স্রষ্টার প্রেমের এক অনন্য প্রতীক বিবি মরিয়ম (মা মেরি)

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৫ , চলতি সংখ্যা
হাসিনা আকতার নিগার


খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব উদ্্যাপন করেন ২৫ ডিসেম্বর, যা বড়দিন বা ক্রিসমাস হিসেবে পরিচিত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মা মেরি বা বিবি মরিয়মের মহিমান্বিত দিক। যিশুর জন্মের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ নিয়ে সঠিক তথ্য না থাকলেও খ্রিষ্টানরা এ দিনকে আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসেবে পালন করে থাকেন।
বিবি মরিয়মের (আ.) গর্ভে হজরত ঈসার (আ.) জন্মকাহিনি যে বিধাতার এক অপূর্ব নিদর্শন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বোপরি বহুবিধ গুণে গুণান্বিত এই রমণী ছিলেন কুমারী মা, পবিত্র নারী, একনিষ্ঠ ধার্মিক, ধৈর্যশীল, সচ্চরিত্রবান, ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞ, আন্তরিক এবং অটল আনুগত্যশীল, নিষ্কলঙ্ক ও স্রষ্টার নির্দেশিত সন্তানের জন্মদাত্রী একজন প্রকৃত মা। তাই তাঁকে স্রষ্টার নির্দেশ অনুযায়ী বলা হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নারী।
পবিত্র কোরআনের সুরা মরিয়মে বর্ণিত, হজরত মরিয়মকে (আ.) খ্রিষ্টানরা ‘মা মেরি’ বলেন। এ মহীয়সী ধর্মপ্রাণ নারীকে তাঁর মা-বাবা বৃদ্ধ বয়সে জন্ম দেন। একই সঙ্গে সন্তান জন্মদানের প্রচলিত পদ্ধতি ছাড়াই হজরত ঈসাকে (আ.) জন্ম দিয়েছিলেন বলে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। সে সময় তাঁকে ‘উম্মে ঈসা’ বলে ডাকা হতো। যার শাব্দিক অর্থ হলো ‘ঈসার মা’। বিবি মরিয়ম (আ.) আল্লাহ তায়ালার প্রতিটি কথা ও ঐশ্বরিক বাণীকে ভক্তিভরে যে পালন করতেন, তার প্রমাণ মেলে ঈসার (আ.) জন্মের ঘটনা হতে।
মা মেরির এ অলৌকিকতার ঘটনা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। বিবি মরিয়ম (আ.) হলেন হজরত ইমরান (আ.) ও বিবি হান্নাহর (আ.) কন্যা এবং হজরত হারুনের (আ.) বোন। তাঁর পুরো নাম হজরত মরিয়ম বিনতে ইমরান (আ.)। তিনি হজরত দাউদের (আ.) বংশের ছিলেন। হজরত জাকারিয়া (আ.) তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। হজরত ইমরান ও বিবি হান্নাহর বিয়ের পর অনেক বছর পার হলেও তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। তাঁরা সন্তানের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন নিরাশ না হয়ে। তাঁদের প্রার্থনা কবুল হলে সন্তানসম্ভবা বিবি হান্নাহ স্রষ্টার কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে, তা আমি আপনাকেই “নজর” দিলাম, যেন তাকে মুক্ত রেখে আমার কাছ থেকে কবুল করে নিন। আপনিই তো সবকিছু শোনেন ও জানেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৫)
কিন্তু বিবি হান্নাহ কন্যাসন্তান প্রসব করলে তিনি স্রষ্টার কাছে করা ওয়াদা পালনের বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারণ, তখনকার সময়ে সন্তানকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করা বলতে বাইতুল মুকাদ্দাসের ইবাদতখানায় সেবকের কাজ করার জন্য দেওয়াকে বোঝাত, সেখানেই তারা থাকত। তাই মূলত ছেলেসন্তানদেরই এ কাজে উৎসর্গ করা হতো। ইবাদতখানার সেবার কাজে কোনো কন্যাসন্তানকে উৎসর্গ করার কথা কেউ চিন্তা করত না। সন্তান প্রসবের পর বিবি হান্নাহ বললেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তো মেয়ে প্রসব করেছি। আল্লাহ বেশ জানেন, সে যা প্রসব করেছে। ওই মেয়েটির মতো কোনো ছেলেই যে নেই। তার নাম রেখেছি মরিয়ম। আমি তাকে আর তার সন্তানকে তোমার আশ্রয়ে দিলাম অভিশপ্ত শয়তানের হাত থেকে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩৬)।
