পাচার করা টাকা দেশে যাচ্ছে রেমিট্যান্স হিসেবে 

কালো টাকা সাদা করার ধুম

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ , অনলাইন ভার্সন
নির্বাচনের মওসুমে বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের ধুম লেগেছে। পাচার করা টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ‘চোখের পলকে’ অর্থাৎ মুহূর্তেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। পরে তা রেমিট্যান্স হয়ে আবার বাংলাদেশে যাচ্ছে। বলতে গেলে- দেশে অবৈধ উপায়ে উপার্জিত কালো টাকা বিদেশ ঘুরে দেশে ঢুকছে সাদা হয়ে, বৈধপথে। 
গেল নভেম্বর  মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। ওই তথ্য মতে, সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। গেল নভেম্বর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১ হাজার ৯৩০ মিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। প্রবাসীরা ২০২২ সালের নভেম্বরে দেশে ১ হাজার ৫৯৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন।
সর্বশেষ সংযোজনের ফলে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের (অর্থবছর-২৪) প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে দেশে মোট ৮ হাজার ৮১৪  মিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিট্যান্স গেছে। গত বছর এটি ছিল ৮ হাজার ৭৯৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকার অনাবাসী বাংলাদেশিদের (এনআরবি) দেশে অর্থ প্রেরণে উৎসাহিত করতে আইনসিদ্ধ চ্যানেলকে দ্রুত ও সহজ করার ব্যবস্থা নেওয়ায় দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু অন্যরা বলছেন, ডলারের দাম নির্ধারণে একপ্রকার তেলেসমাতি চলছে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি ডলারের দাম যেখানে নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দিচ্ছে ডলার প্রতি ১২২ টাকা ৫ পয়সা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে আরো বেশী। তবে অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা যেখানে আড়াই শতাংশ দিচ্ছে, সেখানে সরকারি ব্যাংক দিচ্ছে ৫ শতাংশ প্রণোদনা। ডলারের দামের এই তেলেসমাতির সুযোগে হুন্ডি ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। 
এদিকে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবাহ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় এখন যেসব প্রবাসী বৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের নজরে পড়েছেন। অনেকের রেমিট্যান্স আটকে রাখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা প্রবাসীদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি খুঁজতে শুরু করেছে। কানাডার মত যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে প্রবাসীদের আয় ও সম্পদের খোঁজ চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর (ইউএসসিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের শেষে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার। এর মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজারের কিছু বেশির। দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের খানাপিছু গড় বার্ষিক আয় ৬৮ হাজার ডলারের কিছু কম।
ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিস্টিকসের (্ইউএসবিএলএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২১ সালে মাথাপিছু গড় ব্যয় ছিল প্রায় ৬৭ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি উপার্জনকারীরা গোটা বছরজুড়ে আয় করেছেন দেশটির গড় ব্যয়ের চেয়ে সামান্য বেশি। এ হিসাব আমলে নিলে বাংলাদেশি পরিবারগুলোর উদ্বৃত্ত বা সঞ্চয়ও খুব বেশি হওয়ার কথা না। যদিও এ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিরাই এখন দেশের রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় উৎস।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক বাংলাদেশি প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে। যদিও সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বক্তব্য হলো প্রতি মাসে জীবনযাপনের ব্যয় বহন করে দেশে ২ হাজার ডলার পাঠানো বেশির ভাগ বাংলাদেশি প্রবাসীর পক্ষেই প্রায় অসম্ভব। তাহলে এত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে কারা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা জানতে পেরেছে, নতুন নতুন কিছু অ্যাকাউন্ট খুলে রেমিট্যান্স যাচ্ছে বাংলাদেশে। 
বাংলাদেশ থেকে কি পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে আসছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন বিনিয়োগ উৎস থেকে বৈধ পথেও অর্থ ঢুকছে যুক্তরাষ্ট্রে। অতীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠান বা শাখা খুলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে টাকা আনছে যুক্তরাষ্ট্রে। পরে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের দায়ভার নিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এরপর ওই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাচ্ছে। এভাবে নানা উপায়ে টাকা পাচার হয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রে।  
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সৌদি আরবে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন ৫৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি। এছাড়া দক্ষ পেশাজীবী হিসেবেও সেখানে অবস্থান করছেন আরো অনেকে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এ বিপুলসংখ্যক সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশির চেয়েও বেশি অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ সেখানে আছেন শিক্ষার্থী হিসাবে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি ও সেখানে বসবাসের খরচ বহন করে দেশে এত বিপুল অংকের অর্থ পাঠানো সম্ভব নয়। উপরন্তু দেশটিতে মূল্যস্ফীতি এখন প্রকট আকার নিয়েছে। এ মূল্যস্ফীতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সম্প্রতি আগ্রাসী মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে এসেছে। সে হিসেবে দেশটি থেকে এত বিপুল পরিমাণ অংক বাংলাদেশে রেমিট্যান্স হিসেবে আসার বিষয়টি বিস্ময়কর।
জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্সকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন বাংলাদেশের ব্যাংক নির্বাহীরা। দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে, সেটি দেখে তারা নিজেরাও বিস্মিত। হঠাৎ করে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটি বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ব্যাংকগুলো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে রেমিট্যান্স কিনে নেয়। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান কী প্রক্রিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ডলার কিনছে, সেটি জানা সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে হঠাৎ রেমিট্যান্স আসা বেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে ব্যাখ্যা করে পাচারের অর্থ রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফিরছে কিনা, এ প্রশ্ন তুলেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি সিপিডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটা একেবারেই আনইউজাল, কখনোই হয় না। কারণ, আমরা জানি আমাদের বেশিরভাগ রেমিট্যান্স মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে। গত ১০ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৯ দশমিক ২২ লাখ মানুষ গেছে। সেখান থেকে প্রত্যাশা মতো রেমিট্যান্স আসছে না। লোক যাওয়া ও রেমিট্যান্সের মধ্যে মিসম্যাচ হচ্ছে। এতদিন সৌদি আরব থেকে বেশি রেমিট্যান্স এলেও যুক্তরাষ্ট্র এখন সে জায়গা দখল করেছে। সিপিডি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সৌদি থেকে ৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩.০৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিকে সন্দেহের চোখে দেখছে সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যারা যায় তাদের বেশিরভাগই হোয়াইট কালার জব করে। অনেকেই ঘরবাড়ি ও জমিজমা বিক্রি করে দেশ থেকে টাকা নিয়ে চলে যায়। অনেক শিক্ষার্থীও সে দেশে আছে। তারা তো আর টাকা পাঠাতে পারে না। তাহলে বিপুল এ রেমিট্যান্স আসছে কোথা থেকে! তিনি বলেন, এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে এমন- যেখান থেকে টাকাটা পাচার হয়েছে সেটা আবার রেমিট্যান্স হয়ে দেশে ফেরত আসছে। রেমিট্যান্সের ওপর যে আড়াই শতাংশ ইনসেন্টিভ বা সাবসিডি দেয়া হচ্ছে সেটার সুযোগ নেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আরও গভীরে গিয়ে বিষয়টির অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

 
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041