
আমেরিকার নিয়ম অনুযায়ী গত রবিবার (১০ মার্চ) থেকে ডে লাইট সেভিং শুরু হয়েছে। এই রবিবার আবার আমাদের বাংলাপঞ্জি অনুসারে ভোর পাঁচটা বা ছ’টায় শুরু হয় না কিন্তু। সেটা হয়, আমরা যাকে বলি ইংরেজি ক্যালেন্ডার, সে মতে। অর্থাৎ শনিবার রাত দুপুরের পর। যদিও থিওরেটিক্যালি শনিবার রাত ১২টা ০১ মিনিটে রবিবার শুরু হয়, কিন্তু বিশেষ কারণে ডে লাইট সেভিং শুরু হয় শনিবার রাত দু’টোয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী একে রবিবার সকাল দুইটায় ‘ডে লাইট সেভিং টাইম’ শুরু হলো বলে ধরা হয়।
মানে হলো, বর্তমানে ঘড়ির কাঁটা যেভাবে চলছিল, সেটাকে জোর করে একঘন্টা এগিয়ে দেয়া হলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হলো, ঐ রাতে এখন যেখানে রাত ২টা হবার কথা, সেটা না হয়ে ১টা ৫৯ মিনিটের পর ঘড়ির কাঁটা আর এক মিনিট পরে ২টার বদলে সোজা ১ ঘন্টা এগিয়ে একেবারে রাত ৩টায় চলে যায়। মানে আজকে শনিবার যখন সকাল ৭টা ছিল, আগামীকাল রবিবার একই সময়টা ঘড়িতে আপনা আপনি সকাল ৮ টা হয়ে গেছে দেখতে পাওয়া যাবে। অবশ্য এগুলো ডিজিট্যাল ক্লকের কথা বলছি, যেমন টিভি, সেলফোন, কম্পিউটার, ডিজিট্যাল অ্যালার্ম ক্লক, ডিজিট্যাল হাতঘড়ি ইত্যাদি। অবশ্য যাদের অ্যানালগ ঘড়ি আছে, তাদেরকে ঘড়ির কাঁটা ম্যানুয়্যালি ঘুরিয়ে ঠিক করতে হয়।
ফলে, শনিবার রাত্রে আগের রাত্রের, মানে শুক্রবারের রাতের মতো একই সময়ে যারা ঘুমাতে গিয়েছে, তারা যদি আগামীকাল রবিবার সকালে শনিবারের সকালের টাইমে, ধরুন সকাল ছ’টায় ওঠে, দেখবে তাদের ঘুম একঘন্টা কম হয়েছে। কারণ তখন তো সকাল সাতটা বেজে গেছে। আবার সন্ধ্যাও তেমনি এক ঘন্টা পরে আসবে। অর্থাৎ আজকে শনিবার যেখানে বিকেল ৬ টায় সূর্য ডুবেছিল, আগামীকাল রবিবার থেকে সুর্য ডুবে সন্ধ্যা যখন নামবে, তখন ঘড়ির কাঁটায় দেখা যাবে সময়টা দেখাচ্ছে আসলে ৭টা, ৬টা নয়। এই একঘন্টার তফাৎটা হলো ডে লাইট সেভিং টাইম। বসন্তকাল থেকে ঋতু যখন গ্রীষ্মের দিকে যাবে, দিন বাড়তে থাকবে, তখন ঘড়ির কাঁটা আর না পাল্টালেও ডে লাইট সেভিং টাইম আরো বেড়ে যাবে। দেখা যাবে বাড়তে বাড়তে সন্ধ্যা নামতে সাড়ে ন’টা বেজে যাচ্ছে। বেশ লম্বা লম্বা দিন সব তখন! এ সময় রোজার মাস হলে অনেক কষ্ট হয়। গত কয়েক বছর জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে রমজান মাস পড়ায় রোজাদারদের রোজা রাখার সময়গুলো বেড়ে গিয়েছিল। উপরন্তু সূর্যের তাপ প্রখর থাকার জন্যও কষ্ট বেড়েছিল।
