মুহম্মদ শামসুল হক : বর্ষপরিক্রমার ডানায় ভর করে পবিত্র লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান (শাবানের মধ্যভাগের রাত) বা লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্য রজনী আবারও বিশ্ব মুসলিমের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। শাবান মাসের পঞ্চদশ রজনী তথা আগামী ৬ মার্চ সোমবার দিবাগত রাতে বাংলাদেশিদের পরিচালনাধীন নিউইয়র্কের মসজিদগুলোতে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার খবর মিলেছে। সম্প্রতি লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্য রজনী উদ্্যাপন নিয়ে মুসলিম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিভেদ-বিভক্তি এবং মতানৈক্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। লাইলাতুল বরাতের সপক্ষীয় এবং বিপক্ষীয় বিশেষজ্ঞরা পরস্পরকে কাফের ফতোয়া দিতেও পিছপা হচ্ছেন না।
এমনতর বাস্তবতায় আমাদের মতো গোবেচারা প্রকৃতির মুসলমানদের চরম যুগসন্ধিক্ষণের মধ্যে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্বপ্রতিপালক মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা এবং ধর্মীয় যাবতীয় বিভেদ-বিসংবাদ ও মতানৈক্যের অবসান কামনা করছি।
লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্য রজনী নিয়ে সহস্র মতানৈক্য সত্ত্বেও শাবান মাসের মধ্যভাগের রজনীর মাহাত্ম্য, গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সম্পর্কে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আদৌ বিবাদ-বিসংবাদ বা মতানৈক্য নেই। প্রত্যেক ধর্মীয় বিশেষজ্ঞই অকপটে স্বীকার করেন, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের পাপ স্খলন এবং তাদের প্রতি অতুলনীয় রহমত হিসেবে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা পাঁচটি বিশেষ দিবস ও রজনী বরাদ্দ করেছেন। পবিত্র শাবানের মধ্যভাগের রাত বা নিসফে মিন শাবান সেই পরম মহিমান্বিত ও রহমতপূর্ণ রজনীর অন্যতম। অনবদ্য কারণে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট চরম আজাব-গজবের সকরুণ শিকার এবং বিপথগামী ও পাপসাগরে নিমজ্জমান বিশ্ব মুসলিমের জীবনে পবিত্র লাইলাতুল বরাত বা নিসফে মিন শাবানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই বিশেষ রজনীতে মহান আল্লাহ তায়ালা মাগরিবের পর থেকে ফজর পর্যন্ত বিশ্ববাসীর ওপর তাঁর অফুরন্ত রহমত বর্ষণ করেন এবং বিশেষ ধরনের অপরাধী (বান্দার হক আত্মসাৎকারী এবং আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারকারী ছাড়া) অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ক্ষমা প্রার্থনাকারী সকলের অপরাধ মার্জনা করেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন বলেছেন, শাবানের পঞ্চদশ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকুলের প্রতি বিশেষ রহমত ও বরকতপূর্ণ দৃষ্টিপাত করেন এবং দুই ধরনের অপরাধী ছাড়া অবশিষ্ট সকল ক্ষমাপ্রার্থীর পাপরাশি মোচন করেন। ওই দুই ধরনের অপরাধী হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদে অংশীদারকারী এবং অন্য মুসলমানের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ ভাব বা ঘৃণা পোষণকারী [আহমদ]। আল্লাহর একত্ববাদে অংশীদারকারী, মুসলমানদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণকারী ছাড়াও বান্দার হক তছরূপকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং পিতামাতার অবাধ্যদের কথাও অন্যান্য হাদিসে মহানবী (সা.) উল্লেখ করেছেন বলে জানা যায়। যাহোক, লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান উপলক্ষে আমরা ছগিরা-কবিরা, জানা-অজানা, ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত সকল ধরনের অপরাধ ও পাহাড় পরিমাণ গোনাহ মাফের জন্য বিশ্ববিধাতার মহান রহমত এবং কৃপা ভিক্ষা করছি। আমিন!
লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বর্ণনাকালে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, শাবানের মধ্যভাগের এক রজনীতে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘক্ষণ একটি সেদজায় রত ছিলেন। বহুক্ষণ পর্যন্ত নবীজির (সা.) কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি মহানবী (সা.) এর জীবন অবসানের আশঙ্কায় চরম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। মহানবী (সা.) জীবিত আছেন, তা নিশ্চিত হওয়ার নিমিত্তে বর্ণনাতীত শঙ্কা ও আতঙ্ক নিয়ে আমি সেজদারত নবী (সা.) এর পা মোবারক স্পর্শ করলেম। মহানবী (সা.) তাঁর পা মোবারক সরিয়ে নিলেন এবং সেজদারত অবস্থায় আমাকে শুনিয়ে এই দোয়াটি [আল্লাহুম্মা আউজু বিরিদাকা মিন সাখাতিকা। ওয়া বিমু আফাতিকা মিন উকুবাতিকা, ওয়া আউজুবিকা মিনকা। লা উহসি ছানাআন আ’লাইকা। আনতাকামা আছনাইতা আ’লা নাফসিকা] উচ্চারণ করতে লাগলেন। দোয়াটির বাংলা পারিভাষিক অর্থ দাঁড়ায় : হে বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা, আপনার ক্রোধ বা দ্বেষ থেকে আমি আপনার সন্তুষ্টির আশ্রয় চাই। আপনার শাস্তির পরিবর্তে আমি আপনার পুরস্কার ভিক্ষা করছি।
আপনাকে ভুলে থাকার পরিবর্তে আমি আপনার মাঝেই আশ্রয় খুঁজে পেতে চাই। আমি তো আপনার পর্যাপ্ত গুণগান বা মহিমা কীর্তন করতে পারি না; আপনি স্বয়ংই নিজের প্রশংসা অনুপুঙ্খ কীর্তন করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) আরও বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, শাবান মাসের মধ্যভাগের বিশেষ রজনীতে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা সর্বনিম্ন আসমানে অবতরণ করেন এবং অসংখ্য মেষ-ছাগলের মালিক আরবের বিখ্যাত বানু কলব গোত্রের মেষ-ছাগলের পশমের চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন [ইবনে মাজা এবং অন্যান্য]। হজরত আয়েশা (রা.) আরও বলেন, পবিত্র রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য মাসের মধ্যে শাবান মাসেই আমাদের মহানবী (সা.) সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন। পবিত্র রমজানের ফরজ রোজার প্রস্তুতি হিসেবেই মহানবী (সা.) ওই রোজা রাখতেন বলে আম্মাজান আয়েশা (রা.) জানান। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরই জানা আছে যে নিজের ধরাধামে আগমন উপলক্ষে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতি সোমবার এবং বান্দার সাপ্তাহিক আমলনামা আল্লাহর দরবারে জমাদানের দিবস হিসেবে প্রতি বৃহস্পতিবার সর্বোপরি প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সাওম পালন বা রোজা রাখতেন। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, রজব হচ্ছে আল্লাহর মাস, শাবান হচ্ছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাস এবং রমজান হচ্ছে বান্দা তথা মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের মাস। আর সাওম বা রোজার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহই প্রদান করবেন।
যাহোক, লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, নিসফে মিন শাবান রজনীর সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দাদের উদ্দেশে বলেন, আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি ক্ষমা করে দেব। আমার নিকট রিজিক-আশ্রয়-সাহায্য প্রার্থনাকারী এমন কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি রিজিক-আশ্রয়-সাহায্য প্রদান করব। রোগে কাতর এবং শোকে মুহ্যমান এমন কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি আরোগ্য দান এবং দুর্দশা লাঘব ও পরিত্রাণ দান করতে পারি [ ইবন মাজা]। মোদ্দাকথা, নিসফে মিন শাবান রজনীর সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত নিজ বান্দাদের ক্ষমা করার, রিজিক বৃদ্ধির, রোগমুক্তিসহ বিভিন্ন রহমত বর্ষণের প্রতিশ্রুতি স্বয়ং বিশ্ববিধাতা আল্লাহই প্রদান করেছেন।
