নকীব-ই-কিবরিয়া
কিছু দুর্লভ মুহূর্ত আর সেটা যদি ঐতিহাসিক সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার গৌরব হয়, সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। সিলেট শহরের জনমানবশূন্য রাস্তায় ঘোরাফেরার অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করব। আমরা থাকতাম সিলেট শহরের পশ্চিম প্রান্তে ভাতালিয়ায়। শান্ত এবং গ্রামীণ পরিবেশ। একটি মাত্র পাকা রাস্তা বা গলি যা-ই বলি, লামাবাজার থেকে ভাতালিয়ার ভেতর দিয়ে কাজল শা পর্যন্ত ছিল। কাজল শায় মেডিকেল কলেজের বিশাল দালানকোটা নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তখনো হাসপাতাল স্থানান্তরিত না হওয়ায় ভীষণ নীরব ও শান্ত ছিল ওই এলাকা। ভাতালিয়া মসজিদ ছিল বেশ বড় ও প্রাণবন্ত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আমল (অনুষ্ঠান) ছিল। বৃহস্পতিবার আসরের নামাজ পড়েই খোঁজারখোলার উদ্দেশে তাবলিগ জামাতের একদল রওনা হয়। খোঁজারখোলা ছিল সিলেটের তাবলিগ জামাতের মারকাজ বা প্রধান মসজিদ। সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে পলিটেকনিক কলেজের পাশেই ছিল ওই মসজিদ।
প্রতি বৃহস্পতিবার আসরের পর থেকে পরদিন শুক্রবার ফজরের পর পর্যন্ত ইজতেমা (অনুষ্ঠান) হতো। অনেকে বিছানা-বালিশ নিয়ে মসজিদে রাত থাকতেন আবার অনেকে এশার নামাজ পড়ে ঘরে ফিরতেন। ১০-১৫ জনের সেই জামাতের সঙ্গে আমিও খোঁজারখোলার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ছোটদের অর্থাৎ ১২-১৪ বছরের কেউ যাওয়ার অনুমতি শুধু তখনই মিলত, যদি সঙ্গে বড় কোনো অভিভাবক থাকেন। ওই জামাতের আমির হলেন আমার বড় চাচা ডাক্তার আনোয়ার আহমদ চৌধুরী। জকিগঞ্জে তার ক্লিনিক ও কর্মস্থল। বাসাও ছিল কুশিয়ারা নদীর পাশেই। নদীর ওই পারেই আসামের করিমগঞ্জ, যা কোনো এক সময় সিলেট জেলারই মহকুমা ছিল। ভারত ভাগের সময় গণভোটের মাধ্যমে আসামের সিলেট জেলা পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত হলেও রেড ক্লিফের কুশিয়ারা নদীকে সীমান্তরেখা টানায় করিমগঞ্জ মহকুমা শহরসহ বহু অংশ আসামেই রয়ে যায়। এ পারে নতুন থানা সৃষ্টি হয়, নাম হয় জকিগঞ্জ। পূর্বে এই এলাকার নাম ছিল ভরন। এই জকিগঞ্জ উপজেলাই বাংলাদেশের সর্ব পূর্ব-উত্তর উপজেলা। মানচিত্রে পাখির ঠোঁটের মতো দেখায়। যুদ্ধের কারণে চাচা সিলেটে আটকা পড়ায় ভাইবোনদের নিয়ে চাচি তার বাপের বাড়ি বালাউটে চলে যান।
যুদ্ধের তীব্রতার কারণে সিলেট শহরের দোকানপাট সবই বন্ধ, মাঝেমধ্যে এখানে-সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে মর্টার ও রকেট সেল এসে পড়ছিল। ভারতীয় যুদ্ধবিমান প্রায়ই আকাশে চক্কর দিত। নয়া সড়ক মসজিদের দক্ষিণ পাশেই ছিল খাজাঞ্চি বাড়ি, একটু উঁচু টিলার ওপর বড় এলাকা নিয়ে। এখানে ছিল কালো সালোয়ার-কামিজ পরা মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্প। ভারতীয় বিমান থেকে এখানে বোমা ফেলা হয়েছিল, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আরেকটু দক্ষিণে গিয়ে পড়ে বারুতখানায়, বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। মিরাবাজার মিশনের পুকুরের পূর্ব পাড়ে রাস্তার পাশে এক বাসার সামনের উঠানে পড়েছিল রকেট শেল, যা বিস্ফোরিত হয়নি, চারদিকে বালির বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল।
