মুহম্মদ শামসুল হক
১৯৭১ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ-দিনপঞ্জির হিসাবে দীর্ঘ ৫২ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে কিশোরদের ষাটোর্ধ্ব বয়সে; যুবকদের পলিতকেশ-অশীতিপর বুড়োর এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানকারীদের বেশির ভাগেরই নবতিপর বুড়োতে এবং সেক্টর কমান্ডারদের সিংহভাগেরই ইহলোকের পাট চুকিয়ে চিত্তগুপ্তের খতিয়ানে নাম লেখানোর বয়স বহু আগেই উতরে গেছে। আর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতা এবং একাত্তরের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যমণ্ডলীর ৯৫ শতাংশই সম্ভবত মরহুমের তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তাই ৫২তম শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং বিজয় দিবস উপলক্ষে নিহতদের আত্মার চিরপ্রশান্তি ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য কামনা এবং স্বজনহারাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ শতকের শেষ অধ্যায় এবং একুশ শতকের প্রথম অধ্যায়ে বিশ্বজুড়ে বহু রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ও ক্ষমতার হাতবদল ঘটেছে। মানুষের চিন্তাচেতনা ও রুচির জগতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঢেউ খেলে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষ সাধিত হওয়ায় গোটা বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় এসেছে। সাবেক কুর্নিশ ঠেকা পৃথিবীর ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট রাষ্ট্রগুলো গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে বিচরণ করছে এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহে বসতি স্থাপনের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।
অবশ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সভ্যতা ও মন-মানসিকতার ঈর্ষণীয় পরিবর্তনের ফলে মান্ধাতার আমলের অনেক অনাচার বর্তমানে সামাজিক ও ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়েছে। সনাতনী আমলের যৌথ পরিবারব্যবস্থা নির্বাসনে গেছে। ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু হয়েছে। সহজাত আবেগ-অনুভূতি-মমত্ববোধ-সামাজিক বন্ধন-পারিবারিক শৃঙ্খলাবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বহুলাংশে বিজ্ঞানের শাণিত যুক্তি-তর্কের অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়েছে। ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক-জাতীয় জীবনে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ সবকিছুকে বাস্তবতার কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করতে শিখেছে। গুরুজনদের হিতোপদেশ, ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সাবেক আমলের প্রথানুযায়ী বয়স্কদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করা, মানীর অপমান বজ্রাঘাততুল্য; সৎ উপায়ে জীবিকার্জন ইবাদততুল্য; অসহায়কে সাহায্য, সর্বহারা আশাহতকে প্রাণবন্ত করে তোলার প্রচেষ্টা ইত্যাদি জনবহুল প্রবাদ-প্রবচন পেশিশক্তির আশীর্বাদধন্য সমাজে পুরোপুরি বেমানান। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সেকেলে বিবেচনায় চরমভাবে উপেক্ষিতও বটে। সালাম-আদাব-কুশল বিনিময় বর্তমান সমাজ থেকে লজ্জায় পালিয়েছে বললে অতিশয়োক্তি হবে না।
পেশিশক্তির বর্তমান মগের মুল্লুকে সনাতনী আমলের সামাজিক লৌকিকতা ও শিষ্টাচার দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক ও ক্ষমতার মদদপুষ্টরা আশরাফ-আতরাফ-বর্ষীয়ান-ন্যুব্জদেহ-কুব্জপৃষ্ঠ নির্বিশেষে সবার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে হরহামেশা ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে। দলীয় রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাবশালীদের বিশেষ আশীর্বাদধন্যরা বর্তমান সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এবং সব ধরনের আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে। হাইব্রিডদের বাড়াবাড়ি ও দৌরাত্ম্যে ত্যাগী নেতাকর্মীরা রাজনীতির ময়দানে চরমভাবে কোণঠাসা, এমনকি দেশছাড়া বলেও মাঝে মাঝে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