কয়েকমাস চলার পর যখন শরৎ বা ‘ফল’ সিজন আসবে। তখন আমেরিকার সময় আবার ব্যাক টু প্যাভেলিয়ান, অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড টাইমে চলে যাবে। তখন এটা গ্রিনিচ মিন টাইম-এর সঙ্গে তাল রেখে চলবে। এতে করে যে সমস্ত দেশে টাইম বদল হয় না, তাদের সঙ্গে আর আমাদের সময় অ্যাডজাস্ট করার ঝক্কিটা পোহাতে হবে না। উদাহরণ স্বরূপ, বলা যায় এই স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী শিকাগোতে যখন দিনদুপুর ১২টা, তখন ঢাকাতে রাতদুপুর ১২টা, কোলকাতায় রাত ১১টা ৩০ মিনিট ও করাচিতে তখন রাত ১১টা হয়ে যাবে। এই সময়ে শিকাগোবাসীদের ঢাকার জন্য টাইমের ব্যাপারে আর কোন মাথাব্যথা থাকে না। দু’জায়গাতেই একই টাইম, কেবল একটা দিনের, অন্যটায় রাতের। কিন্তু এই স্প্রিং-সামার-ফল সিজনটা অন্যদের সঙ্গে, মানে যাদের টাইম বদল হয় না, তাদের জন্য এক মহা ঝক্কির ব্যাপার। অনেকে এটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। অনেকে এই ডে-লাইট সেভিং ছাড়াও ভিন্ন দেশে যে সময়ের তফাৎ, অর্থাৎ তাদের সময়ও যে ভিন্ন, সেটা বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না। ফলে অনেকের আত্মীয় বা অনেক বন্ধু কুশল জিজ্ঞাসা বা আড্ডা মারার জন্য বিকেলের দিকে ফস করে হয়তো টেলিফোন করে বসল। তখন ধরুন ঢাকায় বিকেল সাড়ে তিনটা, কলকাতায় তিনটা। সে সময়টাতে শিকাগোতে আপনি পুরো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন! কারণ আপনার সময় তখন রাত তিনটা। আপনি হুড়মুড় করে উঠে ফোন ধরবেন এই মনে করে যে- দেশে আত্মীয়-স্বজনদের কারো ইমার্জেন্সি অবস্থা। এভাবে মাঝে মাঝে ঝামেলা হয়।
মার্চ মাসে ডে লাইট সেভিং-এর জন্য ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলোÑ যাতে করে বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত, সামারের দিনগুলোর এক্সট্রা টাইমটা বেশি করে এনজয় করা যায় ও সময়টা আর একটু বেশি কাজে লাগানো যায়। যেমন সকালের একঘন্টা অফিস বা বাণিজ্যের জন্য সকালটা একটু বেশি কাজে লাগানো যায়। অফিস ছুটি হলেও দেখা যায়, তখনও অনেক বেলা আছে। তখন অনেকে তাদের শখের বাগানে কাজ করেন। অনেকে ব্যায়াম করার জন্য আর ওয়ার্ক আউট প্লেসে না গিয়ে, জগিং করতে বা হাঁটতে যান। অনেকে তাদের সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অনেকে রান্না ঘরে রান্না না করে বাইরে বার-বি-কিউ করের। অনেকে বাড়ির খুটখাট, নানারকম মেরামতের কাজ করে, ঘর সাজায়, পেন্ট করে। এর আরেকটা দিক হলো, এ সময় ন্যাচারাল লাইট পাওয়া যায় বলে আলো জ্বালাবার সময় একঘন্টা কমে যায়, মানে ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার না করার ফলে এনার্জি সেভিং হয় প্রায় বছরের ছয় মাস ধরে। এই ডে লাইট সেভিং-এর আইডিয়াটা রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন-এর মাথা থেকে এসেছিল ১৭৮৪ সালে। যখন তিনি ফ্রান্সে আমেরিকার একজন প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে বাস করতেন। তিনি