আর বিশ্ব মুসলিমের শাশ্বত জীবনবিধান পবিত্র কোরআনের চতুর্দশ অধ্যায়ের সুরা নাহলের অষ্টাদশ আয়াতে বলা হয়েছে, ওয়া ইন তাউদ্দু নিমতাল্লাহে লা তুহছুঅ হা, ইন্নাল্লাহা লাগাফুরুর রাহিম (আর যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতরাজির গণনা আরম্ভ করো, তবে এর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না, বাস্তবিকই আল্লাহ তায়ালা অতিশয় ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু)। পবিত্র কোরআনের দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ প্যারার সুরা ইউসুফের ৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, লা তাইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে, ইন্নাহু লা ইয়াইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে ইন্নাল কাওমুল কা’ফেরুন [আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় মহান আল্লাহর রহমত থেকে শুধু সেসব লোকই নিরাশ হয়, যারা কাফের।] পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে, লা তাকনাতুম্ মির-রাহমাতিল্লাহে, ইন্নাল্লাহা ইয়াগফেরুজ যুনুবা, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিম (আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপরাধীদের অপরাধ মার্জনাকারী; বাস্তবিকই আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু)। অতএব, শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত বা লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান নিয়ে যতই মতানৈক্য থাকুক না কেন, শাবান মাসের মধ্যভাগের রজনী যে বর্তমানের পথভ্রান্ত এবং ইসলামের আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত, তা রীতিমতো বর্ণনাতীত।
স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত বিশ্বচরাচরে শয়তানের প্ররোচনায় কিংবা ব্যক্তি-গোষ্ঠী-পারিবারিক-দলীয় স্বার্থে বর্তমানে জাগতিক মোহাবিষ্ট বিশ্বমুসলিম পারলৌকিক পাথেয় সংগ্রহের তুলনায় পার্থিব ভোগবিলাসিতা, ক্ষমতার বাহাদুরি এবং পরস্ব হরণকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকার্জন বা হালাল রোজগারের চেয়ে বাম হাতের লেনদেনের মাধ্যমে অল্প দিনে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতায় আদাজল খেয়ে লেগেছে। অবৈধ অর্থে আকাশ আড়াল করা সুরম্য ও দৃষ্টিনন্দন অস্থায়ী হর্ম গড়তে গিয়ে জেনেশুনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য জাহান্নাম খরিদ করছে।
স্মর্তব্য, করোনা নামক শতাব্দীর ভয়াবহ আসমানি গজবে কয়েক কোটি লোকের প্রাণহানি এবং তুরস্ক ও সিরিয়ার উপর্যুপরি সাম্প্রতিক দুই দফা ভূমিকম্পে রাতারাতি ৫০ সহস্রাধিক লোকের ঝরে যাওয়া আমাদের মনুষ্যত্ববোধে আঁচড় কাটতে সক্ষম হয়েছে কি না, তাও অনিশ্চিত। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের ৯৫ শতাংশই বাংলার সহস্র বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ধর্মীয় ও সামাজিক মূূল্যবোধ এবং স্বজনদের স্নেহসান্নিধ্য ছিন্ন ও করুণাকাতর মুখচ্ছবির মর্মবেদনা বুকে চাপা দিয়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দুর্গম-দুর্লঙ্ঘ্য পথপ্রান্তর এবং শ্বাপদসংকুল বনবাদাড় মাড়াতে গিয়ে অনেকেই পথিমধ্যে চিরতরে ঝরে গেছেন।
আর যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখা ভাগ্যবান বাংলাদেশিদের কেউ কেউ প্রাকৃতিক বৈরিতা ও হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা উপেক্ষা করে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের অনেকেই নিজেদের পোষ্যদেরও শিক্ষা-দীক্ষায় একুশ শতকের চাহিদার উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তবে আমাদের পারিবারিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়টা অর্জনের চেয়ে বর্জনের পাল্লাকে আমার দৃষ্টিতে ভারী করে তুলেছে। সর্বোপরি, সর্বস্তরে এবং সর্বক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিযোগিতা বর্তমানে প্রতিহিংসায় রূপ নেওয়ায় আমাদের সনাতনী সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পান থেকে চুন খসে পড়ার মতো তুচ্ছ বাগ্্বিতণ্ডা-মনোমালিন্যকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের বাধ্যতামূলক দায়িত্ববোধের দীক্ষাকেও নির্বাসনে পাঠাচ্ছে।
আবার পার্থিব ঐশ্বর্য হাসিলের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বর্তমানে নানা অজুহাতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায়েও আমাদের অনীহা প্রকট আকার ধারণ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের প্রবাসজীবন দায়িত্ব এবং কর্তব্যের রজ্জুতে আঁটসাঁট বাঁধা। পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে আমরা কলুর বলদের মতো অহর্নিশ জীবনরথের ঘানি টেনে যাচ্ছি। নিতান্ত সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকের পক্ষেই ধর্মকর্মে ইচ্ছেমতো সময় দেওয়ার সুযোগ এবং সংগতি হয় না।