অবশ্য বিগত ৫২ বছরে বাংলাদেশে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং অবকাঠামোগত অনেক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ, অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ইত্যাদি যুগান্তকারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সর্বমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসার্হ। নিরক্ষরতা নির্মূল এবং নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। তবে প্রকৃত শিক্ষিতের হার বেড়েছে কি কমেছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কারণ, শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার পোশাকি রূপে দেহ সুশোভিত করলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত শিক্ষিত বা ডিগ্রিধারী এবং ক্ষমতাসীনদের জীবনাচরণে মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের ন্যূনতম নজির না মেলার ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। পত্রপত্রিকার সংবাদ অনুসারে, প্রাত্যহিক জীবনের নিত্য প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে নিরক্ষররা দায়ে ঠেকে চুরি-চামারির আশ্রয় নেয়। পক্ষান্তরে অর্থবিত্তের মোহাবিষ্ট উচ্চ ডিগ্রিধারী এবং প্রভাবশালী সম্প্রদায় প্রকল্প, মেগা প্রকল্প ইত্যাদি মুখরোচক বুলির আড়ালে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করে গোটা দেশ এবং দেশবাসীকে ঋণের সাগরে তলিয়ে দিচ্ছে।
যাহোক, বর্তমান বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা মুখরোচক ও জনবহুল শব্দটি হচ্ছে সিন্ডিকেট। তেল-লবণ, চিনি-গুড়, চাল-ডাল, রসুন-আদা-পেঁয়াজ, তরিতরকারি ইত্যাদি প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য সামগ্রীর সবকিছুর একক নিয়ন্ত্রক-ত্রাতা-ভাগ্যবিধাতা সিন্ডিকেট। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের চেয়ে সিন্ডিকেট অধিকতর প্রভাবশালী বলে সর্বসম্মুখে উচ্চারণ করেন মন্ত্রী-এমপিরা। আবার অনেকের মতে, সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে জনদুর্ভোগ তুঙ্গে ওঠা সত্ত্বেও দেশের নিরীহ আমজনতা সর্বংসহা বসুন্ধরার মতো সবকিছু নীরবে-নির্বিবাদে সহ্য করছে হরহামেশা। আবার সেই মান্ধাতার আমলের মাছে-ভাতে বাঙালি জনশ্রুতিটি আমাদের সমাজজীবন থেকে বহু আগেই বিদায় নিয়েছে। ৮০ টাকা ডিমের হালির বর্তমান বাজারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় ৯৫ শতাংশ বাঙালির নিকট ডিমও মহার্ঘে পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি গরুর মাংসের দর নিয়ে সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজির খবরে স্বদেশে ও বিদেশে বাঙালিদের কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম হয়। তার ওপর রোজার আগেই বিশেষ সিন্ডিকেট চক্রের সক্রিয় তৎপরতার আগাম হুঁশিয়ারির বার্তায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
উল্লেখ্য, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই বিজিতদের পক্ষ থেকে ভোটে কারচুপি, পরবর্তীতে সূক্ষ্ম কারচুপি, পর্যায়ক্রমে কেন্দ্র দখল, এককভাবে সিল মারা, গুন্ডা-হুন্ডা-মাস্তানদের পেশিশক্তি প্রদর্শন, মিডিয়া ক্যু, দিনের ভোট রাতে নেওয়া ইত্যাদি নিত্যনতুন সংবাদ দেশবাসী এবং ভোটাররা শুনে আসছেন।
বর্তমানে প্রার্থী, ডামি প্রার্থী এবং নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবরাখবর কারও অজানা নয়। তাই সে ব্যাপারে আলোকপাত নেহাত অপাঙ্ক্তেয়। তবে ভোট সিন্ডিকেটের কোনো খবর অদ্যাবধি পত্রপত্রিকায় না মেলায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বিস্মিত। বাংলাদেশের ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক-পারিবারিক-ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের পটভূমিতে অন্যান্য সিন্ডিকেটের চেয়ে ভোট সিন্ডিকেটের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বললে সত্যের আদৌ অপলাপ হবে না। কায়ক্লেশে ভোট সিন্ডিকেট গড়ে তোলা গেলে জাতীয় জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ল্যাটা চুকে যাবে, মসনদ-কেন্দ্রিক হানাহানিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
