বাহারুল আলম : মার্কিন মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক নানা কারণে মাঝেমধ্যে খবরের শিরোনাম হন। অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ৯২ বছর বয়সী রুপার্ট মারডক গত বছরের মার্চ মাসে ঘোষণা দেন, তিনি তার সঙ্গী (Partner) ৬৬ বছর বয়সী লেজলি স্মিথকে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মে বিয়ে করবেন। এটি হবে তার পঞ্চম বিয়ে। এর আগে তিনি যে চারজন নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তারা হলেন প্যাট্রিসিয়া বুকার, অ্যানামার ডকম্যান, ওয়েন্ডি ডেং এবং জেরি হল। চতুর্থ স্ত্রী জেরি হলের সঙ্গে ২০২২ সালে বিবাহবিচ্ছেদের পর তিনি পেশায় ডেন্টাল হাইজিনিস্ট লেজলি স্মিথের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান।
আসন্ন বিয়ের বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি তার মালিকানাধীন পত্রিকা নিউইয়র্ক পোস্টকে জানান, I am dreaded falling in love, but I know this would be my last. It better be. I am happy. For both of us, it’s a gift from God. We are both looking forward to spending the second half of our lives together.
হবু বধূর স্বামী চেস্টার স্মিথ ১৪ বছর আগে মারা যান। রুপার্ট মারডক হবেন তার দ্বিতীয় স্বামী। চীনা বংশোদ্ভূত ওয়েন্ডি ডেং ছিলেন রুপার্ট মারডকের তৃতীয় স্ত্রী। মারডকের সঙ্গে বিবাহিত থাকাবস্থায় চীনা গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্রিটিশ রাজনীতিক টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে ডেংয়ের গোপন সম্পর্ক থাকার খবর প্রকাশ পেলে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এর ফলে রুপার্ট মারডকের সঙ্গে টনি ব্লেয়ারের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরও অবসান ঘটে।
লেজলি স্মিথকে বিয়ের প্রস্তাব প্রদানকালে মারডক তাকে দুই মিলিয়ন ডলার মূল্যের হীরার আংটি উপহার দেন বলে জানা যায়। এত কিছু হওয়ার পর এ বছরের ৪ এপ্রিল রুপার্ট মারডক অনেকটা আকস্মিকভাবে তার বিয়ের ঘোষণা বাতিল করে দেন। শোনা যায়, হবু বধূর ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার নিজের ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে বিয়ে বাতিল হয়। উল্লেখ্য, ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে রুপার্ট মারডক ইহুদি এবং লেজলি স্মিথ একজন ধর্মভীরু খ্রিষ্টান।
অবশ্য কেউ কেউ বিয়ে বাতিলের নেপথ্যে মারডকের আগের ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নানা বিষয়ে হবু বধূর মতবিরোধকে দায়ী করেন। মারডক ছয় সন্তানের জনক।
রুপার্ট মারডক একজন বিলিয়নিয়ার। প্রাপ্ত তথ্যমতে, তিনি কমবেশি ২২ বিলিয়ন ডলারের অর্থবিত্তের মালিক। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১তম শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন যেখানে জড়িত, সেখানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে এই বিয়ে না হলেও রুপার্ট মারডক তার বাকি জীবন একাকী কাটাবেন, সেটা মনে করার কারণ নেই। অচিরেই তিনি অন্য কোনো রমণীর সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বেন না, সে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে সে ক্ষেত্রে হবু বধূকে মারডকের পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে মানিয়ে চলা, তথা তাদের মতামতকে গ্রাহ্য করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে বলে কেউ কেউ মনে করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় পত্রিকা প্রকাশনা ব্যবসা শুরুর পর মারডক যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে তার মিডিয়া ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটান। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং বিপুল জনপ্রিয় ক্যাবল নিউজ টিভি চ্যানেল ফক্স নিউজের প্যারেন্ট কোম্পানি ফক্স নিউজ করপোরেশনের তিনি চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী।
তা ছাড়া হার্পার কলিন্স নামের একটি পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেরও তিনি মালিক। এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বহু Best Seller গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তা ছাড়া তিনি লন্ডনের দ্য সান ও দ্য টাইমস এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড সান ও দ্য অস্ট্রেলিয়ান পত্রিকার স্বত্বাধিকারী।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক জনপ্রিয় ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক ফক্স নিউজ তার মালিকানাধীন ফক্স নিউজ করপোরেশনের অধীন একটি মিডিয়া।
