
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেয়া শেষ। এমএসসিতে আমরা তিনজন মাত্র প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে তখন শিক্ষকের প্রয়োজন থাকলেও বিজ্ঞপ্তি না হওয়াতে আবেদন করতে পারছি না। ওদিকে হলের সিটটাও হাতছাড়া। একদিকে আশ্রয় খোঁজা, অন্যদিকে চাকরির বিজ্ঞপ্তি খুঁজে আবেদন করা। বন্ধু শাহজাহান দিব্যি বিসিএসআইআর ল্যাবোরেটরিতে গবেষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে মহা খুশি। আমার হলমেট ও সাথী হিসেবে বলল-
‘এনায়েত! চিন্তা করো না। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমাদের ভাড়া বাসাতেই থাকতে পারবা।’
কথাটা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। অতঃপর শাহজাহানের ভাড়া করা বাসায় ওর অন্য কয়েকজন ছোট ভাইয়ের সাথে আমারও ঠাঁই হলো কাঠাল-বাগান বাজারের ভিতরে অবস্থিত একটা বাংলো টাইপের টিনের একচালা বাড়িতে। এখান থেকেই জীবনের প্রথম চাকরির আবেদন করলাম ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসের দিকে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রভাষকের (লোকজন তখন বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের প্রফেসর বলেই সম্বোধন করতো) চাকরি। বেতন স্কেল অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক স্কেলের চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি! অর্থাৎ ৩৭৫ টাকা মাসিক বেতন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক স্কেল, তথা-৩৭০ টাকা থেকেও ৫ টাকা বেশি ছিল!
খবর পেলাম, তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম.বি. চৌধুরী। ডেপুটেশনে সরকারি কলেজ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কুমিল্লায় বদলি হয়ে এসেছেন। ১৮৯৯ খৃস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় একটি গৌরবময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরস্পর জানতে পারলাম, বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এম.বি. চৌধুরী সিলেট জেলার লোক। আমাদেও হলমেট এবং সতীর্থ মেসবাহুল বার চৌধুরীর পিতা। এসএম হলে ও তখন পূর্ব হাউসের আবসিক। আর আমি পশ্চিম হাউসের আবাসিক। মেসবাহুল বার চৌধুরী অর্থনীতির আর আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র। মাঝে-মধ্যে ক্যান্টিন, ডাইনিং হল কিংবা হল ক্যাম্পাসের টেনিস/ব্যাডমিন্টন কোর্টে দেখা-সাক্ষাত হয়েছে। বার চৌধুরীর পিতা অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত জেনে মনে যেন কিছুটা সাহস পেলাম!
মৌখিক পরীক্ষার আগের দিন আমার কয়েক জন শুভাকাক্সক্ষী, বিশেষ করে অধ্যাপক শেখর রঞ্জন সাহা, অধ্যাপক মিফতা-উর রহমান এবং প্রদর্শক জয়ন্ত ভূষণ দেব আমাকে মিসেস জাহানারা মুনশির বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাত করাতে নিয়ে গেল। চা-নাস্তা খেতে খেতে নিয়োগ সম্পর্কে জাহানারা আপা তাঁর চিন্তাধারার কথা ব্যক্ত করলেন। -‘এনায়েত সাহেব! আপনার তো ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার। প্রথম শ্রেণি লাভ করে আপনি কী আর এই মফস্বল শহরের কলেজে পড়ে থাকবেন! আপনাকে যদি আমরা সিলেকশন করে নিয়োগ দেই, তাহলে তো কিছুদিন পরেই আমাদের নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে!’
কথাগুলো শুনে আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। মনে মনে বললাম- হায় খোদা! আমার প্রথম শ্রেণি পাওয়াটাই কী দোষের হয়ে গেলো!
-‘আপা, আমাকে ক্ষমা করবেন। মানুষ তো তার ভবিষ্যত জানে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ঠিক কবে পদ বিজ্ঞাপিত হবে এবং সেখানে আমি আবেদনপত্র জমা দিয়েও নিয়োগপত্র পাবো কিনা তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে।
আপাতত: আমি কুমিল্লাতেই শিক্ষকতা করতে চাই, আপা!’
