টিমওয়ার্ক কথাটা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। ভালো কিছু করতে হলে টিমওয়ার্কের বিকল্প নেই-এই কথাও আমাদের বহুবার শোনা। এ কথা অতি সত্যি যে ভালো টিমওয়ার্ক করতে পারলে যেকোনো অসাধ্য সাধন করা যায়। অনেক কম দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা নিয়েও বড় বড় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া যায় শুধু ভালো টিমওয়ার্কের জোরে।
আজকের পৃথিবীতে যত বড় বড় কোম্পানি আর ব্র্যান্ড, যত ভালো ভালো স্পোর্টস ক্লাব আর টিম, যত শক্তিশালী সেনাবাহিনীÑসবই আসলে টিমওয়ার্কের অবদান। আপনিও যদি চান জীবনে অনেক বিশাল কিছু করতে, তবে আপনাকেও টিমওয়ার্ক সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখার পাশাপাশি ভালো একজন টিম মেম্বার হতে হবে। কিন্তু সত্যিকার টিমওয়ার্ক কী? এবং কীভাবে একজন যোগ্য টিম মেম্বার হওয়া যায়? আজ আমরা এটাই আপনাকে বলব।
টিমওয়ার্ক কী?
মনে করুন দুটি ফুটবল টিমের মধ্যে খেলা হচ্ছে। ‘ক’ আর ‘খ’। টিম ‘ক’ এর সবাই পায়ে বল পেলেই নিজে গোল দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের মধ্যে কোনো বোঝাপড়াই নেই। সবাই যেন নিজের জন্য খেলছে। আর ‘খ’ টিমের সবাই একটি নির্দিষ্ট ছকে খেলছে। একজন বল পেলে, যাকে দেওয়া দরকার তাকে পাস দিচ্ছে। কেউ বল পেলেই নিজে গিয়ে গোল দেওয়ার চেষ্টা করছে না। গোল করার পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় যে আছে, তার কাছে বলটি দিয়ে দিচ্ছে।
এখানে ‘খ’ টিম, টিমওয়ার্ক করে খেলছে।
সোজা কথায়, যখন কিছু মানুষ এক হয়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে কাজ করে, তাকেই টিমওয়ার্ক বলে।
আদর্শ টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে টিমের সদস্যরা নিজের লাভের চেয়ে টিমের লাভকে বেশি মূল্য দেন। ব্যক্তিগতভাবে ক্রেডিট নেওয়ার বদলে টিমের লক্ষ্যপূরণের জন্য কাজ করেন।
একটি ভালো টিমওয়ার্ক তখনই হয়, যখন টিমের প্রত্যেক সদস্য বা মেম্বার নিজের দায়িত্বে পুরোপুরি শতভাগ নিবেদিত থেকে ভালোভাবে নিজের কাজ করেন এবং অন্যদের কাজে সাহায্য করেন।
একটি টিমকে ভালো টিমওয়ার্ক করতে হলে টিম মেম্বারদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো থাকার পাশাপাশি কাজের স্বার্থে একজন আরেকজনকে সাহায্য করার মনোভাব থাকতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না।
টিমওয়ার্ক কেন প্রয়োজন?
স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের নাম তো আপনি নিশ্চয় শুনেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে সফল ও দামি ফুটবল ক্লাব এটি। ২০০০ সালের দিকে এই ক্লাবটি বিশ্বের সেরা সেরা সব ফুটবলারকে ভীষণ চড়া দাম দিয়ে কিনে নেয়। এক দলে এত তারকা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। সবাই তাদের ‘গ্যালাটিকোস’ বা নক্ষত্রপুঞ্জ বলে ডাকতে শুরু করে। মনে হচ্ছিল, এদের সামনে সব দল তুলার মতো উড়ে যাবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, একদম নিচু সারির দলের সঙ্গেও তারা ভালো খেলতে পারছে না। প্রথম কিছুদিন ভালো খেলে, পরে টানা তিন বছর তারা কোনো শিরোপা জিততে পারেনি। ১৯৫৩ সালের পর রিয়াল মাদ্রিদের এত বাজে সময় কাটেনি (দ্য গার্ডিয়ান)। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুপারস্টার খেলোয়াড় নিয়ে রিয়ালের ‘গ্যালাটিকোস’ টিম গড়া হয়েছিল।
আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কেন তারা ভালো খেলতে পারেনি। কারণ প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজের জন্য খেলছিল। জিদান, বেকহাম, রোনালদো, ফিগোদের যখন আপনি এক টিমে খেলাবেন, তখন সবাই নিজেকে নিজের মতো করে প্রমাণ করতে চাইবে, যদি না আপনি তাদের সেভাবে টিমওয়ার্ক শেখাতে পারেন।
টিম
আবার ২০০৫ সালে একবার অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পুরো বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া একাদশের খেলা হয়েছিল। বিশ্ব একাদশের সেই শোচনীয় পরাজয় ক্রিকেটভক্তরা আজও ভুলতে পারেনি। কিন্তু ধারেভারে বিশ্ব একাদশ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তারা ‘টিম’ ছিল না। টিমের মেম্বাররা যতই দক্ষ, অভিজ্ঞ আর সেরা হোক না কেন, তারা যদি টিমওয়ার্ক না করতে পারে, তবে তাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না।
বিশ্ববিখ্যাত লেখক ও পারফরম্যান্স ও লিডারশিপ কোচ সাইমন সিনেক তার এক ইন্টারভিউয়ে এলিট ফোর্স ‘নেভি সিল’দের কথা বলেছিলেন। আমরা মনে করি, সবচেয়ে সেরা আর সাহসী যোদ্ধাদের দিয়ে এলিট ফোর্স তৈরি হয় কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম কিছুই নয়। সাইমন সিনেক বলেন, আপনি যতই দক্ষ, সাহসী আর চৌকস যোদ্ধা হন না কেন, নেভি সিলে আপনাকে নেওয়া হবে না, যদি আপনি নিজের স্বার্থ ভুলে টিম মেম্বারদের জন্য কাজ করতে না পারেন। এলিট ফোর্সে সেই সব লোকদেরই নেওয়া হয়, যারা অন্যের জন্য আর টিমের মিশনের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে।