ভাতালিয়া মসজিদে সপ্তাহের প্রতিদিনই কোনো না কোনো আমল (কার্যক্রম) চলছিল। বিশেষ করে, বিকেলে আসরের নামাজের পর কোনো দিন সুরা ইয়াসিনের খতম, কোনো দিন লা ইলাহার খতম। সেদিন মঙ্গলবার ১৪ ডিসেম্বর ছিল দোয়ায়ে ইউনুসের খতম, খুবই গরম দোয়া। নবী ইউনুস (আ.) কে বিশাল তিমি গিলে ফেলেছিল, তখন তিনি এই দোয়া পড়েছিলেন। কয়েক হাজার বার পড়তে হয় এই দোয়া। তাই নুড়িপাথর নিয়ে আমরা পড়ছিলাম। হঠাৎ ধাম্ ম্ ম্ ম্, সিলেট শহর প্রকম্পিত করে বিকট শব্দ।
কেউ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল, কারও হাত থেকে পাথর ছিটকে পড়ল। মনে হচ্ছিল, মসজিদের পেছনেই বোমা ফেটেছে। সন্ধ্যার মধ্যেই খবর এল, সুরমার ওপর একমাত্র সেতু কিন ব্রিজ পাক বাহিনী তাদের নিরাপত্তার জন্য ভেঙে দিয়েছে। সেদিন রাতেই নদীর উত্তর পাড়ে দুবড়ির হাওরে হেলিকপ্টারে করে ভারতীয় প্যারাট্রুপ নামায়। সারা রাত ছিল হেলিকপ্টারের আনাগোনা। দুবড়ির হাওরে বর্ষায় পানি থাকলেও শীতকালে শুকিয়ে যেত, লোকজন চাষাবাদ করত। ১৯৭৮ সালে আমরা যখন এমসি কলেজে পড়ি, কলেজের পাশ দিয়ে পাহাড় কেটে মাটিভর্তি সারি সারি ট্রাকে দুবড়ির হাওর ভরাটের কাজ চলছিল। বর্তমানে ওই জায়গা উপশহর নামে পরিচিত।
১৯৭১ সালের মে মাসে আমরা যখন সিলেটে আসি, তখনো শহর স্বাভাবিক ছিল না, রাতের বেলায় কারফিউ থাকত। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর পর আমার বাবা প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এপ্রিলের শেষ দিকে পাক বাহিনী নোয়াখালী দখল করলে আমরা নৌকাযোগে সিলেটে চলে আসি। আমরা প্রাণে বাঁচলেও আমাদের সর্বস্ব লুট হয়ে যায়। সিলেট শহরের পূর্ব প্রান্তে আগপাড়া রায়নগরে আমাদের বাসা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তার কথা ভেবে শহরের পশ্চিম প্রান্তে ভাতালিয়ায় ভাড়াটিয়া বাসায় ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলাম। পড়ালেখা থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন থাকলেও জুন মাসে আমরা চার ভাইকে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। আমাদের স্কুলের পাশেই সিলেট সার্কিট হাউস। এখানে ছিল পাক বাহিনীর ক্যাম্প। একদিন স্কুল চলাকালীন ক্লাস থেকে সকল ছাত্রকে মাঠে এনে জড়ো করানো হলো।
কিছুক্ষণ পর প্রধান শিক্ষকসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিলেট অঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার আহমদ রানা এলেন। তিনি তার সদর দফতর মৌলভীবাজার থেকে তশরিফ এনেছেন। তার উর্দু বক্তৃতা আমাদের ধর্মশিক্ষার মৌলভি স্যার তরজমা করছিলেন। ন্যাড়া মাথা ভয়ে-লজ্জায় জীর্ণশীর্ণ। উপরের ক্লাসের সম্ভবত নবম শ্রেণির একজন ছাত্রকে আমাদের সামনে আনা হলো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, এই ছেলে, ব্ল্যাকবোর্ডে কে বাংলা জিন্দাবাদ, ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ লিখেছে, এটা কোনো সাচ্চা পাকিস্তানির কাজ হতে পারে না। সে তার ভুল বুঝেছে, মাফ চেয়েছে, বাচ্চা আদমি বলে তাকে মাফ করা হয়েছে। আমাদের সবাইকে সাচ্চা পাকিস্তানি হওয়ার নসিহত করে তিনি সভা (মিটিং) শেষ করলেন।
