
মাহমুদ রহমান
দেশে নতুন কারিকুলামে শিক্ষা দেওয়ার উপযোগী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অনেকগুলো ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। এর মধ্যে কিছু অবশ্য ফেক কিংবা ভিন্ন কোনো দেশ ও বিষয়ের ভিডিও, যা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য কেউ কেউ নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসেবে প্রচার করছেন। তবে অনেকগুলো ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে ছাত্রদের শেখানোর অংশ হিসেবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আসল ভিডিও বলে অনেকে জানিয়েছেন।
আমি অবশ্য এগুলো দেখে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছি। কয়েকটি ভিডিও, যেমন হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করে দুই হাতকে ডানা বানিয়ে সামনে চলা, ব্যাঙের লাফ, ডিম ভাজি, বিছানা গোছানো ইত্যাদি অত্যন্ত চমৎকার। প্রতিদিন যদি কোনো শিক্ষক আধঘণ্টা হাঁস ও ব্যাঙের চলাফেরা লাফিয়ে লাফিয়ে দেখান, তাহলে ছাত্রদের যা-ই শেখা হোক না কেন, শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক শরীরচর্চা হয়ে যাবে। মধ্যবয়সে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদ্্রোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা সবার জন্য জরুরি। শিক্ষকেরা এ প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান যদি নিয়মিত ক্লাসে প্রয়োগ করেন, তাহলে শিক্ষক-ছাত্র সবাই সুস্থ থাকবে।
তারপর ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি থেকে ডিম ভাজি, বিরিয়ানি, ভুনা খিচুড়ি তৈরি করে নিয়ে এলে দুপুরের খাবারদাবারও খারাপ হবে না। শরীরচর্চা ও সুষম খাবার গ্রহণের পর রাতে গোছানো বিছানায় চমৎকার ঘুম হবে। আর বিনোদনের জন্য নাচ-গান তো আছেই। এ পর্যন্ত ভালোই। ঘুম থেকে উঠে বিছানা গোছানোর দৃশ্য দেখে আমি অবশ্য কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে কীভাবে ঘুমাবে, সেই দৃশ্যও যদি প্রদর্শন করতে হয়, তাহলে ইজ্জতের সর্বনাশ হয়ে যাবে! অবশ্য দয়া করে পাঠ্যসূচি এত দূর পর্যন্ত যায়নি। শেখানোর জন্য সবকিছু প্রদর্শন করতে হয় না-এ বোধটুকু আছে বলেই তারা আমাদের এমন দৃশ্য দেখানো থেকে বিরত থেকেছেন। তবু মানুষ সমালোচনা করছে।
শিক্ষামন্ত্রী সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, রান্নাবান্না এগুলো তো বাসায় করার কথা নয়। স্কুলেই এগুলো শিখবে। অবশ্য বাংলাদেশের কটি স্কুলে রান্নাবান্নার সরঞ্জাম কেনার বাজেট ও কিচেন সেটআপ দেওয়া আছে, তা তিনি বলেননি। বলার প্রয়োজনও নেই। যা বলেছেন তা যদি না-ই বলতেন, তাহলে তাকে দিয়ে বলানোর সাধ্য কারও ছিল না। জনগণের কথায় কান দেওয়ার সময় এখন আমাদের মান্যবর রাজনীতিকদের নেই। জানা গেছে, ফিনল্যান্ডের কারিকুলামের অনুসরণে বাংলাদেশের কারিকুলাম নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এবার প্রাইমারি ও হাইস্কুলের কয়েকটি ক্লাসে নতুন বই দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর অন্যান্য ক্লাসে দেওয়া হবে। সরকারের অতি উন্নত (!) একটি প্রকল্প নিয়ে আমজনতার হইচই শুনে অনেকেই অতি-বিরক্ত। আমজনতা না জেনে, না বুঝে সবকিছু নিয়ে সমালোচনা করে!