সরকার, নির্বাচন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, বিরোধী রাজনৈতিক দল, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শিরঃপীড়াও রাতারাতি উপশম হয়ে যাবে। ভোট সিন্ডিকেটই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মতো ভোটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড একচ্ছত্রভাবে নির্বাহ করবে। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির সংকট আঁচ করে সিন্ডিকেট চক্র আগেভাগে এলসি খুলে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো থেকে ভোট আমদানি করবে। আর ভোটার উপস্থিতি বেশি হলে পচা পেঁয়াজ, আদা-রসুন, মসলা, চিনি-লবণ ইত্যাদির মতো আমদানিকৃত বাড়তি ভোট বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের নদ-নদীর বানে ভাসিয়ে দেবে। আবার নিজেদের পছন্দের দলকে মসনদে বসাবে; প্রতিপক্ষকে ঠেঙিয়ে দেশছাড়া করবে। ফলে দেশজুড়ে শান্তি-সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। আর তথাকথিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের খোঁজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বাড়িঘরে অহর্নিশ হানা দিতে হবে না; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, নির্বাচন কমিশনকে নিত্যনতুন তথ্যের ফুলঝুড়ি ছড়াতে হবে না; ভিনদেশিদের রক্তচক্ষুর শাসানিরও সুযোগ থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অধিকন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সূক্ষ্ম কারচুপি, মিডিয়া ক্যু, কেন্দ্র দখল, দিনের ভোট রাতে দেওয়া ইত্যাদি অপবাদ/অভিশাপ থেকে দেশ-দশ-জাতি-রাজনীতিবিদেরাও মুক্তি পাবেন।
যাহোক, হাল আমলের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের জীবনাচরণ থেকে বাপ-দাদা বা পূর্বপুরুষদের পরিচিতি বিদায় নিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট একুশ শতকের বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী প্রত্যেকে নিজদের বিশেষ দলের নেতাকর্মী, বিশেষ নেতা-নেত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তারা যথাসম্ভব নিজেদের কোনো বিশেষ দলের ওয়ার্ড-গ্রাম-অঞ্চল-শাখার সদস্য/কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছে। তবে সাময়িক দলীয় পরিচিতির মাধ্যমে যুবক-যুবতীরা বাহাদুরি জাহির করলেও বস্তুত এই প্রবণতা সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ডেকে আনছে বলে অভিজ্ঞ মহলের সুচিন্তিত অভিমত। এতে নিকট ভবিষ্যতে গোটা জাতি ছিন্নমূল-উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এদিকে লুঙ্গি বাহিনী, পাজামা বাহিনী, মলম বাহিনী, হাফপ্যান্ট বাহিনী, হেলমেট বাহিনী, টাইগার বাহিনী, গেরিলা বাহিনী, দানব বাহিনী, দৈত্য বাহিনী, নরখেকো বাহিনী, নৈশ বাহিনী ইত্যাদি নানা বাহিনীর উপদ্রব ও উৎপীড়নে সাধারণ দেশবাসীর জীবন অতিষ্ঠ বলে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম থেকে জানা যায়। অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিশেষ কোনো দল-গোষ্ঠী, সম্প্রদায়-বর্ণ, পেশাজীবীর একক অবদান বা আত্মত্যাগের ফসল নয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠী নির্বিশেষে রাজনীতিবিদ-রাজনৈতিক নেতাকর্মী, চাষি, মজুর, কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, শিক্ষক, ছাত্র, কুলি, মজুর, মেথর তথা সর্বপেশা, সর্ব বয়স ও সর্বস্তরের আপামর বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদাতা ৩০ লাখ শহীদের মধ্যেও রয়েছেন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-উপজাতিসহ সকল বাঙালি-অবাঙালি। দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনেরাও ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে বাঙালি-অবাঙালি। স্বাধীনতাকামী প্রত্যেক বাঙালির বুকভরা প্রত্যাশা ছিল সব ধরনের বৈষম্য-অনাচার-বিচারহীনতার সংস্কৃতিমুক্ত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে একশ্রেণির তথাকথিত দেশপ্রেমিক