সাত 

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারী ২০২৪, ১২:৫৬ , অনলাইন ভার্সন
জর্জেস মোহাম্মদ

তালমিছরির মতো হালকা মিষ্টি সদা হাস্য, কিন্তু কঠিন শক্ত। ধরানাথ দা সিদ্ধান্তে অটল। তল্লাটের সবার ঘরের হাঁড়ির খবর তার জানা, কিন্তু কখনোই মুখে প্রকাশ করেন না। অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। গাঁয়ের বড়রা কেউ কেউ শুধু ধরা বলে ডাকে, ছোটরা ডাকে ধরাদা। সমবয়সীর ছেলেরা ধরা-ধরা বলে ডাকে। মা আদর করে ডাকে ধরু বলে। সমবয়সী মেয়েরাও ধরু বলে ডাকে, তাও সব সময় নয়, শুধু স্বার্থসিদ্ধির সময়।
সবিতারা চার বোন, সবাই অঙ্কে বেশ কাঁচা। বিশেষত সবিতা, তাই মুখে ঠোঁটপালিশ লাগিয়ে ধরু-ধরু বলে ডাকে। এখানে অঙ্কের চেয়ে অন্য কিছু লুকিয়ে, যা ওই ঠোঁটপালিশ আর নিঃসঙ্গ কুমারী মন জানে। সবিতার মনের খবর ছোট দর্পণ ভালো জানে। ছৈয়াল বাড়ির সুলেখা অনেক যত্ন করে ডালিমগাছ লাগিয়েছে, পড়ার ঘরের জানালার ধারে। হারিকেনের আলো খেয়ে ধরেছেও বেশ। সুতি কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। ডালিম প্রচুর আলো ও বাতাস চায়। কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখার দায়, দুষ্টু পোকারা শূল দিতে যেন না পারে। আঁধার-আলোতে দেখতে ডাগর হয়েছে বেশ। পড়ায় মন নেই সুলেখার। মন উড়ে বেড়ায় প্রজাপতির পাখায়, ধরাদার হাসির কোণে, চুলের তায়। কবে ডালিম পাকবে, ছিঁড়ে নিয়ে ধরাদাকে ডেকে বলবে, ধরু শোন, খেয়ে দেখিস পেকেছে কি না? এই পেকেছের গভীরে অনেক গল্প, অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা লুকিয়ে। শুধু সুলেখাই জানে। বয়স জানে না কোনো ধর্ম, বর্ণ ও বিশ্বাস। খোঁজে শুধু মনের কথা বলার অধিকার।
শান্ত সৃজন চলার পথে শত্রু নেই। শত্রুমুক্ত থাকার প্রতিটি পদই তার নখদর্পণে। সবকিছু শুনেও ভাব দেখান কিছুই শোনেননি, দেখেও দেখেননি, মুখে বলা অসম্ভব। মুখের কথা আর ধনুকের তির বেরোলে ফেরানো যায় না। অনেক সময় বলে থাকেন, ‘কথার জবাব দেবে ভালো করে শুনে, অর্থ লেনদেন করবে ভালো করে গুনে।’ আকাশের নিচে মানুষের সামনে ভাষণে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু টেবিল বৈঠকে নিপুণ। এই তো সেদিন ঘুগনি বাড়ির গাছ থেকে ডাব চুরি করছিল দুটি ছেলে। ধরানাথ নিচের ছেলেটিকে বলল, একটু সরে দাঁড়া, গাছ থেকে ডাব গায়ে পড়তে পারে। আর গাছের ছেলেটাকে বলল, একটু সাবধানে চড়িস, চুরিকালে মানুষ অসহায় থাকে। একটু ভুলে জীবন যেতে পারে। কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাছের ছেলেটা ছড়ছড় করে নেমে পালাল। চোর যত সাহসীই হোক, ডাক পড়লেই গুলিয়ে যায়। রক্তখেকো চিনাজোঁকের গায়ে লবণের মতো গুলিয়ে যায়। বড়-ছোট, ধর্ম-গোত্র ভেদাভেদ নেই ধরানাথ দার কাছে। এই গাঁয়ের বিদ্যাসাগর। মাটি আর মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চলেছে। বাবা মারা গেছেন, ঘরে শুধু মা। নিয়মিত দেশি-বিদেশি সাপ্তাহিক পড়ে। কখনো শিক্ষকতার সুযোগ নেয়নি। প্রধান শিক্ষক দেখা হলেই তার দপ্তরে নিয়ে যান, গল্প করতে মজা পান। প্রধান শিক্ষক সাহেব গোপনে জ্ঞান ধার করে নেন। জ্ঞান ধার চাওয়া লজ্জার বিষয়, তার ওপর প্রধান শিক্ষক বলে কথা। আমরা সবাই জ্ঞান দিয়ে অভ্যস্ত, জ্ঞান চেয়ে নয়। জ্ঞান ও পরামর্শ দিতে পছন্দ করি। আর গর্ববোধ চেহারায় প্রকাশ পায়। গ্রহ, মহাগ্রহ নিয়ে কথা উঠলেও মন্তব্য আমাদের করা চাই।