এলিট ফোর্সগুলো আসলে স্পেশাল অপারেশন টিম। সবচেয়ে জটিল আর বিপজ্জনক অপারেশনের জন্য এই টিমগুলো সাজানো হয়। আর সেরা টিম মেম্বারদেরই এসব টিমে নেওয়া হয়। যাদের সেরা যোগ্যতা হয় একজন ভালো টিম মেম্বার হওয়া।
কাজেই একটি টিম কত ভালো করবে, তা টিম মেম্বারদের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার চেয়ে তাদের টিমওয়ার্ক করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। টিম মেম্বাররা যখন নিজের স্বার্থ ভুলে টিমের লক্ষ্যপূরণের জন্য এক হয়ে কাজ করে, তখন অনেক বাঘা বাঘা লোক নিয়ে গড়া টিমও তাদের সামনে টিকতে পারে না।
অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান (গুগলসহ) ভালো টিমওয়ার্ক করার ক্ষমতাকে একজন কর্মীর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হিসেবে দেখে। বর্তমান যুগে আপনি চাকরিক্ষেত্রে সেরা হতে চান, অথবা ব্যবসাক্ষেত্রে টপ হতে চান, আপনাকে টিমওয়ার্ক কী এটা জানার পাশাপাশি ভালো টিম মেম্বার কীভাবে হতে হয়, তাও জানতে হবে।
একজন যোগ্য টিম মেম্বার হওয়ার ১০টি প্র্যাকটিস
টিমওয়ার্কে দক্ষ হতে গেলে আপনাকে অবশ্যই একজন যোগ্য টিম মেম্বার হতে হবে। আপনি কাজে যতই দক্ষ আর অভিজ্ঞ হন, টিমওয়ার্কের জন্য আপনাকে আলাদা কিছু বিষয় রপ্ত করতে হবে। আর সেগুলো রপ্ত করার জন্য কিছু প্র্যাকটিস রয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে এই প্র্যাকটিসগুলো করলে আপনি একজন সত্যিকার যোগ্য টিম প্লেয়ার হয়ে উঠবেন।
চলুন তাহলে জেনে নিই বিশ্বখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট ম্যাগাজিন ‘লাইফহ্যাক’ এর নির্দেশিত যোগ্য টিম মেম্বার হওয়ার ১০টি প্র্যাকটিস :
১. নিজের সময়ের পাশাপাশি অন্যদের সময়েরও মূল্য দিন
সোজা বাংলায় নিজের সময়কে যেভাবে মূল্য দেন, অন্যের সময়কেও সেভাবেই মূল্য দেবেন। টিমওয়ার্কের সময়ে প্রত্যেক টিম মেম্বারের আলাদা দায়িত্ব থাকে এবং প্রতিটি কাজের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে।
মনে করুন, আপনার টিম একটি মোবাইল ফোন বানাচ্ছে। মোবাইল ফোনের আলাদা পার্ট আলাদা মেম্বার বানাচ্ছেন। আপনাদেরকে ১০ দিনের মধ্যে কাজটি শেষ করতে হবে। এখন আপনার হয়তো দায়িত্ব মোবাইলের স্ক্রিনটি বানানো। আপনি যতক্ষণ স্ক্রিন বানাতে না পারছেন, ততক্ষণ আপনার যে টিমমেট মোবাইলের অ্যাপ টেস্ট করবে, সে কাজ শুরু করতে পারছে না।
এখন আপনি যদি শুধু নিজের দিকটা চিন্তা করে যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব, তারচেয়ে ধীর গতিতে কাজ করেন, তাহলে আপনার ওই টিমমেট তার কাজ করার জন্য সময় কম পাবে। এবং তার ফলে পুরো কাজটিই দেখা গেল শেষ পর্যন্ত ভালো হলো না। তাই নিজের সময়ের পাশাপাশি অন্যদের সময়ের দিকে খেয়াল রেখে কাজ করুন। সব সময় চেষ্টা করুন সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো আউটপুটটি দিতে। কিন্তু তাই বলে তাড়াহুড়ো করতে যাবেন না। নিজের সেরাটাও আপনাকে দিতে হবে। পুরো বিষয়টিকে যদি ব্যালেন্স করে কাজ করতে পারেন, তাহলে পুরো টিমের আউটপুট অনেক ভালো হবে।
২. সোশ্যাল মিডিয়ায় সাবধান থাকুন
বর্তমান যুগের কালচারে একটি টিমের মেম্বাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন আরেকজনের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকবেনÑএটা খুবই স্বাভাবিক।
অনেক টিমে কাজ শুরুর আগে বা পরে টিম মেম্বাররা নিজেদের সোশ্যাল প্রোফাইল বিনিময় করেন। পরস্পরের পোস্টে লাইক-কমেন্ট করেন, মাঝে মাঝে চ্যাট করেনÑএগুলো দোষের কিছু নয়। কিন্তু এখানে সাবধানও থাকতে হবে। আগেই বলেছি, একজন যোগ্য টিম মেম্বার হতে গেলে টিমের কাজ ও লক্ষ্যকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো টিম মেম্বারের সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না, বা এমন কমেন্ট করা যাবে না, যাতে করে সম্পর্ক নষ্ট হয় বা কাজের সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রফেশনাল অ্যাটিচিউড বজায় রাখতে হবে। টিম মেম্বারদের মাঝে যদি সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তবে টিমের কাজের পরিবেশ নষ্ট হবে। কাজেই কোনো কমেন্ট করার আগে, বা চ্যাটে কিছু লেখার আগে অবশ্যই ভালো করে ভেবে নিয়ে তারপর কাজটি করুন।
৩. কমিউনিকেশনে স্পষ্টতা নিশ্চিত করুন
যখন একটি টিম এক হয়ে কাজ করে, তখন তাদের ভেতরে ক্লিয়ার কমিউনিকেশন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে, কোনো নতুন টিমে ভালো টিমওয়ার্ক করার জন্য টিম মেম্বারদের মধ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই।