জাহানারা আপা অনেক যুক্তি এবং উদাহরণ দিতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত কিছুটা নমণীয় হয়েছেন বলে মনে হলো। কিন্তু তিনি তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন না বলেই মত দিলেন। আমরা সবাই কিছুটা হতাশ হয়েই কান্দিরপাড় এসে পৌঁছালাম। ওখানে পৌঁছে ‘মাতৃভান্ডার’-এ বসে আমরা চারজন দই-মিষ্টি খেলাম।
আমার মনে কেবল-ই একটা কথা বারবার ঘুরে-ফিরে আসছিল। আর তা হলো এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া। এটাই কী আমার কপালে কাল্ হয়ে এলো!
সিলেট নিবাসী অধ্যাপক মিফতা-উর রহমান কেটা বুদ্ধি দিলো।
-‘ভাই এনায়েত! চল না অধ্যক্ষের সাথে দেখা করে বিষয়টা তাঁকে জানানো যাক্। কালকেই যেহেতু তোমার মৌখিক সাক্ষাৎকার, চল এখনই মাগরিবের আযান হওয়ার আগেই অধ্যক্ষের বাসায় গিয়ে দেখা করি।’
মিফতা আর আমি গেলাম অধ্যক্ষের বাসায় দেখা করতে। আর শেখর বাবু ও জয়ন্ত ভয়ে সঙ্গী হতে চাইলো না। কান্দিরপাড়ের ডানদিকে সামান্য এগিয়ে যেতেই ভিক্টোরিয়া কলেজের সীমানা প্রাচীর ও উত্তরের একটা লোহার গেট চোখে পড়ল। হেটে সামান্য দূরেই হাতের বাম দিকে নজর পড়ল একটা বিরাট দীঘি। দীঘির পানি স্বচ্ছ, নির্মল। টল্টল্ করছিল। এরই পশ্চিমপাড়ে কলেজের প্রধান গেট ও নামফলক। গেটের দুদিকে বিশালকৃতির পুরোনো বিদেশি পাম গাছ শোভা পাচ্ছিল। মিফতা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটা গাছপালা ঘেরা বাংলো বাড়ি দেখিয়ে বলল-
‘ঐ তো অধ্যক্ষ সাহেবের বাসা। চল আমরা গেটে এগিয়ে পাহারাদারকে দিয়ে ভিতরে খবর পাঠাই। অনুমতি ছাড়া তো আর বাসায় ঢোকা যাবে না।’
মিফতার চোখে পুরু চশমা। মুখে প্রায় সবসময়েই সিগারেট পুড়ছে। গেটের কাছে পৌঁছে সে জ্বলন্ত সিগারেটটি মাটিতে ফেলে জুতো চেপে নিভিয়ে দিলো। পরে দারোয়ানকে দিয়ে বাসার ভিতরে খবর পাঠালো। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ডাক এলো ভিতরে প্রবেশ করবার জন্য। আমরা দুজন বাসায় ঢুকে একটা সুদৃশ্য, ছিমছাম ও সাজানো বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম। এরপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
ভিতর থেকে একজন দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণের অধিকারী এবং সৌম্য-দর্শন সুপুরুষ ভিতর দিককার দরজার পর্দা সরিয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হলেন। চোখে কালো চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। লাল টক্টকে আপেলের মতো গায়ের রঙ সচরাচর পশ্চিমাদের অর্থাৎ ইংরেজ সাহেবদেরই দেখেছি আগে। আমরা দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। সালাম গ্রহণ করে আমাদের বসতে বললেন। মিফতা জনাব চৌধুরী সাহেবের একই জেলার লোক। আর সিলেট-চিটাগাং- নোয়াখালী এলাকার স্বজন-প্রীতির কথা তখন অনেকেরই জানা বিষয়। অধ্যক্ষ সাহেব মিফতাকে জিজ্ঞেস করলেনÑ
‘মিফতা! ভালো আছ তো? ক্লাস-পরীক্ষাগুলো কেমন চলছে?
-‘ভালো-ই আছি, স্যার! ক্লাসের লোড একটু বেশি! ডিগ্রি কোর্স শুরু হয়েছে। তবে পরীক্ষাগুলো ঠিকমতই শেষ হয়েছে।’
- ‘খুব ভালো খবর! ডিগ্রি ক্লাসের লোড সম্পর্কে বলছিলে না? তোমাদের বিষয়ে শিক্ষাদান করবার জন্য পদ বিজ্ঞাপিত হয়েছে। শিগগিরই যোগ্য শিক্ষক পেয়ে যাবে!’