ধরানাথ দা অত্যন্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত। চুল, দাঁত, নখ সব সময় সুন্দর পরিষ্কার পরিপাটি। কথা বলার ঢং, বাচনভঙ্গি অতুলনীয়। খাওয়া নিয়েও কোনো আহামরি নেই। সঠিক সময়, সঠিক কথা। সঠিক সময়ে সঠিক ভোজন। যুক্তি বোঝে কথা, পুষ্টি মেপে খাদ্য ধরাদার বড় গুণ। রাত দিয়েছে ঘুমের জন্য, দিন দিয়েছে কাজের। ইংরেজিতে যখন কথা বলে, মনে হয় পাকা ডালিমের কোষ সুন্দর পরিপাটি সাজানো একেকটা করে খসে পড়ে। শুধু শুনতেই মন চায়। বুড়োরা বুঝুক আর না বুঝুক, শুধু তাকিয়ে থাকে। আর হালিমণি হাঁ করে শোনে। মনে হয়, কান দিয়ে শোনে না, মুখ দিয়ে শোনে। মুখ দিয়ে অনেক কথাই বলা সম্ভব। চোখ দিয়ে মনের কথাও শোনা সম্ভব। মুখ দিয়ে শোনা অসম্ভব। যেমনটা হয়েছে হালিমণির জীবনে। যখনই ধরাদা কিছু বলে, তখনই হালিমণির চোখের পাতা পড়ে না। হাঁ করে থাকে। শুধু হাঁ করে কথা শোনে না, প্রতিটি উক্তি, তাল-লয় মুখস্থ করে নেয়। এই তো সেদিন শিক্ষা বিভাগ থেকে লোক এসেছে গাঁয়ে, ধরাদাকে ডেকে পাঠানো হলো সামাজিকতা মাত্র। এলাকার মুরব্বিরাও একবাক্যে ধরুকে ডাকো। শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে প্লান্ট ও প্ল্যানেটের কথা বলছে, সূর্যের উপরে আরও একটা বড় সূর্য আছে এবং তার চারপাশে সাতটি নতুন গ্রহ ঘুরছে। আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে আরেক সৌরজগৎ। এমনভাবে বোঝাল, যেন পানকৌড়ি ডুবসাঁতার উপভোগ করছে।
গাঁও তো আর গাঁও নেই, শহর হয়ে গেছে। পুরো না হলেও আধাটা। এখানে এখনো প্রধান শিক্ষক বললে সাধারণ মানুষ তেমন সমীহ করে না। কিন্তু হেডমাস্টার বললে যেন মনে হয়, সে একজন বটে। গম্ভীরতা বজায় রেখে হেডমাস্টার সাহেব প্রশ্ন করলেন, হ্যাঁ রে ধরু, বল দেখি, নতুন সৌরমণ্ডলে সাতটিই কেন গ্রহ হতে হবে? আটটি কেন নয়? দশটি কেন নয়? তা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। আমার জ্ঞানের বাইরে, ভেতরে নয়। তবে সাত নিয়ে আদি থেকে অনেক বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও গাণিতিক প্রচলন আছে। পেছনে যুক্তিও আছে, গুরুত্বও পায়। যেমন ধরুন সাত দিন, সাত রং, সুরের সাত তাল, সাত সাগর, সাত আসমান, লাকি সাত, সাতটি বেহেশত, সাত ফেরা, সাত ধাপে দেহ গড়া, সপ্তম আশ্চর্য আরও কত সাত ইয়ত্তা নেই। আপনি যেহেতু জ্ঞান তৈরির কারখানার প্রকৌশলী, এই শিশুরাই আগামী দিনের বিশ্ব সংসার। আপনার কারখানার প্রধান উৎপাদন শুধু জ্ঞান নয়। জ্ঞানী, গুণী, সৎ ও সুস্থ মানের একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ। যদি পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করতে হয়, তবে আপনাকেও সাতের ওপর বিশ্বাসী হতে হবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা আপনার সুখ-দুঃখ, আপনার ছাত্র ও ছাত্রী, ইংরেজিতে ঝঃঁফবহঃ বলে থাকি। ছাত্রের কোনো জাত নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই; শুধু অধ্যয়ন, অধ্যয়ন আর অধ্যয়ন। প্রকৃত ছাত্রের রূপ সাতটি শব্দের ওপর শোভা পায়।