ক্লিয়ার বা স্পষ্ট কমিউনিকেশন মানে, সবাই সবার কথা ও নির্দেশ ঠিকমতো বুঝতে পারা।
টিমওয়ার্ক
আপনি যখন কোনো টিমের মেম্বার হিসেবে কাজ করবেন, তখন অবশ্যই অন্যদের কথা ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে টিমের অন্য মেম্বারদের কাজের ধরন, তাদের অভ্যাস ও মনোভাব ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করবেন। এতে করে তাদের সঙ্গে কমিউনিকেশন করতে আপনার অনেক বেশি সুবিধা হবে।
কোনো কিছু পুরোপুরি না বুঝলে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করবেন না। তাতে শেষে গিয়ে কাজের ক্ষতি হবে। সেই সঙ্গে অন্যরাও আপনার কথা আসলেই বুঝতে পারছে কি না, তা ভালোমতো নিশ্চিত হোন। বিশেষ করে, নতুন টিম মেম্বারদের টিমের কালচার ও কাজের ধরন এবং প্রত্যেক টিম মেম্বার সম্পর্কে ভালো করে ধারণা দিন। বিশেষ করে, টিম লিডারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো এমনভাবে নির্দেশনা দেওয়া, যাতে সবাই স্পষ্ট করে তা বুঝতে পারে। দরকার হলে প্রত্যেক মেম্বারকে আলাদা করে বোঝাতে হবে।
একটি টিমে ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে আর্টিস্ট পর্যন্ত থাকতে পারে। সবার আলাদা দর্শন ও শিক্ষা থাকলেও ভালো টিম মেম্বার হতে হলে অন্যের দর্শন ও মনোভাব বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আবার যে বোঝাচ্ছে, তাকেও অন্যদের জন্য সহজ করে বোঝাতে হবে।
৪. মতামতের গুরুত্ব দিন
টিমওয়ার্কের সবচেয়ে বড় একটি সুবিধা হচ্ছে যেকোনো কাজের সময় কাজটি কেমন হয়েছে সে বিষয়ে অন্যের মতামত পাওয়া যায়। কিন্তু খুব কম মানুষই এই সুবিধাটি নিতে পারেন। টপ লেভেলের যোগ্যতাসম্পন্ন টিম মেম্বাররা এই বিষয়টির সুবিধা নিতে পারেন।
ইগো দূরে ঠেলে টিমের অন্য মেম্বারদের আপনার কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন। তাদের আইডিয়া ও পরামর্শ চান এবং তারা কোনো মতামত দিলে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করুন।
টিমে বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকায় তাদের বিভিন্ন মত থাকতে পারে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, অন্যরা যখন আপনার কাছে ফিডব্যাক চাইবে, আপনিও খোলামনে তাদের ফিডব্যাক দেবেন। কিন্তু কখনোই বিরূপ সমালোচনা করবেন না।
‘এটা ভালো হয়নি’, ‘এতে কাজ হবে না’Ñএ ধরনের কথার বদলে ইতিবাচক কথা, যেমন ‘এটা এভাবে করলে মনে হয় আরও সুন্দর হবে’, ‘ভালো হয়েছে, আরও ভালো করতে এটা ট্রাই করতে পারেন’Ñএভাবে কথার মধ্যে হালকা প্রশংসা রেখে তারপর পরামর্শ দিন। এতে করে আপনার পরামর্শ আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
৫. সম্পর্ক ভালো করতে শুভেচ্ছা বিনিময় করুন
২ নম্বর পয়েন্টে বলেছিলাম, প্রফেশনাল সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, এমন সম্ভাবনা দেখলেই সাবধান হয়ে যান। অন্যদিকে প্রফেশনাল সম্পর্ক ভালো করার যেকোনো সুযোগ লুফে নিন। প্রতিদিন অন্তত দুবার আপনার সামনে এই সুযোগ আসবে। একবার কাজের জায়গায় আসার সময়ে, আর দ্বিতীয় বার কাজ থেকে বের হওয়ার সময়ে। প্রথমবার হাসিমুখে ওয়েলকাম জানান, ও যাওয়ার সময় সুন্দর করে বিদায় জানান। কেউ নিজে বা তার কাছের কেউ অসুস্থ হলে খোঁজখবর নিন। সমবেদনা জানান।
অনেকে মনে করেন, প্রফেশনাল অ্যাটিচিউড মানে গম্ভীর মুখে শুধু কাজ করে যাওয়া। ব্যাপারটি মোটেই সে রকম নয়। টিম মেম্বাররা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে, ও তাদের মাঝে একটি ভালো সম্পর্ক থাকলে কাজ অনেক ভালো হয়। শুধু সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মতো বা অতি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এড়িয়ে গেলেই হলো।
৬. নিজেকে সব সময় উন্নত করার চেষ্টা করুন
যখন একটি টিমের মেম্বার হিসেবে কাজ করবেন, তখন মাঝে মাঝেই হয়তো আপনার অন্যদের সাহায্য ও পরামর্শ দরকার হবে এবং ভালো টিম মেম্বাররা অবশ্যই একে অপরকে সাহায্য করবে।
আপনাকে সাহায্য করা যেমন অন্য টিম মেম্বারদের দায়িত্ব, তেমনি সাহায্য চাওয়ার পরিমাণ একদম কম পর্যায়ে রাখাটা আপনার দায়িত্ব। একই ব্যাপারে যখন আপনি বারবার টিমমেটদের সাহায্য চাইবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটা সময়ে তারা বিরক্ত হবেন এবং একজন ভালো টিম মেম্বার হিসেবে সেটা করা।
এর সমাধান হচ্ছে, কাজ করতে গিয়ে যেখানেই বাধবেন, প্রথমবার অন্যদের সাহায্য নিন। কিন্তু সাহায্য নেওয়ার পাশাপাশি নিজেও জিনিসটি ভালো করে শিখে নিন। যদি অন্য টিমমেটের কাছ থেকে তখন শিখে নিতে পারেন, সেটা খুব ভালো হয়। অথবা ইন্টারনেট, বই ইত্যাদি থেকে বিষয়টি ভালো করে শিখে নিন। এতে করে আপনি যেমন টিম মেম্বারদের কাছে ভালো হয়ে উঠবেন, নিজের কাজের ক্ষেত্রেও আপনার দক্ষতা বাড়তে থাকবে।
৭. সবাইকে সমানভাবে দেখুন ও সবার সঙ্গে সমান আচরণ করুন