-‘শিক্ষক নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতেই আপনার বাসায় এসে বিরক্ত করতে বাধ্য হলাম স্যার! আর আমার সঙ্গে যাকে দেখছেন তার নাম-
- ‘এ বি এম এনায়েত হোসেন।’ উত্তরটা আমিই দিলাম সালাম দেওয়ার সাথে সাথে।
-‘এনায়েত এ বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রথম শ্রেণি পেয়ে পাস করেছে।’ মিফতা আমার পক্ষে প্রচারণা করল! অধ্যক্ষ সাহেব তাঁর তীক্ষè চাহনি দিয়ে, অথচ কিছুটা মুচকি হাসি হেসে বললেন-
-‘আমি এসব তথ্য জানি!’
আমি একটু ইতস্তত করছিলাম! চৌধুরী সাহেবের সন্তান আনোয়ার-উল বার যে আমার হলমেট ও সমসাময়িক, এ কথাটা অধ্যক্ষ স্যারকে বলা ঠিক হবে কী-না- তা বুঝতে পারছিলাম না। যাহোক, ইতোমধ্যে বৈঠক খানার টেবিলে চা-বিস্কুট ও সিঙ্গারা এসে উপস্থিত। অধ্যক্ষ সাহেব আমাদের চা নিতে বলে নিজেও একটা সুদৃশ্য পেয়ালা হাতে নিয়ে গরম চায়ে চুমুক দিলেন। আমি তাঁর আতিথেয়তায় কিছুটা নির্ভার বোধ করতে লাগলাম। এক ফাঁকে সাহস করে বলেই ফেললাম-
‘স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনার ছেলে আনোয়ার-উল বার এবং আমি একই হলের আবাসিক ছাত্র। ও পূর্ব হাউসে আর আমি পশ্চিম হাউসে ছিলাম। অবশ্য দুজনের পড়াশুনার বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।’
‘হ্যাঁ, বার অর্থনীতিতে এমএ পাস করেছে।’
‘স্যার! যে কারণে আমি এনায়েতকে সঙ্গে নিয়ে আপনারা কাছে এসেছি, তা হলো আগামীকাল সকাল বেলায় উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক নির্বাচন সংক্রান্ত জটিলতা!’ মিফতা অধ্যক্ষ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল।
‘জটিলতা? তা আবার কী রকম? একটু খোলসা করে বলোতো মিফতা।’
‘স্যার! আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, বিভাগীয় প্রধান প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত প্রার্থীর বদলে কোনো একটা মফস্বল শহরের কলেজে অধ্যাপনারত দ্বিতীয় শ্রেণিপ্রাপ্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে আগ্রহী।’
‘তাই না-কি! তাহলে তো মেধার মূল্যায়ন করা হবে না।’
‘ঠিক বলেছেন, স্যার। তাছাড়া বিজ্ঞাপনে কিন্তু উল্লেখ করা হয়নি যে, প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত প্রার্থীদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই।’ আমি কিছুটা ভয়ে ভয়েই কথাটি বললাম।
‘তুমি একটা সুন্দর ও সঠিক যুক্তি উল্লেখ করেছ। বিষয়টা আমি দেখব। তোমরা কোনো চিন্তা করো না।’
আমরা অধ্যক্ষ সাহেবকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম।
পরদিন সকাল ৯.৩০ ঘটিকায় অধ্যক্ষের অফিস কক্ষে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান হলো যথাযথভাবে। কমিটির সদস্যরা ভালোমন্দ দু-একটা কুশল সংক্রান্ত প্রশ্ন করলেন। অধ্যক্ষ সাহেব নিশ্চুপ। মুখে মুচকি হাসি। বিভাগীয় প্রধান মিসেস জাহানারা মুনশি বললেন- ‘আপনার কেরিয়ার তো খুবই ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগেই তো আপনার চাকরি হয়ে যাবে। তাহলে আর কষ্ট করে এই মফস্বল শহরের কলেজে শিক্ষকতা কেন করতে চাইছেন?’
Ñ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে কবে বিজ্ঞপ্তি হবে এবং আদৌ আমার চাকরি সেখানে হবে কী-না, তা আন্দাজ করে আমি কীভাবে বলবো?’