১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আসরের নামাজ পড়েই ভাতালিয়া থেকে বের হয়ে লামাবাজারে ডানে মোড় নিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে কাজির বাজারে খেয়া পার হয়েই ওপারে যাওয়া, এটাই সোজা পথ। কেউ একজন খবর দিলেন, ওপারে পলিটেকনিক কলেজে মুক্তিবাহিনী ঘাঁটি বানানোর কারণে নদীর ওপর খেয়া পারাপারসহ সবকিছুই বন্ধ। আমরা তখন মির্জাজঙ্গল-তালতলা হয়ে দিলশাদ সিনেমা হলের পাশ দিয়ে কোর্ট পয়েন্টের দিকে যেতে থাকি। আশপাশের বাড়িঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ। জনমানবশূন্য রাস্তাঘাট। তাবলিগ জামাতের নিয়ম অনুসারে এক লাইনে রাস্তার ডান পাশ ধরে হাঁটতে হয়। কোর্ট পয়েন্টের কাছে আসতেই লন্ডন ফটো স্টুডিউ ও মুসলিম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির তিন তলা বিল্ডিংয়ের সামনে ফুটপাতে ১০-১৫ জন পাক সেনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝখানে তাদের এক অফিসার। পরে কে একজন বলেছিলেন, এই সেই কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বাশারত, যে জগন্নাথপুরে শ্রী রামশ্রী (ছিরামিশি) গ্রামে স্কুলে সভার নামে ডেকে এনে বহু গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল।
আমরা সোজা রাস্তা পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে নদীর দিকে হাঁটতে লাগলাম। ট্রাফিক আইল্যান্ডের সঙ্গে লাগিয়ে সেনাবাহিনীর একটি জিপ ইটের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল, চার চাকা খুলে নেওয়া হয়েছে। দূরে হাছান মার্কেটে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উড়ছিল। নদীর কাছে এসে কোনো খেয়া তো দূরের কথা, কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই। সেতুর উত্তরের এক অংশ পানিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, যা দুই দিন আগে পাক বাহিনী ভেঙে দিয়েছে। আমরা ডানে ঘুরে নদীর পাড় ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ঘড়ির ঘর পার হয়ে কিছুদূর আসতেই জোরে ধমকের সুরে উর্দুতে কী বলছিল, ডানে ঘুরে দেখি ঘরের বারান্দায় পাঁচ-ছয়জন পাক সৈন্য নদীর দিকে মুখ করে বন্দুক উঁচিয়ে বসে আছে। তারা হাত উঁচিয়ে সরে যাওয়ার ইশারা করল। আমরাও জোরে হাঁটা শুরু করলাম। নদী পার হতে না পেরে এদিক-সেদিক ঘুরে সন্ধ্যার মধ্যে ভাতালিয়া মসজিদে ফিরে এলাম।
এদিকে ঢাকার রেসকোর্সের মাঠে বিকেলে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। সে সময় সিলেটে নদীর দক্ষিণ পাড় মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সিলেট শহর তখনো পাক বাহিনীর দখলে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার বিজয়ের আনন্দে সবাই বেরিয়ে এল। দেশ হলো স্বাধীন। আমরা পেলাম একটা মানচিত্র, স্বাধীন বাংলাদেশ। এই মানচিত্রই আমার পরিচয়। এটাই আমার স্বাধীনতা!!!
