মানবিক ও পাশবিক চরিত্রের কার্যকারণ

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৪০ , অনলাইন ভার্সন
এস এম মোজাম্মেল হক


কড়া শাসন ও অবারিত সুযোগ চরিত্র গঠনের অন্যতম বৈশিষ্ট্যরূপে বিবেচিত। জন্মের সূচনালগ্ন থেকে যে পরিবেশ ও অবলম্বনযোগে বেড়ে ওঠা, তার প্রভাব চরিত্রগঠনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, রিপুনির্ভর দেহের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের ওপর রিপুর যে প্রভাব, তা নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তির শিক্ষা, নৈতিক মনোবল, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সংসর্গ সর্বোপরি মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চরিত্রগঠনের অন্যতম প্রভাবক। জন্মগতভাবে পূর্বপুরুষদের রক্তের ধারাবাহিকতা অর্থাৎ জিনগত বৈশিষ্ট্যও চরিত্রগঠনের প্রভাবক বটে।
ধর্ম মানুষের নৈতিক চরিত্রকে ইতিবাচক ও সৎকর্মের দিকে প্রভাবিত করে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যেকোনো ধর্মের মূল উদ্দেশ্যই ধর্মাশ্রয়ী মানুষকে সৎ পথ ও সত্যাশ্রয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং ধর্মের যারা প্রকৃত অনুসারী, তারা অন্য সাধারণ লোকের চেয়ে নৈতিক চরিত্রে উন্নত হয়; যদিও কিছু কিছু ব্যতিক্রমও যে নেই, তা নয়। ভোগবাদী মানুষ যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, ইহকালকেই তারা প্রাপ্তির সর্বোত্তম স্থান ধরে নিয়ে সেই মোতাবেক ভোগবিলাসে লিপ্ত হতে থাকে। কিন্তু পরকালে বিশ্বাসীরা মনে করেন, ইহকালীন অর্জন পরকালীন সুখ-সমৃদ্ধির প্রভাবক। তাই তারা অর্জন ও বিসর্জনের ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় নিয়ে জীবন পরিচালিত করে থাকেন।
ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতেই যেমন প্রাপ্তির আশাপূরণের ক্ষেত্রে ন্যায় ও অন্যায় পথ অবলম্বনের স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনি বিবেক-বিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে স্বনিয়ন্ত্রিত সুফল ভোগেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে ব্যক্তি তা কীভাবে গ্রহণ-বর্জন করবেন, সেটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। অন্যায়ভাবে সুযোগ-সুবিধা লাভের কারণে শাস্তির বিধান মূলত মানুষকে তার লোভ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে প্রভূত ভূমিকা পালন করলেও লোভী ও অপরাধপ্রবণ লোকজন তাদের কৃত অপরাধ লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাবে, এই বিশ্বাস ধারণ করার ফলে প্রথম দিকে অতি সংগোপনে তারা অপরাধে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এক-দুবার অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু কথা হলো ভালো কাজের যেমন সুনাম-সুখ্যাতি আছে, তেমনি খারাপ কাজেরও দুর্নাম-ভোগান্তি আছে। একসময় যার ফল ঠিকই ভোগ করতে হয়। কারণ কৃতকর্মের বিষয়টি আকাশের চাঁদের মতো। মেঘের কারণে চাঁদ কিছু সময় দৃশ্যপটের বাইরে থাকলেও মেঘ সারাক্ষণ যেমন ঢেকে রাখতে পারে না, মানুষের কৃতকর্মের ভালো-মন্দও তেমনি ঠিকই প্রকাশ পায়।
সৃষ্টির সবকিছুই বিজ্ঞানময়। সময় যত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ততই তা মানসচরিত্রে স্পষ্টতর হচ্ছে। যদিও মানুষ শিক্ষার প্রয়োজনে বিষয়ভিত্তিক বিভাজনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনে বাহ্যিক তাৎপর্য গ্রহণ ও অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু প্রতিটা বস্তু ও বিষয়ের অন্তর্নিহিত বিজ্ঞানময়তার সন্ধান সবার পক্ষে যেমন সম্ভব নয়, তেমনি প্রয়োজনও নেই। ফলে অনেকেই শুধু বাহ্যিক কার্যকারণটা গ্রহণ করে শান্ত ও ক্ষান্ত থাকে। তবে জ্ঞানের চাহিদা ও অনুসন্ধিৎসা সবার সমান নয়। তাই বস্তু বা বিষয়ের অন্তর্নিহিত বিজ্ঞানময়তা খোঁজার এবং গবেষণার মাধ্যমে তা জনসম্মুখে নিয়ে আসার যে নিরন্তর চিন্তা ও প্রচেষ্টা, তা থেকেই বিষয়ভিত্তিক পিএইচডির উদ্ভাবন, যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিজ্ঞানময়তার প্রকাশ।