সর্বভূক হায়েনার মতো সর্বগ্রাসী ক্ষুধা এবং অর্থবিত্ত কুক্ষিগত করার দুর্দমনীয় মোহে আবিষ্ট হওয়ায় দেশ ও জাতির যাবতীয় স্বপ্ন এবং আকাক্সক্ষা দুমড়ে-মুচড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বিহারিদের পরিত্যক্ত সম্পদ এবং সরকারি-বেসরকারি কোষাগার লুণ্ঠন, নদী-নালা-খাল-বিল দখলের মাধ্যমে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, এক সাগর বিসর্জিত রক্ত, মা-বোনের খোয়ানো সম্ভ্রম, মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বস্তর-পেশা ও বয়সী আপামর বাঙালির আত্মত্যাগ রাতারাতি বালির বাঁধের মতো হাওয়ায় মিশে গেছে। পরিণতিতে মনুষ্যত্ববোধ, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অপমৃত্যু হয়েছে এবং নতুন এক দানবীয় শক্তি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে কুক্ষিগত করেছে।
বিগত ৫২ বছরে এই দানবীয় শক্তির ধারক-বাহক-কথক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি আমলা-কামলা-স্বার্থান্বেষী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-লুণ্ঠন দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো পারিবারিক-সমাজ-রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। নৈতিকতার আদর্শবিবর্জিত উঠতি বয়সী যুবকেরা অন্যের অস্ত্রধারী মাস্তান-দেহরক্ষীতে পরিণত হয়েছে। গাঁজা-আফিম-ভাঙ-ইয়াবা ইত্যাদি নেশাজাতীয় পণ্যের রমরমা বাজার ইউনিয়ন-গ্রামগঞ্জ-হাটবাজার সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ, অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ইত্যাদি গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য সামাজিক-নৈতিক-মূল্যবোধের ভূমিধস অবক্ষয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির যূপকাষ্ঠে আত্মাহুতি দিয়েছে বললে সম্ভবত বাড়িয়ে বলা হবে না। তাই সামগ্রিক সাফল্য-ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণের মানদণ্ডে আর্টিকেলের শিরোনামের যৌক্তিকতা নির্ধারণের দায়িত্ব ঠিকানার পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করা হলো।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ১২ ডিসেম্বর ২০২৩।
১৯৭১ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ-দিনপঞ্জির হিসাবে দীর্ঘ ৫২ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে কিশোরদের ষাটোর্ধ্ব বয়সে; যুবকদের পলিতকেশ-অশীতিপর বুড়োর এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানকারীদের বেশির ভাগেরই নবতিপর বুড়োতে এবং সেক্টর কমান্ডারদের সিংহভাগেরই ইহলোকের পাট চুকিয়ে চিত্তগুপ্তের খতিয়ানে নাম লেখানোর বয়স বহু আগেই উতরে গেছে। আর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতা এবং একাত্তরের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যমণ্ডলীর ৯৫ শতাংশই সম্ভবত মরহুমের তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তাই ৫২তম শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং বিজয় দিবস উপলক্ষে নিহতদের আত্মার চিরপ্রশান্তি ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য কামনা এবং স্বজনহারাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ শতকের শেষ অধ্যায় এবং একুশ শতকের প্রথম অধ্যায়ে বিশ্বজুড়ে বহু রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ও ক্ষমতার হাতবদল ঘটেছে। মানুষের চিন্তাচেতনা ও রুচির জগতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঢেউ খেলে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষ সাধিত হওয়ায় গোটা বিশ্ব মানুষের হাতের মুঠোয় এসেছে। সাবেক কুর্নিশ ঠেকা পৃথিবীর ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট রাষ্ট্রগুলো গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে বিচরণ করছে এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহে বসতি স্থাপনের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।
