পড়া

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:৩২ , অনলাইন ভার্সন
কামরুল হোসেন লিটু

একদম নিজের জন্য আমি কিছু লিখি না অথবা বলা যায় লিখতে পারি না। এ কারণেই ডায়েরি লেখা হয় না আমার। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করেছি ইদানীং, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় তথ্য নোটবুকে লিখে রাখি। এটাই আমার একান্ত নিজের জন্য লেখা।
অনেক চিন্তাভাবনা করে বহু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সমসাময়িক কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে মন চায়। রোমান্টিক, পারিবারিক ও সমাজের বিভিন্ন সংগতি-অসংগতি নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখতে চাই কিন্তু আজকাল মানুষের বই, পত্র-পত্রিকা পড়ার প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় কমে গেছে দেখে উৎসাহ পাই না। একজন লেখক সব সময়ই চায় তার লেখা পাঠক পড়ুক এবং লেখার প্রশংসা বা সমালোচনা হোক। পাঠকের ভালো-মন্দ যেকোনো প্রতিক্রিয়া লেখকের জন্য যেমন উৎসাহের, তেমনি সংশোধনের। প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে মানুষের পড়ার প্রতি আগ্রহ উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। প্রায় সবাই ভিডিও দেখতে চায়, পড়তে চায় না। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকসহ অনেক মাধ্যমে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করছে। তবু অল্প সময়ের জন্য হলেও বই বা পত্রিকা পড়ছে না।

পৃথিবীর যেকোনো ভাষার মানুষকেই আগে পড়তে হয়, প্রথম অক্ষর চেনা হয় পড়ার মাধ্যমেই। স্কুলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে খবরের কাগজ পড়া এবং বিভিন্ন ছবি দেখার মধ্য দিয়েই আমার পড়ার অভ্যাস শুরু হয়। যখন যে শ্রেণিতে পড়েছি, তখন সেই শ্রেণির বাংলা বইয়ের গল্পগুলো প্রথমেই পড়ে ফেলতাম। আমার ছেলেবেলায় সম্ভবত তখন থ্রি-ফোরে পড়ি, সে সময় আব্বাহুজুর এলাকার বড় মসজিদ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত বিভিন্ন নবী ও সাহাবির গল্পের বই এনে আমাকে পড়তে দিতেন। সেসব ঐতিহাসিক গল্প ছিল সততা ও কঠোর পরিশ্রমের জীবনকাহিনি। মাধ্যমিক স্কুলে পড়াকালীন এলাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে যাওয়া একসময় আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিন বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম বিভিন্ন লেখকের গল্প-উপন্যাস পড়ার জন্য। শরৎচন্দ্র, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শাহাদাত হাসান মান্টো, সুনীল-সমরেশ এবং আমাদের হুমায়ূন আহমেদের প্রচুর লেখা পড়েছি। সুনীল-সমরেশ ও হুমায়ূনের অনেক বই পড়তে পড়তে শেষের দিকে এলে মনে হতো, আহা শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এখনো বইপড়ার প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ। কেউ দেশে গেলে বা এলে বই আনতে বলি। বিভিন্ন রকমের বই পড়লে আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়, অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। এবার বাংলাদেশে গেলে ব্যাগভরে বই কিনে আনার ইচ্ছা আছে। অবসরে বইপড়ার চেয়ে আনন্দ আমার কাছে আর কোনো কিছুতে নেই। কত ভালো ভালো বই পড়া যে বাকি, সেটা ভাবলে সত্যিই খারাপ লাগে, জানি না আমার মনের তালিকায় থাকা বইগুলো পড়তে পারব কি না।
প্রবন্ধ-গল্প-কবিতা অথবা দেশ-বিদেশের নানাবিধ খবর পড়লে যেকোনো ব্যক্তির মানসিক বিকাশ হয়, মনের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়। সবাই লেখক, বিজ্ঞানী বা ডাক্তার হয় না কিন্তু পড়ার মাধ্যমে সকল বিষয়েই জ্ঞান লাভ সম্ভব। দুঃখের বিষয়, আমাদের বেশির ভাগ পড়ালেখাই বৈষয়িক। যেকোনো প্রকার লাভ না থাকলে সেসব পড়ায় আমরা খুবই অনাগ্রহী।

প্রখ্যাত লেখক প্রমথ চৌধুরী যে ব্যারিস্টার ছিলেন, সে তথ্য অনেকেই জানি না। তিনি তার ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যারা হাজারখানা ল’ রিপোর্ট কেনেন, তারা একখানা কাব্যগ্রন্থ কিনতে প্রস্তুত নন। কেননা, তাতে ব্যবসার কোনো সুসার নেই। নজির না আউড়ে কবিতা আবৃত্তি করলে মামলা যে হারতে হবে, সে তো জানা কথা, কিন্তু যে কথা জজে শোনে না, তার কোনো মূল্য নেই, এইটাই হচ্ছে পেশাদারদের মহাভ্রান্তি। জ্ঞানের ভান্ডার যে ধনের ভান্ডার নয়, এ সত্য তো প্রত্যক্ষ।’

ইদানীং অবশ্য নতুন একটা ফ্যাশন লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ড্রয়িং রুমের বুক শেলফে বিভিন্ন নামকরা বইয়ে ঠাসা থাকে, বিশেষ করে রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎ, সুনীল, সমরেশ, হুমায়ূন রচনাবলিসহ অন্যান্য এক নামে চেনা বিদেশি বই। কিন্তু ওই বুক শেলফে সাজিয়ে রাখা পর্যন্তই, পড়া আর কারও হয়ে ওঠে না। স্টিফেন হকিংয়ের ১৯৮৮ সালের বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ সারা পৃথিবীতে বেস্ট সেলার। বইটি ৩৫টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বিক্রি হয়েছে এক কোটির বেশি কপি। আবার এই বইকেই বলা হয় সর্বকালের সবচেয়ে না পড়া বই।