তখনকার দিনে মোমবাতি সংরক্ষণের জন্য এক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে ওঠার আইডিয়াটা চালু করেন। এ ব্যপারে তিনি ‘দি জার্নাল অফ প্যারিস’-এর সম্পাদকের কাছে ‘অ্যান ইকনোমিক প্রোজেক্ট ফর ডিমিনিশিং দি কস্ট অফ লাইট’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠান। এটি পড়ে পত্রিকার সম্পাদক খুব উৎসাহিত হয়েছিলেন ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। অবশ্য এই ধারণা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে ব্যবহার উপযোগী হতে দীর্ঘদিন সময় লেগে গিয়েছিল। কানাডার পোর্ট আর্থার, যেটা এখন ওন্টারিয়োতে ‘থান্ডার বে’ নামে পরিচিত, সেখানে ১৯০৮ সালের জুলাই মাসে সর্বপ্রথম ডিএসটি (ডে লাইট সেভিং টাইম) ব্যবহার করা শুরু হয়।
এর প্রায় এক দশক পরে, ১৯১৮ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিএসটি প্রথা চালু করা হয়। এই একই সময়ে রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন মানবাধিকার আইনের বিলে স্বাক্ষর করেন। ডিএসটির যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ বা স্মুথ ছিল না, বরং কিছুটা বাম্পি (নঁসঢ়ু) ছিল বলা যায়। প্রচলন করার এক বছর পর ডিএসটি বাতিল করা হয়, যদিও আমেরিকার কিছু অংশ ব্যবস্থাটা অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু এতে ট্রান্সপোর্টেশান ও ব্রডকাস্টিং কোম্পানিগুলোর নানা অসুবিধা হতে থাকে । ১৯৬৬ সালে আমেরিকান কংগ্রেস ‘ইউনিফর্ম টাইম অ্যাক্ট’ আইন প্রণয়ন করে, যাতে নিশ্চিতভাবে ডিএসটি পর্যবেক্ষণকারী রাষ্ট্রগুলি একই তারিখের একই সময় তা শুরু এবং শেষ করে। প্রথম সূত্রপাতের পর, সময়ের সাথে সাথে ডিএসটি-র শুরু এবং শেষ হবার তারিখগুলো কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে অবশ্য। অবশেষে, ২০০৭ সাল থেকে ডিএসটি মার্চ মাসের দ্বিতীয় রবিবার এবং নভেম্বরের প্রথম রবিবারে যে হবে, সেই সিদ্ধান্তটাই চূড়ান্ত হয়েছে।
ডে-লাইট সেভিং টাইম (ডিএসটি)-র কিছু পাশ্ব-প্রতিক্রিয়া
১. ডিএসটির সঙ্গে কি হার্ট অ্যাটাকের কোন সম্পর্ক আছে?
ডিএসটি হৃদযন্ত্রের ক্রীয়াকলাপের (কার্ডিয়াক ইভেন্টগুলির) সঙ্গে সংযুক্ত। স্প্রিং টাইমে (বসন্তকালে) রবিবার সকালে তুলনামূলকভাবে এক ঘণ্টা ঘুম কম হওয়ায়, দেখা গেছে পরের দিন সোমবার অন্যন্য সোমবারের তুলনায় ২৫% হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ তথ্যটি ২০১৪ সালে, ডেন্ভার শহরের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। তাই ঐধরণের রোগীদের জন্য তাদের উপদেশ, ঐ দিন কাজকর্ম কিছুটা হালকাভাবে করুন এবং আগের রাতে একটু আগে বিছানায় যান।
২. ঘড়ির কাঁটা এবং চকোলেট ক্যান্ডির মধ্যে কি কোন যোগসূত্র আছে?