আমাদের কথাবার্তার মাঝে অধ্যক্ষ সাহেব বাঁধা দিলেন, এ কথা বলে-
‘এসব কথা বলে আর লাভ কী? উনি এ কলেজে চাকরি পেতে আবেদন করেছেন। মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা দোষের হতে পারে না। প্রশ্ন হলো উনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা করতে রাজি আছেন কী না!’
Ñ ‘হ্যাঁ স্যার! আমি এ কলেজে চাকরি করবো বলেই তো দরখাস্ত করেছি।’ আমার সোজাসুজি উত্তর।
অধ্যক্ষ সাহেব মৌখিক সাক্ষাৎকারে ইতি টানলেন এ কথা বলে-
‘ব্যাস্! তাহলে তো আর কোনো কথা থাকে না। জনাব এনায়েত হোসেনকেই নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।’
সাক্ষাৎকার শেষে হাসিমুখে অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে কলেজের শিক্ষক কমন রুমে এলাম অপেক্ষমান মিফতা-উর রহমানসহ শেখর রঞ্জন সাহা এবং জয়ন্ত ভুষণ দেবকে খবরটা দেওয়ার জন্য। অন্তরে এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি! জীবনের প্রথম চাকরি। শিক্ষকতা পেশায় হাতেখড়ি। যে চাকরিতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা, ট্রেনিং কিংবা পেশাগত কোনো পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পড়াশুনা এবং ডিগ্রিগুলোই মুখ্য।
শিক্ষকতা করা একদিকে যেমন পেশা, অন্যদিক দিয়ে নেশাও বটে। কারণ এ পেশার একটা মোহ আছে। যা হলো শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। কিন্তু কেউ কেউ একে চেয়ারের প্রতি মোহ বা আকর্ষণের কথা বলেছেন। যেমন- আমার বাবা এনছান উদ্দিন আহমদ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর দু-তিন মাস নিজের স্কুলেই শিক্ষকতা করেছেন।
ওই সময় তাঁর স্কুলের গুরুমশাই বাবাকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলি, এনছান উদ্দিন! এই চেয়ারের একটা মোহ আছে। একবার এর মোহে পড়ে গেলে আর এদিক-ওদিক করতে পারবে না। সুতরাং, সময় থাকতে অন্য চাকরি-বাকরি খোঁজা শুরু করে দাও।’
বাবা তাঁর গুরুমশাইয়ের উপদেশ মেনেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি রেলওয়ে কাননগু চাকরির পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। এবং সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।
‘এনায়েত! চিন্তা করো না। চাকরি না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমাদের ভাড়া বাসাতেই থাকতে পারবা।’
কথাটা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। অতঃপর শাহজাহানের ভাড়া করা বাসায় ওর অন্য কয়েকজন ছোট ভাইয়ের সাথে আমারও ঠাঁই হলো কাঠাল-বাগান বাজারের ভিতরে অবস্থিত একটা বাংলো টাইপের টিনের একচালা বাড়িতে। এখান থেকেই জীবনের প্রথম চাকরির আবেদন করলাম ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসের দিকে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে প্রভাষকের (লোকজন তখন বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের প্রফেসর বলেই সম্বোধন করতো) চাকরি। বেতন স্কেল অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক স্কেলের চেয়ে পাঁচ টাকা বেশি! অর্থাৎ ৩৭৫ টাকা মাসিক বেতন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক স্কেল, তথা-৩৭০ টাকা থেকেও ৫ টাকা বেশি ছিল!
খবর পেলাম, তখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম.বি. চৌধুরী। ডেপুটেশনে সরকারি কলেজ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কুমিল্লায় বদলি হয়ে এসেছেন। ১৮৯৯ খৃস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় একটি গৌরবময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরস্পর জানতে পারলাম, বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এম.বি. চৌধুরী সিলেট জেলার লোক। আমাদেও হলমেট এবং সতীর্থ মেসবাহুল বার চৌধুরীর পিতা। এসএম হলে ও তখন পূর্ব হাউসের আবসিক। আর আমি পশ্চিম হাউসের আবাসিক। মেসবাহুল বার চৌধুরী অর্থনীতির আর আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্র। মাঝে-মধ্যে ক্যান্টিন, ডাইনিং হল কিংবা হল ক্যাম্পাসের টেনিস/ব্যাডমিন্টন কোর্টে দেখা-সাক্ষাত হয়েছে। বার চৌধুরীর পিতা অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত জেনে মনে যেন কিছুটা সাহস পেলাম!
মৌখিক পরীক্ষার আগের দিন আমার কয়েক জন শুভাকাক্সক্ষী, বিশেষ করে অধ্যাপক শেখর রঞ্জন সাহা, অধ্যাপক মিফতা-উর রহমান এবং প্রদর্শক জয়ন্ত ভূষণ দেব আমাকে মিসেস জাহানারা মুনশির বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাত করাতে নিয়ে গেল। চা-নাস্তা খেতে খেতে নিয়োগ সম্পর্কে জাহানারা আপা তাঁর চিন্তাধারার কথা ব্যক্ত করলেন। -‘এনায়েত সাহেব! আপনার তো ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার। প্রথম শ্রেণি লাভ করে আপনি কী আর এই মফস্বল শহরের কলেজে পড়ে থাকবেন! আপনাকে যদি আমরা সিলেকশন করে নিয়োগ দেই, তাহলে তো কিছুদিন পরেই আমাদের নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে!’
কথাগুলো শুনে আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। মনে মনে বললাম- হায় খোদা! আমার প্রথম শ্রেণি পাওয়াটাই কী দোষের হয়ে গেলো!
-‘আপা, আমাকে ক্ষমা করবেন। মানুষ তো তার ভবিষ্যত জানে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ঠিক কবে পদ বিজ্ঞাপিত হবে এবং সেখানে আমি আবেদনপত্র জমা দিয়েও নিয়োগপত্র পাবো কিনা তারই বা কী নিশ্চয়তা আছে।
আপাতত: আমি কুমিল্লাতেই শিক্ষকতা করতে চাই, আপা!’
জাহানারা আপা অনেক যুক্তি এবং উদাহরণ দিতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত কিছুটা নমণীয় হয়েছেন বলে মনে হলো। কিন্তু তিনি তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন না বলেই মত দিলেন। আমরা সবাই কিছুটা হতাশ হয়েই কান্দিরপাড় এসে পৌঁছালাম। ওখানে পৌঁছে ‘মাতৃভান্ডার’-এ বসে আমরা চারজন দই-মিষ্টি খেলাম।
আমার মনে কেবল-ই একটা কথা বারবার ঘুরে-ফিরে আসছিল। আর তা হলো এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া। এটাই কী আমার কপালে কাল্ হয়ে এলো!
সিলেট নিবাসী অধ্যাপক মিফতা-উর রহমান কেটা বুদ্ধি দিলো।
-‘ভাই এনায়েত! চল না অধ্যক্ষের সাথে দেখা করে বিষয়টা তাঁকে জানানো যাক্। কালকেই যেহেতু তোমার মৌখিক সাক্ষাৎকার, চল এখনই মাগরিবের আযান হওয়ার আগেই অধ্যক্ষের বাসায় গিয়ে দেখা করি।’
মিফতা আর আমি গেলাম অধ্যক্ষের বাসায় দেখা করতে। আর শেখর বাবু ও জয়ন্ত ভয়ে সঙ্গী হতে চাইলো না। কান্দিরপাড়ের ডানদিকে সামান্য এগিয়ে যেতেই ভিক্টোরিয়া কলেজের সীমানা প্রাচীর ও উত্তরের একটা লোহার গেট চোখে পড়ল। হেটে সামান্য দূরেই হাতের বাম দিকে নজর পড়ল একটা বিরাট দীঘি। দীঘির পানি স্বচ্ছ, নির্মল। টল্টল্ করছিল। এরই পশ্চিমপাড়ে কলেজের প্রধান গেট ও নামফলক। গেটের দুদিকে বিশালকৃতির পুরোনো বিদেশি পাম গাছ শোভা পাচ্ছিল। মিফতা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত একটা গাছপালা ঘেরা বাংলো বাড়ি দেখিয়ে বলল-
‘ঐ তো অধ্যক্ষ সাহেবের বাসা। চল আমরা গেটে এগিয়ে পাহারাদারকে দিয়ে ভিতরে খবর পাঠাই। অনুমতি ছাড়া তো আর বাসায় ঢোকা যাবে না।’
মিফতার চোখে পুরু চশমা। মুখে প্রায় সবসময়েই সিগারেট পুড়ছে। গেটের কাছে পৌঁছে সে জ্বলন্ত সিগারেটটি মাটিতে ফেলে জুতো চেপে নিভিয়ে দিলো। পরে দারোয়ানকে দিয়ে বাসার ভিতরে খবর পাঠালো। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ডাক এলো ভিতরে প্রবেশ করবার জন্য। আমরা দুজন বাসায় ঢুকে একটা সুদৃশ্য, ছিমছাম ও সাজানো বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম। এরপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
ভিতর থেকে একজন দীর্ঘদেহী, গৌরবর্ণের অধিকারী এবং সৌম্য-দর্শন সুপুরুষ ভিতর দিককার দরজার পর্দা সরিয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হলেন। চোখে কালো চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। লাল টক্টকে আপেলের মতো গায়ের রঙ সচরাচর পশ্চিমাদের অর্থাৎ ইংরেজ সাহেবদেরই দেখেছি আগে। আমরা দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। সালাম গ্রহণ করে আমাদের বসতে বললেন। মিফতা জনাব চৌধুরী সাহেবের একই জেলার লোক। আর সিলেট-চিটাগাং- নোয়াখালী এলাকার স্বজন-প্রীতির কথা তখন অনেকেরই জানা বিষয়। অধ্যক্ষ সাহেব মিফতাকে জিজ্ঞেস করলেনÑ
‘মিফতা! ভালো আছ তো? ক্লাস-পরীক্ষাগুলো কেমন চলছে?
-‘ভালো-ই আছি, স্যার! ক্লাসের লোড একটু বেশি! ডিগ্রি কোর্স শুরু হয়েছে। তবে পরীক্ষাগুলো ঠিকমতই শেষ হয়েছে।’
- ‘খুব ভালো খবর! ডিগ্রি ক্লাসের লোড সম্পর্কে বলছিলে না? তোমাদের বিষয়ে শিক্ষাদান করবার জন্য পদ বিজ্ঞাপিত হয়েছে। শিগগিরই যোগ্য শিক্ষক পেয়ে যাবে!’
-‘শিক্ষক নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতেই আপনার বাসায় এসে বিরক্ত করতে বাধ্য হলাম স্যার! আর আমার সঙ্গে যাকে দেখছেন তার নাম-
- ‘এ বি এম এনায়েত হোসেন।’ উত্তরটা আমিই দিলাম সালাম দেওয়ার সাথে সাথে।
-‘এনায়েত এ বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রথম শ্রেণি পেয়ে পাস করেছে।’ মিফতা আমার পক্ষে প্রচারণা করল! অধ্যক্ষ সাহেব তাঁর তীক্ষè চাহনি দিয়ে, অথচ কিছুটা মুচকি হাসি হেসে বললেন-
-‘আমি এসব তথ্য জানি!’
আমি একটু ইতস্তত করছিলাম! চৌধুরী সাহেবের সন্তান আনোয়ার-উল বার যে আমার হলমেট ও সমসাময়িক, এ কথাটা অধ্যক্ষ স্যারকে বলা ঠিক হবে কী-না- তা বুঝতে পারছিলাম না। যাহোক, ইতোমধ্যে বৈঠক খানার টেবিলে চা-বিস্কুট ও সিঙ্গারা এসে উপস্থিত। অধ্যক্ষ সাহেব আমাদের চা নিতে বলে নিজেও একটা সুদৃশ্য পেয়ালা হাতে নিয়ে গরম চায়ে চুমুক দিলেন। আমি তাঁর আতিথেয়তায় কিছুটা নির্ভার বোধ করতে লাগলাম। এক ফাঁকে সাহস করে বলেই ফেললাম-
‘স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনার ছেলে আনোয়ার-উল বার এবং আমি একই হলের আবাসিক ছাত্র। ও পূর্ব হাউসে আর আমি পশ্চিম হাউসে ছিলাম। অবশ্য দুজনের পড়াশুনার বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা।’
‘হ্যাঁ, বার অর্থনীতিতে এমএ পাস করেছে।’
‘স্যার! যে কারণে আমি এনায়েতকে সঙ্গে নিয়ে আপনারা কাছে এসেছি, তা হলো আগামীকাল সকাল বেলায় উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক নির্বাচন সংক্রান্ত জটিলতা!’ মিফতা অধ্যক্ষ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল।
‘জটিলতা? তা আবার কী রকম? একটু খোলসা করে বলোতো মিফতা।’
‘স্যার! আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, বিভাগীয় প্রধান প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত প্রার্থীর বদলে কোনো একটা মফস্বল শহরের কলেজে অধ্যাপনারত দ্বিতীয় শ্রেণিপ্রাপ্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে আগ্রহী।’
‘তাই না-কি! তাহলে তো মেধার মূল্যায়ন করা হবে না।’
‘ঠিক বলেছেন, স্যার। তাছাড়া বিজ্ঞাপনে কিন্তু উল্লেখ করা হয়নি যে, প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত প্রার্থীদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই।’ আমি কিছুটা ভয়ে ভয়েই কথাটি বললাম।
‘তুমি একটা সুন্দর ও সঠিক যুক্তি উল্লেখ করেছ। বিষয়টা আমি দেখব। তোমরা কোনো চিন্তা করো না।’
আমরা অধ্যক্ষ সাহেবকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম।
পরদিন সকাল ৯.৩০ ঘটিকায় অধ্যক্ষের অফিস কক্ষে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান হলো যথাযথভাবে। কমিটির সদস্যরা ভালোমন্দ দু-একটা কুশল সংক্রান্ত প্রশ্ন করলেন। অধ্যক্ষ সাহেব নিশ্চুপ। মুখে মুচকি হাসি। বিভাগীয় প্রধান মিসেস জাহানারা মুনশি বললেন- ‘আপনার কেরিয়ার তো খুবই ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগেই তো আপনার চাকরি হয়ে যাবে। তাহলে আর কষ্ট করে এই মফস্বল শহরের কলেজে শিক্ষকতা কেন করতে চাইছেন?’
Ñ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে কবে বিজ্ঞপ্তি হবে এবং আদৌ আমার চাকরি সেখানে হবে কী-না, তা আন্দাজ করে আমি কীভাবে বলবো?’
আমাদের কথাবার্তার মাঝে অধ্যক্ষ সাহেব বাঁধা দিলেন, এ কথা বলে-
‘এসব কথা বলে আর লাভ কী? উনি এ কলেজে চাকরি পেতে আবেদন করেছেন। মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়াটা দোষের হতে পারে না। প্রশ্ন হলো উনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতা করতে রাজি আছেন কী না!’
Ñ ‘হ্যাঁ স্যার! আমি এ কলেজে চাকরি করবো বলেই তো দরখাস্ত করেছি।’ আমার সোজাসুজি উত্তর।
অধ্যক্ষ সাহেব মৌখিক সাক্ষাৎকারে ইতি টানলেন এ কথা বলে-
‘ব্যাস্! তাহলে তো আর কোনো কথা থাকে না। জনাব এনায়েত হোসেনকেই নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।’
সাক্ষাৎকার শেষে হাসিমুখে অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে কলেজের শিক্ষক কমন রুমে এলাম অপেক্ষমান মিফতা-উর রহমানসহ শেখর রঞ্জন সাহা এবং জয়ন্ত ভুষণ দেবকে খবরটা দেওয়ার জন্য। অন্তরে এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি! জীবনের প্রথম চাকরি। শিক্ষকতা পেশায় হাতেখড়ি। যে চাকরিতে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা, ট্রেনিং কিংবা পেশাগত কোনো পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পড়াশুনা এবং ডিগ্রিগুলোই মুখ্য।
শিক্ষকতা করা একদিকে যেমন পেশা, অন্যদিক দিয়ে নেশাও বটে। কারণ এ পেশার একটা মোহ আছে। যা হলো শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। কিন্তু কেউ কেউ একে চেয়ারের প্রতি মোহ বা আকর্ষণের কথা বলেছেন। যেমন- আমার বাবা এনছান উদ্দিন আহমদ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর দু-তিন মাস নিজের স্কুলেই শিক্ষকতা করেছেন।
ওই সময় তাঁর স্কুলের গুরুমশাই বাবাকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলি, এনছান উদ্দিন! এই চেয়ারের একটা মোহ আছে। একবার এর মোহে পড়ে গেলে আর এদিক-ওদিক করতে পারবে না। সুতরাং, সময় থাকতে অন্য চাকরি-বাকরি খোঁজা শুরু করে দাও।’
বাবা তাঁর গুরুমশাইয়ের উপদেশ মেনেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি রেলওয়ে কাননগু চাকরির পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। এবং সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।