রৌদ্র করোটির কবি শামসুর রাহমান

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ১৬:০৬ , অনলাইন ভার্সন
আমিনুর রশীদ পিন্টু

তখন ঢাকা কলেজে পড়ি (১৯৬৫)। স্মৃতির শহর ময়মনসিংহ ছেড়ে এসেছি। বাবা-মাকে ছেড়ে এই প্রথম নতুন অভিজ্ঞতা। মনটা প্রায়ই চলে যেতো শহরের পাশ দিয়ে কুলুকুলু রবে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। বিষণ্নতা মাঝে মাঝে ভরও করতো। মায়ের কথা মনে পড়তো। ঠিক এই সময়ে হাতে এলো দুটো বই- রৌদ্র করোটিতে এবং নিঃসঙ্গ শেরপা। কবি শামসুর রাহমানের সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই। বলাবাহুল্য তরুণ সমাজের সেই সময়ে বইতে গ্রন্থিত কবিতাগুলো বেশ আলোড়ন তুলেছিল। যেমন ‘দুঃখ’ কবিতাটি। ‘আমাদের বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে। কড়িকাঠে চেয়ার টেবিলে। আর খাটে দুঃখ তার লেখে নাম। 

ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধূলোয়। দুঃখ তার আঁকে চকখড়ি এবং বুলোয় তুলি। বাঁশী বাজা আমাদের নাটে।’ হয়তো কবিতাটি একটা ঝড়ের পূর্বাভাস। তখন সবেমাত্র পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গড়ে তুলছে আয়ুব ও মোনেম শাহীর বিরুদ্ধে আন্দোলন। জেগে উঠছে বাংলার তরুণ ছাত্রসমাজ। প্রত্যয় একটাই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বলয় থেকে পূর্ব বাংলার (তৎকালীন) খেটে খাওয়া দুখী মানুষকে মুক্ত করতে হবে। মুক্ত মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে। প্রয়োজনে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।

আসলে কবিরাই তো শোনাবেন মুক্তির গান। তাঁদের লেখা শুধু ফুল-নদী বা লতাপাতা নিয়ে নয়। মানবতার স্বপক্ষে এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে চিরকালই তারা লড়ে গেছেন কালি আর কলম নিয়ে। সেই যুক্তিতে কবি শামসুর রাহমান বাংলাদেশের মানুষের ত্রাণের কবি সেদিনও যেমন আজও তেমন। এখানে আরও একটু বলে রাখা প্রয়োজন ষাটের দশকে সেই সময়ের ছাত্রসমাজ দলে দলে সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নিচ্ছিলেন। বিপ্লবী চেতনা আর সংগ্রামী চেতনার পাশাপাশি শিল্প কলাতেও তারা ছিলেন পারদর্শী। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা মানুষের অন্তরকে বিশুদ্ধ করতে পারে। হয় অবসান দীনতার আর হীন মনস্কতার। যার অবসানে মানব-সমাজ জেগে উঠতে পারে। 

সেদিনের পরাধীন বাংলাদেশে কবি শামসুর রাহমান ছিলেন এই নবজাগরণের একজন পথিকৃত। উল্লেখ্য, ষাটের দশকে কবি সিকান্দার আবু জাফার সম্পাদিক ‘সমকাল’ কবিতা সংকলনটি ছিলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্প্রচারে এক বিরাট মাইল ফলক। উদ্দীপ্ত করেছিল বাংলা ভাষা ও কৃষ্টির উত্তরণকে। এই কাফেলায় সন্নিবেশিত ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ শামসুল হক, কায়সুল হক, ফজল শাহাবুদ্দিন, শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আবদুল গণি হাজারী, আবুল হোসেন, রবিউল হুসাইন, হায়াত মাহমুদ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, রশীদ হায়দার, ওমর আলী, নির্মলেন্দু গুণ, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ আরো অগুণিত কবি সাহিত্যিক, অধ্যাপক বৃন্দ।

তাদের অনেকেই আজ আর নেই। কিন্তু যে সৃষ্টিকর্ম তাঁরা রেখে গেছেন বাংলাদেশের কবিতা অনুরাগীদের এবং শিল্প সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য সেটা এক অমৃত ভান্ডার। ষাটের দশকে যেসব ছাত্রনেতা এবং প্রগতি মনস্ক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলাম- তাঁরা সবাই কবিতা পড়তে উৎসাহিত করতেন। এখনো মনে আছে- জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ আর সুকান্ত ভট্টচার্যের ‘ছাড়পত্র’ এই দুইটি অমূল্য কাব্যগ্রন্থ ছিল অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। নিউমার্কেট থেকে পুরোনো ঢাকার প্রায় সব লাইব্রেরিতেই গিয়েছিলাম বই দুটো সংগ্রহের জন্য। যাহোক এ কাব্য পিপাসার অবসান হয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের সান্নিধ্যে এসে। অর্থাৎ তাঁর রচিত কবিতাগুলো পড়ে। খুব মন দিয়ে পড়তাম। অত্যন্ত সুন্দর সাবলীল শব্দ চয়ন। নিজেকে যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন- তেমনি কবিতাতেও ছিল তাঁর মানবিক প্রাসঙ্গিকতা এবং শিল্পরূপ। তিনি বলতেন- ‘প্রায় সমগ্র জীবন ভর বাগ্দেবীর পেছনে ছুটেছি। প্রাচীন উদ্যান থেকে ঝরনাতলায়, সূযোদয়ে ঝলমলে টিলা থেকে চোরাবালিতে। মাঝে মাঝে অবসাদে বা ব্যর্থতায় ক্ষতবিক্ষত হই- কিন্তু যাত্রা পথ ছাড়িনি। কোনো একদিন হয়তো প্রকৃত সিদ্ধির সন্ধান মিলবে।’ কবি শামসুর রাহমান কবিতার যে ইমরাতখানি এই সাধনার হাত ধরে রেখে গেলেন, সৃজনশীলতার বৈচিত্রে বাঙালি জাতির জন্য দীর্ঘকাল গৌরবকীর্তি হয়ে থাকবে।