কবিতা লেখার প্রধান শর্ত হচ্ছে কবিতা পড়া, কবিতা পড়া আর কবিতা পড়া। তেমনি প্রত্যেক ছাত্রের প্রধান কাজ অধ্যয়ন (S-for Study)। জ্ঞান অর্জনের জন্য অধ্যয়ন অপরিহার্য। শুধু জ্ঞান অর্জন বা অধ্যয়ন করলেই পূর্ণাঙ্গ ছাত্র হওয়া যায় না।
প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে সত্যবাদী হতে হবে (T-for Truthful)। আদি থেকে ধর্ম ও সুস্থ সমাজব্যবস্থা এখনো আছে। প্রতিটির মূলমন্ত্র সত্য প্রতিষ্ঠা। সত্যেই সুখ, সত্যই সুন্দর।
(U-for Unity) সংঘবদ্ধ। সংঘবদ্ধতা দেশ ও জাতির কল্যাণে অতি জরুরি। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে সর্বদা সংঘবদ্ধ থাকতে হবে। তরুণসমাজ জাতির মেরুদণ্ড। সংঘবদ্ধ তরুণসমাজ বিশ্ব মানচিত্রে দেশ ও জাতির সৌরভ ছড়াতে সক্ষম।
(D-for Discipline) শৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খলতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতা সমাজ ও জাতির কল্যাণে আসে না। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে অবশ্যই শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে। শৃঙ্খলা মানুষকে সুস্থ, সবল ও শক্তিশালী জীবন দিতে পারে।
(E-for Exercise) ব্যায়াম। শরীর ও মানসিক সুস্থতার জন্য ব্যায়াম অপরিহার্য। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে পরিমিত খাবার, ঘুম ও সময়মতো ব্যায়াম করতে হবে। আদিকাল থেকে প্রতিটি পাঠশালায় পাঠাগার, খেলার মাঠ ও ব্যায়ামাগার রাখা হয়। শরীর ও মন সুস্থ থাকলে সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
(N-for neat & clean) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে অবশ্যই চলনে, বলনে, পোশাকে, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
(T-for Tactful) তাৎক্ষণিক জ্ঞান। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে অবশ্যই উপস্থিত জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। রুচিশীল মানুষ, সকল প্রতিকূল অবস্থার প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কারও ক্ষতি না করে কল্যাণকর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই ছাত্রছাত্রীর কর্তব্য। পরিবেশ-পরিস্থিতির মোকাবিলা করে প্রতিটি সমস্যাকে স্বাগত জানাতে হবে এবং প্রাধান্যক্রমে সমাধান করতে হবে। উপস্থিত সুবুদ্ধিই ঘটায় আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিতে।
বিশ্বজোড়া মানবকল্যাণকর মানসম্মত জাতি গড়তে হলে অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের এই সাত গুণের অধিকারী হওয়া আবশ্যক। সাত নিয়ে আরও কথা ও যুক্তির জন্ম দেওয়া যেতে পারে। আজ না-হয় এ পর্যন্তই থাকুক।  

 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041