লেখক মাত্রই ভালো পাঠক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। লক্ষ করলে দেখা যায়, আজকালকার লেখকেরা বেশি পড়েন না। সম্প্রতি আমার এক লেখকবন্ধুকে বাংলাদেশে ফোনে কথা প্রসঙ্গে বললাম, আমি একটা কবিতার বই প্রকাশ করতে চাই। সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল কবিতা নয়, গল্প বা উপন্যাস লেখো, যা বই আকারে প্রকাশিত হলে মানুষ কিনবে এবং পড়বে। কবিতা কেউ পড়ে না। এখানে বলে রাখি আমার এই বন্ধুটিও ভালো পাঠক নয়। আমিও জানি, গল্প-উপন্যাসের পাঠক বেশি, সে তুলনায় কবিতা ও প্রবন্ধের পাঠক খুব কম। পাঠকেরা হয়তো মনে করতে পারে কবিতা লেখাটা খুব সহজ, যেকোনো একটা দুর্বোধ্য কিছু লিখে দিলেই কবিতা হয়ে গেল। আমার কাছে অন্তত সেটা মোটেও নয়। আমি যেহেতু পাঠকের জন্য লিখি, আমার মত হলো সংক্ষেপে একটা বক্তব্যকে সাবলীল ভাষায় সুন্দরভাবে উপস্থাপনই কবিতা, সেটা ছন্দে হতে পারে বা ছন্দহীন। কবিতা প্রসঙ্গে তসলিমা নাসরিন সম্প্রতি বলেছেন, ‘কবিতা আসতে হয়। এটিকে যখন তখন আনা যায় না। উপন্যাস আনা যায়, গল্পটল্প আনা যায়। কবিতা কবে আসবে কেউ জানে না। নিজে থেকে না এলে একে ধরে-বেঁধে নিয়ে আসা যায় বটে, তবে সেই কবিতায় প্রাণ থাকে না। প্রাণহীন কবিতা থাকাও যা, না থাকাও তা।’

ফেসবুকের এই যুগে অবশ্য অনেককে দেখি তাদের কবিতা আপলোড করতে। আমিও মাঝেমধ্যে আমার কবিতা ফেসবুকে ছাড়ি। যারা বই কিনবে না, কবিতা পড়বে না, তারাও লক্ষ করেছি ফেসবুকে প্রবাহিত কবিতা পড়ছে, লাইক দিচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে কমেন্ট করছে। গল্প-উপন্যাস বা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে এ ধরনের পাঠক নেই বললেই চলে। তবে ইউটিউবে অডিও বুকের মাধ্যমে গল্প-উপন্যাস শুনতে পাওয়া যায়। আমিও কয়েকবার শুনে বুঝেছি পড়া আর শোনার ভেতরে অনেক পার্থক্য। পড়লে যেকোনো ব্যক্তির মননে ও মগজে ওই গল্প বা উপন্যাসের পরিপূর্ণ রস আস্বাদন সম্ভব, যেটা অডিও শুনে সে রকম উপলব্ধি অনুভূত হয় না।

আমার আম্মাহুজুর, যার বয়স বর্তমানে প্রায় ৮০, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্ভবত সর্বোচ্চ পঞ্চম শ্রেণি। আমার ছোট বয়সে আমি তার সংগ্রহে দেখেছি আলিফ লায়লা, আনোয়ারা ইত্যাদি বই কিন্তু গত তিন যুগেও আমি তাকে আর এ ধরনের বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়তে দেখি না। তবে তিনি নিয়মিত পড়েন দুবেলা বা কমপক্ষে এক বেলা পবিত্র কোরআন।

খুবই জানাশোনা এক দম্পতি, উভয়েই মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। ‘মিস্টার’ শৌখিন লেখক ভাব+আবেগে মাঝেমধ্যে লেখেন। আর ওই লেখাটা প্রথম পড়তে দেন তার ‘মিসেস’কে। ‘মিসেস’ ছোটখাটো ছড়া এবং কবিতা অনেক অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পড়লেও প্রবন্ধ আর গল্প পড়তেই চান না। এ জন্য ‘মিস্টার’ প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন, শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করে ভেবেছিলাম আমার লেখার ভালো-মন্দ কিংবা গঠনমূলক আলোচনা পাব, অথচ...। একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে ওই মিস্টারের মিসেসের সঙ্গে দেখা হলে আমি কৌতূহলী প্রশ্ন করে বসি, ‘আপনার পড়া কোন উপন্যাসটা খুব ভালো লেগেছে?’ মিসেস বিরস বদনে উত্তর দিলেন, উপন্যাস পড়ার সময় কই? তা ছাড়া উপন্যাস বা যেকোনো ভালো লেখকের বড় গল্প পর্যন্ত নাটক বা সিনেমা হিসেবে পাওয়া যায়। ফলে এত কষ্ট করে পড়ার দরকার আছে কি? এর জবাবে আমি লা-জবাব!
M M Shahin, Chairman Board of Editors, Thikana

Corporate Headquarter :

THIKANA : 7409 37th Ave suite 403

Jackson Heights, NY 11372

Phone : 718-472-0700/2428, 718-729-6000
Fax: + 1(866) 805-8806



Bangladesh Bureau : THIKANA : 70/B, Green Road, (Panthapath),
5th Floor, Dhaka- 1205, Bangladesh.
Mobile: 01711238078