জীবনবৃন্তের পাতাঝরা হেমন্ত

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ১৬:০৫ , অনলাইন ভার্সন
লাবলু কাজী

অন্তর আর বাইরের দুটো ভিন্ন দিক নেই, একে অপরের সম্পূরক। অনেক দিন যাবৎ জীবনের কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছি। নিজের জীবন-পাঠশালার পড়ার সমাপ্তি দ্বারপ্রান্তে এসে গেল বলে জীবনের পাঠ পড়তে পড়তে। আমার বাসার সামনের লন, যেটা আমার সবচেয়ে প্রিয়, অযত্ন আর অবহেলায় কী যে অবস্থা হয়েছে, বোঝানো যাবে না। যে প্রতিবেশীরা এর তারিফের বাহবায় মুখরিত হতো, তারাই এখন বলছে রোজ গার্ডেনের যত্ন নেওয়া দরকার। বিকল্পধারার এ জীবন অভ্যাস বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় এমনিতেই অভ্যাস বদলে যায়। ইদানীং প্রায়ই চলে যাওয়া প্রিয়জনদের মুখ নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে আলোর পরশ হৃদয় স্টুডিওর ফটোঘরের ফ্রেমে বাঁধানো ওয়ালে টাঙানো দেয়ালঘড়ির মতো ঘণ্টার কাঁটায় শব্দ করে সজাগ করে। জীবনের ঘুম ভাঙায়, তাদের বড্ড মিস করি। জীবনখাতার সঞ্জীবিত পাতায় ডায়েরির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবি, আর কত পাতা বাকি আছে। জীবন তারার মেলা এত বিশাল নভোমণ্ডলের একটি নক্ষত্র ছুটে পড়ে গেলে কার কী আসে যায়, কে বা তার খবর রাখে...।

প্রকৃতির অদ্ভুত পরিবর্তন ঋতুর পালাবদলের ধারায়। জীবন বদলায়Ñপ্রকৃতি নীরব ভাষায় বলে দেয়। জীবনধারায় নিঃস্বার্থ জীবনের প্রতিদিনের সাথি ভালো ও মন্দ সময়ের। প্রকৃতির রসাদার সবার জন্য সমানে বণ্টিত। জীবনপুলক জীবনসন্ধান বসন্ত ও শীতে ভিন্ন ধারায় আমাদের মনোরঞ্জনের উদ্যোগ আমরা কি দেখতে পাই না? বর্ণের বিভাজনে শীতের পত্রপল্লব কি তখন শোভিত হয় না মন হরণে! এ সবই স্রষ্টার কীর্তি সৃষ্টিতে বান্দার তরে সুখেরও লাগিয়া। ভাবে গদগদ হয়ে নতজানু হয়ে সেজদায় কেন পড়বেন না, সে ভাবনার কি কোনো বিকল্প আছে? না, নাই। ভাবছি বসে আপন মনে এই পরবাসে ঘরছাড়া ঘরে গ্রামছাড়া শহরে। দূর বহুদূর আমার শেকড়ছেঁড়া গাছের মতো, নাড়ি কাটা মায়ের শিশুসন্তানের মতো, বাপ ছাড়া এতিম বাচ্চার মতো...

দুঃখের বইঠা বাইতে বাইতে যারা জীবন নামের সাগরটি পাড়ি দিতে চায়, সুখ নামের সোনার হরিণ ধরার আশায় না তাদের উত্তাল দরিয়া পার হওয়া হয়, না সোনার হরিণ ধরা দেয়। অশান্ত আর উচ্ছল দরিয়া কষ্টের যাতনায়, ঢেউয়ের টালমাটালে মাঝ দরিয়ায়ই হাওয়াইর মিঠাইর মতো উবে যায়। জীবন এক দুস্থ পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যাধি ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যথায় আমরা কাতরাই কিন্তু উপশমের মলম নেই, বড়ই বিরল এখন। বন্য জগৎ এখন দুনিয়া, সবল বাঘের দাপটে হরিণ এখন অসহায়, নিরুপায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিরীহ প্যালেস্টাইনরা মার খাচ্ছে, দেখার কেউ নেই, বলি বলি করে বলেও না আর কেউ। তাইরান আবাবিল পাখিও আর আসে না রক্ষায়, ওরাও আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় থাকলেও আদেশ আর আসে না। নিজ কষ্টগুলো নিজ মনেই আপস করে ফেলি ইদানীং, যখন দেখি বা শুনি, অন্যের দুঃখ ব্যথাগুলো আমার চেয়েও বেশি তীব্র আরও হৃদয়বিদারক। আকাশঘুড়ির পালে এখন উজান দখিনা হাওয়া, সুতার টানে লাটাইয়ের আয়ু শেষ আর সুতা নেই; পাওয়ারও আশা নেই। কাল আমেরিকায় ‘ডে লাইট সেভিংসের শেষ দিন ছিল’। ওদিন ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে নিয়ে এরা সময়ের সমন্বয় করে। ভাবনার চড়কি চড়কগাছের ঘূর্ণনে ঘুরে মন বলে আমরা কেন জীবন নামের ঘড়িটাকে পেছনে টেনে নিতে পারি না? অদ্ভুত এই খেয়ালের কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই উদ্ভট খেয়ালের বাসিন্দা আমরা সকলে।

আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি আমার মায়ের দোয়া। জীবনে অনেকবার পড়ে গিয়েছি অতল তলে। মনে হয়েছে, এই গহিন তল থেকে আর কোনো দিন উঠতে পারব না কিন্তু ঠিকই উঠে গিয়েছি। আর তখনই স্নেহের ডালিতে ভরে দিয়ে মা বলেছেন, ‘ভয় কী বাজান, এই তো আমি আছি তোমার পাশে!’ মা, আজ তুমি আর নেই। এই মায়া-মরীচিকার জীবন হতে অনেক উপরে, তবু তোমায় স্মরি দিন দিন প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটার মতো চব্বিশ ঘণ্টা। মা, তোমার ঋণ আমি শোধ করতে পারিনি, পারবও না কোনো দিন। তবু বিশ্বাস করো মা, আমার চেষ্টার ত্রুটি নেই, সেটা উমরায় রবের দ্বারে অশ্রু বিসর্জনে বা আমার লেখনীতে সব সময় তোমায় ঘিরে আবর্তিত হয়। তুমি ভালো থেকো মা পরকালে ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা...

সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস ও বছর পেরিয়ে অলস ও কর্মঠ দিন শেষে সাকসেসফুল বা নিষ্কর্মণ্য হয়েও আমরা বেঁচে থাকি ধরার প্রয়োজনে, চাহিদার নিমিত্তে প্রয়োজনের চাহিদায়। এত সবের পরও আমাদের সান্ত্বনা কোথায়, যখন আমরা দেখি কাউকে সুখী করতে পারা গেল না। একটা জিনিস সর্বদাই রূঢ় বাস্তবতা হয়ে এই ভালো মানুষগুলোর জীবনে জ্বলজ্বলে কালো রাতের নক্ষত্রের মতোই জীবনপঞ্জিতে দেখা যায় লাল দাগে বৃত্ত আঁকা ‘সবাইকে সুখী করতে গিয়ে নিজেরাই অসুখী হয়ে চলে যাই’। জীবন এক বৃত্তের মতো সাঁতার না-জানা মানুষ যেমন হাত-পা ছুড়েও কূলের নাগাল পায় না, তেমনি হাত-পা বাঁধা মানুষগুলোও প্রাণপণ চেষ্টা করেও এ গোলকধাঁধার বাইরে যেতে পারে না। এখানেই সমাপ্তি ঘুলুতে আটকে পড়া ইঁদুরের মতো খাবারের লোভের পরিণতি ‘এড়ড়ফ নুব পযধৎষরব!’ এসব দিনরাত্রির খেল খেলনায় অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে ভাই-বেরাদর, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের নীরব অভিমানের চাপা কান্না নিয়ে চলে যেতে দেখি। 

আমি প্রশ্নটা নিজেকে বারবার করি, এমন কেন হয়? উত্তরটা মনে হয় এমন, আল্লাহ সোবহানওতায়ালা যে উদ্দেশ্যে আমাদের ভবে প্রেরণ করেছেন, তা থেকে ভুল পথে বিচ্যুত হয়ে আমরা নিজ সৃষ্ট গন্তব্যে চলি, অন্যকেও ধাওয়া করি সঙ্গে চলতে। ভুল পথ, উদ্দেশ্যবিহীন জীবন আরোহণ, তাই ধপাস করে উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে ভূমিতে পতিত প্রাণ দিগ্্বিদিক ছুটে চলে উল্কার গতিতে, থামে গিয়ে রবের দরবারে অপরাধীর বেশে...।

-নিউইয়র্ক, ১৭ নভেম্বর ২০২৩
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: +880  1338-950041