অবশ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সভ্যতা ও মন-মানসিকতার ঈর্ষণীয় পরিবর্তনের ফলে মান্ধাতার আমলের অনেক অনাচার বর্তমানে সামাজিক ও ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়েছে। সনাতনী আমলের যৌথ পরিবারব্যবস্থা নির্বাসনে গেছে। ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু হয়েছে। সহজাত আবেগ-অনুভূতি-মমত্ববোধ-সামাজিক বন্ধন-পারিবারিক শৃঙ্খলাবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বহুলাংশে বিজ্ঞানের শাণিত যুক্তি-তর্কের অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়েছে। ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক-জাতীয় জীবনে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ সবকিছুকে বাস্তবতার কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করতে শিখেছে। গুরুজনদের হিতোপদেশ, ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সাবেক আমলের প্রথানুযায়ী বয়স্কদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করা, মানীর অপমান বজ্রাঘাততুল্য; সৎ উপায়ে জীবিকার্জন ইবাদততুল্য; অসহায়কে সাহায্য, সর্বহারা আশাহতকে প্রাণবন্ত করে তোলার প্রচেষ্টা ইত্যাদি জনবহুল প্রবাদ-প্রবচন পেশিশক্তির আশীর্বাদধন্য সমাজে পুরোপুরি বেমানান। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সেকেলে বিবেচনায় চরমভাবে উপেক্ষিতও বটে। সালাম-আদাব-কুশল বিনিময় বর্তমান সমাজ থেকে লজ্জায় পালিয়েছে বললে অতিশয়োক্তি হবে না।
পেশিশক্তির বর্তমান মগের মুল্লুকে সনাতনী আমলের সামাজিক লৌকিকতা ও শিষ্টাচার দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধ অর্থবিত্তের মালিক ও ক্ষমতার মদদপুষ্টরা আশরাফ-আতরাফ-বর্ষীয়ান-ন্যুব্জদেহ-কুব্জপৃষ্ঠ নির্বিশেষে সবার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে হরহামেশা ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে। দলীয় রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাবশালীদের বিশেষ আশীর্বাদধন্যরা বর্তমান সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা এবং সব ধরনের আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে। হাইব্রিডদের বাড়াবাড়ি ও দৌরাত্ম্যে ত্যাগী নেতাকর্মীরা রাজনীতির ময়দানে চরমভাবে কোণঠাসা, এমনকি দেশছাড়া বলেও মাঝে মাঝে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
অবশ্য বিগত ৫২ বছরে বাংলাদেশে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং অবকাঠামোগত অনেক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ, অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ইত্যাদি যুগান্তকারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সর্বমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসার্হ। নিরক্ষরতা নির্মূল এবং নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। তবে প্রকৃত শিক্ষিতের হার বেড়েছে কি কমেছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কারণ, শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার পোশাকি রূপে দেহ সুশোভিত করলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত শিক্ষিত বা ডিগ্রিধারী এবং ক্ষমতাসীনদের জীবনাচরণে মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধের ন্যূনতম নজির না মেলার ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। পত্রপত্রিকার সংবাদ অনুসারে, প্রাত্যহিক জীবনের নিত্য প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে নিরক্ষররা দায়ে ঠেকে চুরি-চামারির আশ্রয় নেয়। পক্ষান্তরে অর্থবিত্তের মোহাবিষ্ট উচ্চ ডিগ্রিধারী এবং প্রভাবশালী সম্প্রদায় প্রকল্প, মেগা প্রকল্প ইত্যাদি মুখরোচক বুলির আড়ালে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করে গোটা দেশ এবং দেশবাসীকে ঋণের সাগরে তলিয়ে দিচ্ছে।