আসলে পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাদের সঙ্গে আমজনতার কোনো যোগাযোগ নেই। যারা এসব প্রকল্প নেন, তাদের কজনের সন্তান এই পাঠ্যসূচি অনুযায়ী সাধারণ স্কুলে পড়বে কিংবা পড়েছে? গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যেসব স্কুল ও সামাজিক পরিবেশে পড়াশোনা করে, তার সঙ্গে কজন কারিকুলাম প্রণেতার জানাশোনা রয়েছে! যাদের জন্য সিলেবাস তৈরি করা হয় তারা এবং যারা তৈরি করেন তারা মূলত দুই গ্রহের ভিন্ন বাস্তবতার মানুষ। এক পক্ষের কাছে আরেক পক্ষ অপরিচিত। তাই আমজনতা সমালোচনা করছে দেখে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অবাক হয়ে ভূত দেখছেন।
আমজনতাও তাদেরকে চিড়িয়াখানার জন্তু ভেবে অবিরত প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। মাঝখানে সরকার-সংশ্লিষ্ট যারা বিষয়টি দেখার কথা, তাদের সব দিক দিয়ে লাভ। প্রকল্প মানেই টাকা কামানোর অবারিত সুযোগ। তারা প্রথমে এই প্রকল্প থেকে হিসাবের টাকাগুলো লুটে নেবে। তারপর প্রতিবাদকারীদের কোনো কোনো প্রতিনিধিকে ডেকে নেবে তাদের বাসভবনে।
মন দিয়ে এমনভাবে শুনবে, যাতে মনে হয় এগুলো তারা এইমাত্র প্রথম শুনছে। তারপর অর্ডার দেবে এগুলো বদলানোর। যারা দেখা করতে গেলেন, তারা তো মহাখুশি! আমরা নেত্রী/নেতাকে বুঝিয়ে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। স্থানীয়ভাবে এই নেতারও দাম বেড়ে যাবে। আসল কাহিনি হচ্ছে আরেকবার পরিবর্তন করতে আরেকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। আবার টাকার গন্ধ নাকে লাগবে। উফ! কী মজা!
উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে হুবহু কপি করতে গেলেই সমস্যা। তখন দেশীয় শিক্ষার বারোটা বাজবে, অন্যদিকে বিদেশি শিক্ষার সুফলও পাওয়া যাবে না। তাই প্রয়োজন কাস্টমাইজ করে প্রয়োগ করা। এখন কাস্টমাইজ করার সময় ও ধৈর্য কারও নেই। তাড়াহুড়ো করে প্রকল্প করতে হয়। কারণ প্রকল্প মানেই অনেক স্তরে অনেক টাকার সুগন্ধি ছড়ানো!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তখন ক্লাসে বেত ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আমাদের সময়ে শিক্ষকেরা ক্লাসে আসতেন চক, ডাস্টার ও বেতÑএই তিনটি জিনিস নিয়ে। বেতের ভয়ে আমরা দুষ্টুমি না করে শিক্ষকদের কথা শুনতাম। বেত ছাড়া ক্লাস কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তা শোনার জন্য শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছিলাম। বেশির ভাগ শিক্ষকই বলেছিলেন, এখনকার ক্লাস অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন। যার ইচ্ছা সে শিখবে, যার ইচ্ছা সে দুষ্টুমি করবে। ছাত্রছাত্রীকে শাস্তি দিয়ে কোনো শিক্ষক নিজে বিভাগীয় শাস্তি পেতে চান না। তখন আমারও মনে হতো, উন্নত বিশ্বে শাস্তি ছাড়াই উন্নত শিক্ষা দিতে পারলে আমাদের দেশে পারবে না কেন! আমেরিকায় আসার বছরখানেক পর আমার প্রাইমারি স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা ক্লাসে দুষ্টুমি করলে শিক্ষক কী করেন?