-কানাডা প্রবাসী
কিছু দুর্লভ মুহূর্ত আর সেটা যদি ঐতিহাসিক সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার গৌরব হয়, সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। সিলেট শহরের জনমানবশূন্য রাস্তায় ঘোরাফেরার অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করব। আমরা থাকতাম সিলেট শহরের পশ্চিম প্রান্তে ভাতালিয়ায়। শান্ত এবং গ্রামীণ পরিবেশ। একটি মাত্র পাকা রাস্তা বা গলি যা-ই বলি, লামাবাজার থেকে ভাতালিয়ার ভেতর দিয়ে কাজল শা পর্যন্ত ছিল। কাজল শায় মেডিকেল কলেজের বিশাল দালানকোটা নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তখনো হাসপাতাল স্থানান্তরিত না হওয়ায় ভীষণ নীরব ও শান্ত ছিল ওই এলাকা। ভাতালিয়া মসজিদ ছিল বেশ বড় ও প্রাণবন্ত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আমল (অনুষ্ঠান) ছিল। বৃহস্পতিবার আসরের নামাজ পড়েই খোঁজারখোলার উদ্দেশে তাবলিগ জামাতের একদল রওনা হয়। খোঁজারখোলা ছিল সিলেটের তাবলিগ জামাতের মারকাজ বা প্রধান মসজিদ। সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে পলিটেকনিক কলেজের পাশেই ছিল ওই মসজিদ।
প্রতি বৃহস্পতিবার আসরের পর থেকে পরদিন শুক্রবার ফজরের পর পর্যন্ত ইজতেমা (অনুষ্ঠান) হতো। অনেকে বিছানা-বালিশ নিয়ে মসজিদে রাত থাকতেন আবার অনেকে এশার নামাজ পড়ে ঘরে ফিরতেন। ১০-১৫ জনের সেই জামাতের সঙ্গে আমিও খোঁজারখোলার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ছোটদের অর্থাৎ ১২-১৪ বছরের কেউ যাওয়ার অনুমতি শুধু তখনই মিলত, যদি সঙ্গে বড় কোনো অভিভাবক থাকেন। ওই জামাতের আমির হলেন আমার বড় চাচা ডাক্তার আনোয়ার আহমদ চৌধুরী। জকিগঞ্জে তার ক্লিনিক ও কর্মস্থল। বাসাও ছিল কুশিয়ারা নদীর পাশেই। নদীর ওই পারেই আসামের করিমগঞ্জ, যা কোনো এক সময় সিলেট জেলারই মহকুমা ছিল। ভারত ভাগের সময় গণভোটের মাধ্যমে আসামের সিলেট জেলা পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত হলেও রেড ক্লিফের কুশিয়ারা নদীকে সীমান্তরেখা টানায় করিমগঞ্জ মহকুমা শহরসহ বহু অংশ আসামেই রয়ে যায়। এ পারে নতুন থানা সৃষ্টি হয়, নাম হয় জকিগঞ্জ। পূর্বে এই এলাকার নাম ছিল ভরন। এই জকিগঞ্জ উপজেলাই বাংলাদেশের সর্ব পূর্ব-উত্তর উপজেলা। মানচিত্রে পাখির ঠোঁটের মতো দেখায়। যুদ্ধের কারণে চাচা সিলেটে আটকা পড়ায় ভাইবোনদের নিয়ে চাচি তার বাপের বাড়ি বালাউটে চলে যান।
যুদ্ধের তীব্রতার কারণে সিলেট শহরের দোকানপাট সবই বন্ধ, মাঝেমধ্যে এখানে-সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে মর্টার ও রকেট সেল এসে পড়ছিল। ভারতীয় যুদ্ধবিমান প্রায়ই আকাশে চক্কর দিত। নয়া সড়ক মসজিদের দক্ষিণ পাশেই ছিল খাজাঞ্চি বাড়ি, একটু উঁচু টিলার ওপর বড় এলাকা নিয়ে। এখানে ছিল কালো সালোয়ার-কামিজ পরা মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্প। ভারতীয় বিমান থেকে এখানে বোমা ফেলা হয়েছিল, যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আরেকটু দক্ষিণে গিয়ে পড়ে বারুতখানায়, বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। মিরাবাজার মিশনের পুকুরের পূর্ব পাড়ে রাস্তার পাশে এক বাসার সামনের উঠানে পড়েছিল রকেট শেল, যা বিস্ফোরিত হয়নি, চারদিকে বালির বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল।
