও বড় এক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর তা হলো সংশ্লিষ্ট আদালতের জুরিবোর্ড ওই কিশোরের মাকে অনিচ্ছাকৃত নরহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতের জুরিবোর্ড শুধু অপরাধীর মা নন, বাবাকেও দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছেন। মামলাটির রায় ঘোষিত হবে আগামী ৯ এপ্রিল। বিচারে খুনির মা জেনিফারের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। খুনি কিশোরের পিতা জেমসের সামনের মাসে আলাদাভাবে বিচার হওয়ার কথা। যে ৯ এমএম এসআইজি হ্যান্ডগান দিয়ে ইয়ান তার স্কুলের সহপাঠীদের খুন করেছিল, সেই বন্দুকটি ইয়ানের মা-বাবা উপহার হিসেবে কিনে দিয়েছিলেন ছেলেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ছেলের অপরাধের কারণে মা-বাবাকে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত করে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার ঘটনা এটিই প্রথম। মিশিগানের জুরিবোর্ড সেই সাহস দেখিয়ে আদালতের রায়কে ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে পরিণত করলেন। এ রায় ওই ধরনের শিশুহত্যা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে কি না-সেটিই এখন দেখার বিষয়।