নন্দিনী লুইজা
এমনই এক ঋতুরাজ বসন্তের পাগল করা দিনে দেখা হয়েছিল শিমুল আর শাওনের। প্রায় ১২ বছর আগের কথা। যখন শাওনেরা থাকত কুমিল্লা জেলায়। শাওনের বাবা একজন চাকরিজীবী। শাওন ছিল বড় ছেলে, কান্তা ছোট। বেশ সুখের সংসার ওদের। শাওন বরাবর ভালো ছাত্র। ও এখন সবেমাত্র একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তখন ওর সহপাঠী শিমুলের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে কখন যে ওদের মধ্যে ভালোবাসার সুখপাখি বাসা বেঁধেছে, দুজনের একজনও জানে না। শাওন কলেজ সংসদের সম্পাদক। তাই পড়াশোনা ছাড়াও ওর অনেক কাজ করতে হয়। ওর কাজে সাহায্য করে শিমুল। যা করে দুজনে মিলে। অল্প দিনের মধ্যেই ওরা সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। সবার মুখোমুখি শিমুল-শাওন। ওদের চিন্তাধারা গঠনমূলক, জীবনধর্মী। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিমুল-শাওন না থাকলে মজা হবে না।
একদিন ক্লাস শেষে দুজনে আমগাছের নিচে বসে কী যেন আলাপ করছিল। শিমুল বলে উঠেছিল, শাওন, তুমি সবার কাজ করে যাচ্ছ কিন্তু এভাবে কাজ করতে থাকলে অল্প দিনের মধ্যেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন শাওনও কী যেন ভাবছিল। শিমুল তার চোখ দেখে বুঝতে পেরেছে, শাওন সারাক্ষণ কী যেন ভাবে। তার কথা এতটুকু ভাবে না। তাই অভিমানে বলেছিল, তুমি কি একটি বারও আমার কথা ভাবো না, শাওন? তখন শাওন বলে, শিমুল, তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। তোমাকে পাশে রেখেই তো আমি এত কাজ করতে পারি। তুমি ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তার পর থেকে শিমুল শাওনের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল।
তখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দুই বছর পর তারা বেরিয়ে আসবে। দেশে দেখা দিল স্বাধীনতার ডাক। দেশ স্বাধীন করার তীব্র প্রত্যাশা। হাজার হাজার যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য নেমে পড়েছে। এমন সময় শাওন বসে থাকতে পারে না। বাবা-মা তার প্রিয়তমার আঁচলের নিচে। শাওন যোগ দিয়েছিল যুদ্ধে। হাতে তুলে নিয়েছিল রাইফেল। তখন তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে দেশ স্বাধীন করার বাসনা। শাওনকে সাহায্য করতে গোপনে ওকে হাতবোমা ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আসত শাওনদের আস্তানায়। শিমুলও জানে দেশ স্বাধীন হলে শাওনকে পাবে। একবুক আশা নিয়ে দিন গুনতে থাকে। বসন্তের এই দিনে আবার গাছে গাছে ফুল ফুটবে, পাখি গান ধরবেÑকত কিছু কল্পনা করে।
কিন্তু সেই কল্পনার জাল মাকড়সার জালের মতো ছিঁড়ে যায়। একজন এসে খবর দেয়, শাওন ভাইয়ার খবর খুব খারাপ। ভাইয়া আপনাকে ডাকে। শিমুলের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, আমার শাওনের কী হয়েছে, ও কোথায়, আমাকে নিয়ে চলো। শিমুল যখন শাওনের কাছে যায়, তখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। বুকের তাজা তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। চিৎকার দিয়ে বলে, শা-ও-ন, শা-ও-ন, তুমি আমাকে ফেলে কোথায় চলে যাচ্ছ, আমাকে নিয়ে চলো। তারপর নিজেকে কিছুটা সংযত করে শিমুল শাড়ির আঁচল দিয়ে শাওনের রক্ত মুছতে মুছতে বলে, শাওন, তুমি ভালো হয়ে উঠবে। এই তো আমি কাছে। তোমাকে নিতে এসেছি। শাওন তখন শিমুলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু হেসে বলে, তুমি কাঁদছ কেন? আমি না থাকলেও তোমার বুকের রত্ন স্বাধীনতা আছে, তাকে বুকে নিয়ে তুমি বেঁচে থাকবে। ওকে তুমি সুন্দরভাবে মানুষ করে তুলবে। এমনভাবে মানুষ করে তুলবে, ওর মাঝে তুমি তোমার শাওনকে খুঁজে পাবে। আজ তুমি গোমরা মুখে থেকো না লক্ষ্মীটি। আমাকে হাসিমুখে বিদায় দাও, বলতে বলতে শিমুলের কোলে ঢলে পড়ে।