সে জানাল, তাদের ক্লাসে সবুজ, হলুদ ও লাল কার্ড রয়েছে। কেউ দুষ্টুমি করলে তাকে হলুদ ও লাল কার্ড দেখানো হয়। কারও ভাগ্যে এ রকম-কয়েকটি কার্ড জমে গেলে তাকে পরবর্তী সময়ে বড় শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন রিসেসের সময় সবাই খেলবে, শুধু শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রটি একা বসে থাকবে। আবার কখনো কখনো দুপুরের খাবারের রুমের এক কোণে শাস্তি হিসেবে না খেয়ে বসে থেকে সবার খাওয়া দেখবে। গত বছর লন্ডন শহরে বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে শুনলাম, দুষ্টুমির জন্য স্কুল ছুটির পর আধা ঘণ্টা/এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় ছাত্রছাত্রীকে। একজন শিক্ষককে ২৫-৩০ জন ছাত্রছাত্রীর ক্লাস সামলাতেও এ রকম শাস্তির আয়োজন করতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় বেত নেই, তা সত্য। কিন্তু বিকল্প যা আছে, তা কি প্রয়োগের সুযোগ বাংলাদেশের বাস্তবতায় আছে? যদি না থাকে, তাহলে একজন শিক্ষক ৮০ থেকে ১০০ জন ছাত্রছাত্রীর ক্লাস কীভাবে সামলাবেন, তা কেউ ভাবে না। মুখস্থ বুলি আওড়ে উন্নত দেশে পারলে আপনারা পারবেন না কেন? অবশ্য আমি ক্লাস সামলানোর অজুহাতে কিছুসংখ্যক শিক্ষকের মাত্রাতিরিক্ত অমানবিক ছাত্র নির্যাতনের ঘোর বিরোধী। এসব অসুস্থ শিক্ষকের চাকরি থাকাই উচিত নয়।
প্রসঙ্গে ফিরে যাই। নতুন কারিকুলাম নিয়ে কথা বলছিলাম এক প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ক্লাস সেভেন-পড়ুয়া তার মেয়ে বাসায় এসে বিরিয়ানি রান্না করে স্কুলে নিয়ে যেতে চায়। তিনি মেয়েকে বলেছেন, তোমার শিক্ষকদের গিয়ে বলবে, ওনারা যেন তোমাকে প্রথমে রান্না স্কুলেই শেখান। তারপর বাসায় প্র্যাকটিস করবে। আরেক প্রধান শিক্ষিকা সম্পর্কে ভাবি হন। তিনি জানালেন, তাকে নাকি প্রশিক্ষণে বলা হয়েছিল নাচতে হবে। বুড়ো বয়সে নাচতে হবে শুনে তিনি খুব আপসেট হয়ে পড়েন। ভাগ্য ভালো ছিল তার, নাচার টার্ন আসার আগেই নামাজের সময় হয়ে যায়। তিনি নামাজে গিয়ে একটু দেরি করে ফেরেন, যাতে আর নাচতে না হয়।
এবার একটি গল্প বলে শেষ করে নিই। এক ছেলে জুতার দোকানে গেল তার জুতা কিনতে। এক হাজার টাকা বাজেটে জুতা কিনতে হবে। তার পায়ের মাপের সবগুলো জুতা দেখল, কিন্তু তার পছন্দ হচ্ছে না। কিছু সময় দোকানে হাঁটাহাঁটি করে দেখল, খুবই সুন্দর ডিজাইনের একটি জুতা। তার পায়ের মাপের অন্যান্য জুতার চেয়ে ডিজাইন দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি চামড়াও ভালো। শুধু সাইজে একটু বড়। ভাবল, সেও ধীরে ধীরে বড় হবে, একসময় যেহেতু জুতার মাপে পা বড় হয়ে যাবে, তাই একই দামে ভালো জিনিসটি কেনা দরকার। যেই চিন্তা সেই কাজ। বাসায় এসে জুতা পরে বাইরে যায়। কিন্তু জুতা তো পায়ে আটকায় না। নতুন জুতার শখে অনেক কসরত করে পায়ের সঙ্গে জুতা আটকে রেখে বেরিয়ে গেল। একসময় আর কিছুতেই জুতা পায়ে আটকে রাখতে পারেনি। পা সামনে চলে যায়, জুতা পেছনে পড়ে রয়। অবশেষে চমৎকার ডিজাইনের জুতাটি বগলে নিয়ে খালি পায়েই তাকে বাসায় ফিরতে হয়।
আর্থসামাজিক বাস্তবতা চিন্তা না করে কোনো ভিন্ন দেশের সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা অনুকরণ করতে গেলে ওই ছেলেটির মতো পুরো জাতিকে একসময় জুতা বগলে নিয়ে হাঁটতে হবে। দয়া করে শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো পলিসি গ্রহণের আগে দশবার চিন্তা করুন। ঢাকা শহরের এসি রুমে না বসে প্রতিটি উপজেলায় যান। স্কুলগুলো দেখেন। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলুন। তারপর এ দেশের আর্থসামাজিক পরিবেশের উপযোগী সিদ্ধান্ত নিন।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান।