ভাতালিয়া মসজিদে সপ্তাহের প্রতিদিনই কোনো না কোনো আমল (কার্যক্রম) চলছিল। বিশেষ করে, বিকেলে আসরের নামাজের পর কোনো দিন সুরা ইয়াসিনের খতম, কোনো দিন লা ইলাহার খতম। সেদিন মঙ্গলবার ১৪ ডিসেম্বর ছিল দোয়ায়ে ইউনুসের খতম, খুবই গরম দোয়া। নবী ইউনুস (আ.) কে বিশাল তিমি গিলে ফেলেছিল, তখন তিনি এই দোয়া পড়েছিলেন। কয়েক হাজার বার পড়তে হয় এই দোয়া। তাই নুড়িপাথর নিয়ে আমরা পড়ছিলাম। হঠাৎ ধাম্ ম্ ম্ ম্, সিলেট শহর প্রকম্পিত করে বিকট শব্দ।
কেউ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল, কারও হাত থেকে পাথর ছিটকে পড়ল। মনে হচ্ছিল, মসজিদের পেছনেই বোমা ফেটেছে। সন্ধ্যার মধ্যেই খবর এল, সুরমার ওপর একমাত্র সেতু কিন ব্রিজ পাক বাহিনী তাদের নিরাপত্তার জন্য ভেঙে দিয়েছে। সেদিন রাতেই নদীর উত্তর পাড়ে দুবড়ির হাওরে হেলিকপ্টারে করে ভারতীয় প্যারাট্রুপ নামায়। সারা রাত ছিল হেলিকপ্টারের আনাগোনা। দুবড়ির হাওরে বর্ষায় পানি থাকলেও শীতকালে শুকিয়ে যেত, লোকজন চাষাবাদ করত। ১৯৭৮ সালে আমরা যখন এমসি কলেজে পড়ি, কলেজের পাশ দিয়ে পাহাড় কেটে মাটিভর্তি সারি সারি ট্রাকে দুবড়ির হাওর ভরাটের কাজ চলছিল। বর্তমানে ওই জায়গা উপশহর নামে পরিচিত।
১৯৭১ সালের মে মাসে আমরা যখন সিলেটে আসি, তখনো শহর স্বাভাবিক ছিল না, রাতের বেলায় কারফিউ থাকত। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর পর আমার বাবা প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এপ্রিলের শেষ দিকে পাক বাহিনী নোয়াখালী দখল করলে আমরা নৌকাযোগে সিলেটে চলে আসি। আমরা প্রাণে বাঁচলেও আমাদের সর্বস্ব লুট হয়ে যায়। সিলেট শহরের পূর্ব প্রান্তে আগপাড়া রায়নগরে আমাদের বাসা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তার কথা ভেবে শহরের পশ্চিম প্রান্তে ভাতালিয়ায় ভাড়াটিয়া বাসায় ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলাম। পড়ালেখা থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন থাকলেও জুন মাসে আমরা চার ভাইকে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। আমাদের স্কুলের পাশেই সিলেট সার্কিট হাউস। এখানে ছিল পাক বাহিনীর ক্যাম্প। একদিন স্কুল চলাকালীন ক্লাস থেকে সকল ছাত্রকে মাঠে এনে জড়ো করানো হলো।
কিছুক্ষণ পর প্রধান শিক্ষকসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিলেট অঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার আহমদ রানা এলেন। তিনি তার সদর দফতর মৌলভীবাজার থেকে তশরিফ এনেছেন। তার উর্দু বক্তৃতা আমাদের ধর্মশিক্ষার মৌলভি স্যার তরজমা করছিলেন। ন্যাড়া মাথা ভয়ে-লজ্জায় জীর্ণশীর্ণ। উপরের ক্লাসের সম্ভবত নবম শ্রেণির একজন ছাত্রকে আমাদের সামনে আনা হলো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, এই ছেলে, ব্ল্যাকবোর্ডে কে বাংলা জিন্দাবাদ, ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ লিখেছে, এটা কোনো সাচ্চা পাকিস্তানির কাজ হতে পারে না। সে তার ভুল বুঝেছে, মাফ চেয়েছে, বাচ্চা আদমি বলে তাকে মাফ করা হয়েছে। আমাদের সবাইকে সাচ্চা পাকিস্তানি হওয়ার নসিহত করে তিনি সভা (মিটিং) শেষ করলেন।