একজন যোগ্য টিম মেম্বারের সবচেয়ে বড় গুণ এটি। আপনার টিমমেটদের মাঝে কখনোই তুলনা করতে যাবেন না। অন্য টিম মেম্বাররা যদি কাউকে নিয়ে আলোচনা করে, বা দুজনের মধ্যে তুলনা করে, তবে সেই আলোচনায় অংশ না নেওয়ার পাশাপাশি সেই আলোচনা থামানোর চেষ্টা করুন। যখনই টিমের একজনের সঙ্গে আরেকজনের তুলনা হবে, তখনই বুঝবেন টিমের বারোটা বেজে যাচ্ছে।
আপনি যদি ‘ক’ আর ‘খ’ এর সঙ্গে দুই রকম আচরণ করেন, তাহলে টিমের ব্যালেন্স নষ্ট হবে। ‘ক’ কে যদি বেশি গুরুত্ব দেন, তবে ‘খ’ এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তো খারাপ হবেই, সেই সঙ্গে ‘ক’ এর সঙ্গে ‘খ’ এর সম্পর্ক অবশ্যই খারাপ হয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে টিমের কাজ নষ্ট হবে। একজন যোগ্য টিম মেম্বার হিসেবে তাই আপনার উচিত হবে সবাইকে সমান চোখে দেখা এবং এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা থামানোর চেষ্টা করা।
এখানে আরেকটা জিনিস অবশ্যই মাথায় রাখবেন, আপনি হয়তো কাউকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না। কিন্তু টিমে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন, সেই লোকটি টিমে আছে। একজন যোগ্য ও ভালো টিম মেম্বার হিসেবে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে কাজের ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দেবেন না। অবশ্যই কাজকে আগে রাখবেন। কাজের দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বিচার করবেন। একজনকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না বলে যদি তার ভালো কাজেও দোষ খোঁজার চেষ্টা করেন, তবে টিমওয়ার্কের যোগ্যতা আপনার এখনো হয়নি। তাই আদর্শ টিম মেম্বার হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে ওঠার প্র্যাকটিস শুরু করুন।
৮. ভুল হলে স্বীকার করুন
যদি এমন একজন মানুষ দেখেন, যার কোনো বন্ধু নেই, তাহলে ৯৯% নিশ্চিত হতে পারেন যে মানুষটি কোনো সময়েই নিজের ভুল স্বীকার করে না। এ ধরনের মানুষের সঙ্গে কেউ কাজ করতে চায় না। আপনি যদি একজন সত্যিকারের যোগ্য টিম মেম্বার হতে চান, তবে অবশ্যই ভুল হলে স্বীকার করা শিখুন। ভুল যে কারও হতে পারে এবং ভুল স্বীকার করে তা শোধরানোর চেষ্টা করলে তা সবাই মেনে নেয়। কিন্তু যদি ভুল স্বীকার না করেন, অথবা অন্যের ওপর দোষ চাপাতে চেষ্টা করেন, তাহলে টিমওয়ার্ক আপনার জন্য নয়।
৯. একদম অপারগ না হলে নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাবেন না
একটি টিম যদি যোগ্য টিম মেম্বার দিয়ে গড়া হয় এবং তারা যদি আসলেই ভালো টিমওয়ার্ক করে, তবে অবশ্যই তারা একে অন্যকে সাহায্য করবে। কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে যদি কেউ নিজের কাজ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে থাকে, তাহলে তাকে কোনোভাবেই যোগ্য টিম মেম্বারের কাজ বলা যায় না।
একজন যোগ্য টিম মেম্বার হিসেবে আপনাকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করতে হবে। আপনার সামর্থ্য ও মেধার পুরোটা দিয়ে কাজ করার পর যদি কোনো জায়গায় আটকে যান, শুধু তখনই অন্যের কাছে সাহায্য চাইবেন। আর সেটাও মাত্র একবারের জন্য, কারণ কাজটি পরে আপনাকে শিখে নিতে হবে (*৬ নম্বর পয়েন্ট)।
১০. নিজের কাজ শেষে অন্যকে সাহায্য অফার করুন
প্রথমেই বলেছি, যোগ্য টিম মেম্বার টিমের সাফল্যের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে কাজ করে। এমন হতে পারে, আপনার অংশ আপনি বেশ আগে করে ফেলেছেন এবং হাতে কিছু ফ্রি টাইম আছে। ভালো টিম মেম্বার হিসেবে আপনার কাজ হবে, অন্যদের কাজে সাহায্য অফার করা, যাতে করে কাজ আরও দ্রুত ও ভালো হয়। নিজেকে ব্যক্তি না ভেবে একটি ইউনিটের অংশ ভাবতে হবে।
শেষ কথা
যেকোনো কাজে সাফল্যের জন্য ভালো টিমওয়ার্কের বিকল্প নেই। এই ১০টি প্র্যাকটিস যদি একজন মানুষ করে, তবে ধীরে ধীরে সে একজন ভালো টিম মেম্বার হয়ে উঠবে। আপনার মাঝে হয়তো ইতিমধ্যেই এই গুণগুলোর সব না থাকলেও বেশির ভাগই আছে। কোন প্র্যাকটিসগুলো আপনি ইতিমধ্যে করেন এবং কোনগুলো করেন না, তা ভেবে বের করুন এবং যেগুলো করেন না, সেগুলো করতে শুরু করুন। আপনার টিমের অন্যদেরও এগুলো প্র্যাকটিস করতে উৎসাহ দিন।
আমার লেখা আপনাদের যদি ভালো লাগে, তবেই আমি সার্থক। আর যদি মনে হয় লেখাটি পড়ে অন্যরা উপকৃত হবেন, তবে তাদের জানিয়ে দিন।
আজকের পৃথিবীতে যত বড় বড় কোম্পানি আর ব্র্যান্ড, যত ভালো ভালো স্পোর্টস ক্লাব আর টিম, যত শক্তিশালী সেনাবাহিনীÑসবই আসলে টিমওয়ার্কের অবদান। আপনিও যদি চান জীবনে অনেক বিশাল কিছু করতে, তবে আপনাকেও টিমওয়ার্ক সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখার পাশাপাশি ভালো একজন টিম মেম্বার হতে হবে। কিন্তু সত্যিকার টিমওয়ার্ক কী? এবং কীভাবে একজন যোগ্য টিম মেম্বার হওয়া যায়? আজ আমরা এটাই আপনাকে বলব।
টিমওয়ার্ক কী?