দেশে নতুন কারিকুলামে শিক্ষা দেওয়ার উপযোগী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অনেকগুলো ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। এর মধ্যে কিছু অবশ্য ফেক কিংবা ভিন্ন কোনো দেশ ও বিষয়ের ভিডিও, যা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য কেউ কেউ নতুন কারিকুলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসেবে প্রচার করছেন। তবে অনেকগুলো ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে ছাত্রদের শেখানোর অংশ হিসেবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আসল ভিডিও বলে অনেকে জানিয়েছেন।
আমি অবশ্য এগুলো দেখে খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছি। কয়েকটি ভিডিও, যেমন হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করে দুই হাতকে ডানা বানিয়ে সামনে চলা, ব্যাঙের লাফ, ডিম ভাজি, বিছানা গোছানো ইত্যাদি অত্যন্ত চমৎকার। প্রতিদিন যদি কোনো শিক্ষক আধঘণ্টা হাঁস ও ব্যাঙের চলাফেরা লাফিয়ে লাফিয়ে দেখান, তাহলে ছাত্রদের যা-ই শেখা হোক না কেন, শিক্ষকদের বাধ্যতামূলক শরীরচর্চা হয়ে যাবে। মধ্যবয়সে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হৃদ্্রোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা সবার জন্য জরুরি। শিক্ষকেরা এ প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান যদি নিয়মিত ক্লাসে প্রয়োগ করেন, তাহলে শিক্ষক-ছাত্র সবাই সুস্থ থাকবে।
তারপর ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি থেকে ডিম ভাজি, বিরিয়ানি, ভুনা খিচুড়ি তৈরি করে নিয়ে এলে দুপুরের খাবারদাবারও খারাপ হবে না। শরীরচর্চা ও সুষম খাবার গ্রহণের পর রাতে গোছানো বিছানায় চমৎকার ঘুম হবে। আর বিনোদনের জন্য নাচ-গান তো আছেই। এ পর্যন্ত ভালোই। ঘুম থেকে উঠে বিছানা গোছানোর দৃশ্য দেখে আমি অবশ্য কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে কীভাবে ঘুমাবে, সেই দৃশ্যও যদি প্রদর্শন করতে হয়, তাহলে ইজ্জতের সর্বনাশ হয়ে যাবে! অবশ্য দয়া করে পাঠ্যসূচি এত দূর পর্যন্ত যায়নি। শেখানোর জন্য সবকিছু প্রদর্শন করতে হয় না-এ বোধটুকু আছে বলেই তারা আমাদের এমন দৃশ্য দেখানো থেকে বিরত থেকেছেন। তবু মানুষ সমালোচনা করছে।
শিক্ষামন্ত্রী সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, রান্নাবান্না এগুলো তো বাসায় করার কথা নয়। স্কুলেই এগুলো শিখবে। অবশ্য বাংলাদেশের কটি স্কুলে রান্নাবান্নার সরঞ্জাম কেনার বাজেট ও কিচেন সেটআপ দেওয়া আছে, তা তিনি বলেননি। বলার প্রয়োজনও নেই। যা বলেছেন তা যদি না-ই বলতেন, তাহলে তাকে দিয়ে বলানোর সাধ্য কারও ছিল না। জনগণের কথায় কান দেওয়ার সময় এখন আমাদের মান্যবর রাজনীতিকদের নেই। জানা গেছে, ফিনল্যান্ডের কারিকুলামের অনুসরণে বাংলাদেশের কারিকুলাম নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এবার প্রাইমারি ও হাইস্কুলের কয়েকটি ক্লাসে নতুন বই দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর অন্যান্য ক্লাসে দেওয়া হবে। সরকারের অতি উন্নত (!) একটি প্রকল্প নিয়ে আমজনতার হইচই শুনে অনেকেই অতি-বিরক্ত। আমজনতা না জেনে, না বুঝে সবকিছু নিয়ে সমালোচনা করে!