১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আসরের নামাজ পড়েই ভাতালিয়া থেকে বের হয়ে লামাবাজারে ডানে মোড় নিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে কাজির বাজারে খেয়া পার হয়েই ওপারে যাওয়া, এটাই সোজা পথ। কেউ একজন খবর দিলেন, ওপারে পলিটেকনিক কলেজে মুক্তিবাহিনী ঘাঁটি বানানোর কারণে নদীর ওপর খেয়া পারাপারসহ সবকিছুই বন্ধ। আমরা তখন মির্জাজঙ্গল-তালতলা হয়ে দিলশাদ সিনেমা হলের পাশ দিয়ে কোর্ট পয়েন্টের দিকে যেতে থাকি। আশপাশের বাড়িঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ। জনমানবশূন্য রাস্তাঘাট। তাবলিগ জামাতের নিয়ম অনুসারে এক লাইনে রাস্তার ডান পাশ ধরে হাঁটতে হয়। কোর্ট পয়েন্টের কাছে আসতেই লন্ডন ফটো স্টুডিউ ও মুসলিম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির তিন তলা বিল্ডিংয়ের সামনে ফুটপাতে ১০-১৫ জন পাক সেনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝখানে তাদের এক অফিসার। পরে কে একজন বলেছিলেন, এই সেই কুখ্যাত ক্যাপ্টেন বাশারত, যে জগন্নাথপুরে শ্রী রামশ্রী (ছিরামিশি) গ্রামে স্কুলে সভার নামে ডেকে এনে বহু গ্রামবাসীকে হত্যা করেছিল।
আমরা সোজা রাস্তা পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে নদীর দিকে হাঁটতে লাগলাম। ট্রাফিক আইল্যান্ডের সঙ্গে লাগিয়ে সেনাবাহিনীর একটি জিপ ইটের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল, চার চাকা খুলে নেওয়া হয়েছে। দূরে হাছান মার্কেটে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উড়ছিল। নদীর কাছে এসে কোনো খেয়া তো দূরের কথা, কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই। সেতুর উত্তরের এক অংশ পানিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, যা দুই দিন আগে পাক বাহিনী ভেঙে দিয়েছে। আমরা ডানে ঘুরে নদীর পাড় ধরে পশ্চিম দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ঘড়ির ঘর পার হয়ে কিছুদূর আসতেই জোরে ধমকের সুরে উর্দুতে কী বলছিল, ডানে ঘুরে দেখি ঘরের বারান্দায় পাঁচ-ছয়জন পাক সৈন্য নদীর দিকে মুখ করে বন্দুক উঁচিয়ে বসে আছে। তারা হাত উঁচিয়ে সরে যাওয়ার ইশারা করল। আমরাও জোরে হাঁটা শুরু করলাম। নদী পার হতে না পেরে এদিক-সেদিক ঘুরে সন্ধ্যার মধ্যে ভাতালিয়া মসজিদে ফিরে এলাম।
এদিকে ঢাকার রেসকোর্সের মাঠে বিকেলে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। সে সময় সিলেটে নদীর দক্ষিণ পাড় মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সিলেট শহর তখনো পাক বাহিনীর দখলে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার বিজয়ের আনন্দে সবাই বেরিয়ে এল। দেশ হলো স্বাধীন। আমরা পেলাম একটা মানচিত্র, স্বাধীন বাংলাদেশ। এই মানচিত্রই আমার পরিচয়। এটাই আমার স্বাধীনতা!!!
-কানাডা প্রবাসী