এরপর বিবি মরিয়ম (আ.) হজরত জাকারিয়ার (আ.) অভিভাবকত্বে বড় হতে থাকেন। তৎকালীন মোসাক আইন অনুযায়ী, কন্যা হওয়ার কারণে শিশু মরিয়ম (আ.) বাইতুল মুকাদ্দাসের ইবাদতখানার সেবকের দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না। কিন্তু জাকারিয়া (আ.) বিবি মরিয়মের (আ.) জন্য বাইতুল মুকাদ্দাসের ইবাদতখানায় আলাদা একটি কক্ষ তৈরি করে দিলেন। ঈশ্বরের বিশেষ প্রতিরক্ষায় বিবি মরিয়ম ওই কক্ষেই বড় হতে থাকেন। হজরত জাকারিয়া (আ.) প্রতিদিনই বিবি মরিয়মের খোঁজখবর নিতেন। এ সময়ই তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে বিবি মরিয়মের নৈকট্যের প্রমাণ পান। একদিন তাঁর কুঠুরির মধ্যে জাকারিয়া (আ.) যখন এলেন, তখন দেখতে পেলেন কিছু খাবার রয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ‘হে মরিয়ম! এসব তোমার কাছে আসে কোত্থেকে?’ মরিয়ম বললেন, ‘এসব আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছে। আল্লাহ যাকে খুশি বেশুমার রুজি দান করেনÑএ কথা সুনিশ্চিত।’ এভাবেই হজরত মরিয়ম (আ.) একটি ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে সর্বক্ষণ আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন। এই পরিবেশের মধ্য থেকেই তিনি দৈব শিশু হজরত ঈসাকে (আ.) জন্মদান করেন।
বিবি মরিয়মের গর্ভজাত সন্তান হজরত ঈসা (আ.) বা যিশুর জন্মকথা পবিত্র কোরআনেও রয়েছে। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ‌ বাইবেল হতে জানা যায়, মা মেরিকে গর্ভকালীন সময় ও যিশুর জীবদ্দশায় বেশ প্রতিকূল অবস্থা পাড়ি দিতে হয়। দুই হাজার বছরের কিছু আগে কুমারী মা মেরি নিজের গর্ভধারণের কথা স্বর্গদূতের কাছে শুনে হতবিহ্বল হন। তিনি তাঁকে বলেন, ‘স্বামীর শারীরিক স্পর্শ ছাড়াই তিনি কীভাবে সন্তানের জন্ম দেবেন।’ স্বর্গদূত মেরিকে বলেন, ‘ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা তার ওপর অবস্থিতি হবে এবং তাঁর প্রভাবেই মেরি গর্ভবতী হবেন এবং তাঁর ছেলে হবে।’ আর ছেলের নাম যিশু রাখার নির্দেশ দেন। এমনকি তখনকার ইহুদি নিয়ম অনুযায়ী, কুমারী অবস্থায় গর্ভধারণ করায় তাকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হতে পারে; এটা জেনেও ঈশ্বরের প্রদত্ত সন্তান জন্ম দেওয়াকে সাদরে গ্রহণ করেন তিনি। তাই গর্ভধারণের পর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে দূরবর্তী স্থান বেথলেহেম উপত্যকায় বাস করতে চলে যান।
মেরি ছিলেন ইসরাইলের নাজারেথবাসী যোসেফের বাগদত্তা। সৎ, ধর্মপ্রাণ যোসেফ যখন জানতে পারেন মেরি সন্তানসম্ভবা, তখন তাঁকে আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ঈশ্বরের বাণী সম্পর্কে দূত তাঁকে বলেন, ‘মেরি গর্ভবতী হয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে এবং তাঁর যে সন্তান হবে, তা ঈশ্বরেরই পরিকল্পনা।’ যোসেফ যেন মেরিকে সন্দেহ না করে তাকে গ্রহণ করেন। তখন যোসেফ দূতের কথামতো মেরিকে বিয়ে করেন কিন্তু সন্তান জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত তাকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকেন।