যাহোক, বর্তমান বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা মুখরোচক ও জনবহুল শব্দটি হচ্ছে সিন্ডিকেট। তেল-লবণ, চিনি-গুড়, চাল-ডাল, রসুন-আদা-পেঁয়াজ, তরিতরকারি ইত্যাদি প্রাত্যহিক জীবনের অপরিহার্য সামগ্রীর সবকিছুর একক নিয়ন্ত্রক-ত্রাতা-ভাগ্যবিধাতা সিন্ডিকেট। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের চেয়ে সিন্ডিকেট অধিকতর প্রভাবশালী বলে সর্বসম্মুখে উচ্চারণ করেন মন্ত্রী-এমপিরা। আবার অনেকের মতে, সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে জনদুর্ভোগ তুঙ্গে ওঠা সত্ত্বেও দেশের নিরীহ আমজনতা সর্বংসহা বসুন্ধরার মতো সবকিছু নীরবে-নির্বিবাদে সহ্য করছে হরহামেশা। আবার সেই মান্ধাতার আমলের মাছে-ভাতে বাঙালি জনশ্রুতিটি আমাদের সমাজজীবন থেকে বহু আগেই বিদায় নিয়েছে। ৮০ টাকা ডিমের হালির বর্তমান বাজারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় ৯৫ শতাংশ বাঙালির নিকট ডিমও মহার্ঘে পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রতি গরুর মাংসের দর নিয়ে সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজির খবরে স্বদেশে ও বিদেশে বাঙালিদের কান ঝালাপালা হওয়ার উপক্রম হয়। তার ওপর রোজার আগেই বিশেষ সিন্ডিকেট চক্রের সক্রিয় তৎপরতার আগাম হুঁশিয়ারির বার্তায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
উল্লেখ্য, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই বিজিতদের পক্ষ থেকে ভোটে কারচুপি, পরবর্তীতে সূক্ষ্ম কারচুপি, পর্যায়ক্রমে কেন্দ্র দখল, এককভাবে সিল মারা, গুন্ডা-হুন্ডা-মাস্তানদের পেশিশক্তি প্রদর্শন, মিডিয়া ক্যু, দিনের ভোট রাতে নেওয়া ইত্যাদি নিত্যনতুন সংবাদ দেশবাসী এবং ভোটাররা শুনে আসছেন।
বর্তমানে প্রার্থী, ডামি প্রার্থী এবং নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের খবরাখবর কারও অজানা নয়। তাই সে ব্যাপারে আলোকপাত নেহাত অপাঙ্ক্তেয়। তবে ভোট সিন্ডিকেটের কোনো খবর অদ্যাবধি পত্রপত্রিকায় না মেলায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বিস্মিত। বাংলাদেশের ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক-পারিবারিক-ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের পটভূমিতে অন্যান্য সিন্ডিকেটের চেয়ে ভোট সিন্ডিকেটের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বললে সত্যের আদৌ অপলাপ হবে না। কায়ক্লেশে ভোট সিন্ডিকেট গড়ে তোলা গেলে জাতীয় জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ল্যাটা চুকে যাবে, মসনদ-কেন্দ্রিক হানাহানিও চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
সরকার, নির্বাচন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, বিরোধী রাজনৈতিক দল, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শিরঃপীড়াও রাতারাতি উপশম হয়ে যাবে। ভোট সিন্ডিকেটই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মতো ভোটের যাবতীয় কর্মকাণ্ড একচ্ছত্রভাবে নির্বাহ করবে। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির সংকট আঁচ করে সিন্ডিকেট চক্র আগেভাগে এলসি খুলে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো থেকে ভোট আমদানি করবে। আর ভোটার উপস্থিতি বেশি হলে পচা পেঁয়াজ, আদা-রসুন, মসলা, চিনি-লবণ ইত্যাদির মতো আমদানিকৃত বাড়তি ভোট বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের নদ-নদীর বানে ভাসিয়ে দেবে। আবার নিজেদের পছন্দের দলকে মসনদে বসাবে; প্রতিপক্ষকে ঠেঙিয়ে দেশছাড়া করবে। ফলে দেশজুড়ে শান্তি-সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। আর তথাকথিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের খোঁজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বাড়িঘরে অহর্নিশ হানা দিতে হবে না; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, নির্বাচন কমিশনকে নিত্যনতুন তথ্যের ফুলঝুড়ি ছড়াতে হবে না; ভিনদেশিদের রক্তচক্ষুর শাসানিরও সুযোগ থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অধিকন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সূক্ষ্ম কারচুপি, মিডিয়া ক্যু, কেন্দ্র দখল, দিনের ভোট রাতে দেওয়া ইত্যাদি অপবাদ/অভিশাপ থেকে দেশ-দশ-জাতি-রাজনীতিবিদেরাও মুক্তি পাবেন।