মনে করুন দুটি ফুটবল টিমের মধ্যে খেলা হচ্ছে। ‘ক’ আর ‘খ’। টিম ‘ক’ এর সবাই পায়ে বল পেলেই নিজে গোল দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেদের মধ্যে কোনো বোঝাপড়াই নেই। সবাই যেন নিজের জন্য খেলছে। আর ‘খ’ টিমের সবাই একটি নির্দিষ্ট ছকে খেলছে। একজন বল পেলে, যাকে দেওয়া দরকার তাকে পাস দিচ্ছে। কেউ বল পেলেই নিজে গিয়ে গোল দেওয়ার চেষ্টা করছে না। গোল করার পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় যে আছে, তার কাছে বলটি দিয়ে দিচ্ছে।
এখানে ‘খ’ টিম, টিমওয়ার্ক করে খেলছে।
সোজা কথায়, যখন কিছু মানুষ এক হয়ে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে কাজ করে, তাকেই টিমওয়ার্ক বলে।
আদর্শ টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে টিমের সদস্যরা নিজের লাভের চেয়ে টিমের লাভকে বেশি মূল্য দেন। ব্যক্তিগতভাবে ক্রেডিট নেওয়ার বদলে টিমের লক্ষ্যপূরণের জন্য কাজ করেন।
একটি ভালো টিমওয়ার্ক তখনই হয়, যখন টিমের প্রত্যেক সদস্য বা মেম্বার নিজের দায়িত্বে পুরোপুরি শতভাগ নিবেদিত থেকে ভালোভাবে নিজের কাজ করেন এবং অন্যদের কাজে সাহায্য করেন।
একটি টিমকে ভালো টিমওয়ার্ক করতে হলে টিম মেম্বারদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো থাকার পাশাপাশি কাজের স্বার্থে একজন আরেকজনকে সাহায্য করার মনোভাব থাকতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না।
টিমওয়ার্ক কেন প্রয়োজন?
স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের নাম তো আপনি নিশ্চয় শুনেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে সফল ও দামি ফুটবল ক্লাব এটি। ২০০০ সালের দিকে এই ক্লাবটি বিশ্বের সেরা সেরা সব ফুটবলারকে ভীষণ চড়া দাম দিয়ে কিনে নেয়। এক দলে এত তারকা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। সবাই তাদের ‘গ্যালাটিকোস’ বা নক্ষত্রপুঞ্জ বলে ডাকতে শুরু করে। মনে হচ্ছিল, এদের সামনে সব দল তুলার মতো উড়ে যাবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, একদম নিচু সারির দলের সঙ্গেও তারা ভালো খেলতে পারছে না। প্রথম কিছুদিন ভালো খেলে, পরে টানা তিন বছর তারা কোনো শিরোপা জিততে পারেনি। ১৯৫৩ সালের পর রিয়াল মাদ্রিদের এত বাজে সময় কাটেনি (দ্য গার্ডিয়ান)। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুপারস্টার খেলোয়াড় নিয়ে রিয়ালের ‘গ্যালাটিকোস’ টিম গড়া হয়েছিল।
আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কেন তারা ভালো খেলতে পারেনি। কারণ প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজের জন্য খেলছিল। জিদান, বেকহাম, রোনালদো, ফিগোদের যখন আপনি এক টিমে খেলাবেন, তখন সবাই নিজেকে নিজের মতো করে প্রমাণ করতে চাইবে, যদি না আপনি তাদের সেভাবে টিমওয়ার্ক শেখাতে পারেন।
টিম
আবার ২০০৫ সালে একবার অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পুরো বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া একাদশের খেলা হয়েছিল। বিশ্ব একাদশের সেই শোচনীয় পরাজয় ক্রিকেটভক্তরা আজও ভুলতে পারেনি। কিন্তু ধারেভারে বিশ্ব একাদশ অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিল। কিন্তু তারা ‘টিম’ ছিল না। টিমের মেম্বাররা যতই দক্ষ, অভিজ্ঞ আর সেরা হোক না কেন, তারা যদি টিমওয়ার্ক না করতে পারে, তবে তাদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না।
বিশ্ববিখ্যাত লেখক ও পারফরম্যান্স ও লিডারশিপ কোচ সাইমন সিনেক তার এক ইন্টারভিউয়ে এলিট ফোর্স ‘নেভি সিল’দের কথা বলেছিলেন। আমরা মনে করি, সবচেয়ে সেরা আর সাহসী যোদ্ধাদের দিয়ে এলিট ফোর্স তৈরি হয় কিন্তু ব্যাপারটা সে রকম কিছুই নয়। সাইমন সিনেক বলেন, আপনি যতই দক্ষ, সাহসী আর চৌকস যোদ্ধা হন না কেন, নেভি সিলে আপনাকে নেওয়া হবে না, যদি আপনি নিজের স্বার্থ ভুলে টিম মেম্বারদের জন্য কাজ করতে না পারেন। এলিট ফোর্সে সেই সব লোকদেরই নেওয়া হয়, যারা অন্যের জন্য আর টিমের মিশনের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারে।
এলিট ফোর্সগুলো আসলে স্পেশাল অপারেশন টিম। সবচেয়ে জটিল আর বিপজ্জনক অপারেশনের জন্য এই টিমগুলো সাজানো হয়। আর সেরা টিম মেম্বারদেরই এসব টিমে নেওয়া হয়। যাদের সেরা যোগ্যতা হয় একজন ভালো টিম মেম্বার হওয়া।