মেরির সন্তান প্রসবের সময় যখন ঘনিয়ে আসে, ঠিক সেই সময় রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার আদমশুমারি করেন। তিনি নির্দেশ দেন, যার যার পিতৃপুরুষদের শহরে গিয়ে নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে। যোসেফের পিতৃপুরুষেরা ছিলেন যিহুদিয়ার বেথলেহেমের। যোসেফ তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মেরিকে নিয়ে নাম লেখাতে সেখানে গেলেন। কিন্তু নাম লেখাতে প্রচুর লোক আসায় তারা থাকার জন্য কোনো জায়গা পেলেন না। পরে একজন লোক তাদের গোয়ালঘরে থাকতে দিলেন। সেখানেই মেরি সন্তান প্রসব করেন এবং কাপড়ে জড়িয়ে যাবপাত্রে (যে পাত্রে পশুদের ঘাস, খড় বা পানি খেতে দেওয়া হয়) রাখলেন। স্বর্গদূতের কথামতো যোসেফ শিশুটির নাম রাখলেন ‘যিশু’।
যিশুর জন্মের সময় বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। ওই সময়ে মাঠে ভেড়া চরানো রাখালদের কাছে গিয়ে স্বর্গদূত যিশুর জন্মের খবর দেন। রাখালেরা তখনই যিশুকে দেখতে যান এবং উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যান একটি ভেড়ার বাচ্চা। আবার সে সময় আকাশে একটি উজ্জ্বল তারা দেখা যায়, যা দেখে কয়েকজন জ্যোতির্বিদ ও পণ্ডিত বুঝতে পারেন, একটি বিশেষ শিশুর জন্ম হয়েছে। তারাও নানাভাবে সন্ধান করে যিশুকে দেখতে আসেন স্বর্ণ ও সুগন্ধি দ্রব্য উপহারাদি নিয়ে।
এভাবে একের পর এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে যিশু বড় হতে থাকেন মা মেরির যত্নে। ছোটবেলা থেকেই যিশু মানুষের মাঝে মুক্তির বাণী প্রচার করেন। যার ফলে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু যিশুকে দেখার জন্য দেশের দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতে থাকে। যিশুর জন্ম ও এই দৈব ক্ষমতার কথা যখন ইহুদি সম্রাট হেরোডোটাসের কাছে পৌঁছাল, তখন তিনি বুঝলেন, এমন একজন ব্যক্তি এসেছেন, যাঁর কারণে ভবিষ্যতে তাঁর নিজের সিংহাসন ও জনগণের ওপর আধিপত্য করার অধিকার হুমকির মুখে পড়বে। সম্রাট যিশুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে জেনে মা মেরি ছেলেকে নিয়ে মিসরে চলে যান।
মিসরে যিশু ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে বসবাস করেন। এরপর যখন ঈশ্বরের বাণীসমৃদ্ধ ইঞ্জিল কিতাব তাঁর ওপর অবতীর্ণ হয়, তখন তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে ফিরে গিয়ে ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈশ্বরের সত্যবাণী প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। তিনি আল্লাহর হুকুমে মাটির তৈরি পাখিকে ফুঁ দিয়ে উড়ন্ত পাখিতে পরিণত করেন; চির অন্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে ভালো করে তোলেন এবং মরা লোককে বাঁচিয়ে তোলেন; এমনকি তাঁর কাছে আসা লোকেরা নিজেদের ঘরে কী রেখে এসেছে, তাও তিনি বলে দিতে পারতেন। এই ক্ষমতা দেখে ইহুদিরা আকৃষ্ট হয়ে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে থাকে।
তবে যিশুর শিক্ষা ও আশ্চর্য কাজ ইহুদি ধর্মগুরুদের ঈর্ষান্বিত করে তোলে এবং তারা রোমান শাসকদের কাছে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ক্রুশ দিয়ে যিশুকে হত্যা করে। বাইবেল অনুযায়ী, এটাও ছিল ঈশ্বরের পরিকল্পনা। কারণ মৃত্যুর তিন দিন পর যিশু পুনরুত্থান করে স্বর্গে চলে যান। যিশুর জন্মতারিখ থেকেই খ্রিষ্টীয় সাল গণনা শুরু হয় বিশ্বে।
ঈশ্বরের নির্দেশ পালন করে একজন কুমারী নারীর গর্ভধারণ, সমাজের কটাক্ষ, বাক্যবান, উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ, প্রসববেদনা সহ্য করার অভিজ্ঞতার প্রামাণ্য নিদর্শন হলেন বিবি মরিয়ম। যিনি খ্রিষ্টানদের কাছে কেবল যিশুর মা মেরি নন, তিনি হলেন স্রষ্টার প্রেমের অনন্য প্রতীক।

লেখক : কলামিস্ট
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078