কবির অনেক কবিতার মাঝেও ‘কখনো আমার মাকে’ - এই কবিতাটি সেদিন যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তেমনি কবিতার প্রতিটি স্তবক আজো এই সুদূর পরবাসে অন্তরে অন্তরে ভেসে আসে। যেমন তিনি লিখেছিলেন-

‘--- এখন তাদের গ্রন্থিল শরীর থেকে/ কালেভদ্রে সুর নয়/শুধু ন্যাপ্থলিনের তীব্র ঘ্রাণ/ ভেসে আসে।’ মাকে হয়তো তিনিও খুব ভালোবাসতেন। যখন শ্যামলীর বাসায় তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়Ñ দেখছিলাম উনার লাইব্রেরিতে শত শত বইয়ের মাঝে নিজের মায়ের ছবিটি শোভা পাচ্ছে। তবে মোদ্দা কথা হলো কবিতা যেমন সত্য ও সুন্দরের কথা বলে তেমনি কবিতা কথা বলে হৃদয়ের সাথে। প্রাণে প্রাণে যে না বলা বাণী যে অনুভূতি শব্দ আর আবেগ সেই তরঙ্গ বাজিয়ে দিয়ে যায়। আসলেই তো কবিতা যদি হৃদয়কে স্পর্শ না করেÑ তাহলে আর কবিতা কেন?

সেই প্রশ্নটাই একদিন করেছিলাম। স্বভাব সূলভ ভঙ্গীতে মৃদু হেসে বললেন- ‘বাগ্দেবীর পূজো করতে হবে।’ 

সেদিনের সাক্ষাতে বুঝেছিলাম- কবিতা বিষয়টি আসলেই এক অধ্যাত্মিক বিষয়। লিখে গেলেই কবিতা হয় না। পূজোর থালায় প্রতিটি ফুল যেমন গন্ধ ছড়ায়- পাঁপড়ি থেকে যেমন ভেসে আসে সুরভী আর রঙের বাহার চিত্তকে আন্দোলিত করেÑ সেই তো কবিতা। তাই তো কবি বন্ধুর প্রয়াণে সৈয়দ শামসুল হক লিখলেন- ‘রাতের আকাশ/ জাগে নক্ষত্রের অক্ষরে অক্ষরে/ সেই পংক্তি জ্বলজ্বল করেÑ কবির তো মৃত্যু নেই/ মৃত্যু নেই মৃত্যুর পরেও।’

অক্টোবর মাস ছিল কবির জন্মদিন (২৩ শে অক্টো/১৯২৯)। শাস্ত্রে বলে- ‘মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করে।’ কবি শামসুর রাহমানের আবির্ভাব ছিল কাব্য পিপাসুরদের শিল্প ভাবনা ও সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে। সৌজন্যে ও সভ্যতার তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান কবি।
সর্বশেষে যে প্রসঙ্গটি এসে যায়- সেটি হলো কবিতার বিষয়বস্তু। প্রেম-বিরহ-আবেগ ও সৌন্দর্য চেতনার বাইরেও থেকে যায় একটি বিশেষ মানবিক বিষয়, এবং সেটা হচ্ছে কবির সমাজচেতনা। সমাজে দুঃশাসন কিংবা অধঃপতন যে কবিকে বিচলিত করে- তিনিই তো যথার্থ কবি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর রাজনৈতিক নৈতিক স্খলন দেখে কবি শামসুর রহমান লিখেছেন- ‘আমার মনের মতো সমাজ এ দেশে গড়ে ওঠেনি। মুক্তচিন্তা সমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সমাজ আমার কাম্য। 

সে রকম সমাজের প্রতীক্ষায় আছি। জানি না দেখে যেতে পারবো কিনা! যদি কোনোদিন হয়, তাহলে আমাদের লড়াই একেবারে ব্যর্থ হয়নি।’ আর সমাজের উৎকর্ষ সাধনে বিরোধ নয়, প্রয়োজন মিত্রতা। তাই তো কবির সোচ্চার উচ্চারণ- ‘মানুষ কেনো যাবে না মানুষের কাছে/ কেনো পরস্পর মেলাবে না হাত/--- মানুষ কেনো ফিরিয়ে রাখবে/মুখ শুধু মানুষের কাছ থেকে/কিছু মানবিক ঘ্রাণের জন্যই। পরস্পর করে মেলামেশা/সব বিচ্ছিন্ন মানুষ।’ কবির এই দর্শন কী আমরা আজো মেনে নিতে পেরেছি? যদি পারতাম তবে সংঘাত এড়িয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে একটা সুন্দর ও সভ্য সমাজ গড়ে তুলতো পারতাম।

কবি শামসুর রাহমানকে তাঁর চোখের চিকিৎসার জন্য কিছু ওষুধ পাঠিয়েছিলাম। কবি সেটা কৃতজ্ঞচিত্ত স্মরণ করে আমাকে একটা ছোট্ট চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটা এখানে সন্নিবেশিত হলো। কবির জয় হোক- কবিতার জয় হোক। শ্রদ্ধা অবনত চিত্তে কবি শামসুর রাহমানকে স্মরণ করি।
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041