২০০৬ সাল পর্যন্ত, ডিএসটি এপ্রিলের প্রথম রবিবারে শুরু হতো এবং অক্টোবরের শেষ রবিবার শেষ হতো। শেষটি আসলে ‘হ্যালোইন’-এর ২/৩ দিন আগে গিয়ে পড়তো। চকোলেট, ক্যান্ডি প্রস্তুতকারকরা কয়েক দশক ধরে ডিএসটি-টি হ্যালোইনের পর পর্যন্ত প্রসারিত করার জন্য ধর্ণা দিয়ে আসছিল। কেন? কারণ ছোট ছোট বাচ্চা এবং কিশোররাও যখন দোড়ে দোড়ে ‘ট্রিক অর ট্রিট’ বলে নানাসাজে সেজে ক্যান্ডি সঞ্চয় করতে যায়, তখন অনেক ছলচাতুরি করা প্রতারক তরুণ কৌতুক করে আজে বাজে জিনিষ, এমন কি অনেক সময় বিপজ্জনক জিনিষও বাচ্চাদের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। একবছর দেখা গেয়েছিল, ক্যান্ডির প্যাকেটের মধ্যে কেউ ব্লেডের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেজন্য কর্তারা ঠিক করেন যে, অন্ধকারের মধ্যে এই জিনিষগুলি সংগ্রহ করা ঠিক নয়। যতটা দিনের আলোর মধ্যে করা যায়, ততটাই ভালো। তাই পরে এই ডিএসটির মেয়াদ সম্প্রসারিত করে অক্টোবর থেকে নভেম্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
৩. ঘড়ি ও গৃহপালিত পশু : অনেক গৃহপালিত পশুরও এতে অসুবিধা হয়। বাড়িতে পোষা কুকুর, বিড়াল এই এক ঘন্টা টাইম বদলানোতে কনফিউজড হয়ে যায়। বিশেষ করে ফার্মের গরুরা, যারা একই নির্ধারিত সময়ে দুধ দিতে অভ্যস্ত।
৪. কতকগুলি স্টেট ভাবে ইট ইজ টু মাচ : আমেরিকার কয়েকটি স্টেট, যেমন আরিজোনা, হাওয়াই, পোর্তোরিকো, ভার্জিন আইল্যান্ডস, আমেরিকান সামোয়াÑ এরা ডিএসটি অনুসরণ করে না। কারণ তাদের এরিয়াতে এমনিতেই যথেষ্ট পরিমাণে সূর্যের আলো থাকে। তারা মনে করে আরো এক ঘন্টা বেশি সূর্যের আলো আসলে তাদের তেমন কোন লাভ হবে না।
৫. কোন কোন স্টেটে আবার ঐ সময়টা দু’রকম টাইম অনুসরণ করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্ডিয়ানা স্টেটের অর্ধেক অংশ ডে লাইট সেভিং টাইম মেনে চলে, আবার অন্য অর্ধেক অংশ তা মেনে চলে না।
৬. জন্মদিন নিয়ে বিড়ম্বনা : এটি একটি মজার ঘটনা। ২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর। নর্থ ক্যারোলিনায় লরি সিরিওলি নামে এক ভদ্রমহিলা একটি যমজ সন্তানের জন্ম দেন। ছেলে পিটারের জন্ম হয় রাত ১টা ৩২ মিনিটে এবং ৩৪ মিনিট পরে জন্ম হয় কন্যা অ্যালিসনের। তাহলে ভাই পিটার বড় ও বোন অ্যালিসন ছোট, তাই তো? ওহ্ গড! ডে লাইট সেভিং টাইম বদল হয় রাত ২টায়। আর ফল সিজনে ডে লাইট সেভিং টাইম উলটে যাওয়ার ফলে সময় এক ঘন্টা পেছনে চলে যায়। সে হিসেবে অ্যালিসনের জন্মের সময় যেটা রাত ২টা ৬ মিনিটে হওয়ার কথা, সেটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে গিয়ে হয়েছে রাত ১টা ৬ মিনিট। এই বদালানো টাইম অনুযায়ী পিটারের জন্ম ১টা ৩২ মিনিটের বদলে গিয়ে দাঁড়ায় ১২টা ৩২ মিনিটে। তাহলে এখন কে বড়, আর কে ছোট?