মনে রাখা উচিত, লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় বিশেষ দিন এবং রাতের আগমন ঘটে বছরে মাত্র একবার। আর এক বছরের ব্যবধানে রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ক্ষমতার হাতবদল ছাড়াও অসংখ্য আদম সন্তানকে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করতে হয়। আপনি-আমি-আমরা কেউই ওই শাশ্বত বিধান এবং বিশ্বপ্রতিপালকের সুনির্দিষ্ট আদেশের বাইরে নই। তাই এবারের লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানই হয়তো-বা হতে পারে অনেকের জীবনের আখেরি লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্য রজনী।
আবার সারা দেহ পাপসাগরে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও আমরা কাফের নই; বরং আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর গোনাহগার উম্মত। তাই অশ্রুসিক্ত নয়নে সবিনয় প্রার্থনা : হে, রাব্বুল আলামিন, তুমি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হওয়ার তওফিক দান করে বিশেষভাবে ধন্য এবং কৃতজ্ঞ করেছ। আবার আমাদের মতো পাপী-তাপীদের পাপরাশি মোচনের লক্ষ্যে অপরিসীম রহমত হিসেবে লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের মতো বিশেষ কল্যাণময় ও তাৎপর্যমণ্ডিত পাঁচটি দিবস-রজনী বরাদ্দ করেছ। তাই তোমার দরবারে সানুনয় মিনতি, পবিত্র লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের রহমত ও বরকত অর্জনের তওফিক আমাদের দান করো। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
এমনতর বাস্তবতায় আমাদের মতো গোবেচারা প্রকৃতির মুসলমানদের চরম যুগসন্ধিক্ষণের মধ্যে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্বপ্রতিপালক মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা এবং ধর্মীয় যাবতীয় বিভেদ-বিসংবাদ ও মতানৈক্যের অবসান কামনা করছি।
লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্য রজনী নিয়ে সহস্র মতানৈক্য সত্ত্বেও শাবান মাসের মধ্যভাগের রজনীর মাহাত্ম্য, গুরুত্ব এবং তাৎপর্য সম্পর্কে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আদৌ বিবাদ-বিসংবাদ বা মতানৈক্য নেই। প্রত্যেক ধর্মীয় বিশেষজ্ঞই অকপটে স্বীকার করেন, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের পাপ স্খলন এবং তাদের প্রতি অতুলনীয় রহমত হিসেবে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা পাঁচটি বিশেষ দিবস ও রজনী বরাদ্দ করেছেন। পবিত্র শাবানের মধ্যভাগের রাত বা নিসফে মিন শাবান সেই পরম মহিমান্বিত ও রহমতপূর্ণ রজনীর অন্যতম। অনবদ্য কারণে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট চরম আজাব-গজবের সকরুণ শিকার এবং বিপথগামী ও পাপসাগরে নিমজ্জমান বিশ্ব মুসলিমের জীবনে পবিত্র লাইলাতুল বরাত বা নিসফে মিন শাবানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই বিশেষ রজনীতে মহান আল্লাহ তায়ালা মাগরিবের পর থেকে ফজর পর্যন্ত বিশ্ববাসীর ওপর তাঁর অফুরন্ত রহমত বর্ষণ করেন এবং বিশেষ ধরনের অপরাধী (বান্দার হক আত্মসাৎকারী এবং আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারকারী ছাড়া) অনুশোচনাগ্রস্ত চিত্তে ক্ষমা প্রার্থনাকারী সকলের অপরাধ মার্জনা করেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন বলেছেন, শাবানের পঞ্চদশ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকুলের প্রতি বিশেষ রহমত ও বরকতপূর্ণ দৃষ্টিপাত করেন এবং দুই ধরনের অপরাধী ছাড়া অবশিষ্ট সকল ক্ষমাপ্রার্থীর পাপরাশি মোচন করেন। ওই দুই ধরনের অপরাধী হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদে অংশীদারকারী এবং অন্য মুসলমানের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ ভাব বা ঘৃণা পোষণকারী [আহমদ]। আল্লাহর একত্ববাদে অংশীদারকারী, মুসলমানদের প্রতি অন্তরে বিদ্বেষভাব পোষণকারী ছাড়াও বান্দার হক তছরূপকারী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং পিতামাতার অবাধ্যদের কথাও অন্যান্য হাদিসে মহানবী (সা.) উল্লেখ করেছেন বলে জানা যায়। যাহোক, লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান উপলক্ষে আমরা ছগিরা-কবিরা, জানা-অজানা, ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত সকল ধরনের অপরাধ ও পাহাড় পরিমাণ গোনাহ মাফের জন্য বিশ্ববিধাতার মহান রহমত এবং কৃপা ভিক্ষা করছি। আমিন!
লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বর্ণনাকালে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, শাবানের মধ্যভাগের এক রজনীতে আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘক্ষণ একটি সেদজায় রত ছিলেন। বহুক্ষণ পর্যন্ত নবীজির (সা.) কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি মহানবী (সা.) এর জীবন অবসানের আশঙ্কায় চরম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। মহানবী (সা.) জীবিত আছেন, তা নিশ্চিত হওয়ার নিমিত্তে বর্ণনাতীত শঙ্কা ও আতঙ্ক নিয়ে আমি সেজদারত নবী (সা.) এর পা মোবারক স্পর্শ করলেম। মহানবী (সা.) তাঁর পা মোবারক সরিয়ে নিলেন এবং সেজদারত অবস্থায় আমাকে শুনিয়ে এই দোয়াটি [আল্লাহুম্মা আউজু বিরিদাকা মিন সাখাতিকা। ওয়া বিমু আফাতিকা মিন উকুবাতিকা, ওয়া আউজুবিকা মিনকা। লা উহসি ছানাআন আ’লাইকা। আনতাকামা আছনাইতা আ’লা নাফসিকা] উচ্চারণ করতে লাগলেন। দোয়াটির বাংলা পারিভাষিক অর্থ দাঁড়ায় : হে বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা, আপনার ক্রোধ বা দ্বেষ থেকে আমি আপনার সন্তুষ্টির আশ্রয় চাই। আপনার শাস্তির পরিবর্তে আমি আপনার পুরস্কার ভিক্ষা করছি।
আপনাকে ভুলে থাকার পরিবর্তে আমি আপনার মাঝেই আশ্রয় খুঁজে পেতে চাই। আমি তো আপনার পর্যাপ্ত গুণগান বা মহিমা কীর্তন করতে পারি না; আপনি স্বয়ংই নিজের প্রশংসা অনুপুঙ্খ কীর্তন করেছেন। হজরত আয়েশা (রা.) আরও বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, শাবান মাসের মধ্যভাগের বিশেষ রজনীতে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা সর্বনিম্ন আসমানে অবতরণ করেন এবং অসংখ্য মেষ-ছাগলের মালিক আরবের বিখ্যাত বানু কলব গোত্রের মেষ-ছাগলের পশমের চেয়ে অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন [ইবনে মাজা এবং অন্যান্য]। হজরত আয়েশা (রা.) আরও বলেন, পবিত্র রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য মাসের মধ্যে শাবান মাসেই আমাদের মহানবী (সা.) সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন। পবিত্র রমজানের ফরজ রোজার প্রস্তুতি হিসেবেই মহানবী (সা.) ওই রোজা রাখতেন বলে আম্মাজান আয়েশা (রা.) জানান। প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরই জানা আছে যে নিজের ধরাধামে আগমন উপলক্ষে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতি সোমবার এবং বান্দার সাপ্তাহিক আমলনামা আল্লাহর দরবারে জমাদানের দিবস হিসেবে প্রতি বৃহস্পতিবার সর্বোপরি প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সাওম পালন বা রোজা রাখতেন। পবিত্র হাদিসের বর্ণনা অনুসারে, রজব হচ্ছে আল্লাহর মাস, শাবান হচ্ছে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাস এবং রমজান হচ্ছে বান্দা তথা মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদের মাস। আর সাওম বা রোজার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহই প্রদান করবেন।