যাহোক, হাল আমলের উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের জীবনাচরণ থেকে বাপ-দাদা বা পূর্বপুরুষদের পরিচিতি বিদায় নিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট একুশ শতকের বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী প্রত্যেকে নিজদের বিশেষ দলের নেতাকর্মী, বিশেষ নেতা-নেত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তারা যথাসম্ভব নিজেদের কোনো বিশেষ দলের ওয়ার্ড-গ্রাম-অঞ্চল-শাখার সদস্য/কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছে। তবে সাময়িক দলীয় পরিচিতির মাধ্যমে যুবক-যুবতীরা বাহাদুরি জাহির করলেও বস্তুত এই প্রবণতা সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ডেকে আনছে বলে অভিজ্ঞ মহলের সুচিন্তিত অভিমত। এতে নিকট ভবিষ্যতে গোটা জাতি ছিন্নমূল-উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এদিকে লুঙ্গি বাহিনী, পাজামা বাহিনী, মলম বাহিনী, হাফপ্যান্ট বাহিনী, হেলমেট বাহিনী, টাইগার বাহিনী, গেরিলা বাহিনী, দানব বাহিনী, দৈত্য বাহিনী, নরখেকো বাহিনী, নৈশ বাহিনী ইত্যাদি নানা বাহিনীর উপদ্রব ও উৎপীড়নে সাধারণ দেশবাসীর জীবন অতিষ্ঠ বলে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম থেকে জানা যায়। অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিশেষ কোনো দল-গোষ্ঠী, সম্প্রদায়-বর্ণ, পেশাজীবীর একক অবদান বা আত্মত্যাগের ফসল নয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠী নির্বিশেষে রাজনীতিবিদ-রাজনৈতিক নেতাকর্মী, চাষি, মজুর, কৃষক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, শিক্ষক, ছাত্র, কুলি, মজুর, মেথর তথা সর্বপেশা, সর্ব বয়স ও সর্বস্তরের আপামর বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদাতা ৩০ লাখ শহীদের মধ্যেও রয়েছেন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-উপজাতিসহ সকল বাঙালি-অবাঙালি। দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনেরাও ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে বাঙালি-অবাঙালি। স্বাধীনতাকামী প্রত্যেক বাঙালির বুকভরা প্রত্যাশা ছিল সব ধরনের বৈষম্য-অনাচার-বিচারহীনতার সংস্কৃতিমুক্ত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে একশ্রেণির তথাকথিত দেশপ্রেমিক সর্বভূক হায়েনার মতো সর্বগ্রাসী ক্ষুধা এবং অর্থবিত্ত কুক্ষিগত করার দুর্দমনীয় মোহে আবিষ্ট হওয়ায় দেশ ও জাতির যাবতীয় স্বপ্ন এবং আকাক্সক্ষা দুমড়ে-মুচড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বিহারিদের পরিত্যক্ত সম্পদ এবং সরকারি-বেসরকারি কোষাগার লুণ্ঠন, নদী-নালা-খাল-বিল দখলের মাধ্যমে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, এক সাগর বিসর্জিত রক্ত, মা-বোনের খোয়ানো সম্ভ্রম, মুক্তিযোদ্ধা এবং সর্বস্তর-পেশা ও বয়সী আপামর বাঙালির আত্মত্যাগ রাতারাতি বালির বাঁধের মতো হাওয়ায় মিশে গেছে। পরিণতিতে মনুষ্যত্ববোধ, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অপমৃত্যু হয়েছে এবং নতুন এক দানবীয় শক্তি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে কুক্ষিগত করেছে।
বিগত ৫২ বছরে এই দানবীয় শক্তির ধারক-বাহক-কথক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি আমলা-কামলা-স্বার্থান্বেষী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-লুণ্ঠন দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো পারিবারিক-সমাজ-রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। নৈতিকতার আদর্শবিবর্জিত উঠতি বয়সী যুবকেরা অন্যের অস্ত্রধারী মাস্তান-দেহরক্ষীতে পরিণত হয়েছে। গাঁজা-আফিম-ভাঙ-ইয়াবা ইত্যাদি নেশাজাতীয় পণ্যের রমরমা বাজার ইউনিয়ন-গ্রামগঞ্জ-হাটবাজার সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ, অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ইত্যাদি গৌরবোজ্জ্বল সাফল্য সামাজিক-নৈতিক-মূল্যবোধের ভূমিধস অবক্ষয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির যূপকাষ্ঠে আত্মাহুতি দিয়েছে বললে সম্ভবত বাড়িয়ে বলা হবে না। তাই সামগ্রিক সাফল্য-ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণের মানদণ্ডে আর্টিকেলের শিরোনামের যৌক্তিকতা নির্ধারণের দায়িত্ব ঠিকানার পাঠকদের ওপর ন্যস্ত করা হলো।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ১২ ডিসেম্বর ২০২৩।