আপনি আমি মাথা চুলকালে কি হবে? রেকর্ড তো হয়ে গেছে অন্যরকম। তাদের বাপ-মাদেরও এর উপরে বলার কিছুই ছিল না। তারা পরে হওয়া বাচ্চাটাকে বড় বাচ্চা বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
বেঁচে থাকো বাবা ডিএসটি।
(শিকাগো)
মানে হলো, বর্তমানে ঘড়ির কাঁটা যেভাবে চলছিল, সেটাকে জোর করে একঘন্টা এগিয়ে দেয়া হলো। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা হলো, ঐ রাতে এখন যেখানে রাত ২টা হবার কথা, সেটা না হয়ে ১টা ৫৯ মিনিটের পর ঘড়ির কাঁটা আর এক মিনিট পরে ২টার বদলে সোজা ১ ঘন্টা এগিয়ে একেবারে রাত ৩টায় চলে যায়। মানে আজকে শনিবার যখন সকাল ৭টা ছিল, আগামীকাল রবিবার একই সময়টা ঘড়িতে আপনা আপনি সকাল ৮ টা হয়ে গেছে দেখতে পাওয়া যাবে। অবশ্য এগুলো ডিজিট্যাল ক্লকের কথা বলছি, যেমন টিভি, সেলফোন, কম্পিউটার, ডিজিট্যাল অ্যালার্ম ক্লক, ডিজিট্যাল হাতঘড়ি ইত্যাদি। অবশ্য যাদের অ্যানালগ ঘড়ি আছে, তাদেরকে ঘড়ির কাঁটা ম্যানুয়্যালি ঘুরিয়ে ঠিক করতে হয়।
ফলে, শনিবার রাত্রে আগের রাত্রের, মানে শুক্রবারের রাতের মতো একই সময়ে যারা ঘুমাতে গিয়েছে, তারা যদি আগামীকাল রবিবার সকালে শনিবারের সকালের টাইমে, ধরুন সকাল ছ’টায় ওঠে, দেখবে তাদের ঘুম একঘন্টা কম হয়েছে। কারণ তখন তো সকাল সাতটা বেজে গেছে। আবার সন্ধ্যাও তেমনি এক ঘন্টা পরে আসবে। অর্থাৎ আজকে শনিবার যেখানে বিকেল ৬ টায় সূর্য ডুবেছিল, আগামীকাল রবিবার থেকে সুর্য ডুবে সন্ধ্যা যখন নামবে, তখন ঘড়ির কাঁটায় দেখা যাবে সময়টা দেখাচ্ছে আসলে ৭টা, ৬টা নয়। এই একঘন্টার তফাৎটা হলো ডে লাইট সেভিং টাইম। বসন্তকাল থেকে ঋতু যখন গ্রীষ্মের দিকে যাবে, দিন বাড়তে থাকবে, তখন ঘড়ির কাঁটা আর না পাল্টালেও ডে লাইট সেভিং টাইম আরো বেড়ে যাবে। দেখা যাবে বাড়তে বাড়তে সন্ধ্যা নামতে সাড়ে ন’টা বেজে যাচ্ছে। বেশ লম্বা লম্বা দিন সব তখন! এ সময় রোজার মাস হলে অনেক কষ্ট হয়। গত কয়েক বছর জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে রমজান মাস পড়ায় রোজাদারদের রোজা রাখার সময়গুলো বেড়ে গিয়েছিল। উপরন্তু সূর্যের তাপ প্রখর থাকার জন্যও কষ্ট বেড়েছিল।
কয়েকমাস চলার পর যখন শরৎ বা ‘ফল’ সিজন আসবে। তখন আমেরিকার সময় আবার ব্যাক টু প্যাভেলিয়ান, অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড টাইমে চলে যাবে। তখন এটা গ্রিনিচ মিন টাইম-এর সঙ্গে তাল রেখে চলবে। এতে করে যে সমস্ত দেশে টাইম বদল হয় না, তাদের সঙ্গে আর আমাদের সময় অ্যাডজাস্ট করার ঝক্কিটা পোহাতে হবে না। উদাহরণ স্বরূপ, বলা যায় এই স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী শিকাগোতে যখন দিনদুপুর ১২টা, তখন ঢাকাতে রাতদুপুর ১২টা, কোলকাতায় রাত ১১টা ৩০ মিনিট ও করাচিতে তখন রাত ১১টা হয়ে যাবে। এই সময়ে শিকাগোবাসীদের ঢাকার জন্য টাইমের ব্যাপারে আর কোন মাথাব্যথা থাকে না। দু’জায়গাতেই একই টাইম, কেবল একটা দিনের, অন্যটায় রাতের। কিন্তু এই স্প্রিং-সামার-ফল সিজনটা অন্যদের সঙ্গে, মানে যাদের টাইম বদল হয় না, তাদের জন্য এক মহা ঝক্কির ব্যাপার। অনেকে এটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। অনেকে এই ডে-লাইট সেভিং ছাড়াও ভিন্ন দেশে যে সময়ের তফাৎ, অর্থাৎ তাদের সময়ও যে ভিন্ন, সেটা বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না। ফলে অনেকের আত্মীয় বা অনেক বন্ধু কুশল জিজ্ঞাসা বা আড্ডা মারার জন্য বিকেলের দিকে ফস করে হয়তো টেলিফোন করে বসল। তখন ধরুন ঢাকায় বিকেল সাড়ে তিনটা, কলকাতায় তিনটা। সে সময়টাতে শিকাগোতে আপনি পুরো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন! কারণ আপনার সময় তখন রাত তিনটা। আপনি হুড়মুড় করে উঠে ফোন ধরবেন এই মনে করে যে- দেশে আত্মীয়-স্বজনদের কারো ইমার্জেন্সি অবস্থা। এভাবে মাঝে মাঝে ঝামেলা হয়।
মার্চ মাসে ডে লাইট সেভিং-এর জন্য ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা এগিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য হলোÑ যাতে করে বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত, সামারের দিনগুলোর এক্সট্রা টাইমটা বেশি করে এনজয় করা যায় ও সময়টা আর একটু বেশি কাজে লাগানো যায়। যেমন সকালের একঘন্টা অফিস বা বাণিজ্যের জন্য সকালটা একটু বেশি কাজে লাগানো যায়। অফিস ছুটি হলেও দেখা যায়, তখনও অনেক বেলা আছে। তখন অনেকে তাদের শখের বাগানে কাজ করেন। অনেকে ব্যায়াম করার জন্য আর ওয়ার্ক আউট প্লেসে না গিয়ে, জগিং করতে বা হাঁটতে যান। অনেকে তাদের সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। অনেকে রান্না ঘরে রান্না না করে বাইরে বার-বি-কিউ করের। অনেকে বাড়ির খুটখাট, নানারকম মেরামতের কাজ করে, ঘর সাজায়, পেন্ট করে। এর আরেকটা দিক হলো, এ সময় ন্যাচারাল লাইট পাওয়া যায় বলে আলো জ্বালাবার সময় একঘন্টা কমে যায়, মানে ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার না করার ফলে এনার্জি সেভিং হয় প্রায় বছরের ছয় মাস ধরে। এই ডে লাইট সেভিং-এর আইডিয়াটা রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন-এর মাথা থেকে এসেছিল ১৭৮৪ সালে। যখন তিনি ফ্রান্সে আমেরিকার একজন প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে বাস করতেন। তিনি তখনকার দিনে মোমবাতি সংরক্ষণের জন্য