আসলে পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাদের সঙ্গে আমজনতার কোনো যোগাযোগ নেই। যারা এসব প্রকল্প নেন, তাদের কজনের সন্তান এই পাঠ্যসূচি অনুযায়ী সাধারণ স্কুলে পড়বে কিংবা পড়েছে? গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যেসব স্কুল ও সামাজিক পরিবেশে পড়াশোনা করে, তার সঙ্গে কজন কারিকুলাম প্রণেতার জানাশোনা রয়েছে! যাদের জন্য সিলেবাস তৈরি করা হয় তারা এবং যারা তৈরি করেন তারা মূলত দুই গ্রহের ভিন্ন বাস্তবতার মানুষ। এক পক্ষের কাছে আরেক পক্ষ অপরিচিত। তাই আমজনতা সমালোচনা করছে দেখে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অবাক হয়ে ভূত দেখছেন।
আমজনতাও তাদেরকে চিড়িয়াখানার জন্তু ভেবে অবিরত প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। মাঝখানে সরকার-সংশ্লিষ্ট যারা বিষয়টি দেখার কথা, তাদের সব দিক দিয়ে লাভ। প্রকল্প মানেই টাকা কামানোর অবারিত সুযোগ। তারা প্রথমে এই প্রকল্প থেকে হিসাবের টাকাগুলো লুটে নেবে। তারপর প্রতিবাদকারীদের কোনো কোনো প্রতিনিধিকে ডেকে নেবে তাদের বাসভবনে।
মন দিয়ে এমনভাবে শুনবে, যাতে মনে হয় এগুলো তারা এইমাত্র প্রথম শুনছে। তারপর অর্ডার দেবে এগুলো বদলানোর। যারা দেখা করতে গেলেন, তারা তো মহাখুশি! আমরা নেত্রী/নেতাকে বুঝিয়ে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। স্থানীয়ভাবে এই নেতারও দাম বেড়ে যাবে। আসল কাহিনি হচ্ছে আরেকবার পরিবর্তন করতে আরেকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। আবার টাকার গন্ধ নাকে লাগবে। উফ! কী মজা!
উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে হুবহু কপি করতে গেলেই সমস্যা। তখন দেশীয় শিক্ষার বারোটা বাজবে, অন্যদিকে বিদেশি শিক্ষার সুফলও পাওয়া যাবে না। তাই প্রয়োজন কাস্টমাইজ করে প্রয়োগ করা। এখন কাস্টমাইজ করার সময় ও ধৈর্য কারও নেই। তাড়াহুড়ো করে প্রকল্প করতে হয়। কারণ প্রকল্প মানেই অনেক স্তরে অনেক টাকার সুগন্ধি ছড়ানো!
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তখন ক্লাসে বেত ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আমাদের সময়ে শিক্ষকেরা ক্লাসে আসতেন চক, ডাস্টার ও বেতÑএই তিনটি জিনিস নিয়ে। বেতের ভয়ে আমরা দুষ্টুমি না করে শিক্ষকদের কথা শুনতাম। বেত ছাড়া ক্লাস কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তা শোনার জন্য শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছিলাম। বেশির ভাগ শিক্ষকই বলেছিলেন, এখনকার ক্লাস অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন। যার ইচ্ছা সে শিখবে, যার ইচ্ছা সে দুষ্টুমি করবে। ছাত্রছাত্রীকে শাস্তি দিয়ে কোনো শিক্ষক নিজে বিভাগীয় শাস্তি পেতে চান না। তখন আমারও মনে হতো, উন্নত বিশ্বে শাস্তি ছাড়াই উন্নত শিক্ষা দিতে পারলে আমাদের দেশে পারবে না কেন! আমেরিকায় আসার বছরখানেক পর আমার প্রাইমারি স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা ক্লাসে দুষ্টুমি করলে শিক্ষক কী করেন?
