মফিজুল হুসাইন
আওয়ামী লীগ সরকার যে কৌশলে এগোচ্ছে, তাতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। খালেদা বা তারেক জিয়াকে বাদ দিয়ে নতুন বিএনপি গঠন করে তারা সরকারের সঙ্গে নির্বাচন করবে-সরকারি পরিকল্পনাকারীরা যদি এ রকম ভেবে থাকেন, তাহলে তারা বেকার স্বর্গে বাস করেন। প্রথমত, বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয়ত, গত ১৫ বছরে বর্তমান বিএনপির নেতারা সরকারি অত্যাচার, হামলা, মামলায় খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছেন, কোনো কিছুতেই তাদেরকে টলাতে পারবে না, এমনকি মৃত্যুভয়ও। তৃতীয়ত, মার্কিন চাপ সম্পর্কে তারা অবগত। তারা জানে, মার্কিনিদের হাতে এমন সব টুলস রয়েছে, যা প্রয়োগ করলে এ সরকার বেশি দিন টিকতে পারবে না, এমনকি আপাতত একটা নির্বাচন করতে পারলেও। চতুর্থত, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট জিএম কাদেরের বক্তব্য এবং জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন মাঠে নেমে পড়ায় বিএনপির নেতারা বুঝে নিয়েছেন, সরকারের পায়ের তলার মাটি কতটুকু শক্ত। বিকল্প বিএনপি গঠন সরকারের প্ল্যান A ব্যর্থ হলে সরকার প্ল্যান B নিয়ে এগোতে চাইবে। প্ল্যান B-তে সরকার চাইছে তাদের অনুগ্রহে গড়ে ওঠা তৃণমূল বিএনপি বা বিএনএনে বিএনপির নেতারা যোগ দিয়ে তাদের সঙ্গে নির্বাচন করুক। সেখানে বিএনপির চতুর্থ বা পঞ্চম সারির কাউকে পাওয়া গেলেও তারা কেউই নির্বাচনের মাঠে গিয়ে দাঁড়াতেই পারবে না। পুলিশ কত দিন তাদের পাহারা দিয়ে রাখবে? সুতরাং প্ল্যান B-ও মাঠে মারা যাবে। আবার তথ্যমন্ত্রীর বিএনপির হাফিজউদ্দিন বীর বিক্রমের নেতৃত্বে নতুন পার্টি গঠনের গল্প তো এক চরম দৈন্যের উপাখ্যান হয়ে গেল।
প্ল্যান A ও B ফলপ্রসূ করতে না পারলে পশ্চিমাদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি নিয়ে সরকার কী করবে? অবশ্য এ মুহূর্তে সরকারের মাথাব্যথা শুধু আমেরিকাকে নিয়েই নয়, দেশের অভ্যন্তরের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে নিয়ে কিছু আলোচনা এদিক-ওদিক থেকে শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের একটি পত্রিকায় একজন শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ থেকে সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের একটু বর্ণনা পাওয়া যায়। তা ছাড়া দেশের অভ্যন্তরের দু-একটি ঘটনার সঙ্গে ওই বিশ্লেষকের বর্ণনার মিল দেখা যায়। কিছুদিন আগে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরাফাতের অপেক্ষাকৃত কম ভোট পাওয়া নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলে কিছু চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। সেখানে আরাফাতের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম বেশ ভোট পান। ফলে ক্যান্টনমেন্টের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ওই এলাকায় কারা কিসে ভোট দিয়েছে, তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একটি গুরুত্বহীন ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোট পড়া উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কম ভোট পাওয়ার তদন্ত কোনো কাকতলীয় ঘটনা ছিল না। এই তদন্তের শেকড় রয়েছে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে, যেখানে সারা দেশের আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট পেলেও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার প্রার্থীর ২০ শতাংশ ভোট পাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণ-বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছিল। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কম ভোট পাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিখ্যাত লেখক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস পরবর্তী সময়ে জে. জিয়া ও জে. মঞ্জুরের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, যা তার বই ‘এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে পাওয়া যায়। ভারতের ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’ অবিনাশ পালিওয়ালের সামরিক বাহিনীর অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘটনাটির সঙ্গে ২০২৩ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ স্থগিত করার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। যদিও সামরিক বাহিনী এখনো সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে-এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। তার পরও পশ্চিমাদের শাখা-প্রশাখা কোথায় কখন বিস্তার করে, তা নিয়ে সরকার একটু উদ্বিগ্ন থাকতেই পারে। সব মিলিয়ে সরকার একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে আছে, তা বলাই বাহুল্য।
২০১৪ সালের নির্বাচন সব দল বয়কট করার ফলে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করার জন্য ভারতের সুজাতা সিং এসে এরশাদকে চাপ দিলেও তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে সিএমএইচে ভর্তি করে নির্বাচন করিয়ে নেওয়া হয়। এবার কিন্তু জিএম কাদের আরও শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সুজাতা সিংরা আসবেন না, রওশন এরশাদও শারীরিকভাবে দুর্বল; তাহলে সরকার কাদেরকে নিয়ে নির্বাচন করবে?
নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদেরা অথবা স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান বলছেন, দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারে অবস্থান করছে, যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। তাহলে এই সংবেদনশীল সময়ে দেশের বাণিজ্যিক অংশীদারদের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি আত্মঘাতী নির্বাচন করা কি কোনো দেশপ্রেমিক সরকারের পক্ষে সম্ভব?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী ভারতের ওপর আস্থাশীল বা এখনো বিশ্বাস করেন, ভারত যেকোনোভাবে হোক আমেরিকাকে ম্যানেজ করে তাকে ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা করবে। সব সরকারপ্রধানই সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তির চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন এবং এ ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার চেয়ে আমেরিকার কাছে ভারতের জাতীয় স্বার্থ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি চিন্তাভাবনা কাজ করতে পারে, যা দু-একজন আওয়ামী লীগ সমর্থকের মুখে শোনা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা আছে, তাতে এক বছর টিকে থাকা যাবে এবং আগামী নির্বাচনে বাইডেন হেরে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে সবকিছু স্বাভাবিক করে নেওয়া সমস্যা হবে না। আবার অনেকের ভাবনা এ রকম-বাংলাদেশ যত সস্তায় তৈরি পোশাক দিতে পারে, পৃথিবীর অন্য কেউ তা দিতে পারবে না। সুতরাং ওই তৈরি পোশাক সেক্টরে কেউ হাত দেবে না। এ দুটিই অবাস্তব ও শিশুসুলভ ভাবনা। অন্যদিকে চীনের দিকে তাকিয়ে থাকা বাংলাদেশের লাভের চেয়ে ক্ষতির দিকটাই বেশি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে ফারুক খান ও মেননের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল চীনে পাঠানো আমেরিকা বা পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার শামিল। চীন এবং পশ্চিমা বিশ্ব যখন একটি স্নায়ুযুদ্ধে ধাবিত, সেখানে চীনের পক্ষ নেওয়ার সামর্থ্য সরকারের আছে কি না, সেটা পরিমাপ করে নিলে ভালো হতো। সমগ্র জনগোষ্ঠী যদি সরকারের পক্ষে থাকত, তাহলে আমেরিকা এতটা খোলামেলা হয়ে হয়তো মাঠে নামত না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাই যখন এ সরকারের পরিবর্তন চাইছে, তখন চীনের সাহায্য প্রত্যাশা করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
এখন খালেদা/তারেককে মাইনাস করে বিএনপি গঠনে ব্যর্থতা বা বিএনপির নেতাদের সরকারি অর্থায়নের কিংস পার্টিগুলোতে যোগদানে হতাশামূলক অগ্রগতি, হাফিজউদ্দিনের চপেটাঘাত, জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে না পারা, ভারতের নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখা, চীনের রাজনৈতিক সাহায্য চেয়ে অর্থবহ কিছু না পাওয়া এবং খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি নিয়ে আরেকটি ২০১৪ এর আদলে বা কম্বোডিয়া মডেলে নির্বাচনের ঝুঁকি নেওয়া কি আওয়ামী লীগের জন্য মঙ্গল হবে? ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হয়তো কয়েক মাসের জন্য লাভ হবে কিন্তু দল হিসেবে অনাগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সাধিত হবে। এখন স্বল্পমেয়াদি লাভ, না দীর্ঘ মেয়াদের ক্ষতি ডেকে আনবেন, তা একান্তই প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে।
-নিউইয়র্ক, ৭ নভেম্বর ২০২৩
আওয়ামী লীগ সরকার যে কৌশলে এগোচ্ছে, তাতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। খালেদা বা তারেক জিয়াকে বাদ দিয়ে নতুন বিএনপি গঠন করে তারা সরকারের সঙ্গে নির্বাচন করবে-সরকারি পরিকল্পনাকারীরা যদি এ রকম ভেবে থাকেন, তাহলে তারা বেকার স্বর্গে বাস করেন। প্রথমত, বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণে। দ্বিতীয়ত, গত ১৫ বছরে বর্তমান বিএনপির নেতারা সরকারি অত্যাচার, হামলা, মামলায় খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছেন, কোনো কিছুতেই তাদেরকে টলাতে পারবে না, এমনকি মৃত্যুভয়ও। তৃতীয়ত, মার্কিন চাপ সম্পর্কে তারা অবগত। তারা জানে, মার্কিনিদের হাতে এমন সব টুলস রয়েছে, যা প্রয়োগ করলে এ সরকার বেশি দিন টিকতে পারবে না, এমনকি আপাতত একটা নির্বাচন করতে পারলেও। চতুর্থত, জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট জিএম কাদেরের বক্তব্য এবং জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন মাঠে নেমে পড়ায় বিএনপির নেতারা বুঝে নিয়েছেন, সরকারের পায়ের তলার মাটি কতটুকু শক্ত। বিকল্প বিএনপি গঠন সরকারের প্ল্যান A ব্যর্থ হলে সরকার প্ল্যান B নিয়ে এগোতে চাইবে। প্ল্যান B-তে সরকার চাইছে তাদের অনুগ্রহে গড়ে ওঠা তৃণমূল বিএনপি বা বিএনএনে বিএনপির নেতারা যোগ দিয়ে তাদের সঙ্গে নির্বাচন করুক। সেখানে বিএনপির চতুর্থ বা পঞ্চম সারির কাউকে পাওয়া গেলেও তারা কেউই নির্বাচনের মাঠে গিয়ে দাঁড়াতেই পারবে না। পুলিশ কত দিন তাদের পাহারা দিয়ে রাখবে? সুতরাং প্ল্যান B-ও মাঠে মারা যাবে। আবার তথ্যমন্ত্রীর বিএনপির হাফিজউদ্দিন বীর বিক্রমের নেতৃত্বে নতুন পার্টি গঠনের গল্প তো এক চরম দৈন্যের উপাখ্যান হয়ে গেল।
প্ল্যান A ও B ফলপ্রসূ করতে না পারলে পশ্চিমাদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি নিয়ে সরকার কী করবে? অবশ্য এ মুহূর্তে সরকারের মাথাব্যথা শুধু আমেরিকাকে নিয়েই নয়, দেশের অভ্যন্তরের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে নিয়ে কিছু আলোচনা এদিক-ওদিক থেকে শোনা যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের একটি পত্রিকায় একজন শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন বিশ্লেষকের বিশ্লেষণ থেকে সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের একটু বর্ণনা পাওয়া যায়। তা ছাড়া দেশের অভ্যন্তরের দু-একটি ঘটনার সঙ্গে ওই বিশ্লেষকের বর্ণনার মিল দেখা যায়। কিছুদিন আগে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরাফাতের অপেক্ষাকৃত কম ভোট পাওয়া নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলে কিছু চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। সেখানে আরাফাতের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম বেশ ভোট পান। ফলে ক্যান্টনমেন্টের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ওই এলাকায় কারা কিসে ভোট দিয়েছে, তা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একটি গুরুত্বহীন ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোট পড়া উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কম ভোট পাওয়ার তদন্ত কোনো কাকতলীয় ঘটনা ছিল না। এই তদন্তের শেকড় রয়েছে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে, যেখানে সারা দেশের আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট পেলেও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার প্রার্থীর ২০ শতাংশ ভোট পাওয়া এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণ-বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছিল। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কম ভোট পাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিখ্যাত লেখক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস পরবর্তী সময়ে জে. জিয়া ও জে. মঞ্জুরের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, যা তার বই ‘এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে পাওয়া যায়। ভারতের ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’ অবিনাশ পালিওয়ালের সামরিক বাহিনীর অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘটনাটির সঙ্গে ২০২৩ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ স্থগিত করার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। যদিও সামরিক বাহিনী এখনো সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে-এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। তার পরও পশ্চিমাদের শাখা-প্রশাখা কোথায় কখন বিস্তার করে, তা নিয়ে সরকার একটু উদ্বিগ্ন থাকতেই পারে। সব মিলিয়ে সরকার একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে আছে, তা বলাই বাহুল্য।
২০১৪ সালের নির্বাচন সব দল বয়কট করার ফলে আওয়ামী লীগকে সাহায্য করার জন্য ভারতের সুজাতা সিং এসে এরশাদকে চাপ দিলেও তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে সিএমএইচে ভর্তি করে নির্বাচন করিয়ে নেওয়া হয়। এবার কিন্তু জিএম কাদের আরও শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সুজাতা সিংরা আসবেন না, রওশন এরশাদও শারীরিকভাবে দুর্বল; তাহলে সরকার কাদেরকে নিয়ে নির্বাচন করবে?
নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদেরা অথবা স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান বলছেন, দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারে অবস্থান করছে, যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। তাহলে এই সংবেদনশীল সময়ে দেশের বাণিজ্যিক অংশীদারদের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি আত্মঘাতী নির্বাচন করা কি কোনো দেশপ্রেমিক সরকারের পক্ষে সম্ভব?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী ভারতের ওপর আস্থাশীল বা এখনো বিশ্বাস করেন, ভারত যেকোনোভাবে হোক আমেরিকাকে ম্যানেজ করে তাকে ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা করবে। সব সরকারপ্রধানই সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তির চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন এবং এ ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার চেয়ে আমেরিকার কাছে ভারতের জাতীয় স্বার্থ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি চিন্তাভাবনা কাজ করতে পারে, যা দু-একজন আওয়ামী লীগ সমর্থকের মুখে শোনা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা আছে, তাতে এক বছর টিকে থাকা যাবে এবং আগামী নির্বাচনে বাইডেন হেরে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে সবকিছু স্বাভাবিক করে নেওয়া সমস্যা হবে না। আবার অনেকের ভাবনা এ রকম-বাংলাদেশ যত সস্তায় তৈরি পোশাক দিতে পারে, পৃথিবীর অন্য কেউ তা দিতে পারবে না। সুতরাং ওই তৈরি পোশাক সেক্টরে কেউ হাত দেবে না। এ দুটিই অবাস্তব ও শিশুসুলভ ভাবনা। অন্যদিকে চীনের দিকে তাকিয়ে থাকা বাংলাদেশের লাভের চেয়ে ক্ষতির দিকটাই বেশি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বমুহূর্তে ফারুক খান ও মেননের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল চীনে পাঠানো আমেরিকা বা পশ্চিমকে চ্যালেঞ্জ দেওয়ার শামিল। চীন এবং পশ্চিমা বিশ্ব যখন একটি স্নায়ুযুদ্ধে ধাবিত, সেখানে চীনের পক্ষ নেওয়ার সামর্থ্য সরকারের আছে কি না, সেটা পরিমাপ করে নিলে ভালো হতো। সমগ্র জনগোষ্ঠী যদি সরকারের পক্ষে থাকত, তাহলে আমেরিকা এতটা খোলামেলা হয়ে হয়তো মাঠে নামত না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়া সবাই যখন এ সরকারের পরিবর্তন চাইছে, তখন চীনের সাহায্য প্রত্যাশা করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
এখন খালেদা/তারেককে মাইনাস করে বিএনপি গঠনে ব্যর্থতা বা বিএনপির নেতাদের সরকারি অর্থায়নের কিংস পার্টিগুলোতে যোগদানে হতাশামূলক অগ্রগতি, হাফিজউদ্দিনের চপেটাঘাত, জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে না পারা, ভারতের নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখা, চীনের রাজনৈতিক সাহায্য চেয়ে অর্থবহ কিছু না পাওয়া এবং খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি নিয়ে আরেকটি ২০১৪ এর আদলে বা কম্বোডিয়া মডেলে নির্বাচনের ঝুঁকি নেওয়া কি আওয়ামী লীগের জন্য মঙ্গল হবে? ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর হয়তো কয়েক মাসের জন্য লাভ হবে কিন্তু দল হিসেবে অনাগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সাধিত হবে। এখন স্বল্পমেয়াদি লাভ, না দীর্ঘ মেয়াদের ক্ষতি ডেকে আনবেন, তা একান্তই প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে।
-নিউইয়র্ক, ৭ নভেম্বর ২০২৩