যাহোক, লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, নিসফে মিন শাবান রজনীর সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দাদের উদ্দেশে বলেন, আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি ক্ষমা করে দেব। আমার নিকট রিজিক-আশ্রয়-সাহায্য প্রার্থনাকারী এমন কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি রিজিক-আশ্রয়-সাহায্য প্রদান করব। রোগে কাতর এবং শোকে মুহ্যমান এমন কেউ বা কারা আছ কি, যাকে বা যাদের আমি আরোগ্য দান এবং দুর্দশা লাঘব ও পরিত্রাণ দান করতে পারি [ ইবন মাজা]। মোদ্দাকথা, নিসফে মিন শাবান রজনীর সূর্যাস্ত থেকে ফজর পর্যন্ত নিজ বান্দাদের ক্ষমা করার, রিজিক বৃদ্ধির, রোগমুক্তিসহ বিভিন্ন রহমত বর্ষণের প্রতিশ্রুতি স্বয়ং বিশ্ববিধাতা আল্লাহই প্রদান করেছেন।
আর বিশ্ব মুসলিমের শাশ্বত জীবনবিধান পবিত্র কোরআনের চতুর্দশ অধ্যায়ের সুরা নাহলের অষ্টাদশ আয়াতে বলা হয়েছে, ওয়া ইন তাউদ্দু নিমতাল্লাহে লা তুহছুঅ হা, ইন্নাল্লাহা লাগাফুরুর রাহিম (আর যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতরাজির গণনা আরম্ভ করো, তবে এর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না, বাস্তবিকই আল্লাহ তায়ালা অতিশয় ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু)। পবিত্র কোরআনের দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ প্যারার সুরা ইউসুফের ৮৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, লা তাইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে, ইন্নাহু লা ইয়াইয়াসু র্মিরাওহিল্লাহে ইন্নাল কাওমুল কা’ফেরুন [আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় মহান আল্লাহর রহমত থেকে শুধু সেসব লোকই নিরাশ হয়, যারা কাফের।] পবিত্র কোরআনে আরও বলা হয়েছে, লা তাকনাতুম্ মির-রাহমাতিল্লাহে, ইন্নাল্লাহা ইয়াগফেরুজ যুনুবা, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিম (আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপরাধীদের অপরাধ মার্জনাকারী; বাস্তবিকই আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু)। অতএব, শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত বা লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান নিয়ে যতই মতানৈক্য থাকুক না কেন, শাবান মাসের মধ্যভাগের রজনী যে বর্তমানের পথভ্রান্ত এবং ইসলামের আদর্শচ্যুত বিশ্ব মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত, তা রীতিমতো বর্ণনাতীত।
স্বার্থের ঘেরাটোপে আচ্ছাদিত বিশ্বচরাচরে শয়তানের প্ররোচনায় কিংবা ব্যক্তি-গোষ্ঠী-পারিবারিক-দলীয় স্বার্থে বর্তমানে জাগতিক মোহাবিষ্ট বিশ্বমুসলিম পারলৌকিক পাথেয় সংগ্রহের তুলনায় পার্থিব ভোগবিলাসিতা, ক্ষমতার বাহাদুরি এবং পরস্ব হরণকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকার্জন বা হালাল রোজগারের চেয়ে বাম হাতের লেনদেনের মাধ্যমে অল্প দিনে অর্থবিত্তের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতায় আদাজল খেয়ে লেগেছে। অবৈধ অর্থে আকাশ আড়াল করা সুরম্য ও দৃষ্টিনন্দন অস্থায়ী হর্ম গড়তে গিয়ে জেনেশুনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য জাহান্নাম খরিদ করছে।
স্মর্তব্য, করোনা নামক শতাব্দীর ভয়াবহ আসমানি গজবে কয়েক কোটি লোকের প্রাণহানি এবং তুরস্ক ও সিরিয়ার উপর্যুপরি সাম্প্রতিক দুই দফা ভূমিকম্পে রাতারাতি ৫০ সহস্রাধিক লোকের ঝরে যাওয়া আমাদের মনুষ্যত্ববোধে আঁচড় কাটতে সক্ষম হয়েছে কি না, তাও অনিশ্চিত। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের ৯৫ শতাংশই বাংলার সহস্র বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ধর্মীয় ও সামাজিক মূূল্যবোধ এবং স্বজনদের স্নেহসান্নিধ্য ছিন্ন ও করুণাকাতর মুখচ্ছবির মর্মবেদনা বুকে চাপা দিয়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দুর্গম-দুর্লঙ্ঘ্য পথপ্রান্তর এবং শ্বাপদসংকুল বনবাদাড় মাড়াতে গিয়ে অনেকেই পথিমধ্যে চিরতরে ঝরে গেছেন।