সে জানাল, তাদের ক্লাসে সবুজ, হলুদ ও লাল কার্ড রয়েছে। কেউ দুষ্টুমি করলে তাকে হলুদ ও লাল কার্ড দেখানো হয়। কারও ভাগ্যে এ রকম-কয়েকটি কার্ড জমে গেলে তাকে পরবর্তী সময়ে বড় শাস্তি দেওয়া হয়। যেমন রিসেসের সময় সবাই খেলবে, শুধু শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রটি একা বসে থাকবে। আবার কখনো কখনো দুপুরের খাবারের রুমের এক কোণে শাস্তি হিসেবে না খেয়ে বসে থেকে সবার খাওয়া দেখবে। গত বছর লন্ডন শহরে বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে শুনলাম, দুষ্টুমির জন্য স্কুল ছুটির পর আধা ঘণ্টা/এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় ছাত্রছাত্রীকে। একজন শিক্ষককে ২৫-৩০ জন ছাত্রছাত্রীর ক্লাস সামলাতেও এ রকম শাস্তির আয়োজন করতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় বেত নেই, তা সত্য। কিন্তু বিকল্প যা আছে, তা কি প্রয়োগের সুযোগ বাংলাদেশের বাস্তবতায় আছে? যদি না থাকে, তাহলে একজন শিক্ষক ৮০ থেকে ১০০ জন ছাত্রছাত্রীর ক্লাস কীভাবে সামলাবেন, তা কেউ ভাবে না। মুখস্থ বুলি আওড়ে উন্নত দেশে পারলে আপনারা পারবেন না কেন? অবশ্য আমি ক্লাস সামলানোর অজুহাতে কিছুসংখ্যক শিক্ষকের মাত্রাতিরিক্ত অমানবিক ছাত্র নির্যাতনের ঘোর বিরোধী। এসব অসুস্থ শিক্ষকের চাকরি থাকাই উচিত নয়।
প্রসঙ্গে ফিরে যাই। নতুন কারিকুলাম নিয়ে কথা বলছিলাম এক প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ক্লাস সেভেন-পড়ুয়া তার মেয়ে বাসায় এসে বিরিয়ানি রান্না করে স্কুলে নিয়ে যেতে চায়। তিনি মেয়েকে বলেছেন, তোমার শিক্ষকদের গিয়ে বলবে, ওনারা যেন তোমাকে প্রথমে রান্না স্কুলেই শেখান। তারপর বাসায় প্র্যাকটিস করবে। আরেক প্রধান শিক্ষিকা সম্পর্কে ভাবি হন। তিনি জানালেন, তাকে নাকি প্রশিক্ষণে বলা হয়েছিল নাচতে হবে। বুড়ো বয়সে নাচতে হবে শুনে তিনি খুব আপসেট হয়ে পড়েন। ভাগ্য ভালো ছিল তার, নাচার টার্ন আসার আগেই নামাজের সময় হয়ে যায়। তিনি নামাজে গিয়ে একটু দেরি করে ফেরেন, যাতে আর নাচতে না হয়।
এবার একটি গল্প বলে শেষ করে নিই। এক ছেলে জুতার দোকানে গেল তার জুতা কিনতে। এক হাজার টাকা বাজেটে জুতা কিনতে হবে। তার পায়ের মাপের সবগুলো জুতা দেখল, কিন্তু তার পছন্দ হচ্ছে না। কিছু সময় দোকানে হাঁটাহাঁটি করে দেখল, খুবই সুন্দর ডিজাইনের একটি জুতা। তার পায়ের মাপের অন্যান্য জুতার চেয়ে ডিজাইন দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি চামড়াও ভালো। শুধু সাইজে একটু বড়। ভাবল, সেও ধীরে ধীরে বড় হবে, একসময় যেহেতু জুতার মাপে পা বড় হয়ে যাবে, তাই একই দামে ভালো জিনিসটি কেনা দরকার। যেই চিন্তা সেই কাজ। বাসায় এসে জুতা পরে বাইরে যায়। কিন্তু জুতা তো পায়ে আটকায় না। নতুন জুতার শখে অনেক কসরত করে পায়ের সঙ্গে জুতা আটকে রেখে বেরিয়ে গেল। একসময় আর কিছুতেই জুতা পায়ে আটকে রাখতে পারেনি। পা সামনে চলে যায়, জুতা পেছনে পড়ে রয়। অবশেষে চমৎকার ডিজাইনের জুতাটি বগলে নিয়ে খালি পায়েই তাকে বাসায় ফিরতে হয়।
আর্থসামাজিক বাস্তবতা চিন্তা না করে কোনো ভিন্ন দেশের সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা অনুকরণ করতে গেলে ওই ছেলেটির মতো পুরো জাতিকে একসময় জুতা বগলে নিয়ে হাঁটতে হবে। দয়া করে শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো পলিসি গ্রহণের আগে দশবার চিন্তা করুন। ঢাকা শহরের এসি রুমে না বসে প্রতিটি উপজেলায় যান। স্কুলগুলো দেখেন। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলুন। তারপর এ দেশের আর্থসামাজিক পরিবেশের উপযোগী সিদ্ধান্ত নিন।
লেখক : রিয়েলটর ও মর্টগেজ ব্যাংকার, মিশিগান।