আজও শিমুল ভুলতে পারে না শাওনের কথা। শিমুল সরকারি কলেজের লেকচারার। আজও শিমুল স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। প্রতিবছর ফিরে আসে বসন্ত, গাছে গাছে ফুল ফোটে, কোকিল গান ধরে, আসে স্বাধীনতা দিবস। চারদিকে স্বাধীনতার বিজয়ের জন্মজয়ন্তী। এই স্বাধীনতা আসলে সফল হয়েছে ৩০ লাখ লোকের রক্তের বিনিময়ে। প্রতিবছর বিজয়ের এই দিনে মিনারে মিনারে ফুল দেওয়া হয়, কালো ব্যাজ ধারণ করে কাঙালিভোজ দেওয়া হয়। এ দেশের অবুঝ মানুষকে বোঝানো হয় স্বাধীনতা আছে কিন্তু স্বাধীনতা নামের লাল গোলাপ শুকিয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ জনতা আজ গুমরে গুমরে কাঁদছে কিন্তু ওর একার পক্ষে কিছুই করার নেই।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। শিমুল আজ সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। অনেক সকালেই ছাদে পায়চারি করছে আর ভাবছে, সামনে রেখে যাওয়া পুত্রের (স্বাধীনতা) কথা। চারদিকে নতুনের সমারোহ, গাছে গাছে কচি পাতায় মৃদুমন্দ বাতাস। আকাশ যেন নীলাম্বরী শাড়ি পরে পৃথিবীকে ছায়া দিচ্ছে। এমন সময় দেখছে লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত। মনে হচ্ছে, পূর্ব আকাশে আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে। শিমুল তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, ঐতিহাসিক স্বাধীনতার বিজয়ের লাল-সবুজের নিশান হাতে নিয়ে শাওন এগিয়ে আসছে তার দিকে। মনের অজান্তেই শিমুল বলে ওঠে, শা-ও-ন, দাঁড়াও, আমি আসছি।
-১৯৮৩ সালে লেখা
এমনই এক ঋতুরাজ বসন্তের পাগল করা দিনে দেখা হয়েছিল শিমুল আর শাওনের। প্রায় ১২ বছর আগের কথা। যখন শাওনেরা থাকত কুমিল্লা জেলায়। শাওনের বাবা একজন চাকরিজীবী। শাওন ছিল বড় ছেলে, কান্তা ছোট। বেশ সুখের সংসার ওদের। শাওন বরাবর ভালো ছাত্র। ও এখন সবেমাত্র একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তখন ওর সহপাঠী শিমুলের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে কখন যে ওদের মধ্যে ভালোবাসার সুখপাখি বাসা বেঁধেছে, দুজনের একজনও জানে না। শাওন কলেজ সংসদের সম্পাদক। তাই পড়াশোনা ছাড়াও ওর অনেক কাজ করতে হয়। ওর কাজে সাহায্য করে শিমুল। যা করে দুজনে মিলে। অল্প দিনের মধ্যেই ওরা সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। সবার মুখোমুখি শিমুল-শাওন। ওদের চিন্তাধারা গঠনমূলক, জীবনধর্মী। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিমুল-শাওন না থাকলে মজা হবে না।
একদিন ক্লাস শেষে দুজনে আমগাছের নিচে বসে কী যেন আলাপ করছিল। শিমুল বলে উঠেছিল, শাওন, তুমি সবার কাজ করে যাচ্ছ কিন্তু এভাবে কাজ করতে থাকলে অল্প দিনের মধ্যেই তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন শাওনও কী যেন ভাবছিল। শিমুল তার চোখ দেখে বুঝতে পেরেছে, শাওন সারাক্ষণ কী যেন ভাবে। তার কথা এতটুকু ভাবে না। তাই অভিমানে বলেছিল, তুমি কি একটি বারও আমার কথা ভাবো না, শাওন? তখন শাওন বলে, শিমুল, তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। তোমাকে পাশে রেখেই তো আমি এত কাজ করতে পারি। তুমি ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। তার পর থেকে শিমুল শাওনের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল।
তখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দুই বছর পর তারা বেরিয়ে আসবে। দেশে দেখা দিল স্বাধীনতার ডাক। দেশ স্বাধীন করার তীব্র প্রত্যাশা। হাজার হাজার যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য নেমে পড়েছে। এমন সময় শাওন বসে থাকতে পারে না। বাবা-মা তার প্রিয়তমার আঁচলের নিচে। শাওন যোগ দিয়েছিল যুদ্ধে। হাতে তুলে নিয়েছিল রাইফেল। তখন তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে দেশ স্বাধীন করার বাসনা। শাওনকে সাহায্য করতে গোপনে ওকে হাতবোমা ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আসত শাওনদের আস্তানায়। শিমুলও জানে দেশ স্বাধীন হলে শাওনকে পাবে। একবুক আশা নিয়ে দিন গুনতে থাকে। বসন্তের এই দিনে আবার গাছে গাছে ফুল ফুটবে, পাখি গান ধরবেÑকত কিছু কল্পনা করে।
কিন্তু সেই কল্পনার জাল মাকড়সার জালের মতো ছিঁড়ে যায়। একজন এসে খবর দেয়, শাওন ভাইয়ার খবর খুব খারাপ। ভাইয়া আপনাকে ডাকে। শিমুলের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে, আমার শাওনের কী হয়েছে, ও কোথায়, আমাকে নিয়ে চলো। শিমুল যখন শাওনের কাছে যায়, তখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। বুকের তাজা তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে। চিৎকার দিয়ে বলে, শা-ও-ন, শা-ও-ন, তুমি আমাকে ফেলে কোথায় চলে যাচ্ছ, আমাকে নিয়ে চলো। তারপর নিজেকে কিছুটা সংযত করে শিমুল শাড়ির আঁচল দিয়ে শাওনের রক্ত মুছতে মুছতে বলে, শাওন, তুমি ভালো হয়ে উঠবে। এই তো আমি কাছে। তোমাকে নিতে এসেছি। শাওন তখন শিমুলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু হেসে বলে, তুমি কাঁদছ কেন? আমি না থাকলেও তোমার বুকের রত্ন স্বাধীনতা আছে, তাকে বুকে নিয়ে তুমি বেঁচে থাকবে। ওকে তুমি সুন্দরভাবে মানুষ করে তুলবে। এমনভাবে মানুষ করে তুলবে, ওর মাঝে তুমি তোমার শাওনকে খুঁজে পাবে। আজ তুমি গোমরা মুখে থেকো না লক্ষ্মীটি। আমাকে হাসিমুখে বিদায় দাও, বলতে বলতে শিমুলের কোলে ঢলে পড়ে।
আজও শিমুল ভুলতে পারে না শাওনের কথা। শিমুল সরকারি কলেজের লেকচারার। আজও শিমুল স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। প্রতিবছর ফিরে আসে বসন্ত, গাছে গাছে ফুল ফোটে, কোকিল গান ধরে, আসে স্বাধীনতা দিবস। চারদিকে স্বাধীনতার বিজয়ের জন্মজয়ন্তী। এই স্বাধীনতা আসলে সফল হয়েছে ৩০ লাখ লোকের রক্তের বিনিময়ে। প্রতিবছর বিজয়ের এই দিনে মিনারে মিনারে ফুল দেওয়া হয়, কালো ব্যাজ ধারণ করে কাঙালিভোজ দেওয়া হয়। এ দেশের অবুঝ মানুষকে বোঝানো হয় স্বাধীনতা আছে কিন্তু স্বাধীনতা নামের লাল গোলাপ শুকিয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ জনতা আজ গুমরে গুমরে কাঁদছে কিন্তু ওর একার পক্ষে কিছুই করার নেই।
আজ ১৬ ডিসেম্বর। শিমুল আজ সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। অনেক সকালেই ছাদে পায়চারি করছে আর ভাবছে, সামনে রেখে যাওয়া পুত্রের (স্বাধীনতা) কথা। চারদিকে নতুনের সমারোহ, গাছে গাছে কচি পাতায় মৃদুমন্দ বাতাস। আকাশ যেন নীলাম্বরী শাড়ি পরে পৃথিবীকে ছায়া দিচ্ছে। এমন সময় দেখছে লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত। মনে হচ্ছে, পূর্ব আকাশে আস্তে আস্তে সূর্য উঠছে। শিমুল তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, ঐতিহাসিক স্বাধীনতার বিজয়ের লাল-সবুজের নিশান হাতে নিয়ে শাওন এগিয়ে আসছে তার দিকে। মনের অজান্তেই শিমুল বলে ওঠে, শা-ও-ন, দাঁড়াও, আমি আসছি।
-১৯৮৩ সালে লেখা