আর যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখা ভাগ্যবান বাংলাদেশিদের কেউ কেউ প্রাকৃতিক বৈরিতা ও হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা উপেক্ষা করে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের অনেকেই নিজেদের পোষ্যদেরও শিক্ষা-দীক্ষায় একুশ শতকের চাহিদার উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তবে আমাদের পারিবারিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়টা অর্জনের চেয়ে বর্জনের পাল্লাকে আমার দৃষ্টিতে ভারী করে তুলেছে। সর্বোপরি, সর্বস্তরে এবং সর্বক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিযোগিতা বর্তমানে প্রতিহিংসায় রূপ নেওয়ায় আমাদের সনাতনী সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পান থেকে চুন খসে পড়ার মতো তুচ্ছ বাগ্্বিতণ্ডা-মনোমালিন্যকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের বাধ্যতামূলক দায়িত্ববোধের দীক্ষাকেও নির্বাসনে পাঠাচ্ছে।
আবার পার্থিব ঐশ্বর্য হাসিলের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বর্তমানে নানা অজুহাতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায়েও আমাদের অনীহা প্রকট আকার ধারণ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের প্রবাসজীবন দায়িত্ব এবং কর্তব্যের রজ্জুতে আঁটসাঁট বাঁধা। পারিবারিক দায়বদ্ধতার কারণে আমরা কলুর বলদের মতো অহর্নিশ জীবনরথের ঘানি টেনে যাচ্ছি। নিতান্ত সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকের পক্ষেই ধর্মকর্মে ইচ্ছেমতো সময় দেওয়ার সুযোগ এবং সংগতি হয় না।
মনে রাখা উচিত, লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় বিশেষ দিন এবং রাতের আগমন ঘটে বছরে মাত্র একবার। আর এক বছরের ব্যবধানে রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, ক্ষমতার হাতবদল ছাড়াও অসংখ্য আদম সন্তানকে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে গমন করতে হয়। আপনি-আমি-আমরা কেউই ওই শাশ্বত বিধান এবং বিশ্বপ্রতিপালকের সুনির্দিষ্ট আদেশের বাইরে নই। তাই এবারের লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানই হয়তো-বা হতে পারে অনেকের জীবনের আখেরি লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্য রজনী।
আবার সারা দেহ পাপসাগরে নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও আমরা কাফের নই; বরং আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর গোনাহগার উম্মত। তাই অশ্রুসিক্ত নয়নে সবিনয় প্রার্থনা : হে, রাব্বুল আলামিন, তুমি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত হওয়ার তওফিক দান করে বিশেষভাবে ধন্য এবং কৃতজ্ঞ করেছ। আবার আমাদের মতো পাপী-তাপীদের পাপরাশি মোচনের লক্ষ্যে অপরিসীম রহমত হিসেবে লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের মতো বিশেষ কল্যাণময় ও তাৎপর্যমণ্ডিত পাঁচটি দিবস-রজনী বরাদ্দ করেছ। তাই তোমার দরবারে সানুনয় মিনতি, পবিত্র লাইলাতুন নিসফে মিন শাবানের রহমত ও বরকত অর্জনের তওফিক আমাদের দান করো। আমিন!
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