এক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে ওঠার আইডিয়াটা চালু করেন। এ ব্যপারে তিনি ‘দি জার্নাল অফ প্যারিস’-এর সম্পাদকের কাছে ‘অ্যান ইকনোমিক প্রোজেক্ট ফর ডিমিনিশিং দি কস্ট অফ লাইট’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠান। এটি পড়ে পত্রিকার সম্পাদক খুব উৎসাহিত হয়েছিলেন ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। অবশ্য এই ধারণা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে ব্যবহার উপযোগী হতে দীর্ঘদিন সময় লেগে গিয়েছিল। কানাডার পোর্ট আর্থার, যেটা এখন ওন্টারিয়োতে ‘থান্ডার বে’ নামে পরিচিত, সেখানে ১৯০৮ সালের জুলাই মাসে সর্বপ্রথম ডিএসটি (ডে লাইট সেভিং টাইম) ব্যবহার করা শুরু হয়।
এর প্রায় এক দশক পরে, ১৯১৮ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিএসটি প্রথা চালু করা হয়। এই একই সময়ে রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন মানবাধিকার আইনের বিলে স্বাক্ষর করেন। ডিএসটির যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ বা স্মুথ ছিল না, বরং কিছুটা বাম্পি (নঁসঢ়ু) ছিল বলা যায়। প্রচলন করার এক বছর পর ডিএসটি বাতিল করা হয়, যদিও আমেরিকার কিছু অংশ ব্যবস্থাটা অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু এতে ট্রান্সপোর্টেশান ও ব্রডকাস্টিং কোম্পানিগুলোর নানা অসুবিধা হতে থাকে । ১৯৬৬ সালে আমেরিকান কংগ্রেস ‘ইউনিফর্ম টাইম অ্যাক্ট’ আইন প্রণয়ন করে, যাতে নিশ্চিতভাবে ডিএসটি পর্যবেক্ষণকারী রাষ্ট্রগুলি একই তারিখের একই সময় তা শুরু এবং শেষ করে। প্রথম সূত্রপাতের পর, সময়ের সাথে সাথে ডিএসটি-র শুরু এবং শেষ হবার তারিখগুলো কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে অবশ্য। অবশেষে, ২০০৭ সাল থেকে ডিএসটি মার্চ মাসের দ্বিতীয় রবিবার এবং নভেম্বরের প্রথম রবিবারে যে হবে, সেই সিদ্ধান্তটাই চূড়ান্ত হয়েছে।
ডে-লাইট সেভিং টাইম (ডিএসটি)-র কিছু পাশ্ব-প্রতিক্রিয়া
১. ডিএসটির সঙ্গে কি হার্ট অ্যাটাকের কোন সম্পর্ক আছে?
ডিএসটি হৃদযন্ত্রের ক্রীয়াকলাপের (কার্ডিয়াক ইভেন্টগুলির) সঙ্গে সংযুক্ত। স্প্রিং টাইমে (বসন্তকালে) রবিবার সকালে তুলনামূলকভাবে এক ঘণ্টা ঘুম কম হওয়ায়, দেখা গেছে পরের দিন সোমবার অন্যন্য সোমবারের তুলনায় ২৫% হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ তথ্যটি ২০১৪ সালে, ডেন্ভার শহরের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। তাই ঐধরণের রোগীদের জন্য তাদের উপদেশ, ঐ দিন কাজকর্ম কিছুটা হালকাভাবে করুন এবং আগের রাতে একটু আগে বিছানায় যান।
২. ঘড়ির কাঁটা এবং চকোলেট ক্যান্ডির মধ্যে কি কোন যোগসূত্র আছে?
