নোঙর তোলো তোলো...

প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:১৮ , চলতি সংখ্যা
আমিনুর রশীদ পিন্টু


‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত, যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি। নির্দেশ দেবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে। আর তারাই হলো সফলকাম।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত-১০৪)

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী হাইকোর্ট থেকে বিদায়ের দিনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি কোনো দিন আমেরিকা যাইনি এবং কোনো দিন যাওয়ার ইচ্ছাও রাখি না।’

সাহস ও তেজস্বিতা রয়েছে তার কথাগুলোতে। রয়েছে দেশপ্রেম এবং ইচ্ছাশক্তি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, সেটা হচ্ছে আমেরিকার বিধিনিষেধ আরোপ। 
যার ফলে বাংলাদেশের অনেক নাগরিকই বিচলিত। আমেরিকায় তাদের আগমন যেমন বিঘ্নিত হতে পারে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কী হতে পারে বা পারে না-এই সংশয় ও শঙ্কার মাঝে মাননীয় বিচারপতি আশার বাণী শোনালেন। এটা সত্য, আমেরিকায় অনেকেই আমরা এসেছি, থেকে গেছি, কেউবা আবার আসার প্রচেষ্টা করেই যাচ্ছি। কিন্তু অনেকেই এখনো দেশের মাটি আঁকড়ে জীবনপাত করছেন। তাদের কোনো দুর্ভাবনা নেই। এই তো দেশপ্রেম।

দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের মাঝে একটু ফারাক রয়ে গেছে। জাতীয়তাবোধ হচ্ছে দেশের বাইরে বা ভেতরে কী হলো, সেগুলো মাথায় না রেখে দেশের গর্বে গর্বিত হওয়া। আর দেশপ্রেম হচ্ছে একজন নাগরিকের যেকোনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশকে মূল্যায়ন করা এবং দেশজ প্রগতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। জাতীয়তাবোধে যে আদর্শ কাজ করে, সেটা অনেকটা নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ফলাফলের ওপর। আর দেশপ্রেম হচ্ছে Pledge of Allegiance. অর্থাৎ ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়েও বড় খাঁটি, আমার দেশের মাটি।’ 

খাঁটি দেশপ্রেমিকেরা বলেন, সমস্ত উত্থান-পতনের মাঝেও দেশটি ঠিকই থেকে যায় এবং প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য দেশের স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা নিয়ে মনোনিবেশ করা। কেননা সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের মাঝেই রয়েছে উন্নতি, প্রগতি, শিল্পায়ন ও শিক্ষার প্রসার। সেই আদর্শগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিস্তৃত হবে-দেশ এগিয়ে যাবে, বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে।

বর্তমান সময়ে এবং সংকটে যখন রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিদিন বিদেশিদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন বিচারপতি হাসান সিদ্দিকীর মন্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। কেননা প্রতিটি সমস্যার ভেতরেই রয়েছে সমাধান। বাইরের শক্তির সঙ্গে হাত মেলানো লজ্জাজনক।

আমেরিকার জনক জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-সংগ্রাম চলাকালীন একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদের রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী ছিলেন। তিনি হলেন থমাস পেইন। পেইন সাহেব জাতে ইংরেজ হলেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, নিপীড়ন ও দাসত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। ফলে তাকে দেশত্যাগ করতে হয় এবং তিনি আমেরিকায় নির্বাসিত জীবন বেছে নেন। তিনি বলতেন, My gretest religion is to serve my country. (আমার ধর্ম হলো নিজের দেশের সেবা করা।)

চিরকালের এই সত্য বাণীটি যারা অন্তরে ধারণ করবেন, বিজয় তাদের জন্যই। রাজনীতির মূল বক্তব্য দেশজ কল্যাণ। একটু ভেবে দেখুন-আমরা নামাজ-রোজা শেষে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি। তখন বারবার এই কল্যাণের আবেদন করি সৃষ্টিকর্তার কাছে। কিন্তু কেন? এ কারণেইÑকল্যাণই যে মঙ্গল সাধনার সোপান। পার্থিব জীবনে সংসারে কিংবা কর্মজীবনে এই কল্যাণের পথ ধরেই আমাদের অগ্রগতি। যত শুদ্ধ ও মুক্ত পরিবেশ থাকবে, ততই একজন নাগরিক তার সুচিন্তাকে জাগ্রত করবেন। জ্ঞান ও মননশীলতার সমন্বয়ে পরাজয় নয়Ñবিজয়ের কথা ভাববেন।