ফক্স নিউজের প্রাইম টাইমে প্রচারিত টাকার কার্লসন, শন হ্যানিটি এবং লরা ইংগ্রাহাম প্রমুখ কর্তৃক উপস্থাপিত টকশোগুলো বিপুল দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান, যে কারণে বহু কোম্পানি তাদের পণ্য ও সেবার বিজ্ঞাপন এসব শোতে প্রচারে আগ্রহ পোষণ করে। বিজ্ঞাপন প্রচার বাবদ বিপুল আয়ের কারণে ফক্স নিউজের আয়-উন্নতি রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ফক্স নিউজ তাদের দর্শক চাহিদার কথা বিবেচনা করে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও বক্তব্য-বিশ্লেষণ প্রচার করে থাকে। রুপার্ট মারডকের ভাষায়, We are Giving the public what they want. দেশের (Suburban) ও গ্রামীণ রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই চ্যানেলের জনপ্রিয়তা বিপুল। এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ ট্রাম্প তথা রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। এসব মানুষের মধ্যে ট্রাম্প বিপুল জনপ্রিয় একজন নেতা। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই মর্মে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, ডেমোক্র্যাটরা কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক তথা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের চাহিদা ও স্বার্থরক্ষায় যতটা আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ, তাদের ক্ষেত্রে তারা ততটা আন্তরিক নন, বরং অনেক ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান তাদের চাহিদার বিপরীতমুখী। এ ক্ষেত্রে তারা ডেমোক্র্যাটদের খোলা সীমান্ত (Open Border), অপরাধ দমনে নমনীয়তা (Soft on Crime) এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের কথিত বাহুল্য ব্যয় নীতির কড়া সমালোচক। এসব ইস্যুতে ট্রাম্প তথা রিপাবলিকানদের অবস্থানকে তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
ফক্স নিউজকে তাদের দর্শক-শ্রোতা ধরে রাখতে অনেক সময় নানা ধরনের অসত্য তথ্য ও বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারমূলক (Misinformation/Disinformation) সংবাদ ও সংবাদ-ভাষ্য প্রচারে লিপ্ত হতে দেখা যায়। এ ধরনের সংবাদ ও বিশ্লেষণ চ্যানেলের দর্শক-শ্রোতাদের ভালো লাগলেও তা সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ, তা নিয়ে বহু মহলে প্রশ্ন রয়েছে।
অবশ্য অন্য নিউজ চ্যানেলগুলোও কমবেশি অনুরূপ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নয়, সেটা বলা যাবে না। বিশেষ করে, ডেমোক্র্যাটপন্থী সিএনএন ও এমএসএন-বিসিকে দিনের অনেকটা সময় ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের সমালোচনায় (Trump Bashing) মুখর থাকতে দেখা যায়। ফক্স নিউজ একসময় সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা একজন মুসলমান এবং তিনি বাল্য বয়সে জাকার্তার এক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন বলে খবর প্রচার করে। তা ছাড়া তার মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়েও ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওবামা নিজেকে একজন খ্রিষ্টান দাবি করে ওয়াশিংটন ডিসির এক চার্চে মাঝেমধ্যে day Mass-এ অংশগ্রহণ করেন বলে জানান।
তা ছাড়া ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের মাধ্যমে ট্রাম্পকে হারানো হয়েছে মর্মে তোলা তার (ট্রাম্প) ভিত্তিহীন অভিযোগের সমর্থনে ফক্স নিউজ ব্যাপক প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালায়। এ ক্ষেত্রে ওহাইও-ভিত্তিক ভোটিং মেশিনের বিরুদ্ধে এই মর্মে অপপ্রচার চালানো হয় যে মেশিনের ত্রুটির কারণে ট্রাম্পকে প্রদত্ত ভোট বাইডেনের ঘরে জমা হয়। ডমিনিয়ন এই অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করে এই মর্মে প্রচার-প্রোপাগান্ডা অবিলম্বে বন্ধ করতে ফক্স নিউজের প্রতি আহ্বান জানায়। রুপার্ট মারডকসহ ফক্সের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীরা ডমিনিয়নের আহ্বানে কর্ণপাত না করায় ডমিনিয়ন সম্প্রতি ডেলাওয়ার রাজ্যের সুপিরিয়র কোর্টে ফক্স নিউজের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মানহানির মামলা করে। মামলার আরজিতে বলা হয়, ডমিনিয়নের বিরুদ্ধে ফক্স নিউজের অসত্য ও বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের কারণে কোম্পানি সুনাম ও আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রায়াল শেষে রায় ঘোষণার প্রাক্কালে উভয় পক্ষের আইনজীবীরা কোর্টের বাইরে ফক্স নিউজ কর্তৃক ডমিনিয়নকে প্রায় ৭৬৭ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদানের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে মামলার আপসরফা করেন। এভাবে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ায় রুপার্ট মারডকসহ ফক্স নিউজের কর্তাব্যক্তি ও টকশো হোস্টরা আদালতের কাঠগড়ায় সশরীরে হাজির হয়ে ডমিনিয়নের আইনজীবীদের জেরা ও প্রশ্নবাণ থেকে রক্ষা পান।
মার্কিন সংবিধানে মতপ্রকাশের (Freedom of expression and speech) অবারিত স্বাধীনতা দেওয়া হলেও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকৃত বিদ্বেষ (Actual Malice) প্রচারের সুযোগ দেওয়া হয়নি। সত্যনির্ভর সংবাদ ও ভাষ্য প্রচারে ডমিনিয়ন মামলার ঘটনা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।