২০০৬ সাল পর্যন্ত, ডিএসটি এপ্রিলের প্রথম রবিবারে শুরু হতো এবং অক্টোবরের শেষ রবিবার শেষ হতো। শেষটি আসলে ‘হ্যালোইন’-এর ২/৩ দিন আগে গিয়ে পড়তো। চকোলেট, ক্যান্ডি প্রস্তুতকারকরা কয়েক দশক ধরে ডিএসটি-টি হ্যালোইনের পর পর্যন্ত প্রসারিত করার জন্য ধর্ণা দিয়ে আসছিল। কেন? কারণ ছোট ছোট বাচ্চা এবং কিশোররাও যখন দোড়ে দোড়ে ‘ট্রিক অর ট্রিট’ বলে নানাসাজে সেজে ক্যান্ডি সঞ্চয় করতে যায়, তখন অনেক ছলচাতুরি করা প্রতারক তরুণ কৌতুক করে আজে বাজে জিনিষ, এমন কি অনেক সময় বিপজ্জনক জিনিষও বাচ্চাদের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। একবছর দেখা গেয়েছিল, ক্যান্ডির প্যাকেটের মধ্যে কেউ ব্লেডের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেজন্য কর্তারা ঠিক করেন যে, অন্ধকারের মধ্যে এই জিনিষগুলি সংগ্রহ করা ঠিক নয়। যতটা দিনের আলোর মধ্যে করা যায়, ততটাই ভালো। তাই পরে এই ডিএসটির মেয়াদ সম্প্রসারিত করে অক্টোবর থেকে নভেম্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
৩. ঘড়ি ও গৃহপালিত পশু : অনেক গৃহপালিত পশুরও এতে অসুবিধা হয়। বাড়িতে পোষা কুকুর, বিড়াল এই এক ঘন্টা টাইম বদলানোতে কনফিউজড হয়ে যায়। বিশেষ করে ফার্মের গরুরা, যারা একই নির্ধারিত সময়ে দুধ দিতে অভ্যস্ত।
৪. কতকগুলি স্টেট ভাবে ইট ইজ টু মাচ : আমেরিকার কয়েকটি স্টেট, যেমন আরিজোনা, হাওয়াই, পোর্তোরিকো, ভার্জিন আইল্যান্ডস, আমেরিকান সামোয়াÑ এরা ডিএসটি অনুসরণ করে না। কারণ তাদের এরিয়াতে এমনিতেই যথেষ্ট পরিমাণে সূর্যের আলো থাকে। তারা মনে করে আরো এক ঘন্টা বেশি সূর্যের আলো আসলে তাদের তেমন কোন লাভ হবে না।
৫. কোন কোন স্টেটে আবার ঐ সময়টা দু’রকম টাইম অনুসরণ করা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্ডিয়ানা স্টেটের অর্ধেক অংশ ডে লাইট সেভিং টাইম মেনে চলে, আবার অন্য অর্ধেক অংশ তা মেনে চলে না।
৬. জন্মদিন নিয়ে বিড়ম্বনা : এটি একটি মজার ঘটনা। ২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর। নর্থ ক্যারোলিনায় লরি সিরিওলি নামে এক ভদ্রমহিলা একটি যমজ সন্তানের জন্ম দেন। ছেলে পিটারের জন্ম হয় রাত ১টা ৩২ মিনিটে এবং ৩৪ মিনিট পরে জন্ম হয় কন্যা অ্যালিসনের। তাহলে ভাই পিটার বড় ও বোন অ্যালিসন ছোট, তাই তো? ওহ্ গড! ডে লাইট সেভিং টাইম বদল হয় রাত ২টায়। আর ফল সিজনে ডে লাইট সেভিং টাইম উলটে যাওয়ার ফলে সময় এক ঘন্টা পেছনে চলে যায়। সে হিসেবে অ্যালিসনের জন্মের সময় যেটা রাত ২টা ৬ মিনিটে হওয়ার কথা, সেটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে গিয়ে হয়েছে রাত ১টা ৬ মিনিট। এই বদালানো টাইম অনুযায়ী পিটারের জন্ম ১টা ৩২ মিনিটের বদলে গিয়ে দাঁড়ায় ১২টা ৩২ মিনিটে। তাহলে এখন কে বড়, আর কে ছোট?
আপনি আমি মাথা চুলকালে কি হবে? রেকর্ড তো হয়ে গেছে অন্যরকম। তাদের বাপ-মাদেরও এর উপরে বলার কিছুই ছিল না। তারা পরে হওয়া বাচ্চাটাকে বড় বাচ্চা বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
বেঁচে থাকো বাবা ডিএসটি।
(শিকাগো)