আপনারা নিশ্চয় নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথা শুনে থাকবেন। দক্ষ সেনাপতি হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে তিনি পরাস্ত হন এবং সিসিলিতে আজীবন নির্বাসিত হন। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, ‘সিংহাসন কী? সিংহাসন তো আর কিছু নয়, দামি মখমল আর মণিমাণিক্য জড়ানো একটি চেয়ার মাত্র।’ অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, যে সিংহাসনে বা গদিতে বসার জন্য এত ষড়যন্ত্র, এত হত্যা বা মারামরি, এত বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতাÑসেটি পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থাৎ আবারও সেই অমূল্য ভাষণÑদেশ, মাটি, রাজপথ, নদী, ঘাট সবই থেকে যায়।

একজন শাসক যদি গদির বদলে এসব উন্নয়নের কথা ভাবেন, তবেই তো জনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া যায়। জনতাই যে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। জনতাই হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর মূল কাঠামো। ১৯৭১-এ পুরো দেশ ছিল রণাঙ্গন। প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে লড়েছেন। তাদের কাছে সিংহাসনের চেয়ে দেশের মাটিকে নরপশুদের হাত থেকে মুক্ত করাই ছিল সবচেয়ে বড় ব্রত। প্রাণের বিনিময়ে এই ব্রত পালনের মাঝেই বাংলাদেশের বিজয় এসেছে।

সুতরাং এই বিজয়ের প্রভাতে শুধু শুভেচ্ছা বিনিময়ে, গান আর কবিতা পরিবেশনের মাঝেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। গাওয়ার মতো একটি গান আর ওড়ানোর মতো একটি পতাকাÑসে তো বিজয় নয়। এই বিজয় যাঁরা আমাদের জন্য বয়ে এনেছেন, তাঁদের অমূল্য আত্মত্যাগকে যত বেশি স্মরণ করা হবে, ততই বিজয়ের সংজ্ঞাটি মূল্যায়িত হবে।

ব্যক্তিগত একটি গল্প দিয়েই শেষ করি। ১৯৭২ সালের কোনো এক দিনে তৎকালীন আদমজী কোর্টে অবস্থিত আমেরিকার কনস্যুলেটে এসেছিলাম। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল বহির্বিশ্বে কোথাও না কোথাও গিয়ে উন্নত শিক্ষা নেব। কিন্তু আমাকে কনস্যুলার সাহেব শোনালেন ভিন্ন এক বাণী। তিনি বললেন, ‘তুমি ফার্মাসিস্ট। আবেদন করো এক্ষুনি। তোমার ভিসা হয়ে যাবে।’

কেন এত জামাই আদর? আমার প্রশ্নের উত্তরে কনস্যুলার সাহেব মুচকি হেসে বললেন, ‘তোমরা একটা নতুন দেশ পেয়েছ। তোমাদের এখন ভিন্ন পরিচিতি। তোমরা পাকিস্তানি না হয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অভিবাসনের সুযোগ পাবে।’

সেদিনই বুঝেছিলাম-স্বাধীনতা একটি জনগোষ্ঠীর জন্য কত প্রয়োজন। আমেরিকায় আসার জন্য এই স্বাধীনতা নয়। ‘বাংলাদেশের নাগরিক’-বিশ্বব্যাপী এই পরিচয়টি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রাণ ও মেধার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন। এর চেয়ে বড় গৌরব বা মুক্তির, স্বস্তির নিঃশ্বাস আর কী হতে পারে? তাই তো বলি, ‘বিজয়’ একটি মহামূল্য অর্জন। এই অর্জনটি না হলে পুরো পৃথিবী আমাদের বর্জন করতে পারত?

তাই বিবেচনা করুন-এই যে হরতাল, ধর্মঘট বা জ্বালাও-পোড়াওয়ের কোনো প্রয়োজন আছে কি? মুক্ত, স্বাধীন স্বদেশ আমাদের। জনগণকে যারা ভালোবাসবেন, তারাই আবার গদিতে বসবেন। 
মনে রাখতে হবে, দেশপ্রেমের মূলকথা হলো জনতার প্রতি ভালোবাসা। বাংলাদেশের মানুষ খুবই সাধারণ। সারা দিন প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা ফসল ফলায়। উৎপাদনে ঘাম ঝরায়। এদের গায়ে আঁচড় লাগার মানে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আঘাত করা। স্বাধীন দেশে এবং বিজয়ের মাসে সে কি আকাক্সিক্ষত হতে পারে? ডিসেম্বর তাই আবারও দেশজ কল্যাণ নিয়ে ভাবনার মাস।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078