মহাবিশ্বের প্রতিটা অণু-পরমাণুর মধ্যেই প্রতিনিয়ত বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ গতিময়তা। যেকোনো গতিহীন বস্তু সহজেই তার জীবনীশক্তি হারায় কিন্তু গতিশীল বস্তুর জীবনীশক্তি তত সহজে নষ্ট হয় না। পৃথিবীর বাইরে চলমান গ্রহ-নক্ষত্র যখন গতি হারায়, তখন তা নিস্তেজ হয়ে ব্ল্যাকহোলের গভীরে নিপতিত হয়। কারণ বস্তুর অবিনাশিতার ধারণামতে, বস্তুর জন্ম বা সূচনালগ্ন গতিশীল এবং তার সমাপ্তি হয় গতিহীনতায়। আর তখন সেটা পুনরায় অস্তিত্বহীন অবস্থায় পর্যবসিত হয়, যা সৃষ্টির প্রাকৃতিক নিয়ম। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে অদূর ভবিষ্যতে নতুন কোনো আবিষ্কারের ফলে প্রতিষ্ঠিত এ ধারণাও পাল্টে যাবে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
নেতিবাচক কর্মের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। অনেকে বিষয়টির প্রতি দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। তবে সত্য ও ন্যায়ের পথপ্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণের কথা বিবেচনা করলেই এর যৌক্তিকতা বোঝা সহজ হবে। কারণ, অন্যায়-অবিচার কখনো ন্যায্যতা পায়নি এবং কখনো পাবেও না। তা সত্ত্বেও খারাপ কাজের অনুসারী নেহাত কম নয়। এ থেকেই বোঝা যায়, চেষ্টা করেও ভালো কাজের অনুসারী করা না গেলেও বিনা চেষ্টায় খারাপ স্বভাবের বশবর্তী হওয়া লোকজন অতি সহজেই সে পথের অনুসারী হয়ে থাকে। এর কারণ ষড়রিপুর অব্যাহত তাড়না। তা ছাড়া সমাজে কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেদের সব সময় পারফেক্ট এবং যত ভুল তা সব অন্যের বলে মনে করে এবং কেউ যদি তাদের এ আচরণকে বেঠিক মনে করে বা মন্তব্য করে, তবে এ লোকগুলোর আচরণ হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ণ। তারা তাদের এমন সব অশ্রাব্য কথায় বিদ্ধ করে, যা সভ্যতা-ভব্যতার মাত্রা অতিক্রম করে এবং তাদের সমর্থনে অনুরূপ স্বভাবের বহু লোক তাদের পক্ষ অবলম্বন করে। অথচ তারা ঠান্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখারও প্রয়োজন বোধ করে না, এসব লোকের কারণেই সমাজে বেশির ভাগ সময় অশান্তি বিরাজ করে। বিষয়টি তারা তো উপলব্ধি করেই না বরং কেউ তা বোঝানোর চেষ্টা করলে তার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে। এ কারণে পারতপক্ষে তাদের সঙ্গে সহসা কেউ যুক্তিতর্কে অবতীর্ণ হয় না। ফলে তারা সব সময় নিজেদের ভুলের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে। তারা নিজেদের মতপ্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তির পরিবর্তে স্বভাবসুলভ উগ্রতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এতে সাময়িকভাবে তারা নিজেদের বিজয়ী ভাবলেও প্রকারান্তরে তাদেরই পরাজয় হয়। কারণ, যুক্তিতে বিশ্বাসী লোকজন তাদেরকে এড়িয়ে চলে। ফলে একসময় তারা ভালো ও গ্রহণযোগ্য লোকদের সঙ্গ হারায়।
স্মর্তব্য, এসব লোকের সবাই মূর্খ বা অশিক্ষিত নয়, বরং শিক্ষার সুফল লাভ করে তারা যথোপযুক্ত পর্যায়ে উপনীত হতে ব্যর্থ। যে কারণে তারা নিজেদের যতই মর্যাদাপূর্ণ ভাবুক না কেন, বাস্তবে লোকজন তাদেরকে তেমন গুরুত্ব প্রদান করে না। যদিও এ বিষয়টিও তারা অনুভব করতে ব্যর্থ। ফলে তাদের কথা, কাজ ও আচার-আচরণ অন্যের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার পরিবর্তে অন্যের নিকট বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে। এভাবে একসময় তারা ভালো সঙ্গী ও সঙ্গবিহীন হয়ে পড়ে, যাকে প্রকৃতিপ্রদত্ত শাস্তি বলা যেতে পারে। এটাকেই মানবিক চরিত্রের বিপর্যয় ও পাশবিক চরিত্রের শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এটা পাশবিক চরিত্রের অধিকারীদের যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধিতে আসবে, তাদের ও সমাজের জন্য ততই মঙ্গল।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041