কাজেই একটি টিম কত ভালো করবে, তা টিম মেম্বারদের দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার চেয়ে তাদের টিমওয়ার্ক করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। টিম মেম্বাররা যখন নিজের স্বার্থ ভুলে টিমের লক্ষ্যপূরণের জন্য এক হয়ে কাজ করে, তখন অনেক বাঘা বাঘা লোক নিয়ে গড়া টিমও তাদের সামনে টিকতে পারে না।
অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান (গুগলসহ) ভালো টিমওয়ার্ক করার ক্ষমতাকে একজন কর্মীর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হিসেবে দেখে। বর্তমান যুগে আপনি চাকরিক্ষেত্রে সেরা হতে চান, অথবা ব্যবসাক্ষেত্রে টপ হতে চান, আপনাকে টিমওয়ার্ক কী এটা জানার পাশাপাশি ভালো টিম মেম্বার কীভাবে হতে হয়, তাও জানতে হবে।
একজন যোগ্য টিম মেম্বার হওয়ার ১০টি প্র্যাকটিস
টিমওয়ার্কে দক্ষ হতে গেলে আপনাকে অবশ্যই একজন যোগ্য টিম মেম্বার হতে হবে। আপনি কাজে যতই দক্ষ আর অভিজ্ঞ হন, টিমওয়ার্কের জন্য আপনাকে আলাদা কিছু বিষয় রপ্ত করতে হবে। আর সেগুলো রপ্ত করার জন্য কিছু প্র্যাকটিস রয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে এই প্র্যাকটিসগুলো করলে আপনি একজন সত্যিকার যোগ্য টিম প্লেয়ার হয়ে উঠবেন।
চলুন তাহলে জেনে নিই বিশ্বখ্যাত সেলফ ডেভেলপমেন্ট ম্যাগাজিন ‘লাইফহ্যাক’ এর নির্দেশিত যোগ্য টিম মেম্বার হওয়ার ১০টি প্র্যাকটিস :
১. নিজের সময়ের পাশাপাশি অন্যদের সময়েরও মূল্য দিন
সোজা বাংলায় নিজের সময়কে যেভাবে মূল্য দেন, অন্যের সময়কেও সেভাবেই মূল্য দেবেন। টিমওয়ার্কের সময়ে প্রত্যেক টিম মেম্বারের আলাদা দায়িত্ব থাকে এবং প্রতিটি কাজের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে।
মনে করুন, আপনার টিম একটি মোবাইল ফোন বানাচ্ছে। মোবাইল ফোনের আলাদা পার্ট আলাদা মেম্বার বানাচ্ছেন। আপনাদেরকে ১০ দিনের মধ্যে কাজটি শেষ করতে হবে। এখন আপনার হয়তো দায়িত্ব মোবাইলের স্ক্রিনটি বানানো। আপনি যতক্ষণ স্ক্রিন বানাতে না পারছেন, ততক্ষণ আপনার যে টিমমেট মোবাইলের অ্যাপ টেস্ট করবে, সে কাজ শুরু করতে পারছে না।
এখন আপনি যদি শুধু নিজের দিকটা চিন্তা করে যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব, তারচেয়ে ধীর গতিতে কাজ করেন, তাহলে আপনার ওই টিমমেট তার কাজ করার জন্য সময় কম পাবে। এবং তার ফলে পুরো কাজটিই দেখা গেল শেষ পর্যন্ত ভালো হলো না। তাই নিজের সময়ের পাশাপাশি অন্যদের সময়ের দিকে খেয়াল রেখে কাজ করুন। সব সময় চেষ্টা করুন সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো আউটপুটটি দিতে। কিন্তু তাই বলে তাড়াহুড়ো করতে যাবেন না। নিজের সেরাটাও আপনাকে দিতে হবে। পুরো বিষয়টিকে যদি ব্যালেন্স করে কাজ করতে পারেন, তাহলে পুরো টিমের আউটপুট অনেক ভালো হবে।
২. সোশ্যাল মিডিয়ায় সাবধান থাকুন
বর্তমান যুগের কালচারে একটি টিমের মেম্বাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় একজন আরেকজনের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকবেনÑএটা খুবই স্বাভাবিক।
অনেক টিমে কাজ শুরুর আগে বা পরে টিম মেম্বাররা নিজেদের সোশ্যাল প্রোফাইল বিনিময় করেন। পরস্পরের পোস্টে লাইক-কমেন্ট করেন, মাঝে মাঝে চ্যাট করেনÑএগুলো দোষের কিছু নয়। কিন্তু এখানে সাবধানও থাকতে হবে। আগেই বলেছি, একজন যোগ্য টিম মেম্বার হতে গেলে টিমের কাজ ও লক্ষ্যকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো টিম মেম্বারের সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না, বা এমন কমেন্ট করা যাবে না, যাতে করে সম্পর্ক নষ্ট হয় বা কাজের সম্পর্কে ব্যাঘাত ঘটে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রফেশনাল অ্যাটিচিউড বজায় রাখতে হবে। টিম মেম্বারদের মাঝে যদি সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তবে টিমের কাজের পরিবেশ নষ্ট হবে। কাজেই কোনো কমেন্ট করার আগে, বা চ্যাটে কিছু লেখার আগে অবশ্যই ভালো করে ভেবে নিয়ে তারপর কাজটি করুন।
৩. কমিউনিকেশনে স্পষ্টতা নিশ্চিত করুন
যখন একটি টিম এক হয়ে কাজ করে, তখন তাদের ভেতরে ক্লিয়ার কমিউনিকেশন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে, কোনো নতুন টিমে ভালো টিমওয়ার্ক করার জন্য টিম মেম্বারদের মধ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই।
ক্লিয়ার বা স্পষ্ট কমিউনিকেশন মানে, সবাই সবার কথা ও নির্দেশ ঠিকমতো বুঝতে পারা।
টিমওয়ার্ক
আপনি যখন কোনো টিমের মেম্বার হিসেবে কাজ করবেন, তখন অবশ্যই অন্যদের কথা ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করবেন। সেই সঙ্গে টিমের অন্য মেম্বারদের কাজের ধরন, তাদের অভ্যাস ও মনোভাব ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করবেন। এতে করে তাদের সঙ্গে কমিউনিকেশন করতে আপনার অনেক বেশি সুবিধা হবে।
কোনো কিছু পুরোপুরি না বুঝলে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করবেন না। তাতে শেষে গিয়ে কাজের ক্ষতি হবে। সেই সঙ্গে অন্যরাও আপনার কথা আসলেই বুঝতে পারছে কি না, তা ভালোমতো নিশ্চিত হোন। বিশেষ করে, নতুন টিম মেম্বারদের টিমের কালচার ও কাজের ধরন এবং প্রত্যেক টিম মেম্বার সম্পর্কে ভালো করে ধারণা দিন। বিশেষ করে, টিম লিডারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো এমনভাবে নির্দেশনা দেওয়া, যাতে সবাই স্পষ্ট করে তা বুঝতে পারে। দরকার হলে প্রত্যেক মেম্বারকে আলাদা করে বোঝাতে হবে।
একটি টিমে ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে আর্টিস্ট পর্যন্ত থাকতে পারে। সবার আলাদা দর্শন ও শিক্ষা থাকলেও ভালো টিম মেম্বার হতে হলে অন্যের দর্শন ও মনোভাব বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আবার যে বোঝাচ্ছে, তাকেও অন্যদের জন্য সহজ করে বোঝাতে হবে।
৪. মতামতের গুরুত্ব দিন
টিমওয়ার্কের সবচেয়ে বড় একটি সুবিধা হচ্ছে যেকোনো কাজের সময় কাজটি কেমন হয়েছে সে বিষয়ে অন্যের মতামত পাওয়া যায়। কিন্তু খুব কম মানুষই এই সুবিধাটি নিতে পারেন। টপ লেভেলের যোগ্যতাসম্পন্ন টিম মেম্বাররা এই বিষয়টির সুবিধা নিতে পারেন।
ইগো দূরে ঠেলে টিমের অন্য মেম্বারদের আপনার কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন। তাদের আইডিয়া ও পরামর্শ চান এবং তারা কোনো মতামত দিলে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করুন।
টিমে বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকায় তাদের বিভিন্ন মত থাকতে পারে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, অন্যরা যখন আপনার কাছে ফিডব্যাক চাইবে, আপনিও খোলামনে তাদের ফিডব্যাক দেবেন। কিন্তু কখনোই বিরূপ সমালোচনা করবেন না।
‘এটা ভালো হয়নি’, ‘এতে কাজ হবে না’Ñএ ধরনের কথার বদলে ইতিবাচক কথা, যেমন ‘এটা এভাবে করলে মনে হয় আরও সুন্দর হবে’, ‘ভালো হয়েছে, আরও ভালো করতে এটা ট্রাই করতে পারেন’Ñএভাবে কথার মধ্যে হালকা প্রশংসা রেখে তারপর পরামর্শ দিন। এতে করে আপনার পরামর্শ আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
৫. সম্পর্ক ভালো করতে শুভেচ্ছা বিনিময় করুন
২ নম্বর পয়েন্টে বলেছিলাম, প্রফেশনাল সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, এমন সম্ভাবনা দেখলেই সাবধান হয়ে যান। অন্যদিকে প্রফেশনাল সম্পর্ক ভালো করার যেকোনো সুযোগ লুফে নিন। প্রতিদিন অন্তত দুবার আপনার সামনে এই সুযোগ আসবে। একবার কাজের জায়গায় আসার সময়ে, আর দ্বিতীয় বার কাজ থেকে বের হওয়ার সময়ে। প্রথমবার হাসিমুখে ওয়েলকাম জানান, ও যাওয়ার সময় সুন্দর করে বিদায় জানান। কেউ নিজে বা তার কাছের কেউ অসুস্থ হলে খোঁজখবর নিন। সমবেদনা জানান।
অনেকে মনে করেন, প্রফেশনাল অ্যাটিচিউড মানে গম্ভীর মুখে শুধু কাজ করে যাওয়া। ব্যাপারটি মোটেই সে রকম নয়। টিম মেম্বাররা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে, ও তাদের মাঝে একটি ভালো সম্পর্ক থাকলে কাজ অনেক ভালো হয়। শুধু সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার মতো বা অতি ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এড়িয়ে গেলেই হলো।
৬. নিজেকে সব সময় উন্নত করার চেষ্টা করুন
যখন একটি টিমের মেম্বার হিসেবে কাজ করবেন, তখন মাঝে মাঝেই হয়তো আপনার অন্যদের সাহায্য ও পরামর্শ দরকার হবে এবং ভালো টিম মেম্বাররা অবশ্যই একে অপরকে সাহায্য করবে।
আপনাকে সাহায্য করা যেমন অন্য টিম মেম্বারদের দায়িত্ব, তেমনি সাহায্য চাওয়ার পরিমাণ একদম কম পর্যায়ে রাখাটা আপনার দায়িত্ব। একই ব্যাপারে যখন আপনি বারবার টিমমেটদের সাহায্য চাইবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটা সময়ে তারা বিরক্ত হবেন এবং একজন ভালো টিম মেম্বার হিসেবে সেটা করা।
এর সমাধান হচ্ছে, কাজ করতে গিয়ে যেখানেই বাধবেন, প্রথমবার অন্যদের সাহায্য নিন। কিন্তু সাহায্য নেওয়ার পাশাপাশি নিজেও জিনিসটি ভালো করে শিখে নিন। যদি অন্য টিমমেটের কাছ থেকে তখন শিখে নিতে পারেন, সেটা খুব ভালো হয়। অথবা ইন্টারনেট, বই ইত্যাদি থেকে বিষয়টি ভালো করে শিখে নিন। এতে করে আপনি যেমন টিম মেম্বারদের কাছে ভালো হয়ে উঠবেন, নিজের কাজের ক্ষেত্রেও আপনার দক্ষতা বাড়তে থাকবে।
৭. সবাইকে সমানভাবে দেখুন ও সবার সঙ্গে সমান আচরণ করুন
একজন যোগ্য টিম মেম্বারের সবচেয়ে বড় গুণ এটি। আপনার টিমমেটদের মাঝে কখনোই তুলনা করতে যাবেন না। অন্য টিম মেম্বাররা যদি কাউকে নিয়ে আলোচনা করে, বা দুজনের মধ্যে তুলনা করে, তবে সেই আলোচনায় অংশ না নেওয়ার পাশাপাশি সেই আলোচনা থামানোর চেষ্টা করুন। যখনই টিমের একজনের সঙ্গে আরেকজনের তুলনা হবে, তখনই বুঝবেন টিমের বারোটা বেজে যাচ্ছে।
আপনি যদি ‘ক’ আর ‘খ’ এর সঙ্গে দুই রকম আচরণ করেন, তাহলে টিমের ব্যালেন্স নষ্ট হবে। ‘ক’ কে যদি বেশি গুরুত্ব দেন, তবে ‘খ’ এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক তো খারাপ হবেই, সেই সঙ্গে ‘ক’ এর সঙ্গে ‘খ’ এর সম্পর্ক অবশ্যই খারাপ হয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে টিমের কাজ নষ্ট হবে। একজন যোগ্য টিম মেম্বার হিসেবে তাই আপনার উচিত হবে সবাইকে সমান চোখে দেখা এবং এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা থামানোর চেষ্টা করা।
এখানে আরেকটা জিনিস অবশ্যই মাথায় রাখবেন, আপনি হয়তো কাউকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না। কিন্তু টিমে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন, সেই লোকটি টিমে আছে। একজন যোগ্য ও ভালো টিম মেম্বার হিসেবে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে কাজের ক্ষেত্রে প্রশ্রয় দেবেন না। অবশ্যই কাজকে আগে রাখবেন। কাজের দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বিচার করবেন। একজনকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন না বলে যদি তার ভালো কাজেও দোষ খোঁজার চেষ্টা করেন, তবে টিমওয়ার্কের যোগ্যতা আপনার এখনো হয়নি। তাই আদর্শ টিম মেম্বার হওয়ার জন্য ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে ওঠার প্র্যাকটিস শুরু করুন।
৮. ভুল হলে স্বীকার করুন
যদি এমন একজন মানুষ দেখেন, যার কোনো বন্ধু নেই, তাহলে ৯৯% নিশ্চিত হতে পারেন যে মানুষটি কোনো সময়েই নিজের ভুল স্বীকার করে না। এ ধরনের মানুষের সঙ্গে কেউ কাজ করতে চায় না। আপনি যদি একজন সত্যিকারের যোগ্য টিম মেম্বার হতে চান, তবে অবশ্যই ভুল হলে স্বীকার করা শিখুন। ভুল যে কারও হতে পারে এবং ভুল স্বীকার করে তা শোধরানোর চেষ্টা করলে তা সবাই মেনে নেয়। কিন্তু যদি ভুল স্বীকার না করেন, অথবা অন্যের ওপর দোষ চাপাতে চেষ্টা করেন, তাহলে টিমওয়ার্ক আপনার জন্য নয়।
৯. একদম অপারগ না হলে নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাবেন না
একটি টিম যদি যোগ্য টিম মেম্বার দিয়ে গড়া হয় এবং তারা যদি আসলেই ভালো টিমওয়ার্ক করে, তবে অবশ্যই তারা একে অন্যকে সাহায্য করবে। কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে যদি কেউ নিজের কাজ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে থাকে, তাহলে তাকে কোনোভাবেই যোগ্য টিম মেম্বারের কাজ বলা যায় না।
একজন যোগ্য টিম মেম্বার হিসেবে আপনাকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করতে হবে। আপনার সামর্থ্য ও মেধার পুরোটা দিয়ে কাজ করার পর যদি কোনো জায়গায় আটকে যান, শুধু তখনই অন্যের কাছে সাহায্য চাইবেন। আর সেটাও মাত্র একবারের জন্য, কারণ কাজটি পরে আপনাকে শিখে নিতে হবে (*৬ নম্বর পয়েন্ট)।
১০. নিজের কাজ শেষে অন্যকে সাহায্য অফার করুন
প্রথমেই বলেছি, যোগ্য টিম মেম্বার টিমের সাফল্যের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে কাজ করে। এমন হতে পারে, আপনার অংশ আপনি বেশ আগে করে ফেলেছেন এবং হাতে কিছু ফ্রি টাইম আছে। ভালো টিম মেম্বার হিসেবে আপনার কাজ হবে, অন্যদের কাজে সাহায্য অফার করা, যাতে করে কাজ আরও দ্রুত ও ভালো হয়। নিজেকে ব্যক্তি না ভেবে একটি ইউনিটের অংশ ভাবতে হবে।
শেষ কথা
যেকোনো কাজে সাফল্যের জন্য ভালো টিমওয়ার্কের বিকল্প নেই। এই ১০টি প্র্যাকটিস যদি একজন মানুষ করে, তবে ধীরে ধীরে সে একজন ভালো টিম মেম্বার হয়ে উঠবে। আপনার মাঝে হয়তো ইতিমধ্যেই এই গুণগুলোর সব না থাকলেও বেশির ভাগই আছে। কোন প্র্যাকটিসগুলো আপনি ইতিমধ্যে করেন এবং কোনগুলো করেন না, তা ভেবে বের করুন এবং যেগুলো করেন না, সেগুলো করতে শুরু করুন। আপনার টিমের অন্যদেরও এগুলো প্র্যাকটিস করতে উৎসাহ দিন।
আমার লেখা আপনাদের যদি ভালো লাগে, তবেই আমি সার্থক। আর যদি মনে হয় লেখাটি পড়ে অন্যরা উপকৃত হবেন, তবে